Additional information
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.76
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা- সম্পাদকীয়
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ২০১২। এ-পর্যন্ত ৩২টি সংখ্যা প্রকাশ করে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ টি বছর অতিক্রম করেছে। এ দশটি বছর অনুপ্রাণন’কে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আজ একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করার মুহূর্তে পেছনের দশটি বছরের দিকে ফিরে স্মৃতিতে অনেক কিছুই ভেসে আসে। লেখক, পাঠক এবং সম্পাদনা পরিষদের সাথে ভাগ করে নেয়ার মতো অনেক কথাই হয়তো বলার থাকে, বলার ছিল। কেননা ১০ বছর তো কম সময় নয়। তবে, শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা অথবা লিটল ম্যাগ প্রকাশের ইতিহাসে প্রায় একই ধরনের ঘটনা হয়তো হর-হামেশাই ঘটে থাকে।
টেকসই সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণে পেশাদারিত্বের অভাব আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এখনো সেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অহমবোধ প্রতিটি সংগঠনের ভিত কুরে কুরে খাচ্ছে। বাইরের থেকে যেটা দেখা যায় সেটা ঠিক ভেতরের চিত্র না। আর তাছাড়া অর্থনীতির বিষয়টা তো আছেই। আর সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করার ঘাটতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জগতে সাধারণভাবেই অর্থের সংকট রয়েছে। সাধারণভাবেই বলা যায় যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির গুরুত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো যথার্থভাবে বুঝতে ব্যর্থ। ভাবা হচ্ছে ভৌত কাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নতির চাকা ঘুরলে দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু আমরা জানি উন্নত সভ্যতা মানেই হচ্ছে উন্নত শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
তাই, অনুপ্রাণন যেসব সাংগঠনিক সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে আছে সেসবের সাথে অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য বা ব্যতিক্রম হয়তো নির্মাণ করা যায়নি। কেননা আমরা শেষ পর্যন্ত, এদেশের প্রকৃতি ও মনুষ্যসমাজেরই অঙ্গ। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি- এসবের সংকট ও সম্ভাবনা থেকে অনুপ্রাণন বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ তো নয়।
এটা ঠিক অনুপ্রাণন পত্রিকাটিকে ঘিরে এই দশ বছরে লেখক-পাঠক ও সুভানুধ্যায়ীদের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এই বৃত্ত কোনো বিশেষ সীমানা রেখা দিয়ে ঘেরা কোনো বৃত্ত না। এই বৃত্ত শিল্প-সাহিত্যের মুক্ত চর্চার মতোই উন্মুক্ত। অনুপ্রাণন মুক্ত চিন্তার চর্চাকেই সবসময় সমর্থন করেছে, অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছে। আর অনুপ্রাণন চেষ্টা করেছে এদেশের তরুণরা যেন বেশী বেশী করে বই পড়া আর শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সারাদেশ জুড়ে অনুপ্রাণনকে ঘিরে আছে একদল তরুণ-তরুণী, যারা নিয়মিত শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারাই অনুপ্রাণনের প্রাণশক্তি। যাদের সাথে অনুপ্রাণনের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক সৌহার্দের। একে আরেকের পরিপূরক।
দশ বছর নিয়মিত বিভাগ নিয়ে ছাপার সংস্করণ আকারে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশ করার পথে লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে ক্রমেই দুটি দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, অনুপ্রাণনের একটি অন্তর্জাল সংস্করণ প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের মুদ্রিত সংস্করণে সাহিত্য ও শিল্পের বিশেষ ধারা, ধরন অথবা বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা।
ইতোমধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুপ্রাণনের পক্ষ থেকে, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্জালভিত্তিক এই সংখ্যাটিতে থাকছে ২০ টি বিভাগ। যথাক্রমে- শ্রদ্ধাস্মরণ, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রবন্ধ, গুচ্ছ কবিতা, যুগল কবিতা, একক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, বড়ো গল্প, ছোট গল্প, অণুগল্প, অনুবাদ গল্প, মুক্তগদ্য, ভ্রমণকাহিনী, বই আলোচনা, ম্যাগ আলোচনা, পাঠ প্রতিক্রিয়া, চলচ্চিত্রকথা, ধারাবাহিক উপন্যাস, নাট্যকথা এবং শিল্প-সাহিত্য সংবাদ।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ইতিমধ্যে অনিয়মিতভাবে ৬ টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে, (১) তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- প্রিয় উপন্যাস সংখ্যা; (২) অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা- গল্প সংখ্যা; (৩) অষ্টম বর্ষ তৃতীয় সংখা- অণুগল্প সংখ্যা; (৪) অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা; (৫) নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা- কবি ও কবিতা সংখ্যা; এবং (৬) দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- বাংলাদেশের ১৫টি সেরা গল্প- পাঠ ও আলোচনা সংখ্যা।
একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যার মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, সকল মুদ্রিত সংস্করণে নিয়মিতভাবেই শুধুমাত্র দেশের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আরো নিবিড়ভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষ ধরন, বিশেষ বিভাগ, বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশ করার সূচনা করতে চায়।
লেখক, পাঠক এবং অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদের সেই চাওয়া থেকেই ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি নির্বাচিত কবি ও কবিতা সংখ্যা- প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ২৭ জন নির্বাচিত কবির জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং আলোচনা প্রকাশিত হয়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রবীণ ও তরুণ কবিদের নিয়ে এই ধরনের লেখা ও আলোচনা নিয়ে আরো কয়েকটি পর্ব প্রকাশিত হবে বলে আমরা আশা করি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের জীবনী ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিকের কয়েকটি পর্বের এই আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে আশা করি আমাদের দেশের তরুণ সমাজ বাংলাদেশের কবিদের কবিতার সাথে সুপরিচিত হবেন এবং আমাদের দেশের সম্মানিত এই কবিদের কবিতা নিয়ে আলাপ, আলোচনা এবং আড্ডার অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার বৃত্তটিকে প্রসারিত করতে পারবেন।
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
সম্পাদকীয়
অনুপ্রাণন: ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়
গত নভেম্বর ২০১২ থেকে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সাহিত্য ও শিল্প বিভাগের বিবিধ সৃজনশীল ও মননশীল লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে নিয়মিত ভাবেই প্রকাশিত হয়ে আসছিল। কিন্তু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাটি বৃহৎ কলেবরে অর্থাৎ নিয়মিত ১৬ ফর্মার বদলে ১৯ ফর্মা আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পরবর্তী ৫ টি সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্পাদকের অসুস্থতা ছাড়াও অলিখিতভাবে সম্পাদনা পরিষদের যে সদস্যবন্ধুটি পত্রিকার কাজে অফিস সমন্বয়কের গুরুদায়িত্ব পালন করছিলেন নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যেতে তিনি নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকলে পত্রিকার কাজে ছেদ পড়তে থাকে। তাছাড়া সম্পাদনা পরিষদের আর একজন বন্ধু অন্য একটি অনলাইন পত্রিকার কাজে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার ফলে তাঁর পক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকায় প্রয়োজনীয় সময় দেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। সম্পাদনা পরিষদের অন্য আর একজন সংগঠক পর্যায়ের সদস্য পত্রিকার চাইতে গ্রন্থ প্রকাশনায় বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশের কাজে লোকবলের এক বিরাট সংকট দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে- ২০১২’এর নভেম্বরে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশ করার উদ্যোগ যারা নিয়েছিলেন তারা প্রত্যেকেই শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যার যার নিজ অবদান ও স্বাক্ষর রাখার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম ও ব্যক্তিগত অনুদানের ভিত্তিতে পত্রিকাটির প্রকাশনার কাজের যাবতীয় কাজ ও ব্যয় নির্বাহ করার অভিপ্রায় গ্রহণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ সংস্কৃতিতে এবং বিশেষ করে তরুণদের মনের মাঝে মানবতা, সহমর্মীতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা, শিল্পরুচি, নান্দনিকতা এবং মুক্তচিন্তার চর্চার জানালাটাকে উন্মূক্ততর করার কাজে নিয়োজিত অনুপ্রাণনের এই প্রচেষ্টা যেন বাধাহীন হয় এবং কোনভাবেই যেন প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদীতার কূট সাংস্কৃতিক আবর্তে পড়ে দিক হারিয়ে না যায়।
যশ ও প্রতিষ্ঠার মোহ যখন শিল্পীকে পেয়ে বসে তখন শিল্পচর্চা তপস্যা অথবা সাধনা থাকে না। কিন্তু, এটাই বাস্তব যে তপস্যা ও সাধনা ছাড়া শিল্পের উৎকর্ষতার শীর্ষ স্পর্শ সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বলয়ে যেসব শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও উদ্যোগ ফেনার মত আমাদের চারদিক ভরিয়ে তুলছে সেসবের স্থায়িত্ব সম্পর্কে কী কোন সন্দেহ থাকা উচিত?
