Description
সম্পাদকীয়-
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ও ঐতিহ্যবাহী একুশে বইমেলা-
বাঙলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ২০১৩ সনে সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করে। তখন অনুপ্রাণনের ২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল; যা কি-না স্টল বরাদ্দ পেতে বাঙলা একাডেমির প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছিল। কিন্তু ঐ শর্ত পূরণ করে আবেদন করা সত্ত্বেও বাঙলা একাডেমি লিটল ম্যাগ চত্বরে অনুপ্রাণন-এর নামে স্টল বরাদ্দ না পেয়ে অনুপ্রাণন বহেরা চত্বরে “উন্মূক্ত স্টল”-এ একটুকু জায়গা করে নেয়। যতটুকু মনে পড়ে যে, লিটল ম্যাগের জন্য ওই বছর বাঙলা একাডেমির বরাদ্দকৃত স্টলের সংখ্যা বড়জোর ৩০-৪০ হতে পারে। এর পরের বছরও অর্থাৎ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার ৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে থাকা সত্ত্বেও অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক পত্রিকার নামে একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ হয়নি। অতএব আবারও সে-বছর উন্মূক্ত স্টলেই হয় অনুপ্রাণনের স্থান। বলে রাখা ভালো যে, উন্মূক্ত স্টলে পত্রিকার স্থান পাওয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগত মর্জি ও সম্মতির ওপরই নির্ভর করে।
নিয়মিত প্রকাশের দুই বছর পর অর্থাৎ প্রথমবারের মতো ২০১৫ সনে বাঙলা একাডেমি লিটল ম্যাগ চত্বরে একুশে বইমেলায় অংশ নেয়ার জন্য শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন স্বনামে স্টল বরাদ্দ পায় এবং এরপর থেকে প্রতি বছরই অনুপ্রাণন একুশে বইমেলায় বাঙলা একাডেমির বহেরাতলায় লিটল ম্যাগ চত্বরে স্টল বরাদ্দ পেয়ে আসছে। আর ঐ যে ২০১৩ সনে একুশে বইমেলায় যেখানে সর্বসাকুল্যে বরাদ্দ পেয়েছিল ৩০-৪০টি শিল্প-সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন, সেটার সংখ্যা এই ২০১৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০-এর অধিক। নিয়মিত স্টল আর উন্মূক্ত স্টল মিলিয়ে ২০০-২৫০টি ম্যাগ ও পত্রিকার স্টল বরাদ্দ দেয়ার জন্য বাঙলা একাডেমির ঐতিহ্যবাহী বহেরা চত্বরে যথেষ্ট স্থান ছিল না। কিন্তু ঐ সীমিত পরিসরে স্থান করে দেয়ার জন্য পুরো স্থানটিতে ঘিঞ্জি করে স্টল নির্মাণ করে যেন এক মাছের বাজারে পরিণত করা হয়েছিল। কেউ কেউ সেটাকে কোনো শরণার্থী শিবিরের সাথে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছে। যাহোক, সমস্যা যেটা হয়েছে যে বরাবরের মতো একুশে বইমেলাকে ঘিরে বহেরাতলা মেলা প্রাঙ্গণে স্থানাভাবের কারণে সেখানে লিটল ম্যাগ কর্মী ও লেখকদের মিলনমেলা, আড্ডা ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার মতো কোনো পরিবেশ আর থাকেনি।
আসলে, একুশে বইমেলায় পুস্তক প্রকাশক অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মূল বইমেলা বড় পরিসরে আয়োজন করার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরের পর ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য লিটল ম্যাগের স্টলসমূহ বাঙলা একাডেমির বহেরাতলা চত্বরেই রাখার জন্য লিটল ম্যাগ কর্মীরাই দাবি রেখেছিল এবং বাঙলা একাডেমি সেই দাবি মেনে নিয়েই লিটল ম্যাগ ও পত্রিকাসমূহের স্টল বাঙলা একাডেমির বহেরাতলাতেই বরাদ্দ দিয়ে আসছে। কিন্তু মনে হয়, লিটল ম্যাগ ও পত্রিকা প্রকাশের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে বাস্তব পরিস্থিতি এখন এটাই যে, লিটল ম্যাগ ও পত্রিকাগুলোর স্টলসমূহের খোলামেলা পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সোহারাওয়ার্দী উদ্যানের বড় পরিসরেই লিটল ম্যাগের স্টলসমূহ স্থানান্তর করে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
কীভাবে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙলা একাডেমিকে ঘিরে মাসব্যাপী বইমেলার প্রচলন হলো, এর প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে দেখা যায় যে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারির যে, প্রভাতফেরি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করতো তাদের অনেকেই একুশে সংকলন নাম দিয়ে ছোট ছোট পুস্তিকা, ম্যাগাজিন বা ট্যাবলয়েড আকারের পত্রিকা বের করতো। যেখানে সংকলিত হতো বাঙলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত রাজনীতি, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজনীতি অথবা সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরির পর শহীদ মিনার চত্বরে এবং ক্রমে বাঙলা একাডেমির ‘বর্ধমান হাউজ’কে ঘিরে চত্বরে সমবেত জনতার কাছে সংগঠনের কর্মীরা সেসব পুস্তিকা ও পত্রিকা ঘুরে ঘুরে বিক্রয় করতো। পরবর্তীকালে একসময় ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ মিনার ও বাঙলা একাডেমি চত্বরে বাঙলা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত বিভিন্ন লেখকদের বইগুলোও ফেরি করে বিক্রয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এটাই ছিল একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে পত্রিকা, পুস্তিকা ও বই বিক্রয়ের চিত্র। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করে।
উইকিপিডিয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য এই যে, “যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হন। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যে চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগের পূর্ব থেকেই সূচনার দিনগুলোতে একুশে সংকলন প্রকাশ ও বিক্রয়ের মাধ্যমে বাঙলা একাডেমি তথা, এই অঞ্চলে যে বৃহদাকারের বইমেলার একটা ভবিষ্যৎ খুব ক্ষুদ্রভাবে হলেও সুপ্ত ছিল সেটা অনুধাবন করে হয়ে ওঠেনি। একইভাবে ’৮০-এর দশকে একুশে বইমেলা চালু হওয়ার সময়ও লিটল ম্যাগ বা সাহিত্য পত্রিকার জন্য চত্বর ও স্টল বরাদ্দ দেয়ার জন্য লিটল ম্যাগ কর্মীদের আন্দোলন করতে হয়েছিল। অথচ এসব লিটল ম্যাগ বা সাহিত্য পত্রিকা সাহিত্যের ইতিহাসে সবসময় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাতিয়ার অথবা অনুষঙ্গ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। মৌলিক, মননশীল ও সৃজনশীল লেখক তৈরি করার একটা ক্ষেত্র হিসেবে সক্রিয় থেকেছে।
বর্তমানে অন্তর্জালে ব্লগ, ওয়েবব্জিন, অনলাইন পত্রিকা ইত্যাদি চালু হওয়ায় কাগজে ছাপা লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে দেখা যায়। শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন মনে করে যে, অন্তর্জাল সত্ত্বেও কাগজে ছাপানো লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকার চর্চা যে, বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পেয়ে যাচ্ছে সেটা সাম্প্রতিক একুশে বইমেলাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা ও মান বৃদ্ধি পাওয়ার যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, সেখান থেকেই এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
There are no reviews yet.