Magazine (শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন)
(Showing 1 – 12 products of 41 products)
অনুপ্রাণন ১৩তম বর্ষ ১ম সংখ্যা, সাম্প্রতিকের কবি ও কবিতা সংখ্যা- প্রথম পর্ব
সম্পাদকীয়- অনুপ্রাণন ত্রয়োদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, সাম্প্রতিকের কবি ও কবিতা সংখ্যা (প্রথম পর্ব)
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ত্রয়োদশ বর্ষে পদার্পণ করল। অনুপ্রাণনের লেখক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী জানেন, একাদশ বর্ষ থেকে বছরের ৪টি সংখ্যাই বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করছে এবং পুরো এক বছরের চারটি সংখ্যা বস্তুত একটি বিশেষ বিষয়কেই সম্পূর্ণ করেছে।
যেমন- একাদশ বর্ষের (২০২২) চারটি সংখ্যায় চারটি ভাগে ভাগ করে বাংলাদেশের ১০০ জন নির্বাচিত কবিকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যে কবিদের জন্ম হয়েছে ১৯০০ সাল থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। দ্বাদশ বর্ষে (২০২৩) চারটি ভাগে ভাগ করে বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ গল্পকারদের নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যে গল্পকারদের জন্ম হয়েছে ১৮৯৭ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এই বিশেষ কবি ও কবিতা সংখ্যা এবং গল্পকার ও গল্পসংখ্যার প্রতিটি প্রবন্ধের বিন্যাসে কবি অথবা গল্পকারের জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা অথবা গল্প এবং তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে সামষ্টিক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রবন্ধগুলো পাঠ করলে এটা স্পষ্ট হয়, গত দুই বছরে আমরা যে ১০০ জন বাংলাদেশের কবি ও যে ১০০ জন বাংলাদেশের গল্পকার নির্বাচিত করেছি তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি রচিত হয়েছে।
বিগত একাদশ ও দ্বাদশ বর্ষে অনুপ্রাণনের হাতে নেওয়া উল্লিখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার পথ ধরে এসে ত্রয়োদশ বর্ষে (২০২৪) সাম্প্রতিকের ১০০ জন কবিকে নির্বাচিত করেছে যাদের জন্ম ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের দুটি দশকে। একইভাবে চারটি ভাগে ভাগ করে নির্বাচিত এই ১০০ জন কবিকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের প্রথম পর্ব হিসেবে ২৫ জন কবিকে নিয়ে অনুপ্রাণনের চলতি সংখ্যা; অর্থাৎ সাম্প্রতিকের কবি ও কবিতা প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো।
গত দুই বছর প্রকাশিত ত্রৈমাসিকের সম্পাদকীয়তে আমরা বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছি কারা বাংলাদেশের কবি ও গল্পকার এবং কীভাবে আমরা সেই ১০০ জন কবি অথবা ১০০ জন গল্পকার নির্বাচন করেছি। ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই, বাংলাদেশের সাহিত্য সারাবিশ্বে বসবাসকারী বাঙালি রচিত বাংলা সাহিত্যেরই অংশ যেখানে জাতীয় ও বৈশ্বিক চেতনার মেলবন্ধন হয়েছে। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য- বাংলা সাহিত্যের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই বিকশিত। তথাপি ধ্রুপদি সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্য থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। আধুনিক বৈশ্বিক ধারা ও রীতির ধ্রুপদি কবিতা রচনার বিষয়টি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কবিদের কবিতায় আরও বেশি করে বিকশিত হতে আমরা দেখি।
পাকিস্তানি শাসকদের কুচক্রের কারণে বৈশ্বিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে ছিল। স্বাধীন হওয়ার এক দশক পর অর্থাৎ ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যাপক বৃদ্ধি পেতে থাকে। পশ্চিমে বাংলাদেশের শক্তিশালী ডায়াসপোরা গড়ে ওঠার ফলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কবিরা বিদেশি সাহিত্যিক ও সাহিত্যের সঙ্গে আরও অধিক পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এর প্রভাব বাংলা কবিতায় দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বহু বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক ঘটনা ও দেশের সাধারণ মানুষের জীবনদানের ভেতর দিয়ে তা ধীরে ধীরে একটা রূপ পেয়েছে। সেই জন্যই হয়তো বাংলাদেশের বেশির ভাগ কবির কবিতায় মেধার তুলনায় আবেগ ও উচ্ছ্বাস বেশি লক্ষ করা যায়। যে দেশকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে বারবার যেতে হয়েছে সেই দেশের কবিতায় সেসব ঘটনা থেকে উৎসারিত আবেগ ও উচ্ছ্বাসের ছাপ থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আটের দশকের পর থেকে বাংলাদেশের কবিতা বাঁক নিতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে কবিতা সমষ্টির জায়গা থেকে ব্যক্তির জায়গায় সরে আসতে দেখা যায়। ব্যক্তির নিজস্ব আলো ও অন্ধকার, বিচ্ছিন্নতা, কেন্দ্রহীনতা ও নৈঃশব্দ্য প্রকাশিত হতে থাকে।
সাম্প্রতিকের কবিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় শিশু ছিলেন। তাদের সেভাবে দেখতে হয়নি বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ, ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য জাতির লড়াই, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ভিন্নমতের অস্থিরতার ভেতর দিয়ে গেছে। স্বৈরাচারী শাসককে মেনে নিতে হয়েছে প্রায় দুই দশক। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, পরবর্তীকালে আধা-গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার উন্মেষ, পুঁজি গঠনের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক কবিতায়।
একদিকে নগর ও নগরায়ন, অন্যদিকে দেশের ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন যা শহর ও গ্রামের দূরত্ব কমিয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে ডিজিটালাইজেশন যুক্ত হয়ে সাম্প্রতিক কবিদের কবিতাকে প্রভাবিত করেছে যা বেশ লক্ষণীয়। ফলে, যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরে এমনকি আশি ও নব্বইয়ের দশকেও দেখা যাচ্ছিল তা অনেকটাই স্তিমিত হতে দেখা গেছে সাম্প্রতিক কবিদের কবিতায়। সাম্প্রতিক কবিদের একটা বড় অংশের মধ্যেই আমরা পাই অনুচ্চকিত, শান্ত ও সংহত আবেগের পাশাপাশি নির্মেদ মেধার ব্যবহার। তবে উচ্ছ্বাসময় কবিতা যে সাম্প্রতিক লেখা হয়নি, তা নয়। কারও কারও কবিতাতেই আবেগের আতিশয্য রয়েছে, রয়েছে কথার ফেনা, কিন্তু একটা বড় অংশের মধ্যে যা নেই তা হলো তারল্য, উচ্ছ্বাস অথবা প্রক্ষোভ।
সাম্প্রতিক সময়ের কবিদের অনেকেই ছন্দে লিখতে পছন্দ করেন, লেখেনও। প্রচলিত ছন্দের বাইরে আগেও লেখা হয়েছে, সাম্প্রতিক কবিরাও লিখেছেন। তবে, সাম্প্রতিকের কবিদের একটা বড় অংশ ছন্দের বাইরে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন বলে প্রতিভাত হয়। সাম্প্রতিক এসব বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়েই থাকছে অনুপ্রাণনের সাম্প্রতিক কবি ও কবিতা সংখ্যার চারটি পর্ব।
Quarterly Anupranan 13th Year 1st Issue, Samprotiker Kabi O Kobita
অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- গল্পকার ও গল্প সংখ্যা চতুর্থ পর্ব
সম্পাদকীয় – অনুপ্রাণন – দ্বাদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, গল্পকার ও গল্পসংখ্যা (চতুর্থ পর্ব)
প্রকাশিত হলো ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, গল্পকার ও গল্প সংখ্যা- চতুর্থ পর্ব। গল্পকার ও গল্পসংখ্যা চতুর্থ পর্ব প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১০০ জন নির্বাচিত গল্পকার, তাদের জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, গল্পকার রচিত গল্পসাহিত্য নিয়ে আলোচনা এবং একটি উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলিত করার কাজ শেষ হলো। এই সংখ্যায় পূর্বের তিনটি সংখ্যার মতোই ২৫ জন গল্পকারকে নিয়ে লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