বছরখানেক বন্ধ থাকার পরও যখন আমরা অনুপ্রাণনের এই সংখ্যাটি প্রকাশের উদ্যোগ নেই তখন আমরা আমাদের পত্রিকার পাঠক, লেখক ও শুভান্যুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সারা পেয়েছি। এই সারা থেকে এই বিশ্বাস আমাদের জন্মেছে যে, আমরা যে পথ অবলম্বন করে এগিয়ে চলতে চাই সেই পথে বাস্তবেই সঙ্গ-সাথীর আমাদের কোন অভাব নেই। এখনও আমাদের দেশের তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ মিথ্যা যশ, প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের মানবিক ও নান্দনিক চর্চা অব্যহত রাখতেই অধিক আগ্রহী। তাই, লেখা আহ্বানে যে সংখ্যক মানসম্পন্ন লেখা আমরা পেয়েছি সেগুলো দিয়ে অনায়াসেই দুটো সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল। চলতি সংখ্যার জন্য লেখা বাছাই করতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় দিতে হয়েছে এবং স্থান সংকুলানের অভাবে প্রায় অর্ধেক লেখাই পরবর্তী সংখ্যার জন্য রেখে দিতে হয়েছে।
লেখা বাছাই করতে গিয়ে আবারো আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সাহিত্য আলোচনা ও সমালোচনা বিভাগে আমরা যথেষ্ট সমৃদ্ধ লেখা পাচ্ছি না যেখানে পেশাদার সমালোচকের কলমের স্পর্শ আরো তীক্ষè অথচ আরো গঠনমূলক হতে পারে। বিশেষ করে কবি ও কবিতা নিয়ে আমাদের আরো তীক্ষè, তীব্র ও গঠনমূলক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কেননা সাহিত্য জগতে কবি ও কবিতার সংখ্যা যতই বাড়ছে কিন্তু আগ্রহী কবিতার পাঠকের সংখ্যা যেন সেই তূলনায় বৃদ্ধি হচ্ছে না। মনে হয়, কবি ও পাঠকের মাঝে বোধ, অনুভব ও ভাষার কোন একটা অন্তর থেকে যাচ্ছে যে অন্তরটি ঘুচে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী কেননা বোধ করি, মূলত কবিতার মধ্যেই রয়েছে তরুণ সমাজের জন্য ভবিষ্যতের বিশেষ বার্ত্তা। অর্থাৎ সাহিত্যের সত্যপাঠ।
দেশে এখন হেমন্ত ঋতু। হাওরের অকাল বন্যা ও দেশব্যাপী অতিবৃষ্টির ফলে ফসলহানী ঘটায় এবছর দেশের সামগ্রিক সমাজ জীবনে খাদ্যের ঊর্ধ্বমূল্য সকল মানুষকেই কষ্ট দিয়েছে। হেমন্তের নতুন ফসল যেমন কৃষকের ঘড়ে ঘড়ে জীবনে ঘুরে দাড়ানোর বার্ত্তা দিয়ে যাচ্ছে- দীর্ঘ বিরতির পর অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকের এই সংখ্যাটি এ-বছর অনুপ্রাণনের ঘুরে দাঁড়ানোরই প্রতীক ও স্বাক্ষর হোক- এটাই আশাবাদ।
ষষ্ঠ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন—নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি যখন আসে তখনই আমরা আমাদের ভাষা তথা, বাঙলা ভাষা ব্যবহারের পরিধি, মান, চর্চা এবং গবেষণার ক্ষেত্র ঘিরে অপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি; কিন্তু ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনার পর এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পর আজও আমরা সারা বছর বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য কোনো পদ্ধতিগত ও সদা চলমান কোনো কর্মসূচি প্রণয়ন করতে সক্ষম হইনি। এই অক্ষমতার কারণ আমার জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মাঝেই বিদ্যমান।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি ভাগে বিভক্ত–বাংলা মাধ্যম, আরবি/ফারসি মাধ্যম এবং ইংরেজি মাধ্যম। ইংরেজি অথবা আরবি/ফারসি মাধ্যমে যারা পড়াশোনা করে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে সীমিত কয়েক শ্রেণি পর্যন্ত বাঙলা ভাষা ও বাঙলা ব্যাকরণের সাথে তাদের যৎসামান্য পরিচয় ঘটে। কিন্তু সেটা দৈনন্দিন জীবনে কথ্যভাষা ছাড়া লিখিত কোনো নথি, রচনা, প্রবন্ধ অথবা প্রতিবেদন লেখার জন্য যথেষ্ট হয়ে ওঠে না। যার ফলে, সরকারি কার্যক্রম চালানোর জন্য নথিতে অথবা আইন ও বিচারব্যবস্থার কাজে ব্যবহৃত যাবতীয় আইন, আদেশ ও রায়ের সকল প্রতিবেদনে অথবা চিকিৎসা ও বিজ্ঞানচর্চার উচ্চতর স্তরে বাঙলা ভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হওয়া অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আর সেটাই হতে আমরা দেখে থাকি।
আইন ও বিচারের নথি প্রস্তুতিতে অথবা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শ্রেণি অথবা মেডিকেল শিক্ষা ও চর্চার কাজে সহজে ব্যবহৃত হতে পারে সেজন্য সহজ ও বোধগম্য শব্দ সংবলিত উপযোগী এবং পূর্ণাঙ্গ পরিভাষা কোষ তৈরি করতে আমরা এখনও সফল হইনি। এই কাজটা কঠিন কিন্তু তাই বলে কাজটা শুরুই কি হলো? আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো কাজ যদি হয়ে থাকে, সেটাও অত্যন্ত নগণ্য এবং অস¤পূর্ণ। একটা ক্ষুদ্র এবং অসম্পূর্ণ পরিভাষা কোষ দিয়ে কি কোনো একটি গ্রন্থ সম্পূর্ণ অনুবাদ হতে পারে? তাই আমরা আইন, বিচারব্যবস্থা, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার সকল ক্ষেত্রে এখনো বাঙলা ভাষার প্রচলন করতে পারিনি।
আইন, বিচারব্যবস্থা, চিকিৎসা-বিজ্ঞানসহ সকল বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে শুধু নয়, সাহিত্য ক্ষেত্রেও বিদেশি ভাষা থেকে বাঙলায় অনুবাদ এবং বাঙলা ভাষা থেকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রটিও অবহেলিত রয়ে গেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে যৎসামান্য যেটুকু হচ্ছে সেটা বাঙলা সাহিত্যকে বিদেশে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বিন্দুসম প্রচেষ্টাই বলা যেতে পারে। বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্যই উভয়বিধ অনুবাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অথচ এটা আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা কতটুকু বোঝেন এটা জানা খুব কষ্ট। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তারা আপসহীন সংগ্রামী। কিন্তু জাতিকে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে ভাষার বহুমাত্রিক বিকাশ যে কতটুকু প্রয়োজনীয় সেটা তারা কী আদৌ বোঝেন?
পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ রয়েছে যাদের মাতৃভাষা বাঙলা। শুধু এই সংখ্যাটার জোরেই আমরা জাতিসংঘে অন্যান্য প্রচলিত ভাষাসমূহের পাশাপাশি বাঙলা ভাষাকেও ব্যবহারের জন্য অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করতে চাই। কিন্তু শুধু সংখ্যার জোরেই কি জাতিসংঘের কাছে এই দাবি গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব? বস্তুতপক্ষে আমরা যদি বাঙলা ভাষাকে বিশ্বের একটি অন্যতম ভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে বাঙলা ভাষাকে উচ্চতর জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উপযোগী করে তুলতে হবে। যদি আন্তর্জাতিকভাবে বাঙলা ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো কোনো প্রতিশব্দের অভাবে বিকল্প হিসেবে বিদেশি ভাষাই ব্যবহার করতে হয় তাহলে কি করে আমরা বাঙলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক অথবা বহুদেশীয় কোনো ফোরামে ব্যবহারে জন্য অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হতে পারি? এই বক্তব্যের সাথে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয় মিলিয়ে ফেলা যাবে না। কেননা, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ, বাঙালির ভাষার জন্য সংগ্রাম ও আত্মদানের প্রতি সম্মান দেখানোর কারণেই সম্ভব হয়েছে। এর সাথে বহুজাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য প্রচলিত অন্যান্য ভাষাসমূহের পাশাপাশি বাঙলা ভাষাকে ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করার সম্পর্ক নেই। এটা সফল করে তুলতে চাইলে বাঙলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধি এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিকাশ ও সমৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে।
বক্তব্যটিকে বাঙলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ এবং সমৃদ্ধির প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রেখে বলতে চাই যে, প্রয়োজন ছিল পরিভাষা এবং অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশ এবং সমৃদ্ধির জন্য একটি স্বতন্ত্র এবং দক্ষ ও মেধাবী সাহিত্যিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় পারদর্শী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কিন্তু বেসরকারিভাবে এই কাজটা করা সম্ভব না। এটা করতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং যার জন্য চাই সরকারের সিদ্ধান্ত। কেন যে সরকার আজ অবধি এডহক-ভিত্তিতে দেশ ও জাতির জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাঙলা একাডেমিকেই দিয়ে রাখলো সেটা আমার বোধগম্য না।
এদিকে মাদরাসা ও ইংরেজি শিক্ষা থেকে পাস করে বেরিয়ে আসা ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করার সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। এ-কথা জানা সত্ত্বেও যে উচ্চতর শিক্ষায় অথবা চাকরি-জীবনে আগত এসব ছাত্ররা বাঙলা ভাষা ব্যবহার না করে অন্য বিদেশি ভাষা ব্যবহার করার প্রবণতা নিয়ে উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে ঢোকে। যার ফলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে অথবা সরকারি প্রশাসন এবং আইন ও বিচারব্যবস্থার উচ্চতর মহলে সার্বিকভাবে বাঙলা ভাষা ব্যবহার প্রচেষ্টায় তাদের আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায় না। বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা ব্যবহার পরিহার করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অনীহার ফলে একপ্রকার বাধা সৃষ্টি করতেও তাদের দেখা যায়।
ভাষার বহুমাত্রিক বিকাশ যদি না ঘটে, তাহলে বদ্ধজলের মতোই ভাষা ও একপ্রকার বন্ধ্যা অবস্থায় পতিত হয়। বিকাশ না ঘটলে যে কোনো অস্তিত্ব সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং সঙ্কুচিত হতে হতে একসময় সেই বস্তুর অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে পড়ে। কথ্য অথবা লিখিত ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে অস্তিত্বের এই বিনাশ শুরু হয় নানা বাঙলা শব্দ বা প্রতিশব্দের বদলে বিদেশি শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যেটা এখন হরহামেশা ঘটছে। নাগরিক কথাবার্তায় অথবা লেখালেখিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলার বদলে আরবি অথবা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার এখন আমরা প্রায়শই হতে দেখছি, কিন্তু তবুও আমাদের সাহিত্যিক অথবা বুদ্ধিজীবী মহলে কিংবা নীতিনির্ধারক মহলের টনক নড়তে দেখা যায় না। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে এটা প্রকৃত বাঙলা শব্দের অভাবে হচ্ছে, সেটা যে তা নয়। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এদের মন-মানসিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সচেতনতা ততোটুকু দৃঢ় নয়। এটা কেন হচ্ছে? কেন বহুসংখ্যক নাগরিক বাঙলার বদলে আরবি অথবা ইংরেজি ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন?
জ্ঞান-বিজ্ঞান অথবা প্রযুক্তির উচ্চতর ক্ষেত্রে যখন বাঙলা প্রতিশব্দের অভাব হয়, তখন সম্পূর্ণভাবেই বাঙলা ভাষার বদলে ইংরেজি ব্যবহার যেন অপরিহার্য হয়ে যায়। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই বাঙলায় একসময় আরবি, ফারসি অথবা উর্দু শব্দ সুকৌশলে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে ঘটেছে, কিন্তু সেটা ছিল পাকিস্তান আমল এবং পাকিস্তানি শাসক মহলকে তোষণ করার জন্যই এটা সচেতনভাবেই করা হতো। কিন্তু এখন কেন আরবি, ফারসি, উর্দু অথবা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। বাঙলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে যেহেতু চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে কাজ হচ্ছে না তাই বাঙলা ভাষার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ছে এবং এর জন্য ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা শতভাগ দায়ী। তাহলে আমরা কি করতে পারি? এটা কি বলতে পারি যে, ভাষার জন্য আমাদের সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটেছে?
