Additional information
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.18
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা- সম্পাদকীয়
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ২০১২। এ-পর্যন্ত ৩২টি সংখ্যা প্রকাশ করে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ টি বছর অতিক্রম করেছে। এ দশটি বছর অনুপ্রাণন’কে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আজ একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করার মুহূর্তে পেছনের দশটি বছরের দিকে ফিরে স্মৃতিতে অনেক কিছুই ভেসে আসে। লেখক, পাঠক এবং সম্পাদনা পরিষদের সাথে ভাগ করে নেয়ার মতো অনেক কথাই হয়তো বলার থাকে, বলার ছিল। কেননা ১০ বছর তো কম সময় নয়। তবে, শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা অথবা লিটল ম্যাগ প্রকাশের ইতিহাসে প্রায় একই ধরনের ঘটনা হয়তো হর-হামেশাই ঘটে থাকে।
টেকসই সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণে পেশাদারিত্বের অভাব আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এখনো সেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অহমবোধ প্রতিটি সংগঠনের ভিত কুরে কুরে খাচ্ছে। বাইরের থেকে যেটা দেখা যায় সেটা ঠিক ভেতরের চিত্র না। আর তাছাড়া অর্থনীতির বিষয়টা তো আছেই। আর সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করার ঘাটতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জগতে সাধারণভাবেই অর্থের সংকট রয়েছে। সাধারণভাবেই বলা যায় যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির গুরুত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো যথার্থভাবে বুঝতে ব্যর্থ। ভাবা হচ্ছে ভৌত কাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নতির চাকা ঘুরলে দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু আমরা জানি উন্নত সভ্যতা মানেই হচ্ছে উন্নত শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
তাই, অনুপ্রাণন যেসব সাংগঠনিক সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে আছে সেসবের সাথে অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য বা ব্যতিক্রম হয়তো নির্মাণ করা যায়নি। কেননা আমরা শেষ পর্যন্ত, এদেশের প্রকৃতি ও মনুষ্যসমাজেরই অঙ্গ। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি- এসবের সংকট ও সম্ভাবনা থেকে অনুপ্রাণন বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ তো নয়।
এটা ঠিক অনুপ্রাণন পত্রিকাটিকে ঘিরে এই দশ বছরে লেখক-পাঠক ও সুভানুধ্যায়ীদের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এই বৃত্ত কোনো বিশেষ সীমানা রেখা দিয়ে ঘেরা কোনো বৃত্ত না। এই বৃত্ত শিল্প-সাহিত্যের মুক্ত চর্চার মতোই উন্মুক্ত। অনুপ্রাণন মুক্ত চিন্তার চর্চাকেই সবসময় সমর্থন করেছে, অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছে। আর অনুপ্রাণন চেষ্টা করেছে এদেশের তরুণরা যেন বেশী বেশী করে বই পড়া আর শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সারাদেশ জুড়ে অনুপ্রাণনকে ঘিরে আছে একদল তরুণ-তরুণী, যারা নিয়মিত শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারাই অনুপ্রাণনের প্রাণশক্তি। যাদের সাথে অনুপ্রাণনের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক সৌহার্দের। একে আরেকের পরিপূরক।
দশ বছর নিয়মিত বিভাগ নিয়ে ছাপার সংস্করণ আকারে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশ করার পথে লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে ক্রমেই দুটি দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, অনুপ্রাণনের একটি অন্তর্জাল সংস্করণ প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের মুদ্রিত সংস্করণে সাহিত্য ও শিল্পের বিশেষ ধারা, ধরন অথবা বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা।
ইতোমধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুপ্রাণনের পক্ষ থেকে, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্জালভিত্তিক এই সংখ্যাটিতে থাকছে ২০ টি বিভাগ। যথাক্রমে- শ্রদ্ধাস্মরণ, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রবন্ধ, গুচ্ছ কবিতা, যুগল কবিতা, একক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, বড়ো গল্প, ছোট গল্প, অণুগল্প, অনুবাদ গল্প, মুক্তগদ্য, ভ্রমণকাহিনী, বই আলোচনা, ম্যাগ আলোচনা, পাঠ প্রতিক্রিয়া, চলচ্চিত্রকথা, ধারাবাহিক উপন্যাস, নাট্যকথা এবং শিল্প-সাহিত্য সংবাদ।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ইতিমধ্যে অনিয়মিতভাবে ৬ টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে, (১) তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- প্রিয় উপন্যাস সংখ্যা; (২) অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা- গল্প সংখ্যা; (৩) অষ্টম বর্ষ তৃতীয় সংখা- অণুগল্প সংখ্যা; (৪) অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা; (৫) নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা- কবি ও কবিতা সংখ্যা; এবং (৬) দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- বাংলাদেশের ১৫টি সেরা গল্প- পাঠ ও আলোচনা সংখ্যা।
একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যার মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, সকল মুদ্রিত সংস্করণে নিয়মিতভাবেই শুধুমাত্র দেশের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আরো নিবিড়ভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষ ধরন, বিশেষ বিভাগ, বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশ করার সূচনা করতে চায়।
লেখক, পাঠক এবং অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদের সেই চাওয়া থেকেই ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি নির্বাচিত কবি ও কবিতা সংখ্যা- প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ২৭ জন নির্বাচিত কবির জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং আলোচনা প্রকাশিত হয়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রবীণ ও তরুণ কবিদের নিয়ে এই ধরনের লেখা ও আলোচনা নিয়ে আরো কয়েকটি পর্ব প্রকাশিত হবে বলে আমরা আশা করি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের জীবনী ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিকের কয়েকটি পর্বের এই আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে আশা করি আমাদের দেশের তরুণ সমাজ বাংলাদেশের কবিদের কবিতার সাথে সুপরিচিত হবেন এবং আমাদের দেশের সম্মানিত এই কবিদের কবিতা নিয়ে আলাপ, আলোচনা এবং আড্ডার অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার বৃত্তটিকে প্রসারিত করতে পারবেন।
অনুপ্রাণন ১১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন– নবম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভূমিকা
শিল্প ও সাহিত্য কীভাবে মানুষের চেতনায় মানবিক মূল্যবোধের প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই আসতে পারে। তাহলে, এটা কি একটি সমস্যা? একই স্থানে, একই সময়ে, একই বিষয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত আসলে আমাদের বোধের জগতে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে কি-না? এর উত্তর অবশ্যই না। কেননা শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন মানবিক মূল্যবোধের বিষয় নিয়ে নিরীক্ষা করতে পারে। কোনো একক দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে অটল বিশ্বাস উল্টো চেতনার জগতে গোঁড়ামির বীজ বপন করার প্রবণতার জন্ম দিতে পারে।
অর্থাৎ, মানবিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের উৎস এবং অভিব্যক্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো সুত্র বা সংজ্ঞা নির্বাচন করা হয়তো সংকীর্ণতার দিকেই ঠেলে দিতে পারে। আমরা যেমন মানবিক সমাজ চাই, সাথে সাথে আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুত্ববাদী সমাজ চাই। সমাজে যদি মুক্তমত ও ভিন্নমতের চর্চা বা অনুসরণ করার সুযোগ রহিত থাকে তবে মুক্তমনা ও মানবিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের চর্চা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী হতে দেখা যেতে পারে। তবে মুক্তমত অর্থে অতিশয়োক্তি আমরা দেখতে চাই না। আমরা চাইবো না সমাজের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ এবং অশান্তি সৃষ্টি করে–এরকম মানবতাবিরোধী শিল্প-সাহিত্য অথবা সঙ্গীতের চর্চা অবারিত হোক। শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃষ্টির সৃজনশীল প্রেরণা ভিন্নতর কোণ থেকে উৎসারিত হলেও লক্ষ্য একটাই হওয়া বাঞ্ছনীয় যেন সেসব সৃষ্টিশীল কাজের অভিব্যক্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মধ্যে উপস্থিত থাকে নান্দনিকতা; জাতি-উপজাতি-বর্ণ-সম্প্রদায় ও লিঙ্গ নির্বিশেষে বিস্তৃত হয় মানবিক সহমর্মিতা, প্রেম, সাম্য ও সমতা। মনে রাখতে হবে যে, ইহজগতে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক প্রথা-প্রচলন, বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কারণে বহুমাত্রিক শোষণ ও নিপীড়নের দুর্ভোগ নিয়ে জীবন যাপন করছে। যদি সৃজনশীল ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত এর লক্ষ্য হয় পশ্চাৎপদ প্রথা-প্রচলন, জাতি-উপজাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য এবং নানাবিধ কুসংস্কার এর হাত থেকে মুক্তির জন্য মানুষের চেতনা জাগ্রত করা, তবেই বলা যেতে পারে যে, সেসব সৃজনশীল ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত এর মানবিক মূল্য রয়েছে।
সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, কারুশিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প, স্থাপত্যকলা, এবং শিল্পের সকল মাধ্যমের মধ্য দিয়েই মানুষের রুচি ও সংস্কৃতির আত্মপরিচয়, উন্মেষ ও উপলব্ধি ঘটে–মানুষের চেতনায় তার স্বপ্নের জগতটি দানা বাঁধে ও বিকশিত হয়। সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য শিল্পের এই মাধ্যমগুলো একেবারে যেন মনের এক-একটি জানালা। এই জানালাগুলো ব্যবহার করে যেমন একটি সংস্কৃতির ইতিবাচক রূপান্তর সম্ভব, ঠিক সেরকম মনের এসব জানালা দিয়েই কলুষিত বাতাস প্রবেশ করে একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই কোনো শিল্পকর্মটি সমাজের ইতিবাচক মানবতাবাদী রূপান্তর এর পক্ষে, আর কোন শিল্প ও সাহিত্যকর্মে মানবিক সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান বিদ্যমান–এটা শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। সাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, কারুশিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প, স্থাপত্যকলা, এবং শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম দিয়ে যেসব কর্ম আমাদের জগতে প্রবেশ করছে–সেসব কর্মসমুহের প্রত্যেকটি কাজের নিবিড় ও যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যুক্তিসঙ্গত এবং বিশ্লেষণমূলক আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ করা তাই অত্যন্ত জরুরী একটা কাজ। পশ্চাৎপদ সমাজে এসব আলোচনা-সমালোচনা রচনা ও প্রকাশ করার কাজে বাধা আসতে পারে। কিন্তু, এই বাধা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলার প্রেরণা সৃজন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। সেজন্য কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিবৃন্দকে সমাজে ইতিবাচক রূপান্তর আনয়নের প্রয়োজনে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী হয়ে ওঠার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
কিন্তু, সমাজে এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে যে, সমাজ পরিবর্তনের কাজে প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে তো নয়ই এমনকি স্ব স্ব অবস্থান থেকেও প্রতিবাদী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কাজ না। শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এই অংশের মত হচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া রাজনৈতিক কর্মী অথবা সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজ। যেন শিল্পীর কাজ সুন্দরের অন্বেষণ করা, অন্তর্নিহিত সত্যের নয়।
আবার, কোনো কোনো কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিবৃন্দকে সমাজের ক্ষমতাধর অধিকর্তাদের তোষণেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই এসব শিল্পী ও সাহিত্যিকরা তাদের কাজে এসব চিহ্ন রেখে গেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প ও সাহিত্য বর্জন না করে শিল্পী ও সাহিত্যিক সমাজের একটি অংশকে নান্দনিকতার দোহাই দিয়ে ঐসব শিল্পকর্মকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কিন্তু, সত্যি কি সমাজের পরিবর্তন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে এবং সেসব শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতকে কালজয়ী আসনে সমাসীন করার কাজে তারা কি সফলতা লাভ করতে পারে?