দ্বাদশ বর্ষে এসে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন থেকে বাংলাদেশের ১০০ জন গল্পকার নিয়ে প্রবন্ধ একত্রিত করে সংকলন প্রকাশ করার কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। প্রথম কাজটি ছিল বাংলা সাহিত্যের গল্পকারদের মধ্য থেকে কারা বাংলাদেশের গল্পকার সেটা নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা, দ্বিতীয়তে এসে বাংলাদেশের গল্পকারদের মধ্য থেকে ১০০ জন গল্পকার বাছাই করা, তৃতীয়তে এসে গল্পকারদের গল্পসাহিত্য নিয়ে সামষ্টিক আলোচনা বা প্রবন্ধ লেখার জন্য লেখক নির্ধারণ করা। এই কয়টা ধাপের কাজ যতটুকু না কঠিন ছিল তার থেকে বেশি কঠিন ছিল যেসকল গল্পকারের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো সহজলভ্য ছিল না সেগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে জোগাড় করা। এই কাজ করতে আমাদের চেষ্টার সফলতার পেছনে যারা কাজ করেছেন, সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমরা তাদের কাছেও বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ যারা বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ গল্পকারকে নিয়ে এক একটি প্রবন্ধ লিখে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কাজে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন একাদশ বর্ষে এসেও একইভাবে বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ কবি তাদের কবিতা নিয়ে চারটি সংকলন প্রকাশ করেছে। তারপর দ্বাদশ বর্ষে এসে বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ গল্পকারকে নিয়ে আরও চারটি সংকলন অনুপ্রাণন থেকে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হচ্ছে- যারা আমাদের কবিতা ও গল্প সাহিত্যের ভিত্তি গড়েছেন তাদের সাথে এবং তাদের কাজের সাথে প্রজন্মকে পরিচিত করে তোলা। আমাদের নির্বাচিত গল্পকারদের মধ্য যিনি সর্বজ্যেষ্ঠ তিনি হচ্ছেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তার জন্ম ১৮৯৭ সালে আর মৃত্যু ১৯৭৮ সালে। আর নির্বাচিত ১০০ গল্পকারের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হচ্ছেন ইমতিয়ার শামীম। তিনি ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পূর্ব সময় এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশই সাহিত্যচর্চা করেছেন। ফলে তাদের সাহিত্য এমন একটা বিশেষ সময়কে ধারণ করেছে যেখানে দুটি দেশভাগের অভিজ্ঞতা হয়েছে। দুটি দেশভাগের কার্যকারণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তাদের লেখায় যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ন্যায্যতা ভিত্তি পেয়েছে ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের স্বত্ব, সত্তা ও মৌলিকত্ব নির্মাণে গল্পকারগণ উদ্যোগী হয়েছেন। আমরা অনুপ্রাণন, বিশ্বের বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের স্বকীয় অবস্থানের বাস্তবতাটিকে প্রবলভাবে অনুভব করি এবং গর্বিত হই।
বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্যের চরিত্রদের জীবনের শেকড় অধিকাংশেই প্রাকৃত জীবনে প্রোথিত। মাটি ও সবুজের সাথে সম্পর্কিত। মাত্রই এক অথবা খুব বেশি হলে দুই প্রজন্ম যারা গ্রামের শ্যামলিমা থেকে নগরের কঠিনতায় অভিবাসিত হয়েছে। নগরে থেকেও তারা যেন শহরতলীতে বসবাস করছে। যাদের কারও কারও শরীর থেকে এখনও মাটির গন্ধ মিলিয়ে যায়নি। তাই অধিকাংশ গল্পের দৃশ্যপট হয় শহর না-হলে শহরতলী। গল্পের মানুষগুলো কৃষক না-হয় কৃষকের শিক্ষিত সন্তান। দৃশ্যপটের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোর বিন্যাসে তাই কখনও গ্রাম সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়ে যায়নি।
গ্রামের রূপান্তর কাহিনী হোক অথবা শহর থেকে নগরায়ণের দিকে উত্তরণের কাহিনী হোক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে এখনও পরিবার; তাই কাহিনী যতটা না ব্যক্তিকে নিয়ে তার থেকে বেশি হচ্ছে পারিবারিক অথবা সামাজিক। কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তই বাংলাদেশের গল্পের প্রধান চরিত্র। ধনী পরিবারের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব, কলহ, প্রেম-ভালোবাসার গল্প হাতে গোনা। বাংলাদেশের গল্পকারদের গল্পের প্লটে সংঘাত ও সংঘর্ষের নিরসনই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু এমন কিছু প্লট সৃষ্টি করতেও দেখা গেছে যেখানে সংকট নিরসন হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশের গল্পকারদের গল্প অধিকাংশই একটি ইতিবাচক সমাধান অথবা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং নেতিবাচক চরিত্র খুব কমই গল্পের সম্পূর্ণতার ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের গল্প রোমান্টিক ভাব ও আবেগে ভারাক্রান্ত হতেই দেখা যায় বেশি এবং পাঠকেরা সেগুলো পছন্দও করছেন। কিন্তু গল্পকাররা তাদের গল্পে ভাব ও আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, বাস্তব বিচারে সেই গল্পগুলো বোদ্ধা ও পরিপক্ব পাঠক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
বাংলাদেশের গল্পের আখ্যানবস্তুতে রোমান্টিকতার প্রভাব বেশি থাকলেও এক ঝাঁক গল্প আছে যেখানে জীবনজিজ্ঞাসার দর্শন চিন্তায় জাগরিত হতে দেখা যাচ্ছে। গল্পের গদ্যনির্মাণ যথেষ্ট পরিপক্ব। বানান, ব্যাকরণ, বাক্য গঠন, রূপকের নান্দনিক ব্যবহারে সমৃদ্ধ। গল্পের শুরুর চমক নিয়ে গল্পকারদের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়। এই ব্যাপারে ভিন্নমত আছে, যদিও পারিবারিক পটভূমিতে নির্মিত গল্পগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চমক দিয়ে শুরু করার একটা প্রবণতা রয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক সংলাপ কোনো কোনো গল্পকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করেছে। কিন্তু বলা যেতে পারে অধিকাংশ গল্পই দৃশ্যপট বর্ণনায় এবং সংলাপের ওপর গল্পকাঠামো নির্মাণ করার কাজটি করেছেন মেদহীন গদ্যে। গল্পগুলো একরৈখিক হয়নি আবার পার্শ্বচরিত্রের উপ-গল্পগুলো গল্পের প্রধান আখ্যানকে ভারাক্রান্ত করেনি। সময়, কালের প্রতি গল্পগুলো সুবিচার করেছে যেখানে সত্য ইতিহাসের সাথে অহেতুক বিতর্কে অবতীর্ণ হয়নি। গল্পের পক্ষ ও প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব ও তাদের আচার-আচরণ অবাস্তব করে তোলা হয়নি। গল্পের চরিত্রগুলোকে দেবতাতুল্য অথবা উল্টোদিকে শয়তানতুল্য করে অবাস্তব কাল্পনিক চরিত্র করে গড়ে তোলা হয়নি। বাংলাদেশের গল্পে রূপকের ব্যবহারে ফ্যান্টাসির তুলনায় বাস্তবের বস্তুগুলোকেই নান্দনিক করে তোলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে নির্বাচিত ১০০ গল্পকারের গল্পগুলো সামগ্রিকভাবেই এমন একটি উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে, যখন বাংলাদেশের গল্পসাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের গল্পের ভাণ্ডারে শামিল হওয়ার যোগ্যতাকে আর অস্বীকার করা যায় না।
অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- গল্পকার ও গল্প সংখ্যা চতুর্থ পর্ব
অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- গল্পকার ও গল্প সংখ্যা তৃতীয় পর্ব
অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা— গল্পকার ও গল্প সংখ্যা— তৃতীয় পর্ব— সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ গল্পকার ও তাদের উল্লেখযোগ্য গল্প নিয়ে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষের যাত্রার তৃতীয় পর্বে প্রকাশিত হলো আরও ২৫ জন গল্পকারের জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা; তাদের রচিত গল্প-সাহিত্য নিয়ে সামষ্টিক আলোচনা এবং একটি করে নির্বাচিত গল্প (আলোচকের পছন্দে)। সংখ্যাটিতে গল্পকারদের নিয়ে রচনাগুলোর অনুক্রম নির্ধারিত আলোচকদের থেকে লেখা প্রাপ্তির ভিত্তিতে বয়সানুক্রমে প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ গল্পকার ও তাদের লেখা গল্প নিয়ে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশের এই উদ্যোগের পদ্ধতিগত ন্যায্যতার প্রশ্ন নিয়ে গল্পকার ও গল্পসংখ্যার পূর্ববর্তী পর্ব দুটোয় সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। তবে সংখ্যাটি ১০০ কেন? ৯৯ বা ১০১ অথবা অন্য কোনো সংখ্যা কেন নয়? এটা নিয়ে দু’একজন প্রশ্ন রেখেছেন। গণনা অথবা পরিমাপ করার জন্য যে গাণিতিক বস্তু ব্যবহার করা হয়ে থাকে; সেটাকেই আমরা সংখ্যা বলি। সংখ্যা একটি বিমূর্ত ধারণা। কিন্তু সময় ও বস্তুর সাথে যুক্ত হয়ে এটি একেকটি বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। ইতিহাসযাত্রার মাইলফলক হিসেবে দুই বছর আগে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। স্বাধীনতার এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদানগুলোতে যে বিবর্তন হয়েছে সেই বিবর্তনের ধারণা নেওয়ার জন্য একটি কোয়ান্টাম সময় অথবা বিবর্তনের সাথে জড়িত প্রতিনিধিদের একটা কোয়ান্টাম সংখ্যা নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্যে চলমান বিবর্তনের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও শ্রেণিভুক্ত সকল প্রকাশের অঙ্গ, ধারা ও উপাদান তুলে ধরার প্রয়োজন মেটানোর জন্য বহুল ব্যবহৃত একটা উপযুক্ত সংখ্যা বেছে নেওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল বলেই আমাদের মনে হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত মেট্রিক ধারণায় ০.০১, ০.