আমাদের একথা বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙলা ভাষার অস্তিত্ব সুরক্ষা করা, এর বিকাশ ঘটানো এবং চলমান রাখা এবং সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা চলার আন্দোলন ও সংগ্রাম, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চাইতেও জটিল ও কঠিন। যার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চাই নিয়মানুবর্তিতা ও অধ্যবসায়।
খুব নীরবে হলেও বিশ্বজুড়ে ভাষার ব্যবহার এবং প্রসার নিয়ে চলছে এক তীব্র প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতার পেছনে রয়েছে উন্নত রাজনীতি এবং অর্থনীতির অধিকারী দেশ ও জাতিসমূহের উৎপাদিত পণ্যসমূহের বাজার সম্প্রসারণ করার সম্প্রসারণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা। যেসব পরিকল্পনাকে তারা কোনো কোনো সময় তাদের নিজ জাতি ও দেশের সুরক্ষা নীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে প্রচার করে থাকে। এসব পরিকল্পনার বিষয় আমাদের বুঝতে হবে। ভাষা, যা কিনা শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাহক সেগুলো তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী এবং স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের তৈরি সাহিত্য, সংগীত ও চলচ্চিত্রের বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত করে চলেছে। আমাদের দেশেই বিদেশিদের বিদেশি ভাষার বই এবং চলচ্চিত্রের যে বাজার রয়েছে, সে তুলনায় আমাদের বাঙলা সাহিত্য অথবা চলচ্চিত্রের বিদেশি বাজার নিতান্তই ক্ষুদ্র। এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা যদি আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও চলচ্চিত্রের বিদেশি বাজার সৃষ্টি না করতে পারি এবং সেসব বাজার সম্প্রসারিত না করতে পারি, এই প্রতিযোগিতার কোনো ভবিষ্যৎকালে একদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় বাঙলা ভাষাই বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।
সারা বিশ্বে নানা দেশে ছড়িয়ে প্রায় সোয়া কোটি বাঙালি রয়েছে। যাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম ক্রমেই বাঙলা ভাষা ব্যবহারের সীমিত সুযোগ পাওয়াতে বাঙলা ভাষা, সংগীত অথবা চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এইভাবে চলতে থাকলে প্রবাসী বাঙালি সমাজে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে এবং তারা মানসিকভাবে স¤পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। প্রবাসী বাঙালিদের ব্যক্তি উদ্যোগে গুটিকয়েক বাঙলা ভাষা শিক্ষা স্কুল এবং সংগীত বিদ্যালয় আছে, যা কি-না প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আমাদের বিদেশি দূতাবাসগুলো এই ব্যাপারটাই নজর দেয়ার একটা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে এবং বিদেশে বিশেষ করে যে সকল শহরে অধিক সংখ্যায় প্রবাসী পরিবার রয়েছে সেখানে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং পাশাপাশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যেসব লাইব্রেরিতে বাঙলা ভাষায় রচিত অথবা বাঙলা ভাষায় অনূদিত সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও কলাবিভাগের গ্রন্থসমূহ এবং বাঙলা চলচ্চিত্রের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থাকতে পারে। পাশাপাশি বাঙলা ভাষা ও সংগীত শিক্ষার জন্য স্কুল থাকতে পারে।
আমাদের দেশে যদি ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউএস, রুশ অথবা ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টার থাকতে পারে, তবে প্রবাসে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে আমরা কেন ‘বাঙলা শিল্প-সাহিত্য কেন্দ্র’ নাম দিয়ে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে তাদের পরিচিতি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারি না? এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জাতীয় বাজেটে এই কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখার কথা ভাবি না?
নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
সম্পাদকীয়-
শিল্পী গোষ্ঠীর সমাজ-সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন
শিল্পী ও সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধভাবে একমাত্র নান্দনিক সৃজনের ঘেরাটোপে বন্দী না থেকে সমাজে বসবাসের শর্তাবলী ও পরিবেশ একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক’কে অন্য যে কোন সচেতন নাগরিকের মতোই একান্তভাবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উৎসারিত ও গৃহীত সকল মতামত প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তাঁর কাজে প্রকাশ করতে দেখা যেতে পারে। বিশেষতঃ একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক পরিবেশ ও সমাজের ক্ষেত্রে গভীরভাবে সংবেদনশীল হওয়ার কারনে তাদের সৃজনশীল কাজে ও রচনায় সমাজের রীতি-নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাল-মন্দ এবং দোষ-গুণের প্রতিফলন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না বরঞ্চ এই থাকাটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্র মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকম সীমা বেঁধে দেয়। এসব সীমার মধ্য থেকেই শিল্প চর্চার বিভিন্ন মাধ্যম ও অবলম্বনের সাহায্য নিয়ে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের যেমন প্রচ্ছন্নভাবে নিজের মতটি প্রকাশ করার প্রচেষ্টা থাকে তেমনই আবার শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ দ্রোহী হয়ে মত প্রকাশের ফলে রাষ্ট্রের অথবা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কোপানলে পড়ে নির্যাতিত হওয়া এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে তাদের সহিংস আক্রমণের শিকার হতেও আমরা দেখেছি।
তাই, এখানে প্রশ্ন এটা নয় যে, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সৃজনশীল কাজে ও রচনায় সমাজের রীতি-নীতি, পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাল-মন্দ এবং দোষ-গুণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে তাদের ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন থাকবে কি-না? বাস্তবে প্রশ্নটা হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে রাষ্ট্র ও জনগণকে সচেতন করা এবং সেসব সমস্যা দূর করার জন্য সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা কীভাবে নির্ধারিত হবে? বরঞ্চ, প্রশ্নটা দুটো হচ্ছে-
ক. শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ নিজেরাই কোন সামাজিক সংগঠন করবে কি-না অথবা পেশাজীবীদের অন্য কোন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হবে কি-না? এবং
খ. স্রেফ শিল্পীদের নিজস্ব অথবা অন্য কোন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে সমাজের কোন ন্যায্য দাবী অথবা সমাজের কোন বাস্তব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত রাজপথের আন্দোলনে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে নিজেরা সম্পৃক্ত হবে কি-না? এবং
গ. যদি শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ নিয়মিতভাবে কোন সামাজিক সংগঠনমূলক কার্যক্রমে সক্রিয় হয়ে যায় এবং সামাজিক ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলনে নেমে পড়ে অথবা সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে যায় তাহলে সময় ও মনোসংযোগ দ্বিধান্বিত হয়ে বাধা পড়ে শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মান ও গুণাগুণের ক্ষেত্রে শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা কোন ক্ষতি বা সমস্যার সম্মুখীন হবে কি-না?
এখানে উল্লেখ্য যে, অন্য সামাজিক সংগঠনের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা অথবা সংহতি প্রকাশ, ঘড়ে বসে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিজস্ব সংগঠন করা অথবা ফেস্টুন ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদী নানা উপায়ে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের পক্ষে সামাজিক আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক সামাজিক আন্দোলনের সাথে কীভাবে যুক্ত হবেন সেটা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এবং এটাও বাস্তব সত্য যে একজন সংবেদনশীল ও সচেতন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক ন্যায্য দাবী ও বক্তব্য নিয়ে পরিচালিত চলমান সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তায় আবদ্ধ হয়ে কোনভাবেই নিষ্ক্রিয় এবং নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না।
১৯৬৯ এর গণভ্যুত্থান অথবা ১৯৭১ এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে শিল্পী সমাজের সদস্যবৃন্দকে সংগঠিতভাবে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে-সংগ্রামে-মিছিলে যুক্ত হতে আমরা দেখেছি। ৭১’এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এমনকি প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মুক্তিযুদ্ধে সংযুক্ত হতে আমরা দেখেছি। এর পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছেন। এসব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র।
স্বাধীনতার পর শিল্পী ও সাহিত্যিকদের যেসব সংগঠন গঠিত হয়েছে সংগঠনভেদে সেগুলোর মূল লক্ষ্যই ছিল জোটবদ্ধভাবে শিল্প চর্চা, আলোচনা-সমালোচনা, শিল্পের প্রচার-প্রসার, পরোক্ষভাবে ব্যক্তির প্রচার ও প্রসারলাভের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা থেকে বিপণন কৌশল অবলম্বন করা পর্যন্ত। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয়, সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংবাদ-মাধ্যম, কর্পোরেট অথবা নন-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পদক-পুরস্কার অথবা আনুকূল্য লাভের জন্য এসব কোন কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগঠন ও জোটের তৎপরতার সুযোগ গ্রহণ করতেও আমরা দেখেছি। শিল্প ও সাহিত্যকেন্দ্রিক নানা তৎপরতা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও এসব সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে সৃজনশীল অথবা মননশীল শিল্পগুণের মান ও রুচির উৎকর্ষতা লাভের ক্ষেত্রে এসব সংগঠন বিশেষ কোন অবদান রাখতে বিশেষ কোন সাহায্য করেছে বলে এরকম উদাহরণ পাওয়া যায় না। দলীয় অথবা ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়গুলো সেখানে খুবই নগ্নভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে এবং যার ফলে দেশে মাঝারী মানের শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতাই হয়েছে অত্যন্ত অধিকহারে। অন্যদিকে প্রচার, প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মৌলিক, মননশীল ও উচ্চতর মানসম্পন্ন শিল্প ও সাহিত্যকর্ম পাঠকদের কাছে ব্যপকভাবে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করতে পারেনি। এবং যার ফলে সত্যিকার প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা হতাশা থেকে প্রচারবিমুখতা ও আত্মকন্দ্রিকতার ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা এবং তাঁদের সাহিত্যকর্মকে আধুনিক শিশু-কিশোর ও তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশে কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী সংগঠন কাজ করছেন। কিন্তু, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্যকর্মের আক্ষরিক পঠন ও মুখস্থ করার উপরই এসব সংগঠনকে বেশী জোর দিতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের মাঝে যে মানবিক চেতনা ও যে দার্শনিক নির্যাস রয়েছে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সাথে অধিকহারে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণদের পরিচয় করিয়ে দেয়া খুব জরুরী। কেননা এতে করে দেশের নতুন প্রজন্মের মনের মাঝে মানবিক চেতনা ও সুন্দর রুচিবোধ স্থান করে নিতে পারে। এসব বিবেচনা করে রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য চর্চা ও গবেষণার জন্য যেসকল সংস্থা ও সংগঠন কাজ করছেন সেসকল সংগঠন দক্ষতার সাথে তাঁদের কাজের পরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে চলুক- এটাই প্রত্যাশা করি।
