Description
\ নিবেদন \
রবীন্দ্র-সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাখা ছোটগল্প। তার পঁচানব্বইটি গল্প সংকলনের নাম গল্পগুচ্ছ। রচনাকাল দীর্ঘ-পরিধি বিস্তৃত। ১৮৭৭ সাল থেকে মৃত্যু-বছর পর্যন্ত। সমগ্র গল্পগুচ্ছে-র শেষখÐে অচলিত সংগ্রহে সংযোজিত হয়েছে করুণা নামের ছোট উপন্যাসখানিও। বিরতি দিয়ে দিয়ে চৌষট্টি বছরে তিনি এ গল্পগুলো লিখেছেন। এক শতাব্দীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমাজ-বিবর্তনের ধারাকে একটি নিবন্ধে ধরতে গেলে যে রূপ পাওয়া যাবে, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ তার একটি সমন্বিত রূপ।
গল্পগুচ্ছে-র নারী-চরিত্র মূলত সামাজিক-সমস্যাকে ঘিরে আবর্তিত। সংকীর্ণ অর্থে কোন কোন পর্যায়ে তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও প্রসারিত। এই দীর্ঘ সময়ের সামাজিক বিবর্তনের ধারায় নারীর অবস্থার যে রূপান্তর ঘটেছে, গল্পগুচ্ছে আছে তার বিশ্বস্ত পরিচয়। নারী-চরিত্র বিশ্লেষণ সমাজ-সমস্যার আসল রূপটিকে উপস্থিত করতে পারে। তাছাড়া এরা সময়েরও মূল্যবান সংস্করণ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের আন্দোলনে এদেশে বিভিন্ন সমাজ-সমস্যার নতুনতর বীক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে নারী-জীবনের সমস্যাও বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। প্রাচীন ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাতে এই সমস্যাটি নানাভাবে আবর্তিত ও আলোচিত হতে থাকে। এদেশে এ সময়ে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচীতে নারী-মুক্তির এষণা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই মুক্তি-আন্দোলনের সূচনাতে রামমোহনই সর্বপ্রথম সমস্যা-জর্জরিত বাঙালি-নারীর প্রতি মানবীয় গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৮১৬ সালে তিনি কলকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন এবং ১৮১৮ সালে সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক নিবর্তকের সম্বাদ রচনার মাধ্যমে হিন্দু-নারীর অস্তিত্ব রক্ষার্থে সতীদাহ-প্রথা উচ্ছেদে সচেষ্ট হন। অতঃপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ প্রচলন আন্দোলন সমাজে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একদিকে তা নারী-মুক্তির প্রশ্নটিকে সামাজিক-চিন্তার অন্যতম মুখ্য বিষয়বস্তু করে তোলে, অন্যদিকে নারী-সংক্রান্ত কতকগুলো আচার-প্রথার মূলে তীব্র আঘাত হানে। তিনি ‘বেদান্তের ভ্রান্ত দর্শন’ থেকে দেশ ও সামাজ তথা নারীকে মুক্ত করার জন্যে তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। ইয়ং বেঙ্গল দলও নারী-শিক্ষা ও নারী-স্বাধীনতার সপক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। নানা কু-প্রথার উচ্ছেদ ও আন্দোলনের মাধ্যমে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বাংলাদেশে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উদ্বোধনের সূচনা হয়েছিল। তবে ‘পূর্ণ আত্মসচেতনতা’ পর্যন্ত পৌঁছাতে তাকে আরও কিছুদিন অর্থাৎ প্রায় বিংশ শতাব্দী অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ইতঃপূর্বে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি পাওয়া গেলেও তা ছিল মূলত সমাজ-নির্ভরশীল। সমাজকে উপেক্ষা করে নারী তার নারীত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে নি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে নারী-প্রগতির সংগ্রাম নতুন পর্যায়ে রূপ নিয়েছে। বিদ্যাসাগর যা করেছিলেন সংস্কারক শক্তিতে, রবীন্দ্রনাথ তা করেছিলেন শিল্পসত্তায়।
আমার আলোচনার মুখ্য বিষয় গল্পগুচ্ছে-র নারী-চরিত্রের এই সমাজিক বিবর্তন। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তৎকালীন এবং সমসাময়িক দেশকালানুসারে বাঙালি নারী-জীবন, তার সমস্যা ও অবস্থান নিয়ে প্রথম অধ্যায়ের উপস্থাপনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে- রবীন্দ্র-গল্পগুচ্ছে-র নারী-সমাজের ক্রমবিবর্তনের পরিচয়। তৃতীয় অধ্যায়ে গল্পগুচ্ছে-র নারী-চরিত্রকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণের প্রয়াস রয়েছে। মোটামুটিভাবে এদেরকে কয়েকটি স্পষ্টভাবে ভাগ করে দেখানো হলো- কুমারী, গৃহবধু ও বিধবা। এসব রূপেই ধরা পড়েছে সমকালীন নারী-জীবনের সমস্যা ও মুক্তির ইতিহাস।
এ অভিসন্দর্ভ রচনাকালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম গ্রন্থাগার, রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার ও রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরির সাহায্য গ্রহণ করেছি। কিছু মূল দলিল ও প্রতিবেদন দেখেছি রাজশাহী মোহাফেজখানায় এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে।
আলোচ্য গবেষণা-কর্মের সাফল্যের সঙ্গে কৃতজ্ঞতার সম্পর্কে সম্পর্কিত রয়েছেন অনেকেই। প্রথমেই স্মরণযোগ্য আমার মা (রিজিয়া খাতুন), বাবা (মোঃ ইয়ার আলী শেখ) পাঁচ ভাই-বোন (পলাশ, নিলু, রজনী, শিউলি, চুমকী), যাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতা, ভালবাসা, পরিচর্যা ও সাহচর্যের আশ্রয়ে আমার দুগ্ধপোষ্য কন্যা স্বর্ণা তার মায়ের অনুপস্থিতিকে ভুলতে পেরেছিল; আর আমি পেরেছিলাম গবেষণা-কর্মে নিশ্চিন্ত মনোযোগের সুযোগ। তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এ গুরুদায়িত্ব পালন কখনোই সম্ভব ছিল না। গবেষণাকালীন সময়ে পরিবার থেকে দূরে অবস্থানের অনুমতি-দানের কারণে আমার স্বামীও (সাফাতুল্লাহ বিশ্বাস) আমার কৃতজ্ঞতার পরিধিকে বাড়িয়ে তুলেছেন। আর স্বর্ণা- মাত্র ছয় মাস বয়সেই যে তার মায়ের কোল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তার কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। সর্বোপরি, যিনি আমার গবেষণা- তত্ত্বাবধায়ক, যাঁর নিরন্তর উৎসাহ, পরামর্শ ও সহমর্মিতাবোধ আমাকে এ অভিসন্দর্ভ চূড়ান্ত করতে সহায়তা করেছে, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মুহম্মদ মজির উদ্দীন। তাঁর প্রতি আমি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ অর্ঘ্য নিবেদন করছি।
আবেদা আফরোজা
সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক,
ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ,
গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
There are no reviews yet.