Description
অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা<> আগস্ট – অক্টোবর ২০২১ <> শ্রাবণ- আশ্বিন ১৪২৮
বাংলা সাহিত্যের অনন্য অবদান- বাংলাদেশের ছোটো গল্প:
“বাংলাদেশের ১৫ টি নির্বাচিত সেরা ছোট গল্প”, পাঠ ও আলোচনার একটি ক্রোড়পত্র অন্তর্ভূক্ত করে- শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের এর ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে। ক্রোড়পত্রটির সাথে যথারীতি আমাদের অন্যান্য নিয়মিত বিভাগসমুহ থাকছে যেখানে অন্যান্য সংখ্যার মতো প্রাসঙ্গিক ধরণের লেখা যুক্ত থাকছে।
“বাংলাদেশের ১৫টি নির্বাচিত সেরা গল্প”, শব্দ-সমষ্টির একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তা না হলে একটা ভুল বুঝাবুঝি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অনুপ্রাণনের ব্যাখ্যাটি এইরূপ। প্রথম যে শব্দটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে শব্দটা ‘বাংলার’ না হয়ে ‘বাংলাদেশের’ হলো কেন? অবশ্যই নির্বাচিত ছোট গল্পের ভাষা যেহেতু বাংলা তাই ‘বাংলাদেশের’ না হয়ে ‘বাংলার’ হওয়াটাই অধিক কাম্য ছিল। কিন্তু পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যার সীমাবদ্ধতার কারনে এইবারের সংখ্যাটিতে বাংলা সাহিত্যের সেরা ছোট গল্পগুলোর মধ্য থেকে বাংলাদেশের সেরা ছোটো গল্প প্রকাশ ও আলোচনার জন্য আমরা চয়ন করতে চেয়েছি। একই কারনে, অর্থাৎ ঐ পৃষ্ঠা সংখ্যার সীমাবদ্ধতার কারনেই গল্পের সংখ্যা ১৫ টি তে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে।
দ্বিতীয় যে শব্দটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, ‘সেরা ছোট গল্প’ কীভাবে এবং কোনটি? এখানে স্পষ্ট করা দরকার যে, ‘সেরা ছোট গল্প’ বলতে নিশ্চয়ই ‘সর্ব-সেরা ছোট গল্প’ বোঝায় না। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলা অথবা বাংলাদেশের সর্ব-সেরা ছোটো গল্প কোনটি অথবা কোনগুলো; তাহলে আমি অবশ্যই নির্দিষ্ট করে সেটা বলতে পারবো না। কারন সর্ব-সেরা ছোট গল্প কীভাবে এবং কোনটি হতে পারে সেটা নির্ণয় করার শর্ত অথবা শর্তাবলী কি কি হতে পারে সেটা আমার জানা নাই। বোধ করি সর্বসেরা বাংলা ছোটগল্প চয়ন প্রচেষ্টায় সংকীর্ণ ব্যক্তিক মতামতের প্রতিফলন থাকার বিস্তর ঝুঁকি রয়েছে।
প্রসঙ্গটি হচ্ছে কিছু সংখ্যক ‘সেরা ছোট গল্প’ নির্বাচন করা। কোন রকম শর্ত না রেখেই বলা যায় যে, বাংলাদেশে যারা জন্মগ্রহন করেছেন এরকম অনেকেই অনেক ভালো ভালো ছোটো গল্প লেখছেন। দেশে ও বিদেশে এসকল গল্পের একটি ভাল সংখ্যায় বাঙালী পাঠকও রয়েছেন। এসব গল্পের মধ্যে আমরা হয়তো সেসব গল্পগুলোকেই ‘সেরা ছোট গল্প’ বলতে চাইছি যে ছোটো গল্পগুলোতে এমন কিছু অন্তর্নিহিত গুণাবলী রয়েছে যে গুণাবলী থাকার কারনে ওই গল্পগুলো সাধারন অথবা গড় মানোত্তীর্ণ হতে পেরেছে। বাংলা ভাষায় এরকম ছোটো গল্পের সংখ্যা নেহাত