প্রথম থেকেই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, ব্যক্তি, দলীয়, গোষ্ঠী অথবা কর্পোরেট তৎপরতার বাইরে নিজের স্বাধীন অবস্থান রক্ষা করে দেশের নবীন ও তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যকদের পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন শিল্প-চর্চার জন্য অনুপ্রেরনা যুগিয়ে এসেছে। সপ্তম বর্ষে পদার্পন করে ‘অনুপ্রাণন’ অবিচলভাবেই ঐ ঘোষিত পথেই তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়। অনুপ্রাণন-এর মূল পৃষ্ঠপোষক অনুপ্রাণন-এর পাঠকেরাই। তাই, বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করতে পেরে অনুপ্রাণন-এর লেখক এবং পাঠকেরা অবশ্যই বিশেষ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন–১০ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা
শিল্প-সাহিত্যে নারীর ভাষা, ভাষ্য ও দৃষ্টিকোণ নির্মাণে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা
ভাষা সমভাষীদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের সহজ ও বোধগম্য উপায়। কিন্তু যখনই বৈষম্যমূলক সমাজ জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি, অঞ্চল ও লিঙ্গভেদ সৃষ্টি করে, তখন সমভাষীদের মধ্যে নানারকম উপভাষা, আঞ্চলিক ভাষা এবং একইসাথে উপ-সংস্কৃতিতে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভাষা ও ভাষ্যের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে তর্ক ও ক্ষেত্রবিশেষে বিবাদ দেখা দিতে পারে। শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার ভেদের সাথে সাথে উচ্চারণেরও নানা ভেদ ও ব্যতিক্রম সৃষ্টি হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বাক্যগঠন, শব্দ ব্যবহার এবং উচ্চারণে বিভেদ ঘোচালেই মানুষে মানুষে বাস্তব ভেদাভেদসমূহ দূর হয়ে যায়। সমাজে যে সকল বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ ও অন্যান্য প্রকার ভেদাভেদ রয়েছে, সেসব ভেদাভেদের শেকড় সমাজের গভীরে নিহিত। এ সকল ভেদাভেদের পেছনে কলকাঠি নাড়ে ইতিহাস, পরম্পরা, প্রথা, প্রচলন, শাস্ত্র, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-সামাজিক তত্ত্ব ও দর্শন। এসব ইতিহাস, পরম্পরা, প্রথা, প্রচলন, শাস্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-সামাজিক তত্ত্ব ও দর্শন নির্মাণ ও বর্ণনার ভাষা, ভাষ্য, শব্দ, বাক্য ও বাগধারার একটি নির্দিষ্ট ছক থাকে। প্রতিষ্ঠাতার নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করার জন্য সংগঠিত, অন্যদিকে বৈষম্য দূর করার জন্য পরিবর্তন ও মানবিক বিকল্পের প্রয়াসে যারা ভাষা, ভাষ্য, শব্দ, বাক্য, বাগধারা অথবা প্রবাদের আলোচনা-সমালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করায় ব্রত রয়েছেন, তারা যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ অথবা যদি তাদের কোনো সংগঠন থেকে থাকে, তবে সেটাও নিতান্ত দুর্বল।
সরল ও স্বাভাবিকভাবে দেখলে শিল্প-সাহিত্য দেশ, সমাজ, রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং চলমান ঘটনারই প্রতিফলন। তাই সমাজে বিরাজমান ভেদাভেদ ও বৈষম্যের প্রতিফলন শিল্প-সাহিত্যে এসেছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে সেসব প্রতিফলন যে, সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা নয়। ক্ষমতাশালী শ্রেণি-গোষ্ঠী, তাদের মত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার ও প্রসারে যেমন ব্রতী হয়েছে, তেমন একইভাবে নানারকম লিখিত-অলিখিত সেন্সরশিপ আইনের প্রকাশ্য অথবা আড়ালে প্রয়োগ করার মাধ্যমে ক্ষমতার বাইরের শ্রেণি-গোষ্ঠীর প্রতিবাদী মানবিক ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্যকে দমন করেছে, নিশ্চিহ্ন করেছে অথবা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে নিষ্ঠুরভাবে। কোনো ভালো অথবা ন্যায্য কাজেও সমাজের ক্ষমতাধরদের রাগ-বিরাগ দেখা দিলে সেসব কাজ নিরুৎসাহিত করার উপায় নানাভাবেই উদ্ভাবিত হয়েছে, সুকৌশলে এসবের প্রয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছে।
সুতরাং শিল্প-সাহিত্যে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর ভাষা, ভাষ্য ও দৃষ্টিকোণ নির্মাণের পথে এক দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করা; এমনকি আত্মদানের অতীত ইতিহাস রয়েছে, যা কি-না সমকালীন সমাজেও চলমান রয়েছে। শিল্প-সাহিত্য শরীরী কোনো খেলা নয় যে, সেটার জন্য দুটো পৃথক মাঠ থাকবে, যেমন—পুরুষ ফুটবল-নারী ফুটবল বা পুরুষ হকি-নারী হকি। শিল্প-সাহিত্য বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। নারী ও পুরুষের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার বিভেদ রেখা টানার বিধান শাস্ত্রে উল্লেখ করে এই বিভেদ রেখাটাকে স্থায়ী করার চেষ্টা হয়েছে এবং সেই চেষ্টা চলমান রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো বৈষম্য নেই। তাই যত চেষ্টাই করা হয়ে থাকুক না-কেন, শিল্প ও সাহিত্যচর্চার মাঠটাকে নারী-পুরুষে ভাগ করা যায়নি।
একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতার সাথে লড়াই করেই নিজের স্থান করে নিতে হয়। আমরা বিষয়টা বুঝে নিতে পারি যে, কেন ইতিহাসে একজন পুরুষ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি পাওয়া যায়, কিন্তু একজন নারী মাইকেলেঞ্জেলো পাওয়া যায় নাই। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিকের নাম দেখতে পাই না। যদিও এসবকালে মৌখিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, যা কি-না পরবর্তীতে নামহীন সাহিত্য হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি রেনেসাঁর যুগেও যখন শিল্প ও সাহিত্যের ব্যাপক জাগরণ ঘটেছিল, তখনও আমরা কি সে-রকম উল্লেখযোগ্য নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিকের নাম পাই? বস্তুত আধুনিক যুগে এসেই বহু লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীরা রচিত শিল্প-সাহিত্যে যেমন স্বমহিমা ও মর্যাদার স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে সে-রকম নিজের অসীম মানসিক শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বল্প সংখ্যায় হলেও শিল্প ও সাহিত্যের জগতে শিল্পী অথবা লেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এসব কারণে নারীদের হৃদয়ের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মাত্রাটা অনেক সময়েই সমাজসচেতন ব্যক্তির কাছেও অননুধাবনযোগ্য হয়ে পড়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ভয়ার্ত শৈশব, অব্যক্ত কৈশোর, বৈষম্যের যৌবন, অতৃপ্তির দাম্পত্য, সামাজিক নিষ্পেষণ যে বিষয়বৈচিত্র্য, কোনোরকম রাখঢাক না করেই সেসব কাহিনির কতটা বাস্তবে উন্মোচন ও প্রকাশে সমাজ সাহসী হয়ে উঠবে? কিন্তু ইঞ্চি ইঞ্চি করে হলেও কুসংস্কারগুলো ঝেড়ে ফেলে সমাজ একটু একটু করে এগিয়েছে।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্প-সাহিত্যে নারীর অবয়বকে জন্মদাত্রী মায়ের অথবা যৌন আবেদনময়ী রমণীর বিভিন্ন প্রতীকী উপস্থাপন হয়েছে অনেকটা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো করে। নারীকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যেমন প্রতীক সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি নারীমুক্তির জন্যও প্রতীক রয়েছে। নারী নিজে কখনো প্রতীক হয়েছেন, নারীর পোশাকে প্রতীক ছড়িয়েছে, নারীকে অবমাননার জন্য প্রতীকের ব্যবহার হয়েছে। নারীর প্রতীকী উপস্থাপন শিল্পকলায়, সাহিত্যে, সভ্যতায় যেভাবে এসেছে, বাস্তবের নারী সেখান থেকে বহুদূরেই রয়ে গেছে। অথবা পুরো বিশ্বব্যবস্থা নারীকে প্রতীকী উপস্থাপনের মাধ্যমে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে, নারী কেবলই সেই বাঁধন ছিঁড়ে বেরোবার জন্য নিরন্তর যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র প্রতীকের অচলায়তন ভেঙে এগিয়ে যাওয়াটাই নারী জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম।
শিল্প-সাহিত্যে নারীর প্রবেশ ও অগ্রগতির পথে সমস্যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনুধাবন করার জন্য নারীশিল্পী ও সাহিত্যিকদের শিল্প-সাহিত্য জগতে প্রারম্ভিক প্রবেশ করা, এগিয়ে আসা এবং অগ্রগতির বিষয়গুলো উল্লেখ করে, আমরা কিছুটা আলোচনা করতে পারি। সভ্যতার হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে যখন শিল্প-সাহিত্যচর্চায় একমাত্র পুরুষদেরই পদচারণা ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপ যখন ধীরে ধীরে রেনেসাঁর দিকে গুটি গুটি পা বাড়াচ্ছিল, তখনও মাত্র অল্প কয়েকজন নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিক রেনেসাঁর প্রস্তুতি পর্বে ‘মর্ত্যরে ভগবান’ তথা পুরুষদের বাধা অতিক্রম করে নিজেদের প্রকাশ্যে নিয়ে আসার জন্য কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। এই সারিতে যে আটজন নারীর নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হয়ে থাকে, তারা হচ্ছেনÑ সোফোনিসবা এঙ্গুইসোলা, লেভিনা তিরলিঙ্ক, লাভিনিয়া ফনটানা, ক্যাথারিনা ভন হেমেসিন, এলিজাবেথ সিরানি, ক্লারা পিটার্স, জুডিথ লেইস্টার এবং আর্টমেসিয়া জেনটিলেসিন।