১, ১, ১০, ১০০ বহুল ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ সকল সংখ্যা। বিজ্ঞানের ধারাতেই শতকরা হিসাবে, বছর হিসাবে, জমির মাপে অথবা প্রতিনিধি নির্বাচনের সংখ্যায়— শতক সংখ্যাটি চলেই আসে। ১ সর্বদাই অবিভাজ্য ঐক্যের প্রতীক, সাথে মেট্রিক ধারণায় শূন্য সংখ্যাটি ১-এর সামনে অথবা পেছনে অবস্থান নিয়ে একের গুণিতককে নির্দেশিত করেছে। একের গুণিতক সংখ্যাই বাস্তবতাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তবে বলে রাখা ভালো, সংখ্যাতত্ত্বের উপর ভর করে কোনো কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসের সাথে এই সব ভাব বা বস্তুনিরপেক্ষ জ্যামিতিক মেট্রিক সংখ্যাগুলোর কার্যত কোনো সম্পর্ক নাই। অনুপ্রাণন কর্তৃক নির্বাচিত ১০০ গল্পকারের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র উনিশজন। নির্বাচিত ১০০ গল্পকারের মধ্যে গল্পকার নির্বাচনের একটি শর্ত ছিল জন্মসাল। নির্বাচিত গল্পকারের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম হচ্ছেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম, যিনি ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কনিষ্ঠতম হচ্ছেন তারা যাদের জন্মসাল ১৯৬৫। সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য একবিংশ শতাব্দীতে এসে নিম্নগামী হয়েছে কিন্তু হ্রাসের গতির পেছনে বিংশ শতাব্দীতে নারী সাহিত্যচর্চাকারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। অনুপ্রাণনের গল্পকার ও গল্প সংখ্যাগুলোতে নির্বাচিত নারী গল্পকারদের গল্পসমূহ নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো পাঠ করলে এই ধারণা স্পষ্ট হয়। স্মর্তব্য যে, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে সংখ্যাগত পার্থক্য শুধু বাংলার নয়— কম-বেশি সারা বিশ্বের। অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশের গল্পকারদের গল্পে প্রবণতা হিসেবে রোমান্টিকতা ও নান্দনিকতার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার তুলনায় সামাজিক বাস্তবতা অর্থাৎ পারিবারিক-সামাজিক, রাজনীতি-অর্থনীতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব ও সংকটের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। গ্রাম ও শহর পৃথক পৃথকভাবে অথবা মিশ্রভাবেও এসেছে। গ্রাম-শহরের বিবর্তন ও রূপান্তরের ফলে সৃষ্ট ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, উৎপাদন অথবা কর্মস্থলের সমস্যা ও সংকটসমূহ চিত্রিত হয়েছে। পরিবর্তন কীভাবে যাপিত জীবনে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে এসব মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণ বাংলাদেশের গল্পকারদের গল্পে এসেছে নিখুঁতভাবে। মানুষের চিন্তাধারা কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। একজন সাহিত্যিকও তার চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন নিয়ে আসেন কখনো সচেতনভাবে অথবা কখনো অবচেতনভাবেই। বাংলাদেশের সাহিত্যে নারী-পুরুষের প্রেম, পরকীয়া, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের মনস্তত্ত্ব যেন এখনো অনেকটা গ্রামীণ। চরিত্রের বাইরের চরিত্র অর্থাৎ পরিবার ও সমাজের সাথে যুক্ততা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। তাই দেখা যায় প্রেম, পরকীয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে কেউ না কেউ নাক গলিয়েই যাচ্ছেন। আমরা এখন চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ডিজিটাল বিষয়গুলোর উত্তরণ ঘটছে, ঘটছে জীবন-যাপনের চালচিত্র। মানবাধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে যেমন মানুষ সোচ্চার হচ্ছে তার পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের অবস্থান দৃঢ়তর হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, বিশেষ করে ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গল্পকারদের গল্পে সমাজই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা - গল্পকার ও গল্প সংখ্যাঃ তৃতীয় পর্ব
অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা – গল্পকার ও গল্প সংখ্যা, দ্বিতীয় পর্ব
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, গল্পকার ও গল্প সংখ্যা (দ্বিতীয় পর্ব)
বালাদেশের ১০০ গল্পকার ও তাদের উল্লেখযোগ্য গল্প নিয়ে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন যাত্রার দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হলো আরও ২৫ জন গল্পকারের জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, তাদের রচিত গল্প-সাহিত্য নিয়ে সামষ্টিক আলোচনা এবং একটি করে তাদের উল্লেখযোগ্য গল্পের অনুলিপি। সংখ্যাটিতে গল্পকারদের নিয়ে রচনাগুলোর অনুক্রম লেখা প্রাপ্তির ভিত্তিতে বয়সানুক্রমে প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের চৌহদ্দিতে পৃথকভাবে বাংলাদেশের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনায় বাংলা সাহিত্যে পাকিস্তানি ভাবধারা অর্থাৎ রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব প্রসঙ্গে পূর্বে আলোচনা হয়েছে। দেশভাগের আগের সাহিত্য অখণ্ড বঙ্গসাহিত্যের সাথে পরোপুরি অন্বিত হলেও পূর্ববাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রচিত সাহিত্যপ্রবণতা কতিপয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একটু স্বতন্ত্র ছিল। বিশেষত তার আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এর সাহিত্যকে নতুন কাঠামো দিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বা দেশভাগ পরবর্তী পর্যায়ে আরবি-ফার্সি ও ইসলামিকরণের প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল না হলেও সেই প্রচেষ্টার কারণে মূলধারার সাহিত্য সৃজনপ্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু, সকল প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের একনিষ্ঠ কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমকে মুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক রাখার চেষ্টা কার্যকরীভাবে সক্রিয় ছিল। তাই পাকিস্তানপন্থি সাহিত্যগোষ্ঠী সফলতা পায়নি এবং তাদের রচিত সাহিত্য স্থায়ী কোনো রূপ পায়নি এবং একসময় মানুষের স্মৃতি থেকে তা হারিয়ে যায়।
ইতোপূর্বে অনুপ্রাণন সম্পাদকীয়তে এটাও আলোচনা হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সাহিত্যের ভিত্তি সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার আগের কয়েক দশকে। পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সময় উদ্দীপ্ত মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ সমাজের মানস আবিষ্কার করেছিলেন লেখকেরা। পরবর্তীকালে স্বাধীনতার শক্তি, সংহতি, মর্যাদাবোধ ও গৌরব বাংলাদেশের আপামর জনগণের মনে যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল এর প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। এর সাথে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়েছে এই বাংলার নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরান লীলা, নদীমাতৃক সজল মনন, আঞ্চলিক জীবন ও ভাষার বৈচিত্র্য, ছোট ছোট সম্প্রদায় ও পেশাজীবী মানুষের অন্তর্লীন জীবনধারা ও বোধ।
যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমসাময়িকতা সাহিত্যকে রসদ জোগায় ঠিকই তবে তা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকরও বটে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যদ্ধের কারণে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল তা লেখকদের মনে স্থায়ী এক প্রভাব ফেলে ঠিকই; যুদ্ধের নানা ধরনের তাৎপর্যগত অধীরতা নিয়ে সাহিত্যকর্ম তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু সব লেখক এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন কিনা বা এর গভীর তাৎপর্যকে ধারণ করার মতো শক্তি সবার ছিল কিনা- প্রসঙ্গটির যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
আর একটি বিষয়, সাময়িক ঘটনার তাৎক্ষণিক উত্তেজনা গভীর বা শাশ্বত কোনো জীবনবোধ সৃষ্টি করতে পারে না। ক্লাসিক বা ধ্রুপদি সাহিত্য সমসাময়িকতাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। সেকারণে বড় আকারের কোনো ঘটনা নিয়ে মহাআখ্যান বা ধ্রুপদি রচনা লিখতে লেখককে অপেক্ষা করতে হয় অনেকটা সময়। অপেক্ষা করতে হয় ততদিন, যতদিন না যুদ্ধ বা মারির সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব বা মানবসমাজে তার প্রভাব আবিষ্কার করার পূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলাদেশের মহান মক্তিযুদ্ধ নিয়ে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যান বা অনন্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়ে গেছে এরকমটা ভাবা হয়তো সঠিক নয়। বরং, হয়তো আরও দীর্ঘ সময় আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে এই পঞ্চাশ বছরে যা রচিত হয়েছে তার মান নিয়ে কথার পাশাপাশি তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং এই আলোচনার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যেভাবে মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় তার গভীর ও নির্মোহ বয়ান আমরা পেয়েছি সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের লেখকদের রচনায়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর প্রো-পাকিস্তানি শক্তিবলয় যে রাজনৈতিক অপতৎপরতা শুরু করে তার ভয়াবহ পরিণাম এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যে ঘটেনি। তখন মুক্তবুদ্ধির সত্যিকারের লেখকদের জীবনে অমোঘ অন্ধকার নেমে এলেও, অবাধ সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা বাধাপ্রাপ্ত হলেও, সামরিক সরকার বা ছদ্মবেশী সামরিক সরকার নতুন জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব নিয়ে জোরেশোরে দল বেঁধে মাঠে নামলেও, তাদের বশংবদ লেখকেরা তেমন কোনো মানসম্পন্ন সাহিত্য রচনা করতে পারেননি। যার ফলে ৯০ দশকের পর থেকে মূলধারার সাহিত্য দ্রুতই স্বস্থান ফিরে পেতে শুরু করেছিল।