কম নয় কিন্তু সেগুলোর মধ্য থেকেই আমরা ১৫ টি সেরা ছোট গল্প শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন এর এই সংখ্যায় পাঠ ও আলোচনা করতে চেয়েছি। এই ১৫ টি গল্পের নির্বাচন পদ্ধতি নিঃসন্দেহে ব্যষ্টিক ও ব্যক্তিক পদ্ধতিতেই করা হয়েছে। কেননা শিল্প-সাহিত্যকর্ম নির্বাচনের এ-ধরণের প্রক্রিয়ায় কোন সামষ্টিক এবং একই সাথে নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতি নির্ধারণ করার প্রমানসিদ্ধ, সঠিক ও সুনির্দিষ্ট কোন জ্ঞান আমাদের নেই।
গল্প-কথার ঐতিহ্য ও নিদর্শন, মানবসভ্যতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। কিংবদন্তী; উপকথা; সাধু-জীবনী; লোককাহিনী; রুপকথা; কাহিনী; আখ্যান; উৎকীর্ণ বাণী; নীতিবাক্য, শ্রুতি, ইত্যাদী পৃথিবীর যে কোন গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং অঞ্চলে প্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান। কোন কোন ক্ষেত্রে গাছের বাকলে, হাড়ে, পাথরে এসব লিখিত কথা পাওয়া গেলেও গল্প-কথার মূল অংশটি পুরুষানুমক্রিকভাবে মৌখিক ঐতিহ্য হিসেবেই সময়ের পথ ধরে এগিয়েছে। মূদ্রণ শিল্পের আবিষ্কার ও উত্থানের মধ্য দিয়েই বলা যায় উনবিংশ শতান্দীর প্রথমার্ধে আজকের দিনের ছোটো গল্পের আবির্ভাব।
মূলতঃ একটি ছোট গল্পে, চরিত্র ও নাটকের বিষদ আখ্যানের একটি সংক্ষিপ্ত ও আঁটসাঁট বর্ণনা আমরা শুনতে অথবা পড়তে পাই- যা কি-না আমাদের জানার অথবা শোনার ইচ্ছা, কৌতুহল ও তৃষ্ণা যতটা মিটায় ঠিক ততটাই জাগ্রত করার সক্ষমতায় পূর্ণ থাকতে পারে। অবশই, যেটা আমরা আমাদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বহুল প্রচলিত হিসেবেই জানি সেটা নতুন করে শোনার মধ্যে হয়তো পাঠক ও শ্রোতার তেমন কোন আগ্রহ বা আকুলতা থাকে না। আমরা সেই গল্পটাই শুনতে চাই, পড়তে চাই বা জানতে চাই যেসব গল্পে চরিত্র ও ঘটনা সম্পর্কে আমরা কতগুলো নতুন প্রশ্ন, কতগুলো ভিন্নতর ব্যাখ্যা অথবা বিশ্লেষণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়ি।
ছোট গল্পের আকার সম্পর্কে এই তত্ত্বটি বহুল স্বীকৃত যে ছোট গল্পের আকার সেটুকুই হওয়া প্রয়োজন যেটা কি-না এক বসাতেই শুনে অথবা পড়ে শেষ করা যায়- সময় হিসাবে যার দৈর্ঘ সাধারণত ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা হতে পারে। ছোট গল্পের গড় শব্দ-সংখ্যা ১০০০ থেকে ৭৫০০ হলেও কোন কোন ছোট গল্পের শব্দ-সংখ্যা ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ শব্দ পর্যন্তও হতে পারে। যে ছোটো গল্পটি এক বসাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়ে শেষ করা যায় না অথবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বসার জন্য যথেষ্ট আকর্ষণ ও আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না সেই ছোট গল্পটির পাঠক সংখ্যা সাধারণত কম হয়।