কিন্তু তারও অনেক পূর্বে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীকালে পারস্য ও মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে সহস্রার্ধ মৌখিক গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সম্রাট শাহরিয়ারের স্ত্রী শাহ্রজাদের কথাসাহিত্য হিসেবে। শাহ্রজাদের সৌভাগ্য যে, ইতিহাস তার নামটি মুছে বেনামী নামকরণ করেনি। পৃথিবীর কথাসাহিত্যের জগতে এ-রকম নানা বিষয়ভিত্তিক ১০০১টি গল্পের রচনা বিস্ময়কর, যেখানে প্রতিটি গল্পের শেষে সম্রাটের কাছে তার স্ত্রী শাহ্রজাদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করার প্রার্থনা গৃহীত হওয়ার কথা যুক্ত রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতায় গুহাচিত্র ও পাথরের ভাস্কর্যে নারী জন্মদাত্রী মাতা অথবা যৌন আবেদনময়ী বস্তু হিসেবেই চিত্রিত হয়েছে। বৈদিক পর্বে শাস্ত্রমতে, নারীর অবস্থান জন্মদাত্রী মাতার অবস্থান হিসেবে নারীকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নির্দিষ্ট করে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এই মর্যাদা লাভের কারণে নারী-পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত ছিল। বাস্তবে প্রাক-উপনিবেশবাদ আমল পর্যন্ত সিন্ধু ও ভারতীয় সভ্যতায় নারী, বংশ রক্ষাকারী মাতার বাইরে আর অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠতে পারে নাই। চীন সভ্যতায়ও সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে তাং রাজত্বকালে নারীদের অবস্থানে স্বকীয়তা অর্জনের কিছু সুযোগ গ্রহণ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিকের নাম পাওয়া যায় না। নারীদের নান্দনিক ক্ষুদ্র অঙ্কন ও সুচি শিল্পের নিদর্শন জাদুঘরে দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্বসাহিত্যে প্রথম নারী কবি প্রাচীন গ্রিসের স্যাফো। ষষ্ঠ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে নব কবিদের একজন ছিলেন এই গীতিকবি। চর্যাপদকে বলা হয় বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। চর্যাপদের পদকর্তাদের মধ্যে একজন নারী পদকর্তা ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। এই নারী পদকর্তার নাম কুক্কুরিপা। রজকিনীকে অনেকে চেনেন চণ্ডীদাসের প্রেমিকা হিসেবে। তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে, তিনি একজন কবি। তিনি রামী ও রামমনি—এই দুই নামে কবিতা লিখতেন। তাঁর পদগুলোর নাম ছিল রামীর পদ। ঋগে¦দ-এ কয়েকজন নারী দার্শনিকের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে একজন লোপামুদ্রা। তিনি কৌষীতকি নামেও পরিচিত ছিলেন। ঋগে¦দে ২৭ জন নারী ঋষির রচিত সূক্তের উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাসে এসব উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সংখ্যাবিচারে বলা যেতে পারে যে, বস্তুত আধুনিক যুগে এসেই নারীরা শিল্প-সাহিত্যে ধীর লয়ে প্রবেশ করার সুযোগ গ্রহণ করে, যখন শিল্প-সাহিত্যে নারীর ভাষা, ভাষ্য ও দৃষ্টিকোণ নির্মাণের বিবরণ পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষায় প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। তাঁর রচিত রামায়ণে তিনি রামের পুরুষালি বাহুবলের পরিবর্তে সীতার বঞ্চনা ও পীড়নের বর্ণনাকে মাহাত্ম্য দিয়েছেন। বলা যায়, নারীকবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যে নারীর ভাষা, ভাষ্য এবং দৃষ্টিকোণ নির্মাণের সূচনা করেন। নারী লেখক রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম মনোত্তমা। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৭ সালে নবপ্রবন্ধ পত্রিকায়। তবে এ উপন্যাসের লেখকের কোনো নাম জানা যায়নি। লেখক-নামের স্থলে কেবল লেখা ছিল ‘হিন্দুকুল-কামিনী প্রণীত’। আবার বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের নাম ছিল রূপজালাল। ওই বছরই ঠাকুর পরিবারের মেয়ে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী লেখেন উপন্যাস, ‘দীপ নির্বাণ’। এ ছাড়া পৃথিবীর প্রথম নারী ঔপন্যাসিক বলা হয়, জাপানি লেখিকা মুরাসাকি শিকিবুকে। তাঁর উপন্যাসের নাম গেঞ্জি, যার ইংরেজি অনুবাদ দ্য টেল অব গেঞ্জি। বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম গদ্যরচনার কৃতিত্ব হলো তাহেরুন্নেসার। ১৮৬৫ সালে ‘বামাগণের রচনা’ নামে বামাবোধিনী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর গদ্য। বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম ঔপন্যাসিক হলেন এস এফ খাতুন। ১৯২১ সালে লেখা তাঁর উপন্যাসের নাম জোবেদা।
নারী শিল্পী ও লেখকদের শিল্প ও সাহিত্য রচনার কাজে নিয়োজিত হওয়ার পথ কখনো মসৃণ ছিল না—এখনো নেই। অন্যদিকে নারী অথবা পুরুষ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের দ্বারা নারীর সামাজিক সমস্যাগুলো চিত্রিত করার কাজেও বিস্তর বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এ সকল পরিস্থিতিতে নারীদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যে আধুনিক নারীর সংগ্রামের ভাষ্য ও রূপরেখা নিয়ে নানা মতভেদও দেখা যায়। প্রশ্ন উঠেছে, এসব মতভেদ শিল্প-সাহিত্যে নারীর অবস্থান সৃষ্টিতে নারী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কি-না? তবে আমরা মনে করি, মতভেদ থাকবেই এবং এসব মতভেদ দ্বান্দ্বিক নিয়মেই দূরীভূত হয়ে একটি নতুন স্তরে উন্নীত হতে পারে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, শিল্প ও সাহিত্যে নারীর সরব উপস্থিতি কামনা করে। অনুপ্রাণন আশা করে, শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যম দিয়ে নারীর ভাষা, ভাষ্য এবং দৃষ্টিকোণ ক্রমেই সমাজে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার কাজে যেন অগ্রসর হতে পারে।
১০ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন– নবম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভূমিকা
শিল্প ও সাহিত্য কীভাবে মানুষের চেতনায় মানবিক মূল্যবোধের প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই আসতে পারে। তাহলে, এটা কি একটি সমস্যা? একই স্থানে, একই সময়ে, একই বিষয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত আসলে আমাদের বোধের জগতে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে কি-না? এর উত্তর অবশ্যই না। কেননা শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন মানবিক মূল্যবোধের বিষয় নিয়ে নিরীক্ষা করতে পারে। কোনো একক দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে অটল বিশ্বাস উল্টো চেতনার জগতে গোঁড়ামির বীজ বপন করার প্রবণতার জন্ম দিতে পারে।
অর্থাৎ, মানবিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের উৎস এবং অভিব্যক্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো সুত্র বা সংজ্ঞা নির্বাচন করা হয়তো সংকীর্ণতার দিকেই ঠেলে দিতে পারে। আমরা যেমন মানবিক সমাজ চাই, সাথে সাথে আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুত্ববাদী সমাজ চাই। সমাজে যদি মুক্তমত ও ভিন্নমতের চর্চা বা অনুসরণ করার সুযোগ রহিত থাকে তবে মুক্তমনা ও মানবিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের চর্চা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী হতে দেখা যেতে পারে। তবে মুক্তমত অর্থে অতিশয়োক্তি আমরা দেখতে চাই না। আমরা চাইবো না সমাজের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ এবং অশান্তি সৃষ্টি করে–এরকম মানবতাবিরোধী শিল্প-সাহিত্য অথবা সঙ্গীতের চর্চা অবারিত হোক। শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃষ্টির সৃজনশীল প্রেরণা ভিন্নতর কোণ থেকে উৎসারিত হলেও লক্ষ্য একটাই হওয়া বাঞ্ছনীয় যেন সেসব সৃষ্টিশীল কাজের অভিব্যক্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মধ্যে উপস্থিত থাকে নান্দনিকতা; জাতি-উপজাতি-বর্ণ-সম্প্রদায় ও লিঙ্গ নির্বিশেষে বিস্তৃত হয় মানবিক সহমর্মিতা, প্রেম, সাম্য ও সমতা। মনে রাখতে হবে যে, ইহজগতে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক প্রথা-প্রচলন, বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কারণে বহুমাত্রিক শোষণ ও নিপীড়নের দুর্ভোগ নিয়ে জীবন যাপন করছে। যদি সৃজনশীল ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত এর লক্ষ্য হয় পশ্চাৎপদ প্রথা-প্রচলন, জাতি-উপজাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য এবং নানাবিধ কুসংস্কার এর হাত থেকে মুক্তির জন্য মানুষের চেতনা জাগ্রত করা, তবেই বলা যেতে পারে যে, সেসব সৃজনশীল ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত এর মানবিক মূল্য রয়েছে।
সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, কারুশিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প, স্থাপত্যকলা, এবং শিল্পের সকল মাধ্যমের মধ্য দিয়েই মানুষের রুচি ও সংস্কৃতির আত্মপরিচয়, উন্মেষ ও উপলব্ধি ঘটে–মানুষের চেতনায় তার স্বপ্নের জগতটি দানা বাঁধে ও বিকশিত হয়। সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য শিল্পের এই মাধ্যমগুলো একেবারে যেন মনের এক-একটি জানালা। এই জানালাগুলো ব্যবহার করে যেমন একটি সংস্কৃতির ইতিবাচক রূপান্তর সম্ভব, ঠিক সেরকম মনের এসব জানালা দিয়েই কলুষিত বাতাস প্রবেশ করে একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই কোনো শিল্পকর্মটি সমাজের ইতিবাচক মানবতাবাদী রূপান্তর এর পক্ষে, আর কোন শিল্প ও সাহিত্যকর্মে মানবিক সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান বিদ্যমান–এটা শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। সাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, কারুশিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প, স্থাপত্যকলা, এবং শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম দিয়ে যেসব কর্ম আমাদের জগতে প্রবেশ করছে–সেসব কর্মসমুহের প্রত্যেকটি কাজের নিবিড় ও যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যুক্তিসঙ্গত এবং বিশ্লেষণমূলক আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ করা তাই অত্যন্ত জরুরী একটা কাজ। পশ্চাৎপদ সমাজে এসব আলোচনা-সমালোচনা রচনা ও প্রকাশ করার কাজে বাধা আসতে পারে। কিন্তু, এই বাধা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলার প্রেরণা সৃজন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। সেজন্য কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিবৃন্দকে সমাজে ইতিবাচক রূপান্তর আনয়নের প্রয়োজনে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী হয়ে ওঠার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
কিন্তু, সমাজে এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে যে, সমাজ পরিবর্তনের কাজে প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে তো নয়ই এমনকি স্ব স্ব অবস্থান থেকেও প্রতিবাদী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কাজ না। শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এই অংশের মত হচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া রাজনৈতিক কর্মী অথবা সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজ। যেন শিল্পীর কাজ সুন্দরের অন্বেষণ করা, অন্তর্নিহিত সত্যের নয়।
আবার, কোনো কোনো কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিবৃন্দকে সমাজের ক্ষমতাধর অধিকর্তাদের তোষণেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই এসব শিল্পী ও সাহিত্যিকরা তাদের কাজে এসব চিহ্ন রেখে গেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প ও সাহিত্য বর্জন না করে শিল্পী ও সাহিত্যিক সমাজের একটি অংশকে নান্দনিকতার দোহাই দিয়ে ঐসব শিল্পকর্মকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কিন্তু, সত্যি কি সমাজের পরিবর্তন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে এবং সেসব শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতকে কালজয়ী আসনে সমাসীন করার কাজে তারা কি সফলতা লাভ করতে পারে?
