Description
সমালোচনা: জ্বিনকন্যা নার্গিসের প্রেম
ডক্টর শাহেদ ইকবাল
‘বসির আহমদের ছেলেকে তিনদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। বসির আহমদ ছেলে নাসির আহমদের শোকে ভীষণ অসুস্থ। ছেলে হারানোর খবর পাওয়ার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী। নাসির আহমদের মা বিলকিস খাতুন মুর্ছা যাচ্ছেন বারবার। সংজ্ঞা ফিরলে রাস্তায় বের হয়ে যাচ্ছেন। তাকে ঘরে ধরে রাখা যাচ্ছে না।’
কথাসাহিত্যিক জনাব হুমায়ুন কবিরের ‘নার্গিস’ উপন্যাসের শুরুটা এরকম। মনে হবে বেশ সাদামাটা। আর দশটা নিখোঁজ সংবাদের মতোই কোনো বিষয়। পাঠকেরও মনে হবে, উপন্যাসের নায়ক নিখোঁজ অথবা অপহরণের শিকার হয়েছে। এই নিয়েই হয়তো গল্প। তেমন আহামরি কিছু না।
কিন্তু কাহিনী যতই সম্মুখে গড়াতে থাকবে, ততই দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকবে। পাঠক মুখোমুখি হবেন এক তীব্র নাটকীয়তা ও শ্বাসরুদ্ধকর গতিময়তার সাথে। উপন্যাসের নায়ক নাসির নিখোঁজ হবে ঠিকই। তবে পৃথিবীতে নয়, পৃথিবীর বাইরে অন্য এক রাজ্যে। তাকে নিয়ে যাবে নার্গিস নামের একটি অসামান্য রূপবতী নারী। এই নার্গিসও পৃথিবীর স্বাভাবিক কেউ নয়।
উপন্যাসের প্রথমভাগে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন জাফর সওদাগরের বাড়ির পরিবেশ দেখে। জাফর সওদাগরের তিন মেয়ের শিক্ষক হিসেবে নায়ক নাসিরের আগমন। এই তিন মেয়ের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থিনী শানু পরমাসুন্দরী। পাঠকের সন্দেহ হবে ছাত্রীর প্রেমের পড়ে নাসিরের এই দশা হতে পারে। সহপাঠী রহিমউল্যা প্যাদার আচরণেও পাঠকের সন্দেহ হবে। ভাববে এটা হয়তো প্রতিপক্ষ প্রেমিকের ষড়যন্ত্র বা অপহরণ কেস। আর কিছু নয়।
কিন্তু পাঠক যতই উপন্যাসের মর্মমূলে প্রবেশ করবেন, ততই সবিস্ময়ে আবিষ্কার করবেন, এটি একটি অবিশ্বাস্য প্রেমকাহিনী। এই প্রেম নিছক মানবীয় নয়, এই প্রেম মানুষ ও জ্বিনকন্যার। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্রস-অ্যাফেয়ার’। উপন্যাসের নায়ক নাসির এক শ্বাসরুদ্ধকর মহাজাগতিক ভ্রমণে পাঠককে নিয়ে গেছেন সুগভীর রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চারে। মানবজীবনের গতিপথ শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের কালচক্রে বাঁধা হলেও এ উপন্যাসের জীবনচক্র যেন আবর্তিত হয়েছে উল্টোরথে। নায়ক পৃথিবী থেকে নির্গত হয়ে একে একে স্পর্শ করেছেন অন্য ভুবনের প্রেম, বিরহ ও উন্মাদনা। কাহিনীর শেষভাগে ফিরে এসেছেন নিজের আস্তানায়। সেই প্রত্যাবর্তনকেও করে তুলেছেন অপার্থিব বর্ণময়।
তারপর?
পাঠক স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়তে থাকবেন, ‘আমি অজ্ঞান ছিলাম না ঘুম থেকে জাগলাম তার কিছুই বুঝলাম না। যখন চোখ খুলেছি, তখন দেখি আমি একটা বড় রাস্তার পাশে পড়ে আছি। রাস্তার দুই পাশে নানান ফলের গাছ।..আমার পাশ দিয়ে অনেক লম্বা লোকজন আসা-যাওয়া করছে। তাদের পা ভীষণ লম্বা। চুলও বড় বড়। মুখ কেমন কেমন মনে হলো। কেউ আমাকে কিছুই বলল না।…এর মধ্যে দেখলাম, সেই নার্গিস নামের জ্বিনকন্যা আমার সামনে এসে হাজির। সে এসে আমাকে বলল, নাসির আমি তোমাকে আমাদের দেশে নিয়ে এসেছি। আমি তোমাকে বিয়ে করব। চলো, আমার সঙ্গে আমাদের ঘরে চলো।…আমি দেখলাম, চারদিকে নানান রকম গাছগাছালি শোভা পাচ্ছে।…যা আমি কখনো দেখিনি।..খাওয়ার পরপরই দেখি, ইয়া বড় দু’জন জ্বিন এসে হাজির।’
কথাসাহিত্যিক জনাব হুমায়ুন কবিরের গদ্যরচনার একটি নিজস্ব শৈলী আছে, যা একেবারেই স্বতন্ত্র। বর্ণনার বাহুল্য নেই, আবার তথ্যেরও ঘাটতি নেই। মানবজীবনের যে অংশগুলো সাধারণের লেখায় বিশদ উল্লেখ থাকে, সেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত। আবার অন্যরা যেখানে সংক্ষেপ করেন, সেখানে তিনি বিস্তৃত। কখনও কখনও দেখা যায়, সাধারণের উপেক্ষিত বিষয়গুলোই তাঁর রচনার মূল নির্যাস। বর্তমান উপন্যাসেও গ্রন্থকারের এই স্বকীয়তা বিশেষভাবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
‘নার্গিস’ উপন্যাসের লেখক শুধু জীবনকেই স্পর্শ করেননি, তিনি স্পর্শ করেছেন ভূগোল ও ইতিহাসকেও। তাঁর বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে বিশ্বের দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক নিদর্শন, জ্বিনজাতির ইতিহাস, সমাজ, সংসার ও প্রেম। উপন্যাসের বাঁকে বাঁকে পাঠক আন্দোলিত হবেন মানবজীবনের হাসিকান্না, স্বপ্ন, অশ্রু, দুঃখ, অভিমান, হিংসা, ঘৃণা, প্রতীক্ষা ও বিসর্জনের দোলাচলে। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে পাঠক দেখতে পাবেন, উপন্যাসের নায়ক নার্গিসের দেওয়া চিঠি ও উপহারসামগ্রী যত্নসহকারে সাজিয়ে রাখছে। কারণ, বড্ড অভিমানী নার্গিস। সে তো আর কখনো আসবে না। নদীর পাড় থেকে যাওয়ার আগে একটি কথা তার কানে এসেছিল। বিদায় বন্ধু, বিদায়। জনমের বিদায়। এ আওয়াজ সে-ই শুধু শুনেছে, আর কেউ নয়।
There are no reviews yet.