একটি সেনাবাহিনী উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত ঠোঁটে করেই ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। আবেগপূর্ণ নাট্যকলা, বাগ্মী বক্তৃতা অথবা অসাধারণ গান, ভাস্কর্য ও অভাবনীয় সৌধ নির্মাণ করে ধর্ম তাদের বাণী মানুষের মনে সঞ্চার ঘটায়। জাতিগত গোষ্ঠী–সঙ্গীত ও নৃত্যের মাঝে তাদের সাংস্কৃতিক শেকড় খুঁজে পায়। অসাধারণ স্থাপত্যশিল্প, যেমন: রোডস্ (জযড়ফবং) এ অবস্থিত সূর্য দেবতা হেলিওস এর অতিকায় মূর্তি, জাপানের একটি পীঠস্থানে ১০৩ টন ওজনের সর্ববৃহৎ বুদ্ধ-মূর্তি, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ইত্যাদি কোনো সম্প্রদায় বা জাতি’র আদর্শের প্রতীক হিসেবে মানুষের গভীরে প্রোথিত হতে থাকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, যখন একটি নতুন সম্প্রদায় অথবা জাতি-গোষ্ঠী পুরানো কোনো সম্প্রদায় অথবা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে তখন পুরানো শাসনব্যবস্থায় প্রচলিত নৃত্য ও সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাদের আদর্শিক গ্রন্থসমুহ পুড়িয়ে ফেলা হয়, মন্দির ও পীঠস্থানগুলো বিনষ্ট করা হয়, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকর্ম সমূহ মাটিতে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। আবার অন্যদিকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, শাসকের আমূল পরিবর্তনের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল রক্ষা পায় প্রেমের অভিব্যক্তি, স্থাপত্য ও মর্মর পাথরে নান্দনিক অলংকরণ শিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে। যদিও শাহজাহান নিজ সন্তানের হাতে বন্দী হয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টে নিজের শেষ জীবনটি অতিবাহিত করেন কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, অনেক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার মধ্যে দিয়েই তিনি শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। একটা সময় পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহান নিকৃষ্টতম কূটচাল আশ্রয় করে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়েই প্রজাদের শোষণ করে ও প্রতিপক্ষদের নৃশংসভাবে হত্যা অথবা দমন করে রাজ্যের বিস্তার ঘটান এবং রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। কথিত আছে যে বিশ হাজার শ্রমিক ও শিল্পী যারা তাজমহল নির্মাণ করেছিল তাদেরকে শুধু দাসের মতোই শোষণ করা হয়নি, একটি বড় অংশকে শিল্পের কলাকৌশলের গোপনীয়তা রক্ষা করার অজুহাতে সম্রাট শাহজাহান হত্যা করেছিলেন। অথচ শাহজাহান ও নুরজাহানের প্রেম বিবৃত করে অন্য ভাষায় তো বটেই এমনকি বাংলা ভাষায় গান ও কবিতা রচিত হয়েছে।
ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে শাসকশ্রেণি কর্তৃক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের উপর নানারূপ আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দেখা গেছে। ব্যতিক্রমী শিল্পী-সাহিত্যিকদের উপর নেমে এসেছে দমন ও নির্যাতনের স্টিম রোলার। আধুনিক কালে, হয়তো শিল্পকলার উপর সবচেয়ে নাটকীয় আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দেখা যায় নাৎসি, কট্টর কমিউনিস্ট এবং মৌলবাদী ও কট্টর এক শ্রেণির ইসলামপন্থীর শাসনে। হিটলারের জার্মানী, মাও সে তুং এর চীন, স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের শাসনের অধীনে যেসব শিল্প, সাহিত্য অথবা সঙ্গীত গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, সাধারণ শৈল্পিক সূত্রসমুহ অনুসরণ করে সেসব শিল্প, সাহিত্য অথবা সঙ্গীতকে নিষ্ফলা এবং বৈচিত্র্যহীন হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি সুনির্দিষ্ট মতবাদের প্রচার, প্রজ্ঞাপন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টার প্রভাবে শিল্পকর্মটি হয়ে ওঠে নিস্তেজ ও অনুজ্জ্বল। এইরূপ শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত মানুষের জন্য কথা না বলে, তাদের নির্দেশ করেই কথা বলে। যেখানে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পরিবর্তে রাষ্ট্রের আশা-আকাক্সক্ষার কথাই প্রকাশ ঘটেছে। মানুষের চেতনার বিশোধনের পরিবর্তে এসব শিল্প রচনার উদ্দেশ্য মানুষের আবেগ-অনুভূতি-ভাবনার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
যে কোনো কালে যখন কোনো কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতি তার কাজটি মুক্ত পরিবেশে সৃজন করে থাকেন অথবা যে কোনো সময় যখন বহির্জগতে প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও শিল্পীরা তারা নিজের অভ্যন্তরে বন্ধনহীন মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হতে পারেন, তাহলে সেই অবস্থায় প্রকাশিত শিল্পকর্মটি হয়তো মানবতাবাদী এবং উদারনৈতিক মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হতে পারে অথবা যে কোনো মানুষকে চেতনাগতভাবে মানবতাবাদী হয়ে ওঠার গভীর উদ্দীপনা এবং অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, তাহলে নান্দনিকতার কোনো সুনির্দিষ্ট মানবিক তত্ত্ব সাজিয়ে দেয়ার চেষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই। যথাযথ কোনো বিশদ বিবরণ-বিবৃতি, অভিব্যক্তি অথবা বার্তা প্রদানের চেষ্টা করারও কোনো প্রয়োজন নাই। আমাদের যেটা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে জাতি-উপজাতি-ধর্মীয় সম্প্রদায় ও লিঙ্গ নির্বিশেষে একটি স্বাধীন, সহমর্মী, মানবতাবাদী ও বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করার জন্য সৎ ও আন্তরিকভাবে সকল মানুষের মনে সুগভীর অনুপ্রেরণা বিস্তার করা। এই কাজটি একটি সৃজনশীল কাজ এবং কোনো বাধাহীন সহজ-সরল পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগও সীমিত। কিন্তু এর কোনো বিকল্প আছে বলে আমার ধারণায় আসে না। তবে এটা বুঝি যে, এই অনুপ্রেরণা হৃদয়ে প্রোথিত হলে–কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিরা নিজেদের স্বাভাবিক কাজের মধ্যেই যে শিল্প সৃজন করবেন কি-না, সেটাই মানবিক বোধ ধারণ করবে এবং একজন মানবতাবাদীর কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠবে।
পরিশেষে এটা বুঝে নিতে হবে যে, ইতিহাসের অধ্যায়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সত্যেরও পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু সুন্দর তার রূপ পরিবর্তন করলেও বোধ এবং অনুভূতিতে সুন্দরের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই, সত্যের মধ্যে সুন্দর এর অনুসন্ধান অনেক সময় বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান ও প্রতিষ্ঠা করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। কেননা কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিরা মিলিতভাবে শিল্পের সকল কর্মীরা চিন্তা-চেতনা, আবেগ ও অনুভূতিতে আমাদের সমাজের অগ্রসর অংশেরই প্রতিনিধি।
উদার পুঁজিবাদ ও মুক্ত বাজার, মানুষের মূল্যবোধের জমিনটিতে পচন ঘটিয়ে চলেছে। মাটিতে যখন পচন ঘটে তখন আর কোনো কিছুই নির্মল থাকতে পারে না। মানুষ কষ্টে আছে। তাই, অবশ্যই সমাজের অগ্রসর অংশটির সামনে পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে নান্দনিক অথচ সত্য শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃজনের একটি মহান দায়িত্ব এসে পড়েছে। অনুপ্রাণন এই দায়িত্বের স্থানটিকে মজবুত করে গড়ে তোলার কাজে অবিরাম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে চাই।
নবম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
সম্পাদকীয়, নবম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা-
কবি ও কবিতার অনুপ্রাণন—