একটি সেনাবাহিনী উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত ঠোঁটে করেই ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। আবেগপূর্ণ নাট্যকলা, বাগ্মী বক্তৃতা অথবা অসাধারণ গান, ভাস্কর্য ও অভাবনীয় সৌধ নির্মাণ করে ধর্ম তাদের বাণী মানুষের মনে সঞ্চার ঘটায়। জাতিগত গোষ্ঠী–সঙ্গীত ও নৃত্যের মাঝে তাদের সাংস্কৃতিক শেকড় খুঁজে পায়। অসাধারণ স্থাপত্যশিল্প, যেমন: রোডস্ (জযড়ফবং) এ অবস্থিত সূর্য দেবতা হেলিওস এর অতিকায় মূর্তি, জাপানের একটি পীঠস্থানে ১০৩ টন ওজনের সর্ববৃহৎ বুদ্ধ-মূর্তি, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ইত্যাদি কোনো সম্প্রদায় বা জাতি’র আদর্শের প্রতীক হিসেবে মানুষের গভীরে প্রোথিত হতে থাকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, যখন একটি নতুন সম্প্রদায় অথবা জাতি-গোষ্ঠী পুরানো কোনো সম্প্রদায় অথবা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে তখন পুরানো শাসনব্যবস্থায় প্রচলিত নৃত্য ও সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাদের আদর্শিক গ্রন্থসমুহ পুড়িয়ে ফেলা হয়, মন্দির ও পীঠস্থানগুলো বিনষ্ট করা হয়, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকর্ম সমূহ মাটিতে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। আবার অন্যদিকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, শাসকের আমূল পরিবর্তনের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল রক্ষা পায় প্রেমের অভিব্যক্তি, স্থাপত্য ও মর্মর পাথরে নান্দনিক অলংকরণ শিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে। যদিও শাহজাহান নিজ সন্তানের হাতে বন্দী হয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টে নিজের শেষ জীবনটি অতিবাহিত করেন কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, অনেক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার মধ্যে দিয়েই তিনি শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। একটা সময় পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহান নিকৃষ্টতম কূটচাল আশ্রয় করে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়েই প্রজাদের শোষণ করে ও প্রতিপক্ষদের নৃশংসভাবে হত্যা অথবা দমন করে রাজ্যের বিস্তার ঘটান এবং রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। কথিত আছে যে বিশ হাজার শ্রমিক ও শিল্পী যারা তাজমহল নির্মাণ করেছিল তাদেরকে শুধু দাসের মতোই শোষণ করা হয়নি, একটি বড় অংশকে শিল্পের কলাকৌশলের গোপনীয়তা রক্ষা করার অজুহাতে সম্রাট শাহজাহান হত্যা করেছিলেন। অথচ শাহজাহান ও নুরজাহানের প্রেম বিবৃত করে অন্য ভাষায় তো বটেই এমনকি বাংলা ভাষায় গান ও কবিতা রচিত হয়েছে।
ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে শাসকশ্রেণি কর্তৃক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের উপর নানারূপ আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দেখা গেছে। ব্যতিক্রমী শিল্পী-সাহিত্যিকদের উপর নেমে এসেছে দমন ও নির্যাতনের স্টিম রোলার। আধুনিক কালে, হয়তো শিল্পকলার উপর সবচেয়ে নাটকীয় আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দেখা যায় নাৎসি, কট্টর কমিউনিস্ট এবং মৌলবাদী ও কট্টর এক শ্রেণির ইসলামপন্থীর শাসনে। হিটলারের জার্মানী, মাও সে তুং এর চীন, স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের শাসনের অধীনে যেসব শিল্প, সাহিত্য অথবা সঙ্গীত গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, সাধারণ শৈল্পিক সূত্রসমুহ অনুসরণ করে সেসব শিল্প, সাহিত্য অথবা সঙ্গীতকে নিষ্ফলা এবং বৈচিত্র্যহীন হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি সুনির্দিষ্ট মতবাদের প্রচার, প্রজ্ঞাপন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টার প্রভাবে শিল্পকর্মটি হয়ে ওঠে নিস্তেজ ও অনুজ্জ্বল। এইরূপ শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত মানুষের জন্য কথা না বলে, তাদের নির্দেশ করেই কথা বলে। যেখানে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পরিবর্তে রাষ্ট্রের আশা-আকাক্সক্ষার কথাই প্রকাশ ঘটেছে। মানুষের চেতনার বিশোধনের পরিবর্তে এসব শিল্প রচনার উদ্দেশ্য মানুষের আবেগ-অনুভূতি-ভাবনার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
যে কোনো কালে যখন কোনো কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতি তার কাজটি মুক্ত পরিবেশে সৃজন করে থাকেন অথবা যে কোনো সময় যখন বহির্জগতে প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও শিল্পীরা তারা নিজের অভ্যন্তরে বন্ধনহীন মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হতে পারেন, তাহলে সেই অবস্থায় প্রকাশিত শিল্পকর্মটি হয়তো মানবতাবাদী এবং উদারনৈতিক মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হতে পারে অথবা যে কোনো মানুষকে চেতনাগতভাবে মানবতাবাদী হয়ে ওঠার গভীর উদ্দীপনা এবং অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, তাহলে নান্দনিকতার কোনো সুনির্দিষ্ট মানবিক তত্ত্ব সাজিয়ে দেয়ার চেষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই। যথাযথ কোনো বিশদ বিবরণ-বিবৃতি, অভিব্যক্তি অথবা বার্তা প্রদানের চেষ্টা করারও কোনো প্রয়োজন নাই। আমাদের যেটা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে জাতি-উপজাতি-ধর্মীয় সম্প্রদায় ও লিঙ্গ নির্বিশেষে একটি স্বাধীন, সহমর্মী, মানবতাবাদী ও বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করার জন্য সৎ ও আন্তরিকভাবে সকল মানুষের মনে সুগভীর অনুপ্রেরণা বিস্তার করা। এই কাজটি একটি সৃজনশীল কাজ এবং কোনো বাধাহীন সহজ-সরল পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগও সীমিত। কিন্তু এর কোনো বিকল্প আছে বলে আমার ধারণায় আসে না। তবে এটা বুঝি যে, এই অনুপ্রেরণা হৃদয়ে প্রোথিত হলে–কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিরা নিজেদের স্বাভাবিক কাজের মধ্যেই যে শিল্প সৃজন করবেন কি-না, সেটাই মানবিক বোধ ধারণ করবে এবং একজন মানবতাবাদীর কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠবে।
পরিশেষে এটা বুঝে নিতে হবে যে, ইতিহাসের অধ্যায়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সত্যেরও পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু সুন্দর তার রূপ পরিবর্তন করলেও বোধ এবং অনুভূতিতে সুন্দরের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই, সত্যের মধ্যে সুন্দর এর অনুসন্ধান অনেক সময় বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান ও প্রতিষ্ঠা করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। কেননা কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিরা মিলিতভাবে শিল্পের সকল কর্মীরা চিন্তা-চেতনা, আবেগ ও অনুভূতিতে আমাদের সমাজের অগ্রসর অংশেরই প্রতিনিধি।
উদার পুঁজিবাদ ও মুক্ত বাজার, মানুষের মূল্যবোধের জমিনটিতে পচন ঘটিয়ে চলেছে। মাটিতে যখন পচন ঘটে তখন আর কোনো কিছুই নির্মল থাকতে পারে না। মানুষ কষ্টে আছে। তাই, অবশ্যই সমাজের অগ্রসর অংশটির সামনে পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে নান্দনিক অথচ সত্য শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃজনের একটি মহান দায়িত্ব এসে পড়েছে। অনুপ্রাণন এই দায়িত্বের স্থানটিকে মজবুত করে গড়ে তোলার কাজে অবিরাম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে চাই।
নবম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
হায়াসিন্থ হাউজ
হাতেগোনা যে-ক’জন লেখক অণুগল্পের ভিত্তি গাড়তে কিংবা প্রচার প্রসার করার মাধ্যমে প্রথম দশকেই একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন কিংবা বলা যায়, অণুগল্পের বিভিন্ন ধরন এবং ধারণায় সাহিত্যের এ-মাধ্যমটি বর্তমানে বহুচর্চার ফল্গুধারায় দুইবাংলার পার ছাপিয়ে গেছে বটে, আশার কথা হচ্ছে, কামরুজ্জামান কাজল বিশুদ্ধ অণুগল্পের ধারক-বাহক হয়েই পাঠকমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্ববর্তী ৩টি গ্রন্থে আমরা তা-ই দেখেছি। আর এখানেই প্রকৃত অণুগল্প আর কাজল সমার্থক হয়ে উঠেছেন।
‘জোড়া নারিকেল বাড়ি’ লেখকের চতুর্থ অণুগল্পের বই। বইটির সাফল্য কামনা করি।
-বিলাল হোসেন
জোড়া নারিকেল বাড়ি
ভূমিকা
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদল চিকিৎসার জন্যে কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের ভেলোর শহরে গিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন তার আজীবন সহযাত্রী, সহযোদ্ধা আমাদের প্রিয় সুলতানা ভাবী। বাদল ভাই ভাবীর সাথে নানান জায়গার ছবি তুলছেন আর তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা লিখে পোস্ট দিচ্ছেন। আমিও মজা করে কমেন্ট করে যাচ্ছি সেইসব পোস্টে। প্রথমদিকে সাদামাটা পোস্ট ভেবেই গভীরে তেমন ঢোকার চেষ্টা করিনি। কিন্তু সময় যতোই যেতে থাকে পোস্টগুলো আমাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে। একসময়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাদল ভাইয়ের ভ্রমণবৃত্তান্তের অপেক্ষায় থাকি, কখন তিনি পোস্ট দিবেন, কখন সেই আখ্যানগুলো পড়বো। অবস্থা যখন এমন পর্যায়ে একদিন বলেই ফেললাম যে লেখাগুলোকে মলাটবদ্ধ করলে একটি ভালো বই হতে পারে। উপযাচক হয়ে এটাও বললাম যে যদি কখনো লেখাগুলো মলাটবদ্ধ হয় আমিই লিখবো এর মুখবন্ধ।