কিন্তু ইদানীং রাজনীতির আপসকামিতার চোরাগলি দিয়ে রক্ষণশীলতা ও মৌলবাদ উদার ও মুক্ত শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে একপ্রকার বাধা হয়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট রয়েছে। যার ফলে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের ছায়া যেন কবি ও কথাসাহিত্যিকদের শিল্প-সাহিত্য চর্চায় ঈষৎ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে যদিও কোনো গভীর সংকট এখনো সৃষ্টি হয়নি তবুও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সাইবার নিরাপত্তার মতো আইন প্রণয়ন সম্পর্কে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন প্রতিবাদ আরও জোরদার হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শিল্প ও সাহিত্য যে কোনো সেন্সরশিপ বা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা প্রকাশের কার্যকরী ক্ষেত্র প্রস্তুত করার হাতিয়ার। শিল্প-সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে সামাজিক অসঙ্গতি ও সংহতি গড়ার এবং উপায়গুলো আবিষ্কার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ পাঠক শিল্প প্রকরণের মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা সন্ধান করার সুযোগ খোজেন। এই মিথস্ক্রিয়ায় রুচি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চলমান ও প্রগতিশীল একটি প্রভাব আছে। কিন্তু, কেউ কেউ এসব বিষয়ে মত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন বা একাত্মতা প্রকাশ না-ও করতে পারেন।
সাহিত্য কেবল অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে জাতিকে উত্তরণের জন্য কাজ করে না, সুন্দরের নানা পথও উন্মোচন করে দেয়। শিল্প-সাহিত্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সন্নিহিত একটি বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠতে আমরা দেখেছি এবং হয়তো চলমান সময়ে ভাঙা-গড়ার প্রক্রিয়ায় কোনো নতুন পথের সন্ধান আমরা পেতে পারি। কিন্তু কোনো কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত ঘটেনি, ঘটবেও না। সেক্ষেত্রে সময়টাকে বদলে দেওয়ার কৌশল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের অনুধাবন করাটা জরুরি।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা - গল্পকার ও গল্প সংখ্যাঃ দ্বিতীয় পর্ব
অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা – গল্পকার ও গল্প সংখ্যা, প্রথম পর্ব
সম্পাদকীয়- দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, গল্পকার ও গল্প সংখ্যা প্রথম পর্ব।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ করেছে। ১১ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে রয়েছে। যে অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা এখন বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে যৎসামান্য হলেও অবদান রাখার মতো কোন কাজের পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারি। যেমন গত বছর আমরা পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলাম বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ জন কবির জীবনী, প্রকাশনা, সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং কবির কবিতাকর্ম নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা চারটি সংখ্যায় সংকলিত করার। যে পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন নিজেদের সক্ষমতা মূল্যায়ণে আমাদের বিস্তর সাহায্য করেছে। কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের উপর আমাদের আস্থা বৃদ্ধির ফলাফল এ-বছরে বাংলাদেশের ১০০ জন গল্পকারের জীবনী, প্রকাশনা, পুরষ্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য গল্প ও গল্পকারের সামগ্রিক গল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা দ্বাদশ বর্ষের চারটি সংখ্যায় সংকলিত করার পরিকল্পনা গ্রহন। সেই পরিকল্পনার প্রথম পর্বে প্রকাশিত হলো বাংলাদেশের ২৫ জন গল্পকারের জীবনী, প্রকাশনা, পুরষ্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য গল্প ও গল্পকারের কাজের উপর সামগ্রিক আলোচনা সংকলন অর্থাৎ গল্পকার ও গল্প সংখ্যা, প্রথম পর্ব।
একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশের ১০০ জন গল্পকার নির্বাচন করেছি। প্রথমতঃ আমরা বিবেচনা করেছি আধুনিক বাংলা ভাষায় চর্চাকারী গল্পকার যাঁর জন্ম বাংলাদেশে অথবা যিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশে বসবাস করেছেন অথবা যাঁর প্রকাশনা ও পাঠকের মূল অংশটি ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। দ্বিতীয়ত আমরা বিবেচনা করেছি যাদের জন্ম ১৮৯৫ থেকে ১৯৬৫ খৃস্টাব্দের মধ্যে। তৃতীয়তঃ আমরা বিবেচনা করেছি যে গল্পকারের গল্পে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের সাধারণ ঐতিহ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির স্বাধীনতা এবং জনগণের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সমাজ-বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে। চতুর্থতঃ যে গল্পকারের এক বা একাধিক গল্প বাঙালি পাঠক মহলের বড় অংশে উল্লেখিত হয়েছে এবং সমাদৃত হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের বিষয়গুলো জাতি তথা মানবজাতির সাধারণ এবং উন্মুক্ত অধিকারের বিষয়। কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের বিষয়গুলো বিবেচিত না হওয়াই কাম্য। কিন্তু তারপরও কতগুলো বিষয় থেকে যায় যে বিষয়গুলো নিয়ে আপস করা কঠিন। আর তাছাড়া প্রজন্মকে কিছু বার্তা দেয়া প্রয়োজন, যে বার্তা, বক্তব্য অথবা কর্ম, সমাজে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কারা পক্ষে ছিল আর কারা বিপক্ষে ছিল? এটা মানবতার পক্ষে অথবা বিপক্ষে থাকার মতোই একটি প্রশ্ন। যখন জাতীয় বিদ্বেষ প্রসূত হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা নিয়ে জেনোসাইড চলে তখন পক্ষের বিষয়টা শুধু রাজনৈতিক থাকে না মানবিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই যখন কোন শিল্পী বা সাহিত্যিক এরকম সঙ্কটপূর্ণ সময়ে বা পরবর্তী সময়ে মানবতার পক্ষে না গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যুদ্ধাপরাধীদের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন তাহলে সেটাকে নিছক ব্যক্তিগত বিষয় বলে গণ্য করা কঠিন হয়ে যায়। আর এই গণ্য করতে না পারার বিষয়টি অনুপ্রাণনের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।
বাংলা সাহিত্যে ফর্ম হিসেবে আধুনিক ছোট গল্পের ধারণা খুব পুরানো নয়। কলকাতা কেন্দ্রিক লেখক ও বুদ্ধিজীবী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেকটা ইউরোপীয় সাহিত্যের সংস্পর্শে এসেই ছোট গল্প রচনার ফর্মটি নিয়ে সাহিত্য চর্চার সূচনা করেন। তখন শুরুতে রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও প্রচার প্রোপাগান্ডার কাজে গদ্য লেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই গদ্য লেখার প্রয়োজনীয় ফর্মটাকে ধরে পাশাপাশি ছোটগল্প লেখার চল শুরু হলে ক্রমেই লেখক ও সাহিত্যিকদের কাছে কবিতা বা পদ্যের পাশাপাশি ছোট গল্পের ফর্মটি প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ছোট গল্প রচনার কৌশলটি আয়ত্ত করতে সময় লাগে। কেননা ছোটগল্প সম্পূর্ণভাবে আখ্যানভিত্তিক একটি রচনা না। আখ্যানের খণ্ডাংশকে ধারণ করে অথবা না করে অনুভূতির বিস্তৃত ক্যানভাসে কতগুলো জট সৃষ্টি এবং সেই জটের পাকানো এক একটা সুতা খোলার মধ্য দিয়ে পাঠককে ধরে রাখা, আবিষ্ট রাখার মুন্সিয়ানা না থাকলে ছোট গল্প ঠিক ছোট গল্প হয়ে ওঠে না।