ছোট গল্পের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে বহুল স্বীকৃত তত্ত্ব হচ্ছে যে ছোটো গল্পে সাধারণত একটি কথাবস্তু বা প্লটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। উপন্যাস বা বড় গল্পের মতো ছোট গল্পে সাধারনত একের অধিক কথাবস্তু বা প্লট, উপ-কথাবস্তু বা সাব-প্লট থাকে না। ছোট গল্প নির্মানে কোন পূর্বলেখের প্রয়োজন না-ও পড়তে পারে।। সাধারণত, শুরুতে সংক্ষেপে কথাবস্তুর সুচনা ভিত্তি নির্মানের অব্যবহিত পরেই ঘটনার পরমক্ষণ বা ক্লাইমেক্স প্রবেশ ও এর সম্পূর্ণ অথবা আংশিক অবসানের মধ্য দিয়েই ছোট গল্পের সমাপ্তি ঘটে। অতীতের ছোট গল্পগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুকে ঘিরে অথবা কোন নৈতিক পাঠ বা পরামর্শ নিয়ে রচিত হয়েছে। পরবর্তীতে মনস্তাত্ত্বিক অথবা বাস্তব,অস্পষ্ট অথবা দ্ব্যর্থবোধক জটিল মানসিক আচার-আচরণসমুহের বোধ ও বিচার- ছোট-গল্পের বিষয়বস্তু হতে থাকে। ধারাবাহিক ব্যতিক্রম সৃষ্টি করার প্রয়াসে নুতন-পুরাতন বিষয়ে নুতন নুতন এবং ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, চিত্রাবলী, পূর্বসুত্র, রূপক, কন্ঠস্বর, শব্দ-নির্বাচন এবং বাক্য গঠন প্রণালী ছোটো গল্প রচনায় শৈল্পিকভাবে সংযুক্ত হতে থাকে। আজ তাই বাংলা ভাষা ও বিশ্বসাহিত্যে ছোট গল্পের সম্ভার অত্যন্ত সমৃদ্ধ রূপ ধারণ করেছে।
রস, বিষয়বস্তু এবং ঘটনার ভিত্তিতে ছোট গল্পগুলোকে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারা বা প্রকারে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- দ্বন্দ্ব, জঙ্গম, রোমাঞ্চ, রোমাঞ্চকর অথবা দুঃসাহসিক অভিযান, জীবন চরিত, হাস্যরসাত্মক, অপরাধ, রহস্য, গোয়েন্দা-কাহিনী, পারিবারিক নাটক, ঐতিহাসিক নাটক, চরম বঞ্চনা-শোষণ-সন্ত্রাসের কোন কল্পিত স্থানের বয়ান, পুরাণ, উপকথা, উদ্ভট কল্প-কথা, লোমহর্ষক নাটক, দর্শন, রাজনৈতিক, রম্য, ব্যঙ্গ, বৈজ্ঞানিক কল্পকথা, অতিপ্রাকৃত, স্বগতোক্তিমূলক এবং বিয়োগান্তক নাটক ইত্যাদী।
আধুনিক ছোট গল্পে কল্পবস্তু, চরিত্র, বয়ান, বিবরন ও ঘটনাক্রম বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিস্তর পরীক্ষানিরিক্ষা লক্ষ্য করা যায়। । একক চরিত্র অথবা চরিত্রসমুহের স্বগতোক্তির মাধ্যমে দৃশ্য, পরিবেশ এবং ঘটনার উন্মোচনক্রমে নানারকম বৈচিত্র্য আনার প্রয়াস পাঠকদের আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। চরিত্রের ক্রিয়াকর্ম অথবা ঘটনার কার্যকারন বিশ্লেষণে দর্শন, সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে আসায় ছোট গল্পের চেতনার গভীরে ডুব দেয়ার অভিজ্ঞতা পাঠকদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করেছে। উত্তর-আধুনিক ছোট গল্পে আমরা আরো দেখতে পাই, খণ্ডিকরন, অন্তর্মুখী অথবা বহির্মুখী বৈপরীত্ব, আপাত অবাস্তবতা ইত্যাদী বিষয়বস্তু নিয়ে লেখক, পাঠক এবং মূলপাঠ এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অন্বেষণ প্রচেষ্টা। বাস্তব বয়ান ও বিন্যাসের সাথে পরাবাস্তবতা, স্বপ্ন অথবা উদ্ভট কল্পনার জগতের সুনিপুণ সমন্বয় ও সংযোগ স্থাপন করে পাঠ বৈচিত্র্য ঘটানোর শৈল্পিক প্রয়াস উত্তরআধুনিক ধারার ছোট গল্পে বিশেষভাবে পরিলক্ষীত হয়েছে।। সরল, অকপট ভাষা এবং স্বল্পস্থায়ী সংলাপ ও বয়ানের সমন্বয় ঘটিয়ে এবং গল্পকথার পরমক্ষণ অথবা ক্লাইমেক্সের কোন সমাধান না ঘটিয়েই, গল্পের সমাপ্তি উন্মুক্ত রাখার উদাহরণও আমরা ছোট গল্প রচনার ক্ষেত্রে কৌতুহল ও বিস্ময় সৃষ্টি করতে দেখি।
বাস্তবে বাংলাদেশে ছোট গল্প রচনার সুত্রপাত দেশভাগের পরই যখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা তখন থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কেউ কেউ যাঁরা আগে কলকাতায় লিখতেন, তাঁরা ঢাকা চলে আসেন। পাকিস্তান আমলে বাংলা ছোটগল্পের প্রথম পর্যায়ের লেখকদের মধ্যে রয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, মাহবুব উল আলম, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রমুখ। এঁদের সমকালীন আরো কয়েকজন গল্পলেখক বাংলা গল্পের ধারাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। এঁরা হলেন শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, আবু রুশদ, সরদার জয়েনউদ্দীন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ছোট গল্প রচনার ক্ষেত্রে নতুন চেতনা ও জীবনচিন্তার প্রকাশ ঘটায়। এই প্রভাবের প্রত্যক্ষ ফলে যে নতুন প্রজন্মের গল্প লেখকদের আবির্ভাব ঘটে এঁদের মধ্যে স্বনামধন্য হলেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, জহির রায়হান প্রমুখ।
ষাটের দশকে বাংলাদেশি গল্পের ধারায় সামাজিক জীবনের ও রাষ্ট্রের সমস্যা ও দ্বন্দ্বের নানা ঘটনা, ছাপ ফেলে। গল্পের বিষয়বস্তুত ও রীতিতে নতুনত্ব নয়িে আসার পাশাপাশি এই সময়ের গল্পলেখকেরা চেয়েছেন বাংলা গল্পকে রূপরীতিতে আরো আধুনিক ও আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। ষাটরে দশকরে অন্যতম সেরা গল্পকারদের মধ্যে রয়েছেন হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, আবু বকর সিদ্দিক, মুর্তজা বশির, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও রশীদ হায়দার।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র আরো প্রশস্ত হয়। গল্পের ভুবনেও আসে নতুন উদ্দীপনা ও নতুন আগ্রহ। স্বাধীনতাত্তোর নতুন প্রজন্মের গল্পকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কায়েস আহমদ, মইনুল আহসান সাবের, হরিপদ দত্ত, মঞ্জ সরকার, নাসরিন জাহান, হরিশঙ্কর জলদাস প্রমুখ।
ইতিহাসের পর্যায়ে পর্যায়ে সংযুক্ত বাংলাদেশের এই সকল সেরা গল্পকার মধ্য থেকেই ১৫ জন সেরা গল্পকারের একটি করে গল্প পাঠ ও আলোচনা নিয়েই আমাদের এই সংখ্যার মূল আয়োজন।
There are no reviews yet.