বলেতো দিয়েছি কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে এই গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপবে! সেদিন হঠাৎই বাদল ভাইয়ের ফোন, ‘কমরেড, ভারতে কয়েকদিন নামের বইটি আসছে আগামী বইমেলায়। ভূমিকা কিন্তু আপনাকেই লিখতে হবে।’ আমিতো সপ্তম আসমান থেকে পড়লাম একেবারে জমিতে।
যাইহোক, সচরাচর ভ্রমণকাহিনী বলতে আমরা যা বুঝি আনোয়ার হোসেন বাদল এর ‘ভারতে কয়েকদিন’ সে অর্থে কিন্তু কোনো ভ্রমণকাহিনী নয়। বরং এটি হচ্ছে সাদা চোখে দেখা সাদামাটা অভিজ্ঞতার এক নির্মোহ বিবরণ, কিছু জানা কথা, কিছু অজানা তথ্যের প্রকাশ।
বইটি এমন সহজ-সরল ভাষায় লিখিত যে—পড়ার সময় মনে হতে পারে পাঠক বই পড়ছেন না বরং লেখকের সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভারতের নানান শহর। নিজের চোখেই পাঠক দেখছেন ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থাপনা আর বিচিত্র প্রকৃতি।
আলোচ্য বইটিতে পাঠকের পরিচয় ঘটবে ভারতের ঐতিহাসিক শহর কোলকাতা, তৃতীয় বৃহত্তম শহর দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই আর ভেলোরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্পসংস্কৃতি ও স্থাপত্যকর্মের সাথে।
বইটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমরকীর্তি হিসেবে স্বীকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
কবি হানিফ মোহাম্মদ
তালেপুর, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।
ভারতে কয়েকদিন
লেখকের কথা
প্রতিটি মানুষের জীবনেই রয়েছে অজস্র গল্প। গল্প ছাড়া মানুষের জীবন হতেই পারে না! আর সেইসব গল্প বাস্তবতার- আদৌ কল্পনার নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। গল্পগুলো সেই সম্পর্কজাত। যা জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। যারা লিখতে পারেন তারা চেষ্টা করেন সেইসব জীবনস্মৃতির গল্পগুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরতে লেখনীর মাধ্যমে। আর যারা লেখায় অভ্যস্ত নন, তারা নিভৃতে মনের ভেতরে সেসব লালন করেন এবং সময়-সুযোগ পেলে অন্যকে বলেন। অনেক লেখক আছেন যারা বিভিন্ন সময় নানা চরিত্রের মানুষের কাছ থেকে তাদের জীবনে অর্জিত অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার গল্প, দুঃখ-বেদনার গল্প, হাসি-খুশির ঘটনা, বিয়োগান্তক কাহিনী ইত্যাদি শুনে উপন্যাস বা গল্পে রূপ দেন।
সাধারণ মানুষ বলি আর বিশিষ্টজন বলি; লেখক বলি আর শিল্পী বলি- তাদের জীবনের গল্পগুলো সাধারণ গল্প নয় বলেই গণমাধ্যমে বা পাঠ্যপুস্তকে সেগুলো প্রকাশিত হয়ে থাকে। শিক্ষামূলক গল্পের যেমন শেষ নেই তেমনি প্রেম-ভালোবাসা, ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, বিচ্ছেদ, লড়াইমুখর গল্পেরও সীমা-পরিসীমা নেই। সেসব জীবনস্মৃতির গল্প পড়ে আমরা বিচিত্র চরিত্র, চিন্তা ও মন মানসিকতার মানুষকে চিনতে, জানতে পারি। এর মধ্যে অনেক গল্পই আছে সাহিত্যরসে টইটুম্বুর- রোমান্টিক, ভাবনার উদ্রেককারী এবং শিক্ষামূলক।
গল্প সাধারণত দুধরনের বলা যায়, এক হচ্ছে, বানানো গল্প বা কল্পলোকের গল্প। দুই হচ্ছে, জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তব গল্প। বানানো গল্পগুলোর চেয়ে জীবনস্মৃতির গল্পগুলো বেশি নাড়া দেয় মানুষ তথা পাঠককে। কারণ সেইসব গল্প অনেক মানুষের জীবনের গল্প। বানানো গল্প যেভাবে সুন্দর ভাষা ও অলঙ্কারে আদর্শ চিত্রকলার মতো করে প্রকাশ করা হয়, জীবনস্মৃতির বাস্তব গল্পগুলো সেই রঙে আঁকা সম্ভব হয় না। এতে করে গল্পের প্রাণ হারিয়ে যায়, সংবেদনশীলতা শীতল হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় আকর্ষণও। বানানো গল্প মনে থাকে না, যদি না তাতে বাস্তবতার নোনাজলের ধারা প্রবাহবান থাকে।
মানুষ হিসেবে আমিও ব্যতিক্রম নই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার এই ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে বহু ঘটনার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, অর্জিত হয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা। কত চরিত্রের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছে তার হিসেব নেই। সেইসব ঘটনা অমূল্য স্মৃতি এবং অকাট্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক এতই অম্ল-মধুর যে, পড়ন্ত বেলায় এসে যতই ভাবি ততই নিজেকে ফিরে ফিরে দেখার সাধ জাগে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিষণ হই। জীবনস্মৃতির সেইসব অজানা গল্পগুলোই পড়ে অনেকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেন। যুগ যুগ ধরে এটাই সাহিত্যে চলে আসছে। এভাবে কালজয়ী, রসোত্তীর্ণ গল্পও আমরা অনেক পেয়েছি। ভবিষ্যতেও পাব।
জীবনস্মৃতির এই গল্পগুলো ‘সম্পর্ক’ শিরোনামে একটি গল্পসংকলনে পত্রস্থ করে স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ‘অনুপ্রাণন প্রকাশন’ ঢাকা প্রকাশ করে আমাকে চিরঋণী করেছেন। আশা করি গল্পগুলো পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেবে।
‘অনুপ্রাণন’কে জানাই অন্তঃস্থল থেকে অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
প্রবীর বিকাশ সরকার, টোকিও.জাপান, ৭, অক্টোবর, ২০১৭
জীবনস্মৃতির গল্প সম্পর্ক
লেখক পরিচিতি :
মারুফ রায়হান। জন্ম করাচিতে। পৈতৃক নিবাস খুলনার ফুলতলায়। আশির দশকের প্রথমার্ধে ছাত্রাবস্থায় নাট্যান্দোলন, লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন, সেই শুরু। প্রধানত কবিতাই লিখেন। এ পর্যন্ত ১৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া গুণীজনদের নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই। সাক্ষাৎকার মূলক বই আছে দু’টি। প্রবন্ধের বই আছে তিনটি।
হৃদয় ও রাজপথ
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে লেখকের নাম হাসান মাহবুব। তিনি নাড়–গোপাল দত্ত অথবা ইসমাইল আহমেদ নন। তিনি রবীন্দ্রনাথ বা আগাথা ক্রিস্টি নন। তিনি দূর আকাশের নীল নক্ষত্র, ধোঁয়া ওঠা কফির মগ, বাজারে মেয়েটির অপরিচ্ছন্ন অন্তর্বাস, ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল বাঁশি অথবা লোম কাটার মওসুমের ভেড়ার দীর্ঘশ্বাসও নন। তিনি লেখেন। তবে ‘তিনি’ই লেখেন কি-না এই নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ লেখার মতো পরিশ্রমের কাজে বছরের পর বছর এত শ্রম দিয়েছেন, দুটো বইও বের করেছেন (প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত এবং আনন্দভ্রম) তার সাথে এসব ঠিক যায় না। এত সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি হাসান মাহবুব হবার চেষ্টা করছেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে আরো একটি বই প্রকাশ করে ফেললেন। তিনি সকলের দোয়া প্রার্থী!
নরকের রাজপুত্র
বাজে অন্তহীন দ্রিমি
ভেসে বেড়াই…
বুকের ভেতরে দ্রিমি দ্রিমি বেজে ওঠে
নিজের বুকে কান লাগিয়ে শুনি সেই শব্দ
কেমন ঘোর, নেশা লাগে!
একটা অসহ্য ভালোবাসার ঘ্রাণ পাই
মানুষ যার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে মরছে
সেই ভালোবাসা…আহা
তার বর্ণিল শব্দ- ঘ্রাণে ঘূর্ণি খেয়ে খেয়ে
মহাকাশ সমান আনন্দে ঘুর-পাক খাই
যাই, অনন্ত অভিযাত্রায়
কবিতার রূপ ধরে প্রেম নামছে পৃথিবীতে
কসমিক খেলা মেতে উঠেছে
সৌরবিভা বসেছে তাকে কেন্দ্র করে
দেখো, কীভাবে বিষণ্ন-প্রচণ্ডতা জেগে ওঠে !
উজ্জ্বল হাসি হয়ে ছায়াপথে ঘুরে বেড়াই
বেজে যায় অন্তহীন দ্রিমি…
বাজে অন্তহীন দ্রিমি
শীতের বিকেলে পিঠে রোদ লাগিয়ে আরাম করে শুয়ে ছিল হাতি। পাশের এক মাটির ঢিবি থেকে পিনপন নামের পিঁপড়েটি পিল পিল করে হাতির সামনে এসে বলে, কথা দিয়েছিলে চাঁদ দেখাবে। কই ডাকলে না তো। বিকেলের নরম রোদে আরামে চোখ বুজে এসেছিল হাতির, পিঁপড়ের গলা পেয়ে চোখ পিটপিট করে বলে, বলেছি যখন তখন দেখাব। আজ রাতেই দেখাব।
রাতে কেন এখনই দেখাও না।
আরে চাঁদ তো রাতে দেখা যায়। এই বনের সবাই যখন ঘুমায়, তখন চাঁদ চুপিচুপি আকাশের গায়ে ওঠে।
হাতির কথা মতো রাতে চাঁদ দেখতে হাজির হয় পিঁপড়েটি। হাতি বলে, কী দেখ? পিনপন বলে, লাঠির মতো কিছু একটা, আবার আমগাছের মতোও মনে হয়। দাঁড়াও একটু চড়ে আসি, দেখি কোনো বাসাটাসা বানানো যায় কি না। পিঁপড়েটি হাতির পা বেয়ে ওপরে উঠে যায়।
হাতি বলে, পেলে কিছু?
অনেক কিছু কিছুমিছু?
হাতি ভাবে মহা মুশকিলে পড়া গেল তো! এই পিঁপড়েটাকে নিয়ে চাঁদ দেখার আয়োজন করাটাই ভুল হয়েছে, তবু কথা যখন দিয়েছি, তা তো রাখতেই হবে। পিঁপড়ে বলে, বেশ মজা হচ্ছে, এখানেই বাসা বানাব ভাবছি।
নেমে এসো বলছি। আমার কেমন সুড়সুড়ি লাগছে।
চাঁদে আমি ঘর বানাব শুনে তোমার কি না সুড়সুড়ি লাগে, হে হে ভারি মজা তো!