অনুপ্রাণন প্রকাশিত গল্পকার ও গল্প সংখ্যার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে গল্পকারদের ছোট গল্পগুলি নিয়ে সামগ্রিক আলোচনার সাথে প্রত্যেক গল্পকারের একটি করে নির্বাচিত গল্প সংযুক্ত করা হয়েছে। এই গল্পগুলো আলোচকরাই নির্বাচন করেছেন। গল্পগুলো পাঠের এই সুযোগের মাধ্যমে এই সংখ্যাটির পাঠকরা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত গল্পকারদের লেখার সাথে পরিচিত হতে পারবেন। বাংলাদেশের গল্পগুলো পাঠ করলে দেখা যাবে কতগুলো গল্প প্রেমবিষয়ক অর্থাৎ এসব গল্পে প্রেম ও রোমান্স প্রাধান্য পেয়েছে। কতগুলো গল্পে গ্রামীণ, আর কতগুলো গল্পে সামাজিক প্রতিবেশ এবং গ্রামীণ অথবা শহুরে সমাজের চিত্র মেলে। বাংলাদেশের গল্পে প্রকৃতি ও মানুষ সবসময় প্রাধান্য পেয়েছে, যেসব গল্পে প্রকৃতির পটভূমিতে চরিত্রাঙ্কন করা হয়েছে। কম হলেও আমরা এমন কিছু গল্প পেয়েছি যেখানে অতিপ্রাকৃত-ভাব বা রহস্য-আচ্ছন্নতা লক্ষ করা যায়। কোন কোন গল্পে হাস্যরস ও নিখাঁদ বিনোদন প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশের গল্পকারদের কতগুলো এমন গল্প আছে যে গল্পগুলোতে অসম্ভব বা অবাস্তব কাহিনী বর্ণিত হতে দেখা যায় যেখানে কতগুলো গল্পের পাত্রপাত্রী বা পরিবেশকে না বুঝিয়ে সাংকেতিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থান বা চরিত্রকে বোঝানো হয়েছে অথবা বার্তা প্রদান করা হয়েছে। ইতিহাসভিত্তিক গল্পগুলোতে কোনও একটি বিশেষ ঐতিহাসিক কালে সংঘটিত ঘটনা বর্ণিত হতে দেখা গেছে। সেখানে দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। খুব কম হলেও কিছু গল্প আছে যেখানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে গল্পটি রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের গল্পে এধরণের গল্পের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায় যেখানে শহুরে অথবা গ্রামীণ পরিবেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক ও গৃহজীবন প্রাধান্য পেয়েছে। তুলনামূলক কম হলেও এরকম বেশ কয়েকটি গল্প দেখতে পাওয়া যায় যেখানে নর-নারীর মনস্তত্ত্ব ও মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের গল্পে এরকম গল্প আছে যেখানে মনুষ্য নয় এমন কোন প্রাণী প্রধান চরিত্র হয়েছে। বাস্তবনিষ্ঠ গল্পে যেখানে জীবনের কোনও ঘটনা বা দিক অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও অকপট ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। কম হলেও কিছু গল্পে পুলিশি তদন্ত ও সত্যানুসন্ধানের রোমাঞ্চকর বর্ণনা পাওয়া যায়। কিছু গল্প আছে যেগুলো বিদেশি পটভূমিকায় বাংলাদেশী অভিবাসী অথবা বিদেশী নরনারীর চরিত্রাঙ্কন করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণভাবে ছোটগল্পের প্রায় সব শাখার গল্পই বাংলাদেশের গল্পকারেরা লিখেছেন।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা - গল্পকার ও গল্প সংখ্যাঃ প্রথম পর্ব
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা – কবি ও কবিতা সংখ্যা, চতুর্থ পর্ব
কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সংগঠন প্রয়োজন। বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও আচার-আচরণের প্রেক্ষাপটে একটি কার্যকরী সংগঠন গড়ে তোলা অনেক শ্রম ও সময়সাপেক্ষ কাজ। বিশেষ করে দেখা যায় যে গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত একটি সংগঠনে ভাঙা গড়া লেগেই থাকে যার ফলে কাজের গতি ও পরিধি সবসময়েই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। অনুপ্রাণন সবসময় নেতিবাচক আলোচনা-সমালোচনাকে এড়িয়ে চলেছে। এর অর্থ এই নয় যে উদ্ভূত সেসব নেতিবাচক বক্তব্যের জবাব আমাদের কাছে নেই কিন্তু আমরা চেয়েছি ইতিবাচক কাজের মাধ্যমেই সেসব নেতিকে নাকচ করার মানসিকতা যেন গড়ে ওঠে। তাই, অনুপ্রাণন সবসময় ইতিবাচক কাজ করে যাওয়ার পক্ষেই শক্তির যোগান দিয়েছে। আমাদের ভালো ভাবে ভেবে দেখা দরকার যে চলমান অস্থির প্রতিযোগিতার পরিবেশে কি-করে শিল্প-সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা সাহিত্যের প্রতি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তোলা যায়। একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয় যে, মনে হয় যেন কবিতা পাঠের থেকে কবিতা লেখার আগ্রহই প্রজন্মের বেশী। এই হিসাবটা হয়তো শতভাগ ঠিক না কিন্তু অনুপ্রাণন প্রকাশনে অনেক তরুণ কবিদের দুর্বল কবিতার পা-ুলিপি নিয়ে প্রকাশনার জন্য ভিড় করা দেখে এরকমই মনে হতে পারে। এই বক্তব্যের প্রতি যদিও ভিন্নমত আছে তবুও আমরা মনে করি যে, সর্বক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবি, লেখক ও শিল্পীর সৃজনশীল কাজ সত্যিকার অর্থে মূল্যায়িত হতে পারে যদি প্রাতিষ্ঠানিক অথবা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলেও তার গড়ে ওঠার পেছনে একটা নির্দিষ্ট ও সুনিবিষ্ট প্রস্তুতি ও চর্চার পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। ব্যতিক্রম থাকেই কিন্তু সেই ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে সাধারণের পক্ষে যুক্ত করাটা হয়তো ঠিক না।
তরুণ লেখকদের এই প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করেই অনুপ্রাণন সেরকমই একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কার্যক্রম গ্রহণ করার প্রয়াস পেয়েছে যেখানে তরুণ কবি ও সাহিত্যিকেরা প্রিন্ট পত্রিকা ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এবং অনুপ্রাণন অন্তর্জালের সাথে যুক্ত হয়ে গ্রন্থ প্রকাশনা পূর্ববর্তী কালের প্রস্ততি গ্রহণের সুযোগ নিতে পারে।
Anupranan Troimasik Year 11 Issue 4, Kabi O Kabita Songkhya- Churtho Porrbo
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ৩য় সংখ্যা- কবি ও কবিতা সংখ্যা- তৃতীয় পর্ব
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণনের একাদশ বর্ষের ৪টি সংখ্যায় বাংলাদেশের ১০০জন নির্বাচিত কবি ও তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনার তৃতীয় পর্বে এসে এই সংখ্যায় ২৩জন কবি ও তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা সমুহ সংকলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকের একাদশ বর্ষ অর্থাৎ এ-বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় বাংলাদেশের ১০০জন নির্বাচিত কবি তালিকা থেকে প্রতিটি সংখ্যায় ২৭জন করে মোট ৫৪জন কবির জীবনী, প্রকাশনা, প্রাপ্ত সম্মাননা ও পুরষ্কার, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং কবিতা নিয়ে বিশেষ আলোচনা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই সংখ্যায় অর্থাৎ ৩য় পর্বে ২৩ জন এবং পরবর্তী ৪র্থ পর্বে আরো ২৩ জন কবি ও কবিতা নিয়ে মোট ১০০ জন কবির জীবনী, প্রকাশনা, পুরষ্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং কবিতা নিয়ে আলোচনা সংকলন সম্পন্ন হবে বলে আশা রাখছি।
বাংলাদেশের কবি ও তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখি যে, বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের কবিদের অপরিসীম ভূমিকা ও অবদান রয়েছে। সাহিত্যমান বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে কবিতাগুলো যে অত্যন্ত উচ্চস্থান দখল করে আছে, এটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। একদিকে নান্দনিক বিবেচনায় কবিতাগুলো যেমন উত্তীর্ণ, অন্যদিকে ঠিক তেমনই চলমান সমাজ, রাজনীতি, শোসিত মানুষের সংগ্রাম, জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও মানবিক চেতনায় উদ্ভাসিত কবিতামালা গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের কবিদের মূল বিষয় হিসেবে বাঙলার প্রকৃতি, মানবতা, মানব প্রেম, মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ, ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় ও সামাজিক মৌলবাদ বিরোধিতা, নারীবাদ ইত্যাদী বিষয়গুলো যেমন এসেছে ঠিক তেমনই পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে মানব-মানবীর প্রেম, বিরহ অথবা ব্যক্তি পরিচয়, আত্মানুসন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসামূলক দার্শনিক বিষয়গুলো। ব্যক্তি, সমাজ ও দেশ কোনটাই অবহেলিত থাকেনি। জয়-পরাজয়, আশা-হতাশা, সংগ্রাম, সংক্ষুব্ধতা অথবা আপসকামিতা ছাড়িয়ে তাদের কবিতা হয়েছে মূলত জীবনধর্মী। তাই বাংলাদেশের কবিদের কবিতায় বহুলাংশে প্রকৃতি, প্রেম ও জীবনের অপার সৌন্দর্য সবসময় উঁচুতে তুলে ধরতে দেখা গেছে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা- সম্পাদকীয়
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ২০১২। এ-পর্যন্ত ৩২টি সংখ্যা প্রকাশ করে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ টি বছর অতিক্রম করেছে। এ দশটি বছর অনুপ্রাণন’কে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আজ একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করার মুহূর্তে পেছনের দশটি বছরের দিকে ফিরে স্মৃতিতে অনেক কিছুই ভেসে আসে। লেখক, পাঠক এবং সম্পাদনা পরিষদের সাথে ভাগ করে নেয়ার মতো অনেক কথাই হয়তো বলার থাকে, বলার ছিল। কেননা ১০ বছর তো কম সময় নয়। তবে, শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা অথবা লিটল ম্যাগ প্রকাশের ইতিহাসে প্রায় একই ধরনের ঘটনা হয়তো হর-হামেশাই ঘটে থাকে।
টেকসই সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণে পেশাদারিত্বের অভাব আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এখনো সেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অহমবোধ প্রতিটি সংগঠনের ভিত কুরে কুরে খাচ্ছে। বাইরের থেকে যেটা দেখা যায় সেটা ঠিক ভেতরের চিত্র না। আর তাছাড়া অর্থনীতির বিষয়টা তো আছেই। আর সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করার ঘাটতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জগতে সাধারণভাবেই অর্থের সংকট রয়েছে। সাধারণভাবেই বলা যায় যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির গুরুত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো যথার্থভাবে বুঝতে ব্যর্থ। ভাবা হচ্ছে ভৌত কাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নতির চাকা ঘুরলে দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু আমরা জানি উন্নত সভ্যতা মানেই হচ্ছে উন্নত শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
