Description
সম্পাদকীয়-
অনুপ্রাণন ও অণুগল্প
সাম্প্রতিককালে অণুগল্প লেখা, চর্চা, প্রকাশ এবং পাশাপাশি বাঙলা সাহিত্যের চমকপ্রদ ও সময়োপযোগী এই শাখাটির প্রচার ও প্রসারে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুপ্রাণনের যে একটি বিশেষ প্রচেষ্টা আছে সেটা লেখকদের একটি বড় অংশ অবগত রয়েছেন। শুধু অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকে নয়, অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকেও অণুগল্প বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বই এবং অণুগল্প সংকলন গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থ বিপণনের ক্ষেত্রেও অনুপ্রাণন বিশেষ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। বাঙলা সাহিত্যের কথাসাহিত্য বিভাগে ছোট গল্প, বড় গল্প ও উপন্যাসের চর্চা যতটুকু প্রসারিত, অন্যদিকে অণুগল্পের লেখক ও গ্রন্থের সংখ্যা বর্তমানে সেই তুলনায় অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিস্তার ঘটায় এই শাখাটি সময়োপযোগী এবং প্রযুক্তিবান্ধব একটি ফর্ম হওয়ার কারণেই অণুগল্প, ছোট-ছোট গল্প, ক্ষুদ্র-গল্প ইত্যাদি রচনাসমূহ বাঙলা সাহিত্যে প্রসারিত হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বলা যেতে পারে যে, আদিকাল থেকেই নানা আঙ্গিকে ছোট-ছোট গল্প বা ইংরেজিতে যা কি-না ফ্ল্যাশ ফিকশন বলে পরিচিত, এসব রচনা ইংরেজিতে অথবা বাঙলায় অনূদিত হয়ে অথবা মৌলিকভাবেই লেখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ যেমন- উপকথা, নীতিকথা, উপদেশপূর্ণ ছোট-ছোট গল্প, ঈশপের গল্পসমূহ, পঞ্চতন্ত্র, জাতকের ক্ষুদে-গল্প, নাসিরুদ্দিন শাহের ক্ষুদে-গল্পসমূহ, জেন দর্শনশাস্ত্রের ক্ষুদে-গল্প ও কথাসমূহ অথবা গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলো ছোট-ছোট গল্প শ্রেণিতেই অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি। এরপর ঊনিশ শতকে কোনো কোনো মার্কিন কথাসাহিত্যিক বড় গল্প, উপন্যাস, ছোট-গল্পের পাশাপাশি কিছু কিছু ছোট-ছোট গল্প বা ফ্ল্যাশ ফিকশন লিখেছেন বলে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীতেও কোনো কোনো কথাসাহিত্যিক ছোট-ছোট গল্প বা ফ্ল্যাশ-ফিকশনের চর্চা করেছেন যাদের মধ্যে সমারসেট মম অন্যতম।
১৯৮০ সাল থেকে ইংরেজি ভাষায় ছোট-ছোট গল্প লেখা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। বলতে গেলে সেটা সময়ের সাথেই জনপ্রিয় হতে থাকে ই-জিন, ওয়েব-জিন এবং অন্তর্জালে বিভিন্ন গ্রুপ, ফোরাম এবং ব্লগের প্রসারের পথ ধরে। কেননা ছোট-ছোট গল্পের শব্দ-সংখ্যা স্বল্প হওয়ার কারণেই রচনাগুলো ই-মেইল, সেলফোনে ক্ষুদেবার্তা, ইত্যাদি মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অনুকূল সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, ইংরেজি সাহিত্যে যেটাকে ছোট-ছোট গল্প বলছে অথবা বাঙলা সাহিত্যে যেটাকে অণুগল্প বলা হচ্ছে সেটা হয়ে ওঠার ব্যাপারে দৈর্ঘ্য ছোট হওয়াটা প্রধান মাপকাঠি নয়। প্রথম কথা হচ্ছে, অণুগল্প প্রধানত একটি ছোট অথবা একটি বড় গল্পের অণু অর্থাৎ সেটা ছোট কিন্তু তার মধ্যে একটি ছোট গল্প অথবা একটি বড় গল্পের সব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে। এ-কারণেই অণুগল্পের মধ্যে আমরা পাই কাহিনীর দীর্ঘতার পরিবর্তে বোধের গভীরতা, দৃষ্টির স্বচ্ছতা এবং মানবিক দ্যোতনা- যেখানে রয়েছে বাস্তব জীবনের বাস্তব ঘটনার স্বচ্ছ, সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিফলন।