সূচনা লগ্ন থেকেই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন, সাহিত্যের এই বিশেষ শাখা অর্থাৎ কবিতা বিভাগটির উপর বিশেষ যত্ন দিয়ে এসেছে। কেননা সাহিত্য রচনায় কবিতাই একমাত্র শাখা যেখানে কবির অন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা অনুভূতিটি উপচে বের হয় কবিতায়। যেখানে কোনো প্লট-পরিকল্পনা বা পূর্বপ্রস্তুতির চিহ্ন খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। হতে পারে কবির সেই কথাগুলো নির্গত হয়েছিল কোনো অস্থির অথবা কোনো বেদনার অথবা কোন শান্ত-সমাহিত ধ্যানের মুহূর্তে। হৃদয় মথিত কোনো নান্দনিক অথবা কোনো মানবতবাদী ভাব সৃষ্টি ও রচনার গভীর অনুপ্রেরণায়। কিন্তু স্বতস্ফুর্তভাবে নির্গত শক্তিশালী কোনো অনুভূতি যে কোনো আকারে প্রকাশিত হলেই কী সেটা কবিতা হয়ে উঠতে পারে? কবিতা—সাহিত্য রচনাশৈলীর এমনই একটি বিশেষ ধারা যেখানে শব্দ ও ছন্দ পার¯পরিকভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখা যায়। কবিতায় শব্দগুলো একসাথে জুড়ে থেকে কোনো প্রকার উচ্চারণ, ধ্বনি, চিত্র অথবা চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে থাকে যা কি-না সরাসরি বর্ণনা করতে গেলে হতে পারে অনেক জটিল অথবা বিমূর্ত। কবিতা রচনায় প্রচ্ছন্ন থাকে ছন্দ ও মাত্রা অর্থাৎ অক্ষর অথবা শব্দাংশের সংখ্যার সম্মিলন অথবা বিন্যাস। কিন্তু, কবিতার এসব গঠন প্রক্রিয়া সবসময় সচেতনভাবে কতটুকু কবির মনে ঘটে থাকে, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমান করা কঠিন।
বাংলা ভাষার হাজার বছরের ইতিহাসে সাহিত্যের আরম্ভ অনেকটাই গীতিকবিতা দিয়েই। যেখানে উচ্চারণ ও ছন্দের মিলের সাথে যুক্ত ছিল সুর। বিষয়বস্তুতে গভীর ব্যক্তি অনুভূতির থেকে অগ্রাধিকার পেল সামাজিক-রাজনৈতিক কাহিনী। কেননা, তখন সমাজই ছিল সব, ব্যক্তির অস্তিত্ব একপ্রকার ছিল না বললেই চলে। তাই সেসব কাহিনীতে ছিল সমাজ ও রাজনীতি, ক্ষেত্রবিশেষে শাসকের গুনকীর্তন আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা, রোমান্টিক প্রেমের জনপ্রিয় আখ্যান, যৌনতা, অথবা বীরের শৌর্য-বীর্য, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম অথবা বিবাহ।
চর্যাপদ দিয়েই বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন। চর্যাপদ কতগুলো আশ্চর্য বিপরীতধর্মী কবিতার সমাহার। তাই চর্যাপদের আরেক নাম—চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়। চর্যাপদে বর্ণিত সাধন তত্ত্ব, তৎকালীন বাংলার সমাজ জীবনের চিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশের অপরূপ বর্ণনা, সকলই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে প্রমাণিত ও গৃহীত। কিন্তু, চর্যাপদের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধীতা, অভিজাতদের ধর্মদর্শন ও ধর্মানুষ্ঠানের প্রতি বিদ্রুপ উচ্চারণ ইত্যাদী’তে লোকায়তিক বৌদ্ধ ও জৈনরা যে সেই খ্রিস্টপূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণ্য-বিধানকে অমান্য করে এসেছে, তারই কতক প্রতিচ্ছবি মেলে চর্যাপদের কোনো কোনো পদ্যে। বাঙালি জাতিসত্ত্বার মূলে রয়েছে—হিন্দু লৌকিক, বৌদ্ধ লৌকিক, ইসলাম লৌকিক; এরকম সকল লৌকিকগণ। এই লৌকিক অনভিজাত বা প্রাকৃত বাঙালিই হচ্ছে প্রকৃত বাঙালি। আঠারো শতক পর্যন্ত রচিত সাহিত্য এই প্রাকৃত বাঙালির উপভোগ্য ছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, বাংলায় রূপান্তরিত রামায়ণ-মহাভারত-ভগবত, বৈষ্ণব পদাবলি, চৈতন্যের জীবনী, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, ইত্যাদী সকল সাহিত্যের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। সে সময়ের লোকসাধারণের কবিরা এই ‘লৌকিক করিয়া’ ‘লৌকিকের মতে’, মূলধারায় কবিতা তথা সাহিত্য রচনা করতেন।
কিন্তু তারপর পরে একটি দীর্ঘ ছেদ। বাংলা সাহিত্যে কথিত অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে বড়ু চণ্ডীদাস নিয়ে আসেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলাচ্ছলে জীবাত্মা-পরমাত্মা লীলা লীলায়িত হলেও মধ্যযুগের শুরুতে একাব্য অনবদ্য ভূমিকা রাখে। তবে মধ্যযুগ বিশেষভাবেই বিখ্যাত মঙ্গলকাব্যের জন্য। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শ্রেণির মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। যদিও মঙ্গলকাব্যগুলোর রূপ প্রায় একই রকম। কতিপয় মঙ্গলকাব্যে কবিতার ভারী যাদু থাকলেও সবচেয়ে বেশি ছিল সমকালীন সামাজিক জীবনের বোধ ও পরিচয়। বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাস জানতে হলে মঙ্গলকাব্য অবশ্যপাঠ্য। বৈষ্ণব পদাবলি আমাদের স্বপ্নে বিভোর করে। বৈষ্ণব পদাবলির পাত্র-পাত্রী কৃষ্ণ-রাধাকে কেন্দ্র করে যে কবিতাগুলো রচিত হয়েছিলো সেগুলো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
রাজসভায় রচিত হলেও মধ্যযুগের সাহিত্য কেবল অভিজাতদের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। মধ্যযুগে সামাজিক বৈষম্য প্রকট থাকলেও, পুরোহিত-মোল্লাদের দাপট থাকলেও, অভিজাত কর্তৃক উৎপীড়ন থাকলেও, সে যুগের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাংলার প্রাকৃতজনেরই প্রাধান্য ছিল। যারা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসবিদ, তাদের অনেকের মতে, মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি হলেন ভারতচন্দ্র আর আধুনিক যুগের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন। মাঝখানে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হলো ‘যুগসন্ধির কবি’।
মধ্যযুগের বিদায়ী দামামা বেজে ওঠে, যখন ১৭৫৭-তে আমরা স্বাধীনতা হারাই। বণিক শাসক হয়। অনেক পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের পরিবর্তন বা পতন ঘটে। ভারতচন্দ্রের রচনায় দেখা যায় পতনের ছাপ। বলা হয়ে থাকে ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ এই সত্তর বছর বাংলা সাহিত্যের পতন ঘটেছিল। সে সময় কবিয়াল ও শায়েরদের উদ্ভবে এক নিম্নরুচি সম্পন্ন সাহিত্য রচিত হয়। অর্থাৎ, কবিগান। কবিগানকে গর্ব করার মতো সাহিত্য বলতে অনেকে নারাজ। কবিয়াল ও শায়েররা বিকিয়ে গেলেও কোনো কোনো কবিগান বা শায়েরি আজো বাংলার প্রাকৃতজনের মনে শেকড় গেড়ে আছে সেসবের অনবদ্য ছন্দ ও সুরের নান্দনিকতার কারণে।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা আনেন মাইকেল মধুসূদন। মহাকাব্য রচনা করে বাংলা কবিতার রূপ বদলে দেন। শুধু তাই নয় তিনি বাংলা পয়ারকে এক নতুন রূপে উপস্থাপন করেন। ব্যবহার ক্লান্ত ছন্দরীতিকে মধুসূদন করে তোলেন প্রবাহমান (অমিত্রাক্ষর)। এর আগে অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় আধুনিকতার হাল্কা আলোকচ্ছটা দেখা যায়। তবে মধুসূদন একাই এক ধাক্কায় বাংলা সাহিত্যকে অনেক এগিয়ে দিয়ে গেছেন। মধুসূদনের দেখাদেখি অনেকে (হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, কায়কোবাদ) মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেন। কিন্তু, শেষপর্যন্ত ওগুলো মহাকাব্য না হয়ে আখ্যানকাব্য হয়ে ওঠে।
বাংলা কবিতায় মহাকাব্যের ধুমধাম চলাকালে রোমান্টিকতা নিয়ে উঁকি দেন বিহারীলাল। বাংলা কবিতার তিনি-ই প্রথম রোমান্টিক ও খাঁটি আধুনিক কবি। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘ভোরের পাখি’ বলেছেন। আত্মভাবপ্রধান কবিতার জন্ম বিহারীলালের হাতে হলেও বিকাশ ঘটে রবীন্দ্রনাথের হাতে। অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতনের মত বিহারীলাল চলে গেলেও তার কবিতার পথ ধরে আসে—সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অক্ষয়কুমার বড়াল, ডিএল রায় ও রবীন্দ্রনাথ। প্রথম মহাযুদ্ধের মাধ্যমে বদলে যাওয়া ইউরোপীয় চেতনার প্রভাব পড়ে আমাদের জীবন ও সাহিত্যে। দু’দণ্ড দেরিতে হলেও সেই প্রভাব আমাদের কবিতায় এসে ভালভাবেই পড়ে। আধুনিক কবিতাগুলো বিশশতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে ওঠে।
বিশশতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-যুগ চলাকালে রবীন্দ্রাগুনে পুড়েছেন অনেকেই। তবে রবীন্দ্র-বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি একইসাথে প্রেম ও দ্রোহের কবি। তার কবিতায় যেমন বিদ্রোহ আছে তেমনি আছে কৈশোরিক প্রেমের কাতরতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক কবিতার রমরমা হাট বসে বাংলা সাহিত্যে। বাংলা কবিতায় বাঙালির প্রথাগত বিশ্বাস, সুন্দর, কল্যাণ, আবেগ, স্বপ্ন, সুখ-দুঃখ ও কাতরতা বিসর্জন দিয়ে আধুনিক কবিগণ নগরের কথা ও ক্লান্তি, অবিশ্বাস, নিরাশার কথা ফুটিয়ে তোলেন কবিতায়। কবিতায় পাল্টে যায় বাঙালির চেতনা। বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু ও অমিয়, এই পাঁচজন কবিকে রবীন্দ্রনাথের পর আধুনিক কবিতা সৃষ্টিকারী বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু তারপর অচিরেই এই পঞ্চকবিকে অনুসরণ করে আসলেন সমর ও সুকান্ত।
সাহিত্যে রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতা মুখোমুখী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় প্রায়শই। বিশ শতকের গোড়াতেই আধুনিক সাহিত্যকে অশালীন বলে গালিগালাজ করে প্রবন্ধ ও বই ছাপেন ঊনিশ শতকের বিভিন্ন রক্ষণশীলেরা। আসলে সাহিত্য কখনো অশালীন বা অশ্লীল হয় না। বিশেষ করে কবিতা। কবিতায় সব বলা যায় সব রকম ভাবে। এছাড়া অশ্লীল কথাটি আপেক্ষিক। শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে বাগ-বিতণ্ডা না করে বরং সাহিত্যকে নিরপেক্ষ মন ও মননেই দেখা উচিত। ইতিহাস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যখনই রাষ্ট্রযন্ত্র বা শাসকশ্রেণি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে তখনই যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখচ্ছবি, অর্থাৎ কবি-সাহিত্যিকরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবিতা অথবা নানা ধরনের গদ্য রচনার মাধ্যমে। যে সাহিত্যগুলো নানাভাবে বিভিন্ন আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে। ঊনবিংশ শতককে কখনো বলা যায় বাংলা গণসংগীতের স্ফুরণকাল। সেভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও দেশ ভাগের পর পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনের হাত ধরে রচিত হয়েছে বহু প্রতিবাদী সাহিত্য, কবিতা ও গণসংগীত। পাকিস্তানিরা প্রথম যখন আমাদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানলো, শুরু হলো আন্দোলন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন একুশের প্রথম এবং অমর এক কবিতা—‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’। তবে একুশের প্রথম কবিতাটি ইতিহাস থেকে প্রায় হারিয়েই গেছে। অর্থাৎ, হানাদারদের বহু হয়রানি ও তল্লাশির দাপটে কবিতাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিসহ কবির বাসা কয়েকবার সার্চ করে লুকানো দু’একটি কপি পর্যন্ত নিয়ে যায় পুলিশ। পরবর্তীতে কবিতাটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে লিখলেন শামসুর রাহমান, যা আন্দোলনকে বেগবান ও সফল করে তুললো। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত হয়েছে বহু প্রতিবাদী ও প্রেরণাদীপ্ত কবিতা, সাহিত্য এবং গণসংগীত। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্মলেন্দু গুণ সামরিক শাসনের কড়া পাহারার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে (১৯৭৭) বীরদর্পে পড়ে শোনালেন তার অগ্নিঝরা কবিতা—
“সমবেত সকলের মত আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায়
শেখ মুজিবের কথা বলি।”
নির্মলেন্দু গুণ-ই প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কবিতার বিষয় করে তুললেন। তারপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখলেন জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামালসহ আরো অনেকে। অর্জুনের মত বীর সময় দোষে নপুংসক সাঁজলেও কবি কখনো তেমনটি হয় না বা হওয়া উচিত না। কবি হবে মজলুম, প্রয়োজনে নির্বাসিত। বলবে মানুষের (সংখ্যাগরিষ্ঠ) কথা, মানবতার কথা। রুদ্র পেলেন বাতাসে লাশের গন্ধ আর তসলিমা সব বয়স্কা বালিকাদের গোল্লা হতে ছুটে বেরুনোর আহ্বান জানালেন কবিতায়। তারপর ’৯০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় কিছু প্রতিবাদী কবিতা ও গণসংগীত।
ইতিহাসের একটি বিশ্লেষণে প্রতিভাত হয় যে, ’৯০-এর দশকের পর থেকে কবিতার পাঠক সংখ্যায় যেন ভাটা পড়েছে। ইদানীং কবি দেখলেই বলাবলি শুরু হয়—কবিতার এখন আর দিন নেই, কবিতা এখন পাঠক খায় না, কবিতার বই বাজারে কাটে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এখানেই ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে যে তথাপি কবির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশেষতঃ কবিতা প্রকাশ করতে এখন আর প্রকাশকের পেছনে লাইন দিতে হয় না। চাইলেই ফেসবুক ওয়ালে কবিতা ছুড়ে দেয়া যায়। হাইকোর্টের সামনে থেকে মূর্তি সরানো ও অন্যত্র স্থাপন নিয়ে এখনি সহস্র কবিতা ছুড়ে দেয়া যায়। এখন মিনিটে মিনিটে রচিত হচ্ছে কবিদের ভ্রুণের চেয়েও বেশি সংখ্যক কবিতা। প্রযুক্তির কল্যাণে কবি ও কবিতার পাঠক এখন একবারে মুখোমুখী দণ্ডায়মান। এটা ভাল। কিছুদিন পূর্বেও যেটা সম্ভব ছিল না খুব বেশি। শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন বা আগ্রাসন কি এখন হচ্ছে না? তবে আমরা সে রকম কোনো কবিতা পাচ্ছি না—কিন্তু কেন?
আজকাল কবিতার বিষয় কী কী, সেটা কিন্তু আমরা হাতের মুঠোয়-ই দেখতে পাচ্ছি। আমরা আজ যা হাতের মুঠোয় দেখতে পাচ্ছি তা যদি নজরুল আগেই বলে যেতে পারেন তার কবিতায়, তাহলে কী আমাদের এখনকার কবিগণ আগামী বিশ্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাদের কবিতায়, অথবা এর চেয়েও পরবর্তী কিছু। আজকাল কবিতায় নারীকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, বিদ্যমান প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র কবিতায় কতোটা স্থান পাচ্ছে নিশ্চয়ই চর্যাপদে বর্ণিত বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর এখনকার সৌন্দর্য এক হবে না। মঙ্গলকাব্য পড়ে যদি বাংলাদেশের মধ্যযুগের সামাজিক অবস্থা (ইতিহাস) জানা যায়, তবে আমাদের আজকের কবিদের কবিতা বা সাহিত্যে সমকালীন পঁচনশীল পুঁজিবাদের ভোগসর্বস্ব কায়েমী স্বার্থবাদী ও পাশাপাশি আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানসিকতার যে সমকালীন সমাজ বাস্তবতা, সেই সমাজ বাস্তবতার ঠাঁই পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাঙালির জমিতে কলের লাঙল পড়েছে, ছনের চাল হয়েছে টিনের এবং সেই চালে বসেছে কাক, শাদা কাক। মোড় নিচ্ছে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা। নেওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। সময়কে তো আর অস্বীকার করা যায় না। কালে কালে মহাকাল অবধি কবিগণই মানুষের সমস্ত অনুভূতি কে বাঁচিয়ে রাখে। কবিদের গর্ভেই বাঁচে মানুষ। আমাদের এই কবিসকল কি পারবেন মানুষের মানবিক অনুভূতিগুলোকে কবিতায় বন্দি করে মহাকাল অবধি দীর্ঘজীবন দিতে নাকি ফেসবুক বা প্রযুক্তি নামক কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন কাক ও কাল যত কিছুকেই আমরা আপন করে নিই না কেন? তাতে কোনো দোষ নেই, তবে লৌকিক বাংলার গভীর মানবিক চেতনার স্বকীয়তা কতটুকু বজায় থাকছে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে বাংলা সাহিত্যের দেবী চিরকাল কাব্যজীবি, কবিতার স্বাদ ছাড়া সে বাঁচবে কী করে। আমরা কি কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি?
নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
সম্পাদকীয়
অনুপ্রাণন: ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়
গত নভেম্বর ২০১২ থেকে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সাহিত্য ও শিল্প বিভাগের বিবিধ সৃজনশীল ও মননশীল লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে নিয়মিত ভাবেই প্রকাশিত হয়ে আসছিল। কিন্তু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাটি বৃহৎ কলেবরে অর্থাৎ নিয়মিত ১৬ ফর্মার বদলে ১৯ ফর্মা আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পরবর্তী ৫ টি সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্পাদকের অসুস্থতা ছাড়াও অলিখিতভাবে সম্পাদনা পরিষদের যে সদস্যবন্ধুটি পত্রিকার কাজে অফিস সমন্বয়কের গুরুদায়িত্ব পালন করছিলেন নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যেতে তিনি নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকলে পত্রিকার কাজে ছেদ পড়তে থাকে। তাছাড়া সম্পাদনা পরিষদের আর একজন বন্ধু অন্য একটি অনলাইন পত্রিকার কাজে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার ফলে তাঁর পক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকায় প্রয়োজনীয় সময় দেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। সম্পাদনা পরিষদের অন্য আর একজন সংগঠক পর্যায়ের সদস্য পত্রিকার চাইতে গ্রন্থ প্রকাশনায় বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশের কাজে লোকবলের এক বিরাট সংকট দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে- ২০১২’এর নভেম্বরে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশ করার উদ্যোগ যারা নিয়েছিলেন তারা প্রত্যেকেই শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যার যার নিজ অবদান ও স্বাক্ষর রাখার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম ও ব্যক্তিগত অনুদানের ভিত্তিতে পত্রিকাটির প্রকাশনার কাজের যাবতীয় কাজ ও ব্যয় নির্বাহ করার অভিপ্রায় গ্রহণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ সংস্কৃতিতে এবং বিশেষ করে তরুণদের মনের মাঝে মানবতা, সহমর্মীতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা, শিল্পরুচি, নান্দনিকতা এবং মুক্তচিন্তার চর্চার জানালাটাকে উন্মূক্ততর করার কাজে নিয়োজিত অনুপ্রাণনের এই প্রচেষ্টা যেন বাধাহীন হয় এবং কোনভাবেই যেন প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদীতার কূট সাংস্কৃতিক আবর্তে পড়ে দিক হারিয়ে না যায়।
যশ ও প্রতিষ্ঠার মোহ যখন শিল্পীকে পেয়ে বসে তখন শিল্পচর্চা তপস্যা অথবা সাধনা থাকে না। কিন্তু, এটাই বাস্তব যে তপস্যা ও সাধনা ছাড়া শিল্পের উৎকর্ষতার শীর্ষ স্পর্শ সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বলয়ে যেসব শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও উদ্যোগ ফেনার মত আমাদের চারদিক ভরিয়ে তুলছে সেসবের স্থায়িত্ব সম্পর্কে কী কোন সন্দেহ থাকা উচিত?
বছরখানেক বন্ধ থাকার পরও যখন আমরা অনুপ্রাণনের এই সংখ্যাটি প্রকাশের উদ্যোগ নেই তখন আমরা আমাদের পত্রিকার পাঠক, লেখক ও শুভান্যুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সারা পেয়েছি। এই সারা থেকে এই বিশ্বাস আমাদের জন্মেছে যে, আমরা যে পথ অবলম্বন করে এগিয়ে চলতে চাই সেই পথে বাস্তবেই সঙ্গ-সাথীর আমাদের কোন অভাব নেই। এখনও আমাদের দেশের তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ মিথ্যা যশ, প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের মানবিক ও নান্দনিক চর্চা অব্যহত রাখতেই অধিক আগ্রহী। তাই, লেখা আহ্বানে যে সংখ্যক মানসম্পন্ন লেখা আমরা পেয়েছি সেগুলো দিয়ে অনায়াসেই দুটো সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল। চলতি সংখ্যার জন্য লেখা বাছাই করতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় দিতে হয়েছে এবং স্থান সংকুলানের অভাবে প্রায় অর্ধেক লেখাই পরবর্তী সংখ্যার জন্য রেখে দিতে হয়েছে।
লেখা বাছাই করতে গিয়ে আবারো আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সাহিত্য আলোচনা ও সমালোচনা বিভাগে আমরা যথেষ্ট সমৃদ্ধ লেখা পাচ্ছি না যেখানে পেশাদার সমালোচকের কলমের স্পর্শ আরো তীক্ষè অথচ আরো গঠনমূলক হতে পারে। বিশেষ করে কবি ও কবিতা নিয়ে আমাদের আরো তীক্ষè, তীব্র ও গঠনমূলক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কেননা সাহিত্য জগতে কবি ও কবিতার সংখ্যা যতই বাড়ছে কিন্তু আগ্রহী কবিতার পাঠকের সংখ্যা যেন সেই তূলনায় বৃদ্ধি হচ্ছে না। মনে হয়, কবি ও পাঠকের মাঝে বোধ, অনুভব ও ভাষার কোন একটা অন্তর থেকে যাচ্ছে যে অন্তরটি ঘুচে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী কেননা বোধ করি, মূলত কবিতার মধ্যেই রয়েছে তরুণ সমাজের জন্য ভবিষ্যতের বিশেষ বার্ত্তা। অর্থাৎ সাহিত্যের সত্যপাঠ।
দেশে এখন হেমন্ত ঋতু। হাওরের অকাল বন্যা ও দেশব্যাপী অতিবৃষ্টির ফলে ফসলহানী ঘটায় এবছর দেশের সামগ্রিক সমাজ জীবনে খাদ্যের ঊর্ধ্বমূল্য সকল মানুষকেই কষ্ট দিয়েছে। হেমন্তের নতুন ফসল যেমন কৃষকের ঘড়ে ঘড়ে জীবনে ঘুরে দাড়ানোর বার্ত্তা দিয়ে যাচ্ছে- দীর্ঘ বিরতির পর অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকের এই সংখ্যাটি এ-বছর অনুপ্রাণনের ঘুরে দাঁড়ানোরই প্রতীক ও স্বাক্ষর হোক- এটাই আশাবাদ।
ষষ্ঠ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা
মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়
বিভিন্ন দেশ, জাতি ও সমাজের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় মুছে দিয়ে চিরকালের জন্য নিজ শাসন ও শোষণের আওতায় নিয়ে আসার জন্য এক একটি জাতি ও উপজাতির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে দুর্বল করে দিয়ে সুকৌশলে একক একটি ভাষা ও সংস্কৃতি জাতিতে জাতিতে চাপিয়ে দেয়া- সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বিস্তারের প্রাথমিক পরিকল্পনারই একটি অপকৌশল। আধুনিক বিশ্বে বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করা ও বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যে অধ্যায়ের মধ্যে আমাদের ভাষা, সাহিত্য শুধু নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মহান সংগ্রামেরই ঐতিহাসিক সূত্রপাত। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মরণে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলা- বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তথা বাঙালী চেতনাকে সম্প্রসারিত ও সুদৃঢ় করে তোলার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের জাতীয় জীবনে অমর একুশে বইমেলার অপরিসীম ভূমিকাকে গুরুত্বের সাথে আমাদের অনুধাবন করতে হবে এবং এই বইমেলার গুণগত মান এমনভাবে পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত করতে হবে যেন এর সুফল সারা বছর জুড়ে আমাদের জাতীয় জীবনে সফলভাবে কার্যকরী থাকে।
ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির উৎকর্ষ সাধনের যে কোন প্রচেষ্টায় দেশের গণমানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে মানসম্পন্ন কাজে রূপান্তরিত করাটাই জরুরী। তাছাড়া, প্রতিনিয়ত নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটানো এবং সেসব নতুন নতুন চিন্তার বাস্তবায়ন একটি জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সুদৃঢ়ভাবে সচল রাখতে এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন মোকাবেলা করতে সবল ও সক্ষম করে তুলতে পারে। একুশে বইমেলাকে ঘিরে সেসব কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর ঘটাতে আমরা কতটুকু সক্ষম হচ্ছি- এটাই আমাদের সামনে মূল প্রশ্ন। গণমানসের অনুবাদই প্রতিভার একমাত্র ধর্ম নয়। গনমানসের সংগঠনে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে উপযোগী রূপান্তর ঘটানোর প্রচেষ্টাই একুশে বইমেলার মতো এই বিরাট কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কিন্তু, আমরা এই বিরাট কর্মযজ্ঞের মাঝে গনমানসের সংগঠনে রূপান্তর ঘটার মত সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখি না। আত্মকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্তির মধ্যে একুশে বইমেলাকে বন্দী রাখার মত অপচয় কীভাবে বন্ধ করার যায়- এ নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। সত্যের এই পরিণতি মনে রাখাটা খুবই জরুরী- যে সাধনার অগতি বন্ধ্যত্ব আনে, সেই বন্ধ্যত্বের মাঝেই স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য, আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের বিনাশ ঘটে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে, একটি জাতির নিজস্ব প্রতিভা ও সৃজনশীলতার চর্চাকে বিপথে পরিচালিত করার অপচেষ্টা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ সবসময় চটকদার কর্মসূচি আমাদের মাঝে হাজির করবে।