তাই, অনুপ্রাণন যেসব সাংগঠনিক সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে আছে সেসবের সাথে অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য বা ব্যতিক্রম হয়তো নির্মাণ করা যায়নি। কেননা আমরা শেষ পর্যন্ত, এদেশের প্রকৃতি ও মনুষ্যসমাজেরই অঙ্গ। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি- এসবের সংকট ও সম্ভাবনা থেকে অনুপ্রাণন বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ তো নয়।
এটা ঠিক অনুপ্রাণন পত্রিকাটিকে ঘিরে এই দশ বছরে লেখক-পাঠক ও সুভানুধ্যায়ীদের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এই বৃত্ত কোনো বিশেষ সীমানা রেখা দিয়ে ঘেরা কোনো বৃত্ত না। এই বৃত্ত শিল্প-সাহিত্যের মুক্ত চর্চার মতোই উন্মুক্ত। অনুপ্রাণন মুক্ত চিন্তার চর্চাকেই সবসময় সমর্থন করেছে, অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছে। আর অনুপ্রাণন চেষ্টা করেছে এদেশের তরুণরা যেন বেশী বেশী করে বই পড়া আর শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সারাদেশ জুড়ে অনুপ্রাণনকে ঘিরে আছে একদল তরুণ-তরুণী, যারা নিয়মিত শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারাই অনুপ্রাণনের প্রাণশক্তি। যাদের সাথে অনুপ্রাণনের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক সৌহার্দের। একে আরেকের পরিপূরক।
দশ বছর নিয়মিত বিভাগ নিয়ে ছাপার সংস্করণ আকারে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশ করার পথে লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে ক্রমেই দুটি দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, অনুপ্রাণনের একটি অন্তর্জাল সংস্করণ প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের মুদ্রিত সংস্করণে সাহিত্য ও শিল্পের বিশেষ ধারা, ধরন অথবা বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা।
ইতোমধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুপ্রাণনের পক্ষ থেকে, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্জালভিত্তিক এই সংখ্যাটিতে থাকছে ২০ টি বিভাগ। যথাক্রমে- শ্রদ্ধাস্মরণ, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রবন্ধ, গুচ্ছ কবিতা, যুগল কবিতা, একক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, বড়ো গল্প, ছোট গল্প, অণুগল্প, অনুবাদ গল্প, মুক্তগদ্য, ভ্রমণকাহিনী, বই আলোচনা, ম্যাগ আলোচনা, পাঠ প্রতিক্রিয়া, চলচ্চিত্রকথা, ধারাবাহিক উপন্যাস, নাট্যকথা এবং শিল্প-সাহিত্য সংবাদ।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ইতিমধ্যে অনিয়মিতভাবে ৬ টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে, (১) তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- প্রিয় উপন্যাস সংখ্যা; (২) অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা- গল্প সংখ্যা; (৩) অষ্টম বর্ষ তৃতীয় সংখা- অণুগল্প সংখ্যা; (৪) অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা; (৫) নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা- কবি ও কবিতা সংখ্যা; এবং (৬) দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- বাংলাদেশের ১৫টি সেরা গল্প- পাঠ ও আলোচনা সংখ্যা।
একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যার মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, সকল মুদ্রিত সংস্করণে নিয়মিতভাবেই শুধুমাত্র দেশের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আরো নিবিড়ভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষ ধরন, বিশেষ বিভাগ, বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশ করার সূচনা করতে চায়।
লেখক, পাঠক এবং অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদের সেই চাওয়া থেকেই ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি নির্বাচিত কবি ও কবিতা সংখ্যা- প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ২৭ জন নির্বাচিত কবির জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং আলোচনা প্রকাশিত হয়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রবীণ ও তরুণ কবিদের নিয়ে এই ধরনের লেখা ও আলোচনা নিয়ে আরো কয়েকটি পর্ব প্রকাশিত হবে বলে আমরা আশা করি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের জীবনী ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিকের কয়েকটি পর্বের এই আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে আশা করি আমাদের দেশের তরুণ সমাজ বাংলাদেশের কবিদের কবিতার সাথে সুপরিচিত হবেন এবং আমাদের দেশের সম্মানিত এই কবিদের কবিতা নিয়ে আলাপ, আলোচনা এবং আড্ডার অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার বৃত্তটিকে প্রসারিত করতে পারবেন।
অনুপ্রাণন ১১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা
অনুপ্রাণনের চড়াই উৎরাই-
তরুণ লেখকদের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার একটি মঞ্চ বা জমিন নির্মাণ করার কাজের অঙ্গীকার নিয়েই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, যাত্রার সূচনা করেছিল। আজ দশ বছর পরে এসে যদি এই প্রশ্ন নিয়ে ফিরে তাকাই যে, এই অঙ্গীকার পূরণে অনুপ্রাণন কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে? অথবা, যদি প্রশ্ন রাখা যায় যে নবীন ও তরুণদের শিল্প-সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণনের মঞ্চ বা জমিনটাই বা কতটুকু প্রসারিত? প্রশ্নের জবাবে অনুপ্রাণনের সফলতা ও ব্যর্থতার একটা প্রতিবেদন হয়তো দেয়া যাবে কিন্তু সে চিত্রটিকে আমাদের সমাজের সামগ্রিক প্রেক্ষিত ও সেটার সাথে সম্পর্কিত মানবিক বোধের ধারায় শিল্প-সাহিত্যের চর্চার বাস্তব পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।
ব্যক্তিক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠে সংগঠন এবং সুগঠিত সাংগঠনিক চেষ্টার মধ্য দিয়ে বস্তুগত শর্ত ও পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। যে শর্ত ও পরিবেশের উপর ভিত্তি করে ভৌত উন্নয়নের পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর সৃজনশীল মন, মনন, উদ্ভাবন-মনস্কতা, নান্দনিক ও মানবিক বোধ জাগ্রত হতে পারে এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যেতে পারে। তাই, এই লক্ষ্য অর্জনের পথে যৎসামান্য অবদান হিসেবে অনুপ্রাণনের উদ্যোগে পরিচালিত সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্য চর্চার কাজে আমাদের ব্যক্তিক ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা কতটুকু কার্যকর ছিল সেই মূল্যায়নের ভার অনুপ্রাণনের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের হাতে। এই বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার দ্বার সবসময় উন্মুক্ত থেকেছে।
বিগত প্রায় দশ বছরের ইতিহাসে অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদ নানা ভাঙ্গা গড়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, যার ফলে প্রচেষ্টার প্রত্যাশিত গমনপথ ও গতিতে পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ অনুপ্রাণনের চলার পথ মসৃণ ছিল না। চড়াই, উৎরাই, অথবা কখনো বন্ধুর পথ অতিক্রম করেই অনুপ্রাণনকে অগ্রসর হতে হয়েছে।
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এ-৪ সাইজের ১৬০টি পৃষ্ঠা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ছাপার পূর্ববর্তী কাজ, কাগজ ও প্রেসের খরচ প্রতিটির বিনিময় মূল্য ৳ ১৫০/- দিয়ে হিসাব করলে পুরোটা খরচ উঠে আসে না। কর্পোরেট হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকার জন্য অনুপ্রাণন, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও তা প্রকাশ করে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় নি। প্রথম থেকেই অনুপ্রাণনের সম্পাদকেরা কোন সম্মানী ছাড়াই একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। লেখকেরাও কোন সম্মানী ছাড়াই লেখা দিচ্ছেন। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনুপ্রাণনের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি করার প্রস্তাব জোরালো যুক্তি নিয়ে সামনে চলে আসছে। কিন্তু, অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক পত্রিকার বিনিময় মূল্য বাড়ালে পাঠকের উপর যে বাড়তি চাপ পরবে এই বিষয়েও অনুপ্রাণন সম্পাদনা পরিষদ সচেতন রয়েছে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ২য় সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন—১০ম বর্ষ ২য় সংখ্যা
অনুপ্রাণন: করোনাকালের গদ্য
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, চীনের উহান প্রদেশ থেকে গতবছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম করোনা সংক্রমণের সংবাদ মিলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নভেল করোনা ভাইরাসটি ২০১৯-এর ডিসেম্বরেই চীনে শনাক্ত হয়েছিল, ফলে ভাইরাসটির নামের সাথে ১৯ সংখ্যাটি জুড়ে গিয়ে এর পুরো নাম হয় কোভিড-১৯। চীন থেকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুতই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়ে অতিমারীর আকার ধারণ করে।