ছোটগল্প সম্পর্কে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বাংলাপিডিয়ায় লেখা হয়েছে যে- ছোটগল্পের কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: এর ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত থাকবে, এর আরম্ভ ও উপসংহার হবে নাটকীয়, এর বিষয়বস্তু সাধারণত স্থান, কাল ও ঘটনার ঐক্য মেনে চলবে, এতে মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, যে কোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন, এতে থাকবে রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত ইত্যাদি। সর্বোপরি গল্পসমাপ্তির পরেও পাঠকের মনের মধ্যে এর গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। তাহলেই তা সার্থক ছোটগল্পে পরিণত হবে।
বাঙলা সাহিত্যের আদিতে ঈশপের গল্প, নীতিকথা, উপকথা, বিভিন্ন শাস্ত্রের ছোট-ছোট রচনা অথবা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন কথাসাহিত্যিকদের বড়-গল্প ও ছোটগল্পের পাশাপাশি ছোট-ছোট গল্প চর্চার ইতিহাস দীর্ঘ হলেও সেগুলো ছোট-ছোট গল্প, নীতিকথা অথবা উপকথা হিসেবেই নামকরণ করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় কোনো ছোট-ছোট গল্পকে বিশেষ করে অণুগল্প হিসেবে নামকরণের ইতিহাস খুব পুরোনো না। সে কারণে আজ পর্যন্ত অণুগল্পের কোনো প্রমিত সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। কেননা এরূপ সংজ্ঞা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাহলে ইংরেজি সাহিত্যে ছোট-ছোট গল্প অথবা মাইক্রোফিকশন সম্পর্কে যেসব সূত্র অথবা সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে তার সাথেই কী অণুগল্পের সংজ্ঞাটিকে মিলিয়ে নিতে হবে? আমার প্রশ্নটা এখানেই। আসলে অণুগল্প কোনটাকে বলবো? ছোটগল্প অথবা ছোট-ছোট গল্পের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের সাথে অণুগল্পের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আদতে কী কোনো পার্থক্য নেই অথবা আছে? এই ব্যাপারে যারা অণুগল্পের চর্চা করছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি যেটা দেখি যে, শব্দ সংখ্যা স্বল্প হওয়া ছাড়া অণুগল্প ও ছোটগল্পের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তবে লক্ষণীয় যে অণুগল্পের স্বল্প পরিসরে ছোটগল্প অথবা ছোট-ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে গিয়ে রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত বিশেষ ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে উঠেছে। তাছাড়া অনেকেই কয়েকটি শব্দের মধ্যে সীমিত ক্ষুদ্র-গল্প (মাইক্রোফিকশন) লিখছেন যার মধ্যে গল্পের থেকে রূপকের ব্যবহার ও গল্পের ইঙ্গিতটাই প্রধান হয়ে উঠছে।
বাঙলা সাহিত্যে, ছোট-ছোট গল্প, ফ্ল্যাশ-ফিকশন, মাইক্রোফিকশন ইত্যাদি থেকে আলাদা করে অণুগল্পকে একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে দাঁড় করানোর একটি সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা আছে বলে লক্ষ করা যায়। এই প্রচেষ্টার আলোকে ব্যক্ত হচ্ছে যে, অণুগল্প ঠিক শুধুমাত্র একটি ছোট-ছোট গল্প বা ইংরেজিতে যেটাকে ফ্ল্যাশ-ফিকশন বলছে সেটা নয়। অণুগল্প পাঠ করলে পাঠক একটি গল্প হয়তো খুঁজে না পেলেও পাবেন একটি গল্পের অণু অথবা বীজ।
অনুপ্রাণনের এই সংখ্যাটিতে অণুগল্প সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ যুক্ত আছে। এই প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি। যেসব অণুগল্প এবং ক্ষুদে-গল্প বা মাইক্রোফিকশন সংযুক্ত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি কতটুকু অণুগল্প অথবা ক্ষুদে-গল্পের ক্ষেত্রে কতটা ক্ষুদে-গল্প হয়ে উঠতে পেরেছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে বাঙলা সাহিত্যে এই শাখাটির চর্চা তুলনামূলকভাবে নূতন এবং সেখানে রচনার গঠন প্রণালী নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ভুল ধারণার প্রভাব থাকতে পারে।
অনুপ্রাণনের পাঠকদের চাহিদার কারণে এই সংখ্যাটি বিশেষ অণুগল্প সংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত বিভাগসমূহ যুক্ত করা হয়েছে। আশা করি এর ফলে পত্রিকাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে।
There are no reviews yet.