গত শতাব্দীর শেষভাগে, নিয়ন্ত্রিত শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা বনাম মুক্ত ও স্বাধীনভাবে শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুফলতা ও কুফলতা নিয়ে বিতর্কের এক রকম অবসান ঘটায় এখন দেশে দেশে মুক্ত ও স্বাধীন শিল্প ও সাহিত্যের চর্চার পক্ষেই জনমত গড়ে উঠেছে। কিন্তু, মুক্তচিন্তার প্রকাশের কারনে শাসক শ্রেণি বিব্রত হয় বলে শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও নিয়ন্ত্রণ একেবারে উঠে যায় নি। সেন্সরশিপ আরোপ এবং গত কয়েক দশকে মুক্তচিন্তা চর্চাকারীদের উপর কট্টরপন্থীদের সশস্ত্র আক্রমণ ছাড়াও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ হতে দেখা যাচ্ছে। এসব প্রচেষ্টা শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথে বাধা। শত শত বছরের ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে নতুন ও মুক্ত চিন্তার চর্চা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গনমানুষের নান্দনিক অভিব্যক্তি বাধাহীন বিকাশ লাভ করে না। নিয়ন্ত্রিত বিকাশ যে বাস্তবে ঘটে না এবং অবশেষে বন্ধ্যত্ব ও স্থবিরতার কবলে পরে ধ্বংস হয়ে যায় এর ঐতিহাসিক প্রমাণ যেমন দুঃখজনক তেমনই বাস্তব।
কিন্তু, এটাও মনে রাখতে হবে যে মুক্ত, স্বাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার নামে নৈরাজ্য একেবারেই কাম্য নয়। বলতে গেলে, দেখা যাচ্ছে যে সাহিত্য চর্চা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে দুধরনের প্রবণতা এই ক্ষেত্রটিকে দারুণ ক্ষতির সামনে দাড় করিয়েছে। কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা যতই মান বিচারে নিরপেক্ষতার কথা বলুক না কেন, বাস্তব কিন্তু তা বলে না। ফলে এমন একটি সুবিধাভোগী শিল্পী ও সাহিত্যিক চক্র তৈরি হচ্ছে যাদের তৈরি শিল্প-সাহিত্যের মান সম্পর্কে ক্রমাগতভাবে ভুল বার্তা দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একটি গড় মানের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মাঝে এমন একটা হতাশা তৈরি হচ্ছে যে তাদের হাত দিয়ে বাংলা শিল্প ও সংস্কৃতিতে যে উচ্চ স্তরের বিকাশ ঘটানো সম্ভব ছিল সেই পথ দুঃখজনকভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটছে, সেটাও খুব দুঃখজনক। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে এর উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে একদল শিক্ষানবিস লেখক নিজ খরচে বই প্রকাশ করে এবং তাঁর পক্ষে দল পাকিয়ে নিজেকে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রচারনায় লিপ্ত হচ্ছেন। এসব সাহিত্যকর্ম একেবারেই মানসম্পন্ন নয় ফলে প্রজন্ম বাংলা সাহিত্যের মান সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রাপ্ত হচ্ছেন। অনুপ্রাণন আশা করে যে, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে মননশীল, সৃজনশীল ও মানসম্পন্ন শিল্প ও সাহিত্যের চর্চা ও সাধনার পক্ষে গভীর সচেতনতা নিয়ে একটি মুক্ত ও স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠবে।
সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন–নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
আমরা এখন একটি বৈশ্বিক মহামারি বা অতিমারি কাল অতিক্রম করছি। নভেল করোনা ভাইরাস ২০১৯ যা সংক্ষেপে ‘এনকোভ-১৯’ নামে পরিচিত যা থেকে সংক্রমিত রোগটির নাম বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে কোভিড-১৯। এনকোভ-১৯ যাকে ব্যাবহারিক সংক্ষেপনে বলা হচ্ছে কেবল করোনা ভাইরাস, অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও প্রাণসংহারী। এই ভাইরাসের সংক্রমণ এর সুত্রপাত হয় এ’বছরে জানুয়ারি’র প্রথমভাগে, চীন এর উহান শহর থেকে। তারপর বিশ্বায়নের অলি-গলি দিয়ে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের প্রায় ২৫০ টি দেশে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় ৮ মার্চ, ২০২০। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার এর অধিক জনের। ২৬ মার্চ, ২০২০ থেকে বাংলাদেশে প্রায় দুই মাস জরুরি বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য, ঔষধ প্রস্তুতকারি ও বিপণন প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালগুলো বাদ দিয়ে সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, দোকান-পাট, শপিং মল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সকল প্রকারের গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। দুই মাস বন্ধের পর স্বাস্থ্যবিধি পালন করা সাপেক্ষে ক্রমে, সরকারি, বেসরকারি অফিস, দোকানপাট, শপিং মল এবং গণপরিবহন খোলা হয়। এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে এবং জুলাই মাস পর্যন্ত আদালতসমুহ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে চালু থেকেছে।
সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আজ পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি এবং মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পৌনে সাত লক্ষ। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ খুবই সীমিত আকারে নানা বাধা নিষেধ নিয়ে চালু আছে। বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারি এবং বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ভাইরাসের সংক্রমণের হাত ত্থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য টিকা বা কোন প্রতিষেধক উদ্ভাবন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বে সংক্রমণ সীমিত করার জন্য সকলকেই প্রায় একই ধরনের এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন কতগুলো জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে।
নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পূর্বে বিশ্বের ইতিহাসে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক মহামারির ঘটনা ঘটেছে। যেসব মহামারিতে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তখনকার সৃষ্ট বিভিন্ন শিল্প, সাহিত্যে ও সঙ্গীতে ঘটে যাওয়া অতীতের অতিমারিসমূহের চিত্র ও বিবরণ পাওয়া যায়। শিল্প, সাহিত্য এবং সঙ্গীতে সর্বদাই সমাজবাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। একই সময়ে সৃজনশীল শিল্প, সাহিত্য এবং সংগীত নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা, দর্শন, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সৃজনশীল ও নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়ে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। শিল্প, সাহিত্য এবং সংগীত ইতিহাসেরই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ঘটনাবলি তাৎক্ষণিকভাবে রচিত শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতে আধৃত হতে দেখা যায়। যার মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্য এবং তৎকালীন সমাজের চিত্র বিম্বিত হতে পারে।
বিগত ১৫০০ বছরে বহুবার ‘বিউবোনিক’ প্লেগের সংক্রমণ ঘটেছে। বিউবোনিক প্লেগ নামের রোগটি ‘ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস’ নামে এক প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়ার কারণে ঘটেছে। ষষ্ঠ, চতুর্দশ, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে বিউবোনিক প্লেগের বৈশ্বিক মহামারি বার বার ফিরে ফিরে আসে এবং বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এই প্লেগের কারণে মারা যায়। প্রতিবারই সংক্রমণ কমে আসে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এসব মহামারির সমাপ্তি ঘটেছিল। একটি অনুমান যে, বিবর্তনের ফলে ‘ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস’ জীবাণুটি দুর্বল হয়ে পড়ে। অথবা সংক্রমিত মানুষদের গ্রামের পর গ্রাম জালিয়ে দেয়ার ফলে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ে নতুন করে আর মহামারি আকার ধারণ করতে পারে নি। ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস নামের ব্যক্টেরিয়াটির অস্তিত্ব প্রাকৃতিকভাবে এখনও রয়েছে প্রেইরি অঞ্চলের এক প্রজাতির কুকুরের লালায়। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম সংক্রমণের সময় এই ব্যক্টেরিয়াটি এক বিশেষ প্রজাতির র্যাট-ফ্লি বা ইঁদুরের মাছিতে জন্ম নিয়েছিল।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পৃথিবীর বিশ্বমহামারিমূহের সমাপ্তি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে হয়েছে। কিন্তু, ইতিহাসে শুধু একটি ব্যতিক্রমই পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে ‘ভ্যারিওলা মেজর’ নামের একটি ভাইরাসের কারণে ছড়িয়ে পড়া গুটি বসন্তের বৈশ্বিক মহামারির ক্ষেত্রে। আর সেটার সমাপ্তি সম্ভব হয়েছে একটি অব্যর্থ টিকা আবিষ্কার এবং সেই টিকা বিশ্বের দেশে দেশে প্রায় সকল মানুষকে প্রয়োগ করার মাধ্যমে। প্রসঙ্গতঃ এই টিকা নিলে একজন মানুষ তার সারাজীবনের জন্য গুটিবসন্তের সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পৃথিবীতে গুটিবসন্ত ভাইরাসটির সংক্রমণের ইতিহাস ছিল প্রায় ৩০০০ বছরের।
১৯১৮ সনের ইনফ্লুয়েঞ্জার বৈশ্বিক মহামারিটিই উদাহরণ হিসেবে আজকের দিনের মহামারির ধ্বংস এবং স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন অথবা সামাজিক দূরত্বের মূল্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে। ১৯১৮ সনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় পৃথিবীতে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এই ইনফ্লুয়েঞ্জাটি সারা পৃথিবীতে ব্যাপক মৃত্যুর স্বাক্ষর রাখার পর ক্রমেই বিলীন হয়ে বিবর্তিত মৌসুমী ফ্লু’র রূপ নেয়, যে ফ্লু দ্বারা বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ প্রতিবছর আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর ঘটনা অনেক কমে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির প্রায় সাথে সাথেই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জার এই বৈশ্বিক মহামারির সমাপ্তি ঘটে। এর পর কতগুলো ফ্লু-এর মহামারি দেখা দিয়েছিল কিন্তু এখনকার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মতো সেগুলোর সংক্রমণ ও মৃত্যুর রূপ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে নি।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং একাবিংশ শতাব্দীতর প্রথম দিকে এবোলা এবং এইচআইভি ভাইরাস এর মহামারি ঘটতে দেখা যায়। যে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি এখনো রয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত এবোলা ভাইরাস এবং এইচআইভি প্রতিরোধের কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র আফ্রিকার কোনো কোনো অঞ্চলে এই ভাইরাস দুইটির সংক্রমণ সীমাবদ্ধ থাকাতে, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা’ এবোলা এবং এইচআইভি মহামারির সমাপ্তি ঘোষণা করে এটাকে জরুরি স্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্বেগের পর্যায়ে নামিয়ে আনে।
যদিও ৩ কোটি বছর পূর্বের কোনো কোনো ফসিল থেকে ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে তবে বিশেষতঃ প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্ব থেকেই বিভিন্ন সময়ে ম্যালেরিয়া মানবসমাজের অস্তিত্বের প্রতি বড় আকারের হুমকি হিসাবে দেখা দেয়। আদি মেসোপটেমিয়া অথবা রোমান সাম্রাজ্যে এবং মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায়। কিন্তু ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটবাহী কিউলেক্স মশার ব্যাপক নিধন এবং ১৮২০ শতাব্দীতে আদি সিনকোনা গাছের ছাল থেকে কুইনাইন আলাদা করা এবং এই ঔষধ অর্থাৎ কুইনাইন এবং পরবর্তীকালে কুইনাইনের উন্নত সংস্করণের ব্যাপক ব্যবহারের পর থেকে ম্যালেরায়ার প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
প্রাচীন ইতিহাসে, হিপক্রিটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭৭) এবং গেলেন (১২৯-২১৬ খ্রিস্টাব্দ) এর বর্ণনায় কলেরা’র মতো একটি রোগ এবং চিকিৎসার বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু, আধুনিক কালের ইতিহাসে কলেরা মহামারি ১৮১৭ সনেই প্রথমে গঙ্গা অববাহিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৮৮৪ সনে কলেরার জীবাণু চিহ্নিত করা হয় এবং কলেরার প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু হয়। ১৮৮৫ সনেই কলেরার টিকার আবিষ্কার হয়, যে টিকা সেবন করলে মানুষ ছয় মাসের জন্য কলেরার অনাক্রমণ্যতা প্রাপ্ত হতে পারে। বিশ্বে কলেরার ৭টি মহামারির ইতিহাস রয়েছে। ৭ম ম্যালেরিয়া মহামারি দেখা যায় ১৯৬১ সনে এবং এই মহামারি ইন্দোনেশিয়ায় থেকে উৎপত্তি হয়ে এশিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯১ সনে এই মহামারি দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছায় এবং সেখানে প্রায় ৪০০০ মানুষ মারা যায়। কলেরার সাতটি পর্বের সংক্রমণে সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটেছিল।
কলেরা মূলত পানিবাহিত রোগ। দূষিত জল পান করার মাধ্যমে এর সংক্রমণ ঘটে তাই শীত প্রধান দেশগুলোর তুলনায় পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলগুলোতেই কলেরার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব অধিক সংখ্যায় ঘটতে দেখা গেছে। ভিবরিও কলেরি নামে একটি জীবানুর কারণে কলেরা হয়। রোগীর মল পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব। যেহেতু কলেরার সংক্রমণ হলে রোগীর প্রচণ্ড উদরাময় হয় তাই দেখা যায় যে প্রথম ধাপে সংক্রমিত হওয়ার সময় খুব দ্রুত শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে পারলেই প্রায় ৯৯% কলেরা রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। সাথে এন্টিবায়োটিক এবং জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে কলেরা রোগ থেকে প্রায় ১০০% রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
বিদেশী চিত্রকর্ম ও সাহিত্যে অতীতের অতিমারিসমূহের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যদিও ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনের শাসক স্বয়ং জাস্টিনিয়ান’এর দুই একটি ফ্রেস্কো দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর প্লেগের ফ্রেস্কো অথবা তৈলচিত্র চতুর্দশ শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগের দ্বিতীয় অতিমারির সময়ে ইউরোপিয়ান কয়েকজন শিল্পী তখনকার সময়ের চিত্র তৈরি’র সময় তাদের কর্মে তুলে আনেন। বোকাচ্চিও এর ডেকামেরন (চতুর্দশ শতাব্দী), ফ্রান্সিস্কো’র ‘মাতৃস্নেহের রূপক কাহিনি’ (১৭৪৩-৪৪) অথবা মানজোনি’র ‘দি বেট্রোথেড (উন-বিংশ শতাব্দীর) তেল চিত্রগুলো এসব শিল্পকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
বিদেশী সাহিত্যে প্লেগ অথবা মহামারি এসেছে প্রত্যক্ষভাবেই। বাংলা সাহিত্যে কলেরা, ম্যালেরিয়া বা গুটিবসন্ত অর্থাৎ জনমানসে ওলাওঠা বলে পরিচিত রোগের অভিঘাত পড়েছিল ব্যাপক আকারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো বড় উপন্যাস বা মহাকাব্য কখনো লেখা হয়নি। যেমনটি আমরা আমরা পাই আমেরিকায় রেড ডেথ মহামারিতে একটি জনপদ উজাড় হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-আখ্যান নিয়ে ১৯১২ সালে জ্যাক লন্ডন [১৮৭৬-১৯১৬] রচিত ‘দ্য স্কার্লেট প্লেগ’ উপন্যাসে। যেমন করে কালজয়ী হয়েছে ১৯৪৫ সালে আলবেয়ার ক্যাম্যু [১৯১৩-১৯৬০] রচিত ‘দ্য প্লেগ’। মহামারিকালে কোয়ারেন্টিনে অবরুদ্ধ ফরাসি-আলজেরিয় ওরান শহরের চার দেয়ালের ভেতর ঘটা আখ্যানভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। আলজেরিয়ার ওরান শহরে ইঁদুরের উপদ্রব হতে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ মহামারিতে মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে সূচিত ‘দ্য প্লেগ’ আজও বিশ^সাহিত্যে কিংবদন্তি হয়ে আছে। অপরদিকে, ১৯৬৭ সালে নোবেলজয়ী স্পানিশ সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসেও কলেরা মহামারির চিত্র বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে নোবলজয়ী পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগো (১৯২২-২০১০) রচিত ‘ব্লাইন্ডনেস ’ উপন্যাসটিও মহামারী কালের চরিত্র বোঝার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বসাহিত্যে সাড়া জাগানো কল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টেইন’ এর লেখিকা মেমরি শেলি ‘দ্য লাস্টম্যান’ উপন্যাস রচনা করে মহামারি নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছেন।
আমাদের দেশের ইতিহাসেও মহামারি নতুন কিছু নয়। তবে অতীতে তার পরিচয় ছিল ‘মড়ক’ হিসেবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক বাঙালির নিত্য সহচর। আর এগুলোর অনিবার্য সঙ্গী হয়ে এসেছে দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর, মড়ক-মহামারি। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের মানুষ আবহমান কাল ধরে এইসব মড়ক-মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর ইত্যাদির সাথে লড়াই-সংগ্রাম করে টিকে আছে। তাই স্বভাবতই বাংলা সাহিত্যেও এসবের প্রভাব ও প্রতিফলন ঘটেছে সেই আদিকাল থেকে।
প্রচলিত মৌখিক সাহিত্য তথা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পাশাপাশি লিখিত সাহিত্যের সকল শাখায় নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে বর্ণিত হয়েছে মড়ক-মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির কথা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগে এবং আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে অতীতে ম্যালেরি গ্রামকে নিয়ে অনেক অতিলৌকিক বা ভৌতিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে লোক মুখেমুখে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে সরাসরি মড়ক-মহামারির কথা উল্লেখ নেই। তবে বৌদ্ধ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সাধন সঙ্গীত হিসেবে রচিত চর্যাপদে রূপকের আশ্রয়ে সমকালীন দরিদ্র বাঙালির নিত্যদিনের অভাব, ক্ষুধা, দুঃখ-দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি-বেদনা-পীড়িত জীবনের করুণ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারির নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীকে কল্পনা করা হতো এবং এসব থেকে বাঁচার জন্য পূজা-অর্চনাসহ নানাভাবে তাদের পরিতুষ্টি বিধানের চেষ্টা করতো অজ্ঞ-অসহায় সাধারণ মানুষ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের আগে এই সব লৌকিক দেব-দেবীর কাল্টের উদ্ভবের সুবাদে তৈরি হয় দেবদেবী মহিমা-কীর্তনকারী কাহিনিকাব্য, পাঁচালি, ব্রতোপাখ্যান। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের লোকজ বাংলা কাব্যে বিকাশ লাভ করে মঙ্গলকাব্য নামে একটি বিশিষ্ট সাহিত্য ধারা। মঙ্গলকাব্যে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর মাহাত্ম্যকথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, বসন্তের দেবী শীতলাকে নিয়ে শীতলামঙ্গল কাব্য এবং কলেরা বা ওলাউঠার নিয়ন্ত্রণকারী দেবী হিসেবে দেবী ওলাইচণ্ডীকে নিয়ে উলামঙ্গল বা চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। এসব কাব্যে শীতলা দেবী বা দেবী ওলাইচণ্ডীর উপাসনার মধ্যদিয়ে সে সময়ে বসন্ত, কলেরার মড়ক-প্রতিরোধ কামনারই কথা বলা হয়েছে।
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে কাহিনির মূল উপজীব্য হিসেবে না হলেও নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে মড়ক-মহামাররি কথা বর্ণিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অগ্রপথিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সেলিনা হোসেনসহ শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের রচনায় বিশেষ করে কথা সাহিত্যে মড়ক-মহামারির বর্ণনা পাই নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে। বঙ্কিম চন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে ১৭৭৬-এর মন্বন্তর এবং মন্বন্তরের সঙ্গী হিসেবেই মারি বা মড়কের বিবরণ পাওয়া যায়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর কালে সমগ্র বাংলায় কলেরা-বসন্ত মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গোরা ও চতুরঙ্গ উপন্যাসে এবং বিভিন্ন ছোটগল্পে কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও মহামারির উল্লেখ করা হয়েছে। মহামারির ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো। মহামারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায়। রবীন্দ্রনাথ ‘ওলাওঠার বিস্তার’ নামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধও লিখেছিলেন এবং তার ‘স্বদেশী সমাজ’ পর্বের বিভিন্ন প্রবন্ধে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি চেয়ে আলোচনা করেছেন নানা প্রসঙ্গ ক্রমে।
অপরাজেয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসে মড়ক-মহামারির কথা বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই শ্রীকান্ত উপন্যাসের কথা বলা যেতে পারে। পুরো উপন্যাস জুড়েই মহামারি, মারি বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে দুর্বিপাকের কথা ছড়িয়ে আছে। শ্রীকান্ত উপন্যাসে আমরা চার চারটি মারণ-ব্যাধির উল্লেখ পাইÑ কলেরা, প্লেগ, বসন্ত ও ম্যালেরিয়া। তাঁর, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘পল্লীসমাজ’, উপন্যাসেও মহামারির প্রসঙ্গ এসেছে। শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন গল্পেও মড়ক-মহামারি প্রসঙ্গ এসেছে।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে মহামারির বর্ণনা এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ এবং ‘গণদেবতা’ উপন্যসে কলেরা মহামারির প্রসঙ্গ পাই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের গাওদিয়া গ্রামে প্রায়ই মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ত কলেরা, টাইফয়েড, কালাজ্বর ও বসন্তের মতো রোগগুলো। বেগম রোকেয়ার রচনাতেও প্লেগ ও মহামারির কথা পাই। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে বেগম রোকেয়া যে ইউটোপিয়ার দেশ নির্মাণ করেছেন তাতে মহামারির আসল কারণ বর্ণিত হয়েছে।
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে কলেরার মড়ক এবং এ নিয়ে গ্রামবাংলার অজ্ঞ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে আবহমান কাল ধরে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের ইতিকথা বর্ণিত হয়েছে। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে বসন্ত রোগের প্রকোপের সময় মানুষের এ পলাতক মনোভাব ফুটে উঠেছে, ‘কবর আর কবর’ উচ্চারণে। আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে কলেরা থেকে পলায়নপর মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, “কলেরার সময় গাঁ ছেড়ে পালাচ্ছে ডরে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে পাশের বাড়ীর মানুষ উধাও”। হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে মেতর বউ-এর জবানীতে লিখেছেন, ‘এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তারবদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কত! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কত যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই।’ সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে ‘বুধা’ তার পরিবারের চারজনকে হারিয়েছে। বুধার মানসিক বিপর্যস্ততার ইঙ্গিত লেখিকার কলমে ধরা দিয়েছে, ‘চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বোনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকতে পারে?’ হয়তো পারে না। তাই পৃথিবীব্যাপী আজ কান্নার রোল। কলেরা মহামারি কীভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যু উপহার দিয়েছে সেলিনা হোসেন তারও উল্লেখ করেছেন। ‘সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লোক।’
বাংলা ছোটগল্পেও মড়ক-মহামারির প্রসঙ্গ এসছে নানা প্রেক্ষিতে। মুজতবা আলী ‘পাদটীকা’ গল্পের শুরুতেই মড়কের প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে– “গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়।”
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ‘পুষ্করা’-তেও বাংলার মন্বন্তর পরবর্তী মড়ক থেকে উদ্ধার পাবার চিত্র প্রতিফলিত। জগদীশ গুপ্ত’র ‘পয়োমুখম’ গল্পে ভূতনাথ নিজের স্ত্রীদের হত্যার পিছনে তার অর্থলিপ্সু কবিরাজ বাবার দুষ্কর্ম ধরে ফেলে শেষ পর্যন্ত। শেষতম বউ বেঁচে যায়। ভূতনাথ বলে, “এ বৌটার পরমায়ু আছে তাই কলেরায় মরল না, বাবা! পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।” মানুষের এক অন্ধকার অধ্যায় বেরিয়ে পড়ে। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পের কথক যে-পাথরে হোঁচট খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল বসন্ত রোগ থেকে বাঁচতে সেই পাথরেই মাথা নোয়ায়। সুকুমার রায়ও তাঁর ‘নানাগল্পে’-র ‘পেটুক’-এ লিখেছেন, “চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।”
বাংলা কবিতাতেও বাদ যায়নি মড়ক-মহামারি প্রসঙ্গ। উনিশ শতকের ঢাকার এক ‘বটতলার কবি’ কুশাই সরকার লোকমুখে প্রচলিত বুলিতে ওলাওঠার মহামারি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তো বহু আগেই তাঁর ‘বোধন’ কবিতায় বলে গেছেনÑ ‘মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার/ আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন/ ভাঙা নৌকার পাল/ এখানে দারুণ দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের কাল’। কবি জীবনান্দ দাশের আট বছর আগে একদিন কবিতায়, “এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!/ রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি” Ñউপমায় প্লেগের জীবাণুবাহী হিসেবে বর্র্ণিত। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসামনী’ কবিতায় পাই- ‘ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে।’
অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর থাবায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে দেশ ও বিশ্ব। এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিণতি ভাবনায় সমাজের আর দশজনের মত আমাদের শিল্পী, কবি-সাহিত্যকরাও উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত। কবি-সাহিত্যিকরা করোনাকে ঘিরে তাদের অনুভব-অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে রচনা করছেন ছড়া, কবিতা, গল্প। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এগুলো প্রকাশিতও হচ্ছে। করোনা কালে রচিত কবিতা নিয়ে ইতোমধ্যে সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। কারও কারও কবিতার আবৃত্তিও স্থান পেয়েছে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এর এই সংখ্যায় অল্পসংখ্যক করোনা কালের কবিতা ও গদ্য ছাপা হয়েছে। মনে হয়, করোনা কাল দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে আর অনুপ্রাণন এর পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে আরো অনেক করোনাকালের কবিতা, ছোট গল্প, অণুগল্প, নাটক, চিত্র-চলচ্চিত্র আলোচনা, প্রবন্ধ ও গদ্য প্রকাশিত হবে, প্রত্যাশা রাখি।
নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
Shopping cart is empty!
There are no reviews yet.