এই ভাইরাসটি কৃত্রিম না প্রাকৃতিক এই নিয়ে কূটনৈতিক বিতর্ক আছে। বিজ্ঞান এটাকে প্রাকৃতিক বলেই রায় দিয়েছে। কৃত্রিম হলে চীনের দায় আছে না হলে নয়, এটা ঠিক নিশ্চিত বলে দেয়া যায় না। প্রকৃতিতে পশুপাখির শরীরে, বিশেষ করে লোমে ও লালায় নানারকম ভাইরাস আছে। গৃহপালিত জীবজন্তুর শরীরে যে সকল ভাইরাস আছে, সেসব ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে ক্ষতির মাত্রা খুব কম, কিন্তু বন্যপ্রাণির শরীরে মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও প্রাণঘাতী যেসব ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে সেসব ভাইরাসের মধ্য থেকে অনেকগুলো সম্পর্কে প্রাণিবিজ্ঞানে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। নভেল করোনা ভাইরাস উহানের একটি বন্যপ্রাণির বাজার থেকেই ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে বন্যপ্রাণি আহরণ ও নিধন বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই বাজারে বন্যপ্রাণি এবং গৃহপালিত জীবজন্তু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আনয়ন করা এবং তার ফলে জনস্বাস্থ্য হানিকর ভাইরাস পশুর দেহ থকে মানবসমাজে প্রবেশের পথ করে দেয়া কোনোভাবেই বিচক্ষণ ও নীতিসম্মত কাজ বলে মেনে নেয়া যায় না।
আমরা যদি অতিমারীর বিশ্ব-ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, ৫৪১ থেকে ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিউবোনিক প্লেগের সংক্রমণের ফলে ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ, তৎকালীন বাইজেন্টাইন ও কনস্ট্যান্টিনোপল সাম্রাজ্যভুক্ত সকল এলাকা, মিশর এবং আরব উপদ্বীপে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর প্রাণহানি ঘটে। মধ্যযুগে ১৩৩১ সালে চীন থেকে একই বিউবোনিক প্লেগের বিশ্বমহামারী দ্বিতীয়বার শুরু হয়। প্লেগের এই মহামারী এবং পাশাপাশি চলমান গৃহযুদ্ধে তখন চীনের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মৃত্যু ঘটে। ক্রমে চীন থেকে তখনকার বিশ্ববাণিজ্যের গমনপথ ধরে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় এই প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। ১৩৪৭ সাল থেকে ১৩৫১ সাল, এই চার বছরে ইউরোপের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর মৃত্যু হয়। শুধুমাত্র সিয়েনা এবং ইতালিতে বিউবোনিক প্লেগে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় অর্ধেক। তারপর পুনরায় ১৮৫৫ সনে চীনে বিউবোনিক প্লেগ দ্বারা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। উল্লেখ করা যায় যে, বিউবনিক প্লেগ একধরনের বাদামি ইঁদুরের শরীর থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়েছিল যা কি-না চীনের বাজারে তখন বিক্রয় হতে দেখা গিয়েছিল। চীন থকে বিউবোনিক প্লেগের তৃতীয় ঢেউ ক্রমেই পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন শুধুমাত্র ইন্ডিয়াতেই এই প্লেগের সংক্রমণের ফলে প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। মোম্বাইয়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই প্লেগের সংক্রমণ রোধকল্পে সংক্রমিত অধিবাসী সহকারে একেকটি পাড়া-মহল্লা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ফ্র্যাঙ্ক স্নোডেন উল্লেখ করেছেন যে, এতে করে যে সত্যি কোনো উপকার হয়েছে কেউ তার প্রমাণ দিতে পারেনি। এগনোলো ডি টুরা নামে চতুর্দশ শতাব্দীর একজন কাহিনিকারের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এই ভয়ানক ঘটনার সত্য বিবরণ মানুষের জিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ করাই অসম্ভব। বলা যেতে পারে যে, এই ভয়াবহ ঘটনা যে দেখেনি, সে বিশেষভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। সংক্রমিত ব্যক্তির বাহুমূল এবং কুঁচকি অস্বাভাবিক ফুলে যায় এবং কথা বলতে বলতেই ধপ করে পড়ে মৃত্যু লাভ করতে থাকে। মৃতের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদেরকে গণকবরে দাফন করা হয়। ফ্লোরেন্স নগরীর জিয়োভানি বোকাচ্চিওর বর্ণনায়, মৃতদেহ সৎকারের জন্য ন্যূনতম শ্রদ্ধাটুকু দেখানো হয়নি যেটা কি-না একটি মৃত ছাগলের জন্যও প্রাপ্য হতে পারতো। কেউ কেউ মৃতদেহ বাড়িতে লুকিয়ে রাখতো। অনেকেই সংক্রমণের ভয়কে মানসিকভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তারপরও ভুগতে ভুগতে মানুষ এক পর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে যায়। বোকাচ্চিওর ভাষায়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানুষ অতিরিক্ত মদ্যপান করতে থাকে, নাচে-গানে মত্ত হয়ে থাকে এবং পৃথিবীর যাবতীয় সুখ এবং আনন্দ উপভোগ করাতেই নিজেদের নিয়োজিত করতে থাকে। সংক্রমণ ও মহামারীর বিষয়টি তারা ঘাড় থেকে এমনভাবে ঝেড়ে ফেলতে চাইতো যেন সেটা একটা বিশাল কৌতুক ছাড়া আর কিছু না। আমরা সেই একই ধরনের পরিণতির দিকে এগোচ্ছি কি-না?
অতীত অতিমারীর বিশ্ব-ইতিহাসে দেখা যায় যে, সংক্রমণের ধাপগুলোর মধ্যে প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ঢেউ অধিক থেকে অধিকতর প্রাণঘাতী হয়েছে। অন্যদিকে টিকা আবিষ্কারের ইতিহাসে বিজ্ঞানীরা চমক দেখিয়ে করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব ও অতিমারীর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ শুরু করেছেন। যার ফলে আশা করা যায় যে, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপটি হয়তো অতীতের মতো ততটা মারাত্মক আকার ধারণ করবে না। কিন্তু তারপরও জীবন অথবা জীবিকা এসব প্রশ্নে, বিশেষ করে লকডাউনের মধ্যেও কীভাবে অর্থনীতিকে ন্যূনতম চলমান রাখা যায়, এসব প্রশ্নে বাস্তবে সর্বোত্তম ভারসাম্য রক্ষা করা দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের দেয়া লকডাউন নীতিমালা ও স¦াস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। তার পরিবারের অন্ন জোগাড়ের প্রয়োজনের চাপে উপার্জনক্ষম মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারছে না।
কিন্তু, অন্যদিক নভেল করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে পুনঃপৌনিক সংক্রমণের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। যার ফলে, সংক্রমণের প্রথম ঢেউ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ভাইরাসের রূপান্তরিত রূপ এই বছরের মার্চ থেকে ক্রমেই প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণের বাঁধ ভেঙে দিয়ে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়া যে প্রথম ঢেউয়ের থেকে আরো উঁচু এটা মৃত্যু ও সংক্রমণের হার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে এ-পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ৮ লাখ এবং একইসময়ে বিশ্বে সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৬৩ লাখ। মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার এবং বিশ্বে প্রায় ৩৪ লাখ। সংক্রমণ ও মৃত্যুর নিছক সংখ্যাগুলোর মধ্যে এক একজনের আপন হারানোর অপার বেদনা লুকিয়ে আছে। আর আমরা আপন হারানোর বেদনার মতোই বেদনা অনুভব করি যখন আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার জগৎ থেকে হারিয়ে যায় তারকা ব্যক্তিরা। এই সংখ্যার শ্রদ্ধাস্মরণ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এপার ও ওপার বাংলার ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের এরকম কয়েকজন ব্যক্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে এক বা একাধিক আলোচনা। যারা সকলেই এই করোনাকালে সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তা ছাড়াও এই সংখ্যাটিতে অতিমারীর অভিঘাতের নানাদিক উঠে এসেছে শিল্প ও সাহিত্যের নানা শাখায়। অন্তর্ভুক্ত গল্প ও কবিতার কোনো কোনোটির মাঝে আমরা দেখতে পাই, অতিমারীর আঘাতের চিহ্ন। মানবতার অসহায়ত্ব ও দুর্ভোগের করুণ বর্ণনা এসব রচনাকে করেছে অশ্রুসিক্ত।
এই অতিমারীর মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল। অনুপ্রাণন পত্রিকাটির ৯ম বর্ষ ২য় সংখ্যা থেকে ৯ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা নির্ধারিত সময় থেকে কিছুটা দেরিতে হলেও প্রকাশিত হয়েছে। ১০ম বর্ষ ১ম সংখ্যাটি ফেব্রুয়ারি, ২০২১ একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়া নির্ধারিত ছিল, কিন্তু বইমেলা পিছিয়ে যাওয়ায় সেটা প্রকাশিত হয় ২ এপ্রিল ২০২১। এই অতিমারীর মধ্যে অমর একুশে বইমেলা শুরু হয় ১৭ মার্চ এবং লকডাউনের বিধিনিষেধের মধ্যে শেষ হয় ১২ এপ্রিল। অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে ২০২০-২০২১ অতিমারীকালে এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ৬৮টি গ্রন্থ। গ্রন্থগুলোর কোনো কোনোটাতে উঠে এসেছে অতিমারীর অনুভব চিত্র।