আরে ওটা চাঁদ নয়, ওটা আমার … উঁ উঁ বলে চিৎকার করে ওঠে হাতিটি। পিঁপড়ে বলে, চাঁদে বেশ মজা চিমটিও কাটা যায়। দেখবে এসো।
আরে ওটা চাঁদ নয় ওটা আমার পা।
তোমার পা! হেহে এখন বলবে তো চাঁদের তোমার পা পড়েছে। মনের দুঃখে হাতি এবার বসে পড়ল।
…………………………………………………
…………………………………………………
…………………………………………………
হাতি ও পিঁপড়ের চাঁদ দেখা
মির্জা মুজাহিদ। পেশাগতভাবে বিজ্ঞাপন শিল্পের সাথে জড়িত। জন্মেছেন নড়াইল শহরে। এখন ঢাকায় থাকেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিয়মিত ‘কথা’র শিল্পী হতে।
বিপ্রতীপ
শঙ্করী দাস
জন্ম: ০৫ মে, ১৯৫৮ সন, জামালপুর।
প্রকাশিত গ্রন্থ গল্প:
প্রতিবিম্ব ও অন্যান্য গল্প
জলমাটির গল্প
পায়ের চিহ্ন
রাহুর চন্দ্রগ্রাস
প্রকাশিত গ্রন্থ কবিতা:
ঘাসবোনা গ্রাম তাঁতবোনা গ্রাম
বিহান বেলার ঈশ্বর
বল তোমার কুশল শুনি
গবেষণামূলক:
গণমানুষের স্মৃতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ
সম্মাননা:
জলমাটির গল্পের জন্য পাক্ষিক ঐকতান (বর্ধমান) পত্রিকা পদক। শিশুকবি রকি সাহিত্য পুরস্কার ও নক্ষত্র সাহিত্য পুরস্কার।
শঙ্করী দাসের ষোলটি গল্প
ছবি ও চেনাগন্ধের মেটাফর
ভূমিকা
অনেকগুলি গল্প কবিতা ও দু’একটি উপন্যাস লিখে ফেলার পর হঠাৎ মনে হলোÑ ছোটদের জন্য তো কিছু লেখা হয়নি! তখন মনে পড়লো আমার ছোটবেলায় গ্রামীণ আবহে শোনা গল্পগুলির কথা। যার ফলশ্রুতিতে এ বইটির সৃষ্টি। ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ বইখানি যদি ছোটদের একটু আনন্দ দিতে পারে তবে নিজেও আনন্দিত হবো। এ গ্রন্থ সৃষ্টি হওয়ার মূলে যে গল্পগুলি তার জন্য যাঁদের কাছে আমি ঋণী তাঁদের নাম করতে গেলে প্রথমেই আমার মেজো’পা (মিলা’পা), কাজিন সেতন আপা ও বিন্দুবাসিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক বীথি আপার নাম করতে হয়। তাদের কাছে শোনা গল্পগুলি আমার মনন গঠনে সাহায্য করেছে।
এ বইয়ের পা-ুলিপি তৈরীতে যিনি সর্বোতভাবে সাহায্য করেছেন তিনি আমার প্রেরণাগুরু প্রয়াত সাংবাদিক জনাব ফরহাদ খাঁ। তাঁর ইচ্ছা ছিল পা-ুলিপিখানির সর্বশেষ ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন, পরিমার্জন ও সম্পাদনা করবেন। কিন্তু ঘাতকের নিষ্ঠুরতায় তাঁকে অসময়ে চলে যেতে হলো বলে সে আশা পূর্ণ হলো না। তাই শেষ কাজটুকু আমার ছোট ছেলে অর্ণব হাসনাতকে দিয়ে করাতে হলো। আমার এ বইটি সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার বড় ছেলে সুবর্ণ আহসান আমাকে সর্বপ্রকারে উদ্দীপনা জুগিয়েছে এবং সাহায্য সহযোগিতা করেছে। সাংবাদিক ফরহাদ খাঁর পর যে দুই ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করতে হয় তার একজন হলেন চাকরিক্ষেত্রে আমার একসময়ের বস জনাব শামসূয জাহান নূর ও অন্যজন সাংবাদিক ভাই ও বন্ধু কাজী সালাহ উদ্দীন আহমেদ। এ ছাড়া আমার লেখকবন্ধু মহিউদ্দীন আকবর এ বইয়ের গল্পগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছেপে ও বিভিন্নভাবে আমাকে উৎসাহ উদ্দীপনা জুগিয়েছেন।
উপরোল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। গল্পগ্রন্থটির ভুলত্রুটি ও ভালমন্দ পাঠক সুধীজন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে মন্তব্য জানালে বাধিত হবো।
লেখক।
সোনার নাও পবনের বৈঠা
শৈশব থেকেই খুব প্রাণচঞ্চল ও প্রাণবন্ত একজন উদার-উদাসী মানুষ; সদা হাস্যোজ্জ্বল এক প্রিয় মুখ। ভাববাদী দর্শনে বিশ্বাসী এই মানুষটির ভিতরে বাস করে এক শিশুহৃদয়। কবি মুহাম্মদ মঈনুল হাসান সরল আত্মমগ্নতার এক বিমুগ্ধ প্রতিচ্ছবি। ঐন্দ্রজালিক শব্দবিন্যাসে জীবন-উপলব্ধির আনন্দ-বেদনা, কোমল অনুভূতি আর ঘন কুয়াশার ছবি এঁকেছেন তাঁর সরল ব্যঞ্জনার কবিতায়। প্রেম ভালোবাসা প্রকৃতি দেশাত্মবোধ ও ঐতিহ্যের সৌন্দর্য অনুধাবনে নস্টালজিক ভাবাবেগে তাড়িত।
স্বভাবজাত কবি তাঁর কবিতায় সহজ-সরল ভাষায় প্রেম ভালোবাসা প্রকৃতি সংসারের বন্দনাগীত গেয়েছেন। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি; যেখানে মেঘালয়ের পাদদেশ ছুঁয়ে ছুটে চলে ঝরনাপ্রবাহে সোমেশ্বরীর জল নিরবধি। এই মানবজীবন পূর্ণতা-অপূর্ণতার এক বহমান নদী। একাকিত্ব-নিঃসঙ্গতা, দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশাকে বন্দি করেছেন তাঁর বুকের নীল পাঁজরে; যা বারবার দোল খেতে থাকে মনের গভীর প্রকোষ্ঠে। কবিতা শ্বাসমূল ছুঁয়ে বেরিয়ে আসা এক তপ্ত বুদবুদ; এই বুদবুদের সম্মিলিত শক্তিই আজকের ‘দ্বীপ জ্বলে কুয়াশায়’। শব্দযানে চড়ে অলীক ভেলায় ভেসে বেড়ানোর ভালোলাগা থেকেই অনুপ্রাণন প্রকাশনের হাত ধরে প্রকাশিত হচ্ছে এই কবিতাগ্রন্থ।
কবিতায় প্রকাশিত হয় আমাদের চিত্তলোকের লুকায়িত চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও ভাবের কথামালা, অন্তর্লোকে উজ্জ¦ল হতে থাকে শব্দের কল্পচিত্র; মনের গহীনে অঙ্কিত হতে থাকে প্রিয় বর্ণমালার মানচিত্র। কবিতায়-কবিতায় আলাদা সুর, ঢেউ ও ঝঙ্কার তুলে। সারা পৃথিবীতে কবিতার তীর্থস্থান আমাদের এই সোনার বাংলা। এরই ধারাবাহিকতায় কবি মুহাম্মদ মঈনুল হাসান ধীরে-ধীরে হয়ে উঠবেন বাংলা কবিতার উত্তরাধিকার। কবি’র জন্য রইলো আমার আন্তরিক অভিনন্দন, শুভকামনা ও ভালোবাসা।
কবি মাহবুব মিত্র
১৬ অক্টোবর ২০১৯, মিরপুর, ঢাকা।
দ্বীপ জ্বলে কুয়াশায়
‘বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা’ দ্বিতীয় দশকের কবি বিষাদ আব্দুল্লাহ’র প্রথম কবিতাবই। চর্চার শুরু থেকেই নিভৃতচারি হিসেবে চলতি দশকের শেষ সময়ে এসে তাঁর বই প্রকাশ হলো। প্রচারের মোহে ভেসে যায় নি বিষাদ বরং হৃদয়ে বারুদ মেখে বুক ঘষে ঘষে নিজেকে তৈরি করেছেন। এই সময়ে সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন আর রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠতে পারা এত সহজ না। করপোরেট পৃথিবী যেখানে নিয়ত রঙিন হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সেই রঙিন পৃথিবী থেকে নিজেকে নিভৃত করাও কঠিন। যে সময়ে প্রেমিকা কবিতা লেখার কারণে টেলিভিশনে দেখে না বলে অভিযোগ করে, পত্রিকার পাতায় বড়-বড় ছবি দেখে না বলে কবিকে নিয়ে হেয়ালি করে, সেই সময়ে নিজেকে এসব দেখানোর বারোবাজি থেকে দূরে রাখা অত্যন্ত দুরূহ। অন্তত প্রেমিকার দাবি মেটাতে গেলেও। বিশেষ করে প্রেমিকার আবদার, সমাজকে দেখানোর বিষয় থেকে বিষাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যার কারণে তথাকথিত দ্বিতীয় দশকের সংকলনগুলোতেও তার কবিতা নেই। কবিতা লেখা সহজ কোন বিষয় নয়, জীবনের দর্শনকে ধারণ করে চিন্তার জগত তৈরি করাও অত মসৃণ নয়। জগতের সবচে কঠিন কাজের একটি। সেই কর্মের দায়ভাগ শুধু কবিতা চর্চাকারী তরুণের একার নয়, দেশেরও। সেই দায়িত্ব দেশকেও নিতে হবে, সুকুমার সৌন্দর্য লালন করতে হবে। শিল্পের জন্য শিল্প, না মানুষের জন্য শিল্প এই বুজরুকি প্রতারণাও শেষ করে দিতে হবে। মানুষের জন্য শিল্পই হোক শিল্পীর অভিস্পা। সেই শিল্প করেও কবিতাকে শিল্পের শর্তে নির্মাণ করা যায়। সুতরাং মানবিক দায় এড়াতে যারা শিল্পের জন্য শিল্প বলে জগতকে ধোঁকা দিতে চায় তাদের কথা আমরা বলবো না। লড়াই দরকার, বিপ্লব প্রয়োজন। ‘বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা’ হোক সেই বিপ্লবের মন্ত্র। মধ্যবিত্ত তারুণ্যকে আঘাত করে এ লড়াই চলবে…
বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.