বাঙালি, লেখক-আড্ডার মধ্য দিয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের সূত্র খুঁজে পায়। বিভিন্ন লোকালয় ভ্রমণের মাধ্যমে গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো ধরা দেয় এবং চলমান জীবনের নানামাত্রিক রূপ তাদের গল্প-উপন্যাসে উঠে আসে। অতিমারীর পূর্বে ঢাকা শহরে এবং দেশের জেলা পর্যায়ে লেখক আড্ডার কতগুলো আয়োজনের কর্মসূচি নিয়মিত অথবা অনিয়মিতভাবে বছরজুড়ে চলতে থেকেছে। লেখকরা ব্যক্তি এবং গ্রুপ পর্যায়ে লেখার বিষয়বস্তু তৈরির জন্য, গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বই সংগ্রহ ও বইপড়ার কাজ চালিয়ে গেছে। কিন্তু এই অতিমারীর সময় আড্ডা বন্ধ হয়ে যায়। লাইব্রেরি বন্ধ থাকায় লেখার জন্য, গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্রমণ অথবা বই সংগ্রহের কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। কিন্তু তাতে কি লেখা বন্ধ থেকেছে? অতিমারীকালে লেখকরাও নতুন পরিস্থিতির, নয়া-স্বাভাবিক অবস্থার সাথে লেখার কার্যক্রমের রুটিন ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে তাদের লেখা চালিয়ে গেছে। এই প্যান্ডেমিকের লকডাউন বা বিধিনিষেধ অথবা সতর্ক অবস্থান নিয়ে বাসায় থাকার সময় অনেক নতুন লেখকের জন্ম হয়েছে। যারা আগে থেকে লেখালেখি করতো অথবা যারা নতুন লেখক তারা সবাই লেখালেখির মধ্য দিয়েই ঘরবন্দী সময়টাকে নিয়োজিত করেছে।
এসব শিল্প-সাহিত্যকর্মে কি জনবিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার স্বাক্ষর থেকেছে? আমার হাতে পত্রিকার জন্য যেসব লেখা অথবা পুস্তক প্রকাশের জন্য যেসব পাণ্ডুলিপি এসেছে, আমার পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে যে, এই নয়া-স্বাভাবিক পরিস্থিতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখার ধারায় পরিবর্তনের কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। স্বাভাবিক জীবনের তীব্র আকাক্সক্ষা নয়া-স্বাভাবিকতাকে গৌণ বোধেরই একটা অন্তহীন প্রচেষ্টা। আর যেসব লেখায় অতিমারী কবলিত নাগরিক অথবা গ্রাম্য জীবনের বাস্তব চিত্র এসেছে সেসব বাস্তব চিত্রে অতিমারীর ভয়াবহতা অথবা ভয়ঙ্কর রূপটি মুখ্য হয়ে ওঠেনি। যদিও আমরা দেখতে পাই, প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু এর সংখ্যাটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির মোট মৃত্যুহারকে অল্পই প্রভাবিত করেছে। এ-রকম একটা ধারণা থেকেই হয়তো মানুষ লকডাউনের বিধিনিষেধ অথবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা হালকাভাবেই নিয়েছে।
কিন্তু তাহলেও দেশে গত মার্চ ২০২০ থেকে কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হওয়ার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেনাবেচায় পণ্যভেদে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বই কেনাবেচার মোট মূল্যমান স্বাভাবিক সময়েও এমনিতে কম। তারপর এই নয়া-স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সেটা কমে নেমে এসেছে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকালে বিক্রয় মূল্যমানের তুলনায় শতকরা ২৫ ভাগে। তবে এটা যদি সাময়িক পরিস্থিতি হয়, তাহলে যে ক্ষতিসাধন হয়েছে সেটা হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এলে অধিকাংশ প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট মুদ্রণশিল্প মিটিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু অতিমারী যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে পুস্তক প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পে যে ক্ষতি হবে, সে ক্ষতির ফলে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের একটি বিরাট অংশ এই জগত থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। মানুষের জীবিকা রক্ষা করার তাড়নার বাস্তবতায় ব্যাপকহারে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন অথবা লকডাউনের নীতিমালা উপেক্ষা করার যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে, এসব ঘটনা যাদের জীবিকা প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পের ওপর নির্ভরশীল তাদের একটি বিরাট অংশকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। কারণ, বইপড়া এই নয়া-স্বাভাবিককালের একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা দূর করার মাধ্যম হয়ে উঠতে আবারো ব্যর্থ হচ্ছে। এই অতিমারীকালে অনলাইনে কেনাবেচার পরিমাণ সামগ্রিক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সেটা বই ও পত্রিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি।
আমাদের দেশে প্রকাশকদের মধ্যে বই অথবা ম্যাগাজিন প্রকাশের ধরনের ওপর ভিত্তি করে কতগুলো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগটি পাঠ্যপুস্তক, নোট অথবা গাইড বইয়ের প্রকাশক। দ্বিতীয় ভাগটি পাঠ্যপুস্তক, নোট অথবা গাইড বই প্রকাশের পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্য অথবা গবেষণাগ্রন্থও প্রকাশ করে থাকে। আর তৃতীয় ভাগটি শুধুমাত্র সৃজনশীল সাহিত্য অথবা গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করে থাকে।
এই তিনটি ভাগ বা শ্রেণির প্রকাশকরা সকলেই এই অতিমারীকালে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকতো, তবে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ততার হাত থেকে বেশ ভালোভাবেই রক্ষা পেতো। অন্যদিকে যেসব প্রকাশক শুধুমাত্র সৃজনশীল সাহিত্য ও সামাজিক গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করে তাদের পরিস্থিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকা-না থাকার সাথে সম্পর্কিত নয়। অতিমারীর কারণে বই ক্রয়-বিক্রয় সামগ্রিক হ্রাস পাওয়ার সাথেই তাদের অর্থনীতি জড়িত এবং যেটা শোচনীয় বললেও কম বলা হবে।
বাস্তবে আমাদের জানা দরকার যে, এই অতিমারীকালে কাদের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং কাদের আয় যে পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে সে পরিমাণ হ্রাস তাদের আর্থিক সচ্ছলতার ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি? কারা সৃজনশীল সাহিত্য, বই ও ম্যাগাজিনের মূল ক্রেতা? যাদের আয় সামগ্রিক হ্রাস পেয়েছ, তারাই কি সৃজনশীল সাহিত্য পুস্তক ও ম্যাগাজিনের ক্রেতা? আবার দৃশ্যত. এই অতিমারীকালেও কাপড়-জামার ঈদবাজার সরগরম হলেও সামগ্রিক ঈদের কেনাবেচার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কি-না? না-কি স্বাভাবিক ছিল? না-কি স্বাভাবিক পরিস্থিতির সময়কাল থেকে কম ছিল? বস্তুত কাপড়-জামার ঈদবাজার এই অতিমারীকালে বেশ চাঙ্গা দেখা গেলেও সামগ্রিক হিসাবে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ অতীত স্বাভাবিক পরিস্থিতিকালের চেয়ে কম ছিল। বস্তুত এই অতিমারীকালে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের খরচের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে এবং খরচের সিংহভাগ ব্যয়িত হচ্ছে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এই অতিমারীকালে যাদের আয় তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পায়নি এবং যারা সৃজনশীল সাহিত্যের বই পড়ে, তারা হয়তো এই অতিমারীকালেও বই কেনা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশটি যারা আয়ের একটি ভাগ কষ্ট করে হলেও সৃজনশীল সাহিত্য অথবা গবেষণাগ্রন্থ ক্রয়ের জন্য ব্যয় করতো, অর্থের অভাবে তারা এই অতিমারীকালে বইয়ের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না; করলেও ক্রয়ের পরিমাণ খুব বড় আকারেই হ্রাস পেয়েছে।
অর্থাৎ একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং অন্যদিকে বইয়ের ক্রেতাদের আয় হ্রাস, সামগ্রিকভাবেই বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। অর্থনীতির অন্যান্য খাতে সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে এই অতিমারীকালে প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু পুস্তক প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পের মালিকরা ব্যাংকখাত থেকে স্বল্পসুদে ঋণ গ্রহণ করার সুযোগ নানাকারণেই গ্রহণ করতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বার্ষিক এককালীন অনুদানের কর্মসূচি নিয়ে সরকারের এগিয়ে আসা এখন এই অতিমারীকালে সময়ের দাবি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার তালিকা করে বার্ষিক এককালীন এই অনুদান প্রদান করার ব্যবস্থা করতে পারে।
সর্বশেষে, করোনাকালের গদ্য নিয়ে কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, করোনাকালের গদ্যের বিষয়বস্তু কী হতে পারে? অবশ্যই অতিমারী ও অতিমারীর অভিঘাত। অতিমারীর অভিঘাত শুধু মানুষের অসুস্থতা, দেহত্যাগ এবং পরিবার ও সমাজে তার বাস্তব ও মানসিক অভিঘাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। করোনাকালের গদ্যের মধ্যে আসতে পারে বহুমাত্রিক বিষয়। যেমন- চিকিৎসা, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় অথবা সামগ্রিকভাবেই এই অতিমারীর বিরুদ্ধে জীবন ও জীবিকা রক্ষার লড়াই। অতিমারীর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা সম্বন্ধীয় চিন্তাভাবনা। নয়া-স্বাভাবিক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিকের বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ। কবিতা ও গল্পের পাশাপাশি করোনাকালের গদ্য রচনায় কোনো কোনো লেখক মনোনিবেশ করতে পারেন।
১০ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা