Additional information
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
$ 0.59
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন—১০ম বর্ষ ২য় সংখ্যা
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, চীনের উহান প্রদেশ থেকে গতবছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম করোনা সংক্রমণের সংবাদ মিলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নভেল করোনা ভাইরাসটি ২০১৯-এর ডিসেম্বরেই চীনে শনাক্ত হয়েছিল, ফলে ভাইরাসটির নামের সাথে ১৯ সংখ্যাটি জুড়ে গিয়ে এর পুরো নাম হয় কোভিড-১৯। চীন থেকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুতই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়ে অতিমারীর আকার ধারণ করে।
এই ভাইরাসটি কৃত্রিম না প্রাকৃতিক এই নিয়ে কূটনৈতিক বিতর্ক আছে। বিজ্ঞান এটাকে প্রাকৃতিক বলেই রায় দিয়েছে। কৃত্রিম হলে চীনের দায় আছে না হলে নয়, এটা ঠিক নিশ্চিত বলে দেয়া যায় না। প্রকৃতিতে পশুপাখির শরীরে, বিশেষ করে লোমে ও লালায় নানারকম ভাইরাস আছে। গৃহপালিত জীবজন্তুর শরীরে যে সকল ভাইরাস আছে, সেসব ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে ক্ষতির মাত্রা খুব কম, কিন্তু বন্যপ্রাণির শরীরে মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও প্রাণঘাতী যেসব ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে সেসব ভাইরাসের মধ্য থেকে অনেকগুলো সম্পর্কে প্রাণিবিজ্ঞানে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। নভেল করোনা ভাইরাস উহানের একটি বন্যপ্রাণির বাজার থেকেই ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে বন্যপ্রাণি আহরণ ও নিধন বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই বাজারে বন্যপ্রাণি এবং গৃহপালিত জীবজন্তু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আনয়ন করা এবং তার ফলে জনস্বাস্থ্য হানিকর ভাইরাস পশুর দেহ থকে মানবসমাজে প্রবেশের পথ করে দেয়া কোনোভাবেই বিচক্ষণ ও নীতিসম্মত কাজ বলে মেনে নেয়া যায় না।
আমরা যদি অতিমারীর বিশ্ব-ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, ৫৪১ থেকে ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিউবোনিক প্লেগের সংক্রমণের ফলে ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ, তৎকালীন বাইজেন্টাইন ও কনস্ট্যান্টিনোপল সাম্রাজ্যভুক্ত সকল এলাকা, মিশর এবং আরব উপদ্বীপে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর প্রাণহানি ঘটে। মধ্যযুগে ১৩৩১ সালে চীন থেকে একই বিউবোনিক প্লেগের বিশ্বমহামারী দ্বিতীয়বার শুরু হয়। প্লেগের এই মহামারী এবং পাশাপাশি চলমান গৃহযুদ্ধে তখন চীনের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মৃত্যু ঘটে। ক্রমে চীন থেকে তখনকার বিশ্ববাণিজ্যের গমনপথ ধরে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় এই প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। ১৩৪৭ সাল থেকে ১৩৫১ সাল, এই চার বছরে ইউরোপের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর মৃত্যু হয়। শুধুমাত্র সিয়েনা এবং ইতালিতে বিউবোনিক প্লেগে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় অর্ধেক। তারপর পুনরায় ১৮৫৫ সনে চীনে বিউবোনিক প্লেগ দ্বারা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। উল্লেখ করা যায় যে, বিউবনিক প্লেগ একধরনের বাদামি ইঁদুরের শরীর থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়েছিল যা কি-না চীনের বাজারে তখন বিক্রয় হতে দেখা গিয়েছিল। চীন থকে বিউবোনিক প্লেগের তৃতীয় ঢেউ ক্রমেই পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন শুধুমাত্র ইন্ডিয়াতেই এই প্লেগের সংক্রমণের ফলে প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। মোম্বাইয়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই প্লেগের সংক্রমণ রোধকল্পে সংক্রমিত অধিবাসী সহকারে একেকটি পাড়া-মহল্লা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ফ্র্যাঙ্ক স্নোডেন উল্লেখ করেছেন যে, এতে করে যে সত্যি কোনো উপকার হয়েছে কেউ তার প্রমাণ দিতে পারেনি। এগনোলো ডি টুরা নামে চতুর্দশ শতাব্দীর একজন কাহিনিকারের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এই ভয়ানক ঘটনার সত্য বিবরণ মানুষের জিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ করাই অসম্ভব। বলা যেতে পারে যে, এই ভয়াবহ ঘটনা যে দেখেনি, সে বিশেষভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। সংক্রমিত ব্যক্তির বাহুমূল এবং কুঁচকি অস্বাভাবিক ফুলে যায় এবং কথা বলতে বলতেই ধপ করে পড়ে মৃত্যু লাভ করতে থাকে। মৃতের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদেরকে গণকবরে দাফন করা হয়। ফ্লোরেন্স নগরীর জিয়োভানি বোকাচ্চিওর বর্ণনায়, মৃতদেহ সৎকারের জন্য ন্যূনতম শ্রদ্ধাটুকু দেখানো হয়নি যেটা কি-না একটি মৃত ছাগলের জন্যও প্রাপ্য হতে পারতো। কেউ কেউ মৃতদেহ বাড়িতে লুকিয়ে রাখতো। অনেকেই সংক্রমণের ভয়কে মানসিকভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তারপরও ভুগতে ভুগতে মানুষ এক পর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে যায়। বোকাচ্চিওর ভাষায়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানুষ অতিরিক্ত মদ্যপান করতে থাকে, নাচে-গানে মত্ত হয়ে থাকে এবং পৃথিবীর যাবতীয় সুখ এবং আনন্দ উপভোগ করাতেই নিজেদের নিয়োজিত করতে থাকে। সংক্রমণ ও মহামারীর বিষয়টি তারা ঘাড় থেকে এমনভাবে ঝেড়ে ফেলতে চাইতো যেন সেটা একটা বিশাল কৌতুক ছাড়া আর কিছু না। আমরা সেই একই ধরনের পরিণতির দিকে এগোচ্ছি কি-না?
অতীত অতিমারীর বিশ্ব-ইতিহাসে দেখা যায় যে, সংক্রমণের ধাপগুলোর মধ্যে প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ঢেউ অধিক থেকে অধিকতর প্রাণঘাতী হয়েছে। অন্যদিকে টিকা আবিষ্কারের ইতিহাসে বিজ্ঞানীরা চমক দেখিয়ে করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব ও অতিমারীর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ শুরু করেছেন। যার ফলে আশা করা যায় যে, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপটি হয়তো অতীতের মতো ততটা মারাত্মক আকার ধারণ করবে না। কিন্তু তারপরও জীবন অথবা জীবিকা এসব প্রশ্নে, বিশেষ করে লকডাউনের মধ্যেও কীভাবে অর্থনীতিকে ন্যূনতম চলমান রাখা যায়, এসব প্রশ্নে বাস্তবে সর্বোত্তম ভারসাম্য রক্ষা করা দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের দেয়া লকডাউন নীতিমালা ও স¦াস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। তার পরিবারের অন্ন জোগাড়ের প্রয়োজনের চাপে উপার্জনক্ষম মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারছে না।
কিন্তু, অন্যদিক নভেল করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে পুনঃপৌনিক সংক্রমণের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। যার ফলে, সংক্রমণের প্রথম ঢেউ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ভাইরাসের রূপান্তরিত রূপ এই বছরের মার্চ থেকে ক্রমেই প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণের বাঁধ ভেঙে দিয়ে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়া যে প্রথম ঢেউয়ের থেকে আরো উঁচু এটা মৃত্যু ও সংক্রমণের হার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে এ-পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ৮ লাখ এবং একইসময়ে বিশ্বে সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৬৩ লাখ। মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার এবং বিশ্বে প্রায় ৩৪ লাখ। সংক্রমণ ও মৃত্যুর নিছক সংখ্যাগুলোর মধ্যে এক একজনের আপন হারানোর অপার বেদনা লুকিয়ে আছে। আর আমরা আপন হারানোর বেদনার মতোই বেদনা অনুভব করি যখন আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার জগৎ থেকে হারিয়ে যায় তারকা ব্যক্তিরা। এই সংখ্যার শ্রদ্ধাস্মরণ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এপার ও ওপার বাংলার ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের এরকম কয়েকজন ব্যক্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে এক বা একাধিক আলোচনা। যারা সকলেই এই করোনাকালে সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তা ছাড়াও এই সংখ্যাটিতে অতিমারীর অভিঘাতের নানাদিক উঠে এসেছে শিল্প ও সাহিত্যের নানা শাখায়। অন্তর্ভুক্ত গল্প ও কবিতার কোনো কোনোটির মাঝে আমরা দেখতে পাই, অতিমারীর আঘাতের চিহ্ন। মানবতার অসহায়ত্ব ও দুর্ভোগের করুণ বর্ণনা এসব রচনাকে করেছে অশ্রুসিক্ত।
এই অতিমারীর মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল। অনুপ্রাণন পত্রিকাটির ৯ম বর্ষ ২য় সংখ্যা থেকে ৯ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা নির্ধারিত সময় থেকে কিছুটা দেরিতে হলেও প্রকাশিত হয়েছে। ১০ম বর্ষ ১ম সংখ্যাটি ফেব্রুয়ারি, ২০২১ একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়া নির্ধারিত ছিল, কিন্তু বইমেলা পিছিয়ে যাওয়ায় সেটা প্রকাশিত হয় ২ এপ্রিল ২০২১। এই অতিমারীর মধ্যে অমর একুশে বইমেলা শুরু হয় ১৭ মার্চ এবং লকডাউনের বিধিনিষেধের মধ্যে শেষ হয় ১২ এপ্রিল। অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে ২০২০-২০২১ অতিমারীকালে এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ৬৮টি গ্রন্থ। গ্রন্থগুলোর কোনো কোনোটাতে উঠে এসেছে অতিমারীর অনুভব চিত্র।
বাঙালি, লেখক-আড্ডার মধ্য দিয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের সূত্র খুঁজে পায়। বিভিন্ন লোকালয় ভ্রমণের মাধ্যমে গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো ধরা দেয় এবং চলমান জীবনের নানামাত্রিক রূপ তাদের গল্প-উপন্যাসে উঠে আসে। অতিমারীর পূর্বে ঢাকা শহরে এবং দেশের জেলা পর্যায়ে লেখক আড্ডার কতগুলো আয়োজনের কর্মসূচি নিয়মিত অথবা অনিয়মিতভাবে বছরজুড়ে চলতে থেকেছে। লেখকরা ব্যক্তি এবং গ্রুপ পর্যায়ে লেখার বিষয়বস্তু তৈরির জন্য, গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বই সংগ্রহ ও বইপড়ার কাজ চালিয়ে গেছে। কিন্তু এই অতিমারীর সময় আড্ডা বন্ধ হয়ে যায়। লাইব্রেরি বন্ধ থাকায় লেখার জন্য, গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্রমণ অথবা বই সংগ্রহের কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। কিন্তু তাতে কি লেখা বন্ধ থেকেছে? অতিমারীকালে লেখকরাও নতুন পরিস্থিতির, নয়া-স্বাভাবিক অবস্থার সাথে লেখার কার্যক্রমের রুটিন ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে তাদের লেখা চালিয়ে গেছে। এই প্যান্ডেমিকের লকডাউন বা বিধিনিষেধ অথবা সতর্ক অবস্থান নিয়ে বাসায় থাকার সময় অনেক নতুন লেখকের জন্ম হয়েছে। যারা আগে থেকে লেখালেখি করতো অথবা যারা নতুন লেখক তারা সবাই লেখালেখির মধ্য দিয়েই ঘরবন্দী সময়টাকে নিয়োজিত করেছে।
এসব শিল্প-সাহিত্যকর্মে কি জনবিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার স্বাক্ষর থেকেছে? আমার হাতে পত্রিকার জন্য যেসব লেখা অথবা পুস্তক প্রকাশের জন্য যেসব পাণ্ডুলিপি এসেছে, আমার পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে যে, এই নয়া-স্বাভাবিক পরিস্থিতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখার ধারায় পরিবর্তনের কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। স্বাভাবিক জীবনের তীব্র আকাক্সক্ষা নয়া-স্বাভাবিকতাকে গৌণ বোধেরই একটা অন্তহীন প্রচেষ্টা। আর যেসব লেখায় অতিমারী কবলিত নাগরিক অথবা গ্রাম্য জীবনের বাস্তব চিত্র এসেছে সেসব বাস্তব চিত্রে অতিমারীর ভয়াবহতা অথবা ভয়ঙ্কর রূপটি মুখ্য হয়ে ওঠেনি। যদিও আমরা দেখতে পাই, প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু এর সংখ্যাটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির মোট মৃত্যুহারকে অল্পই প্রভাবিত করেছে। এ-রকম একটা ধারণা থেকেই হয়তো মানুষ লকডাউনের বিধিনিষেধ অথবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা হালকাভাবেই নিয়েছে।
কিন্তু তাহলেও দেশে গত মার্চ ২০২০ থেকে কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হওয়ার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেনাবেচায় পণ্যভেদে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বই কেনাবেচার মোট মূল্যমান স্বাভাবিক সময়েও এমনিতে কম। তারপর এই নয়া-স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সেটা কমে নেমে এসেছে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকালে বিক্রয় মূল্যমানের তুলনায় শতকরা ২৫ ভাগে। তবে এটা যদি সাময়িক পরিস্থিতি হয়, তাহলে যে ক্ষতিসাধন হয়েছে সেটা হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এলে অধিকাংশ প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট মুদ্রণশিল্প মিটিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু অতিমারী যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে পুস্তক প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পে যে ক্ষতি হবে, সে ক্ষতির ফলে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের একটি বিরাট অংশ এই জগত থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। মানুষের জীবিকা রক্ষা করার তাড়নার বাস্তবতায় ব্যাপকহারে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন অথবা লকডাউনের নীতিমালা উপেক্ষা করার যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে, এসব ঘটনা যাদের জীবিকা প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পের ওপর নির্ভরশীল তাদের একটি বিরাট অংশকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। কারণ, বইপড়া এই নয়া-স্বাভাবিককালের একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা দূর করার মাধ্যম হয়ে উঠতে আবারো ব্যর্থ হচ্ছে। এই অতিমারীকালে অনলাইনে কেনাবেচার পরিমাণ সামগ্রিক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সেটা বই ও পত্রিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি।
আমাদের দেশে প্রকাশকদের মধ্যে বই অথবা ম্যাগাজিন প্রকাশের ধরনের ওপর ভিত্তি করে কতগুলো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগটি পাঠ্যপুস্তক, নোট অথবা গাইড বইয়ের প্রকাশক। দ্বিতীয় ভাগটি পাঠ্যপুস্তক, নোট অথবা গাইড বই প্রকাশের পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্য অথবা গবেষণাগ্রন্থও প্রকাশ করে থাকে। আর তৃতীয় ভাগটি শুধুমাত্র সৃজনশীল সাহিত্য অথবা গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করে থাকে।
এই তিনটি ভাগ বা শ্রেণির প্রকাশকরা সকলেই এই অতিমারীকালে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকতো, তবে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ততার হাত থেকে বেশ ভালোভাবেই রক্ষা পেতো। অন্যদিকে যেসব প্রকাশক শুধুমাত্র সৃজনশীল সাহিত্য ও সামাজিক গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করে তাদের পরিস্থিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকা-না থাকার সাথে সম্পর্কিত নয়। অতিমারীর কারণে বই ক্রয়-বিক্রয় সামগ্রিক হ্রাস পাওয়ার সাথেই তাদের অর্থনীতি জড়িত এবং যেটা শোচনীয় বললেও কম বলা হবে।
বাস্তবে আমাদের জানা দরকার যে, এই অতিমারীকালে কাদের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং কাদের আয় যে পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে সে পরিমাণ হ্রাস তাদের আর্থিক সচ্ছলতার ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি? কারা সৃজনশীল সাহিত্য, বই ও ম্যাগাজিনের মূল ক্রেতা? যাদের আয় সামগ্রিক হ্রাস পেয়েছ, তারাই কি সৃজনশীল সাহিত্য পুস্তক ও ম্যাগাজিনের ক্রেতা? আবার দৃশ্যত. এই অতিমারীকালেও কাপড়-জামার ঈদবাজার সরগরম হলেও সামগ্রিক ঈদের কেনাবেচার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কি-না? না-কি স্বাভাবিক ছিল? না-কি স্বাভাবিক পরিস্থিতির সময়কাল থেকে কম ছিল? বস্তুত কাপড়-জামার ঈদবাজার এই অতিমারীকালে বেশ চাঙ্গা দেখা গেলেও সামগ্রিক হিসাবে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ অতীত স্বাভাবিক পরিস্থিতিকালের চেয়ে কম ছিল। বস্তুত এই অতিমারীকালে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের খরচের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে এবং খরচের সিংহভাগ ব্যয়িত হচ্ছে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এই অতিমারীকালে যাদের আয় তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পায়নি এবং যারা সৃজনশীল সাহিত্যের বই পড়ে, তারা হয়তো এই অতিমারীকালেও বই কেনা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশটি যারা আয়ের একটি ভাগ কষ্ট করে হলেও সৃজনশীল সাহিত্য অথবা গবেষণাগ্রন্থ ক্রয়ের জন্য ব্যয় করতো, অর্থের অভাবে তারা এই অতিমারীকালে বইয়ের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না; করলেও ক্রয়ের পরিমাণ খুব বড় আকারেই হ্রাস পেয়েছে।
অর্থাৎ একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং অন্যদিকে বইয়ের ক্রেতাদের আয় হ্রাস, সামগ্রিকভাবেই বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। অর্থনীতির অন্যান্য খাতে সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে এই অতিমারীকালে প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু পুস্তক প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পের মালিকরা ব্যাংকখাত থেকে স্বল্পসুদে ঋণ গ্রহণ করার সুযোগ নানাকারণেই গ্রহণ করতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বার্ষিক এককালীন অনুদানের কর্মসূচি নিয়ে সরকারের এগিয়ে আসা এখন এই অতিমারীকালে সময়ের দাবি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার তালিকা করে বার্ষিক এককালীন এই অনুদান প্রদান করার ব্যবস্থা করতে পারে।
সর্বশেষে, করোনাকালের গদ্য নিয়ে কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, করোনাকালের গদ্যের বিষয়বস্তু কী হতে পারে? অবশ্যই অতিমারী ও অতিমারীর অভিঘাত। অতিমারীর অভিঘাত শুধু মানুষের অসুস্থতা, দেহত্যাগ এবং পরিবার ও সমাজে তার বাস্তব ও মানসিক অভিঘাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। করোনাকালের গদ্যের মধ্যে আসতে পারে বহুমাত্রিক বিষয়। যেমন- চিকিৎসা, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় অথবা সামগ্রিকভাবেই এই অতিমারীর বিরুদ্ধে জীবন ও জীবিকা রক্ষার লড়াই। অতিমারীর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা সম্বন্ধীয় চিন্তাভাবনা। নয়া-স্বাভাবিক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিকের বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ। কবিতা ও গল্পের পাশাপাশি করোনাকালের গদ্য রচনায় কোনো কোনো লেখক মনোনিবেশ করতে পারেন।
১০ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন– নবম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভূমিকা
শিল্প ও সাহিত্য কীভাবে মানুষের চেতনায় মানবিক মূল্যবোধের প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই আসতে পারে। তাহলে, এটা কি একটি সমস্যা? একই স্থানে, একই সময়ে, একই বিষয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত আসলে আমাদের বোধের জগতে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে কি-না? এর উত্তর অবশ্যই না। কেননা শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন মানবিক মূল্যবোধের বিষয় নিয়ে নিরীক্ষা করতে পারে। কোনো একক দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে অটল বিশ্বাস উল্টো চেতনার জগতে গোঁড়ামির বীজ বপন করার প্রবণতার জন্ম দিতে পারে।
অর্থাৎ, মানবিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের উৎস এবং অভিব্যক্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো সুত্র বা সংজ্ঞা নির্বাচন করা হয়তো সংকীর্ণতার দিকেই ঠেলে দিতে পারে। আমরা যেমন মানবিক সমাজ চাই, সাথে সাথে আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুত্ববাদী সমাজ চাই। সমাজে যদি মুক্তমত ও ভিন্নমতের চর্চা বা অনুসরণ করার সুযোগ রহিত থাকে তবে মুক্তমনা ও মানবিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের চর্চা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী হতে দেখা যেতে পারে। তবে মুক্তমত অর্থে অতিশয়োক্তি আমরা দেখতে চাই না। আমরা চাইবো না সমাজের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ এবং অশান্তি সৃষ্টি করে–এরকম মানবতাবিরোধী শিল্প-সাহিত্য অথবা সঙ্গীতের চর্চা অবারিত হোক। শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃষ্টির সৃজনশীল প্রেরণা ভিন্নতর কোণ থেকে উৎসারিত হলেও লক্ষ্য একটাই হওয়া বাঞ্ছনীয় যেন সেসব সৃষ্টিশীল কাজের অভিব্যক্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মধ্যে উপস্থিত থাকে নান্দনিকতা; জাতি-উপজাতি-বর্ণ-সম্প্রদায় ও লিঙ্গ নির্বিশেষে বিস্তৃত হয় মানবিক সহমর্মিতা, প্রেম, সাম্য ও সমতা। মনে রাখতে হবে যে, ইহজগতে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক প্রথা-প্রচলন, বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কারণে বহুমাত্রিক শোষণ ও নিপীড়নের দুর্ভোগ নিয়ে জীবন যাপন করছে। যদি সৃজনশীল ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত এর লক্ষ্য হয় পশ্চাৎপদ প্রথা-প্রচলন, জাতি-উপজাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য এবং নানাবিধ কুসংস্কার এর হাত থেকে মুক্তির জন্য মানুষের চেতনা জাগ্রত করা, তবেই বলা যেতে পারে যে, সেসব সৃজনশীল ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত এর মানবিক মূল্য রয়েছে।
সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, কারুশিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প, স্থাপত্যকলা, এবং শিল্পের সকল মাধ্যমের মধ্য দিয়েই মানুষের রুচি ও সংস্কৃতির আত্মপরিচয়, উন্মেষ ও উপলব্ধি ঘটে–মানুষের চেতনায় তার স্বপ্নের জগতটি দানা বাঁধে ও বিকশিত হয়। সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য শিল্পের এই মাধ্যমগুলো একেবারে যেন মনের এক-একটি জানালা। এই জানালাগুলো ব্যবহার করে যেমন একটি সংস্কৃতির ইতিবাচক রূপান্তর সম্ভব, ঠিক সেরকম মনের এসব জানালা দিয়েই কলুষিত বাতাস প্রবেশ করে একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই কোনো শিল্পকর্মটি সমাজের ইতিবাচক মানবতাবাদী রূপান্তর এর পক্ষে, আর কোন শিল্প ও সাহিত্যকর্মে মানবিক সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান বিদ্যমান–এটা শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। সাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, কারুশিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প, স্থাপত্যকলা, এবং শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম দিয়ে যেসব কর্ম আমাদের জগতে প্রবেশ করছে–সেসব কর্মসমুহের প্রত্যেকটি কাজের নিবিড় ও যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যুক্তিসঙ্গত এবং বিশ্লেষণমূলক আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ করা তাই অত্যন্ত জরুরী একটা কাজ। পশ্চাৎপদ সমাজে এসব আলোচনা-সমালোচনা রচনা ও প্রকাশ করার কাজে বাধা আসতে পারে। কিন্তু, এই বাধা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলার প্রেরণা সৃজন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। সেজন্য কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিবৃন্দকে সমাজে ইতিবাচক রূপান্তর আনয়নের প্রয়োজনে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী হয়ে ওঠার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
কিন্তু, সমাজে এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে যে, সমাজ পরিবর্তনের কাজে প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে তো নয়ই এমনকি স্ব স্ব অবস্থান থেকেও প্রতিবাদী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কাজ না। শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এই অংশের মত হচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া রাজনৈতিক কর্মী অথবা সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজ। যেন শিল্পীর কাজ সুন্দরের অন্বেষণ করা, অন্তর্নিহিত সত্যের নয়।
আবার, কোনো কোনো কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিবৃন্দকে সমাজের ক্ষমতাধর অধিকর্তাদের তোষণেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই এসব শিল্পী ও সাহিত্যিকরা তাদের কাজে এসব চিহ্ন রেখে গেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প ও সাহিত্য বর্জন না করে শিল্পী ও সাহিত্যিক সমাজের একটি অংশকে নান্দনিকতার দোহাই দিয়ে ঐসব শিল্পকর্মকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। কিন্তু, সত্যি কি সমাজের পরিবর্তন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে এবং সেসব শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতকে কালজয়ী আসনে সমাসীন করার কাজে তারা কি সফলতা লাভ করতে পারে?
একটি সেনাবাহিনী উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত ঠোঁটে করেই ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। আবেগপূর্ণ নাট্যকলা, বাগ্মী বক্তৃতা অথবা অসাধারণ গান, ভাস্কর্য ও অভাবনীয় সৌধ নির্মাণ করে ধর্ম তাদের বাণী মানুষের মনে সঞ্চার ঘটায়। জাতিগত গোষ্ঠী–সঙ্গীত ও নৃত্যের মাঝে তাদের সাংস্কৃতিক শেকড় খুঁজে পায়। অসাধারণ স্থাপত্যশিল্প, যেমন: রোডস্ (জযড়ফবং) এ অবস্থিত সূর্য দেবতা হেলিওস এর অতিকায় মূর্তি, জাপানের একটি পীঠস্থানে ১০৩ টন ওজনের সর্ববৃহৎ বুদ্ধ-মূর্তি, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ইত্যাদি কোনো সম্প্রদায় বা জাতি’র আদর্শের প্রতীক হিসেবে মানুষের গভীরে প্রোথিত হতে থাকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, যখন একটি নতুন সম্প্রদায় অথবা জাতি-গোষ্ঠী পুরানো কোনো সম্প্রদায় অথবা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে তখন পুরানো শাসনব্যবস্থায় প্রচলিত নৃত্য ও সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাদের আদর্শিক গ্রন্থসমুহ পুড়িয়ে ফেলা হয়, মন্দির ও পীঠস্থানগুলো বিনষ্ট করা হয়, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকর্ম সমূহ মাটিতে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। আবার অন্যদিকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, শাসকের আমূল পরিবর্তনের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল রক্ষা পায় প্রেমের অভিব্যক্তি, স্থাপত্য ও মর্মর পাথরে নান্দনিক অলংকরণ শিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে। যদিও শাহজাহান নিজ সন্তানের হাতে বন্দী হয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টে নিজের শেষ জীবনটি অতিবাহিত করেন কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, অনেক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার মধ্যে দিয়েই তিনি শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। একটা সময় পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহান নিকৃষ্টতম কূটচাল আশ্রয় করে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়েই প্রজাদের শোষণ করে ও প্রতিপক্ষদের নৃশংসভাবে হত্যা অথবা দমন করে রাজ্যের বিস্তার ঘটান এবং রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। কথিত আছে যে বিশ হাজার শ্রমিক ও শিল্পী যারা তাজমহল নির্মাণ করেছিল তাদেরকে শুধু দাসের মতোই শোষণ করা হয়নি, একটি বড় অংশকে শিল্পের কলাকৌশলের গোপনীয়তা রক্ষা করার অজুহাতে সম্রাট শাহজাহান হত্যা করেছিলেন। অথচ শাহজাহান ও নুরজাহানের প্রেম বিবৃত করে অন্য ভাষায় তো বটেই এমনকি বাংলা ভাষায় গান ও কবিতা রচিত হয়েছে।
ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে শাসকশ্রেণি কর্তৃক শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের উপর নানারূপ আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দেখা গেছে। ব্যতিক্রমী শিল্পী-সাহিত্যিকদের উপর নেমে এসেছে দমন ও নির্যাতনের স্টিম রোলার। আধুনিক কালে, হয়তো শিল্পকলার উপর সবচেয়ে নাটকীয় আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দেখা যায় নাৎসি, কট্টর কমিউনিস্ট এবং মৌলবাদী ও কট্টর এক শ্রেণির ইসলামপন্থীর শাসনে। হিটলারের জার্মানী, মাও সে তুং এর চীন, স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের শাসনের অধীনে যেসব শিল্প, সাহিত্য অথবা সঙ্গীত গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, সাধারণ শৈল্পিক সূত্রসমুহ অনুসরণ করে সেসব শিল্প, সাহিত্য অথবা সঙ্গীতকে নিষ্ফলা এবং বৈচিত্র্যহীন হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি সুনির্দিষ্ট মতবাদের প্রচার, প্রজ্ঞাপন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টার প্রভাবে শিল্পকর্মটি হয়ে ওঠে নিস্তেজ ও অনুজ্জ্বল। এইরূপ শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত মানুষের জন্য কথা না বলে, তাদের নির্দেশ করেই কথা বলে। যেখানে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পরিবর্তে রাষ্ট্রের আশা-আকাক্সক্ষার কথাই প্রকাশ ঘটেছে। মানুষের চেতনার বিশোধনের পরিবর্তে এসব শিল্প রচনার উদ্দেশ্য মানুষের আবেগ-অনুভূতি-ভাবনার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
যে কোনো কালে যখন কোনো কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতি তার কাজটি মুক্ত পরিবেশে সৃজন করে থাকেন অথবা যে কোনো সময় যখন বহির্জগতে প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও শিল্পীরা তারা নিজের অভ্যন্তরে বন্ধনহীন মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হতে পারেন, তাহলে সেই অবস্থায় প্রকাশিত শিল্পকর্মটি হয়তো মানবতাবাদী এবং উদারনৈতিক মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হতে পারে অথবা যে কোনো মানুষকে চেতনাগতভাবে মানবতাবাদী হয়ে ওঠার গভীর উদ্দীপনা এবং অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, তাহলে নান্দনিকতার কোনো সুনির্দিষ্ট মানবিক তত্ত্ব সাজিয়ে দেয়ার চেষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই। যথাযথ কোনো বিশদ বিবরণ-বিবৃতি, অভিব্যক্তি অথবা বার্তা প্রদানের চেষ্টা করারও কোনো প্রয়োজন নাই। আমাদের যেটা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে জাতি-উপজাতি-ধর্মীয় সম্প্রদায় ও লিঙ্গ নির্বিশেষে একটি স্বাধীন, সহমর্মী, মানবতাবাদী ও বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করার জন্য সৎ ও আন্তরিকভাবে সকল মানুষের মনে সুগভীর অনুপ্রেরণা বিস্তার করা। এই কাজটি একটি সৃজনশীল কাজ এবং কোনো বাধাহীন সহজ-সরল পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগও সীমিত। কিন্তু এর কোনো বিকল্প আছে বলে আমার ধারণায় আসে না। তবে এটা বুঝি যে, এই অনুপ্রেরণা হৃদয়ে প্রোথিত হলে–কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিরা নিজেদের স্বাভাবিক কাজের মধ্যেই যে শিল্প সৃজন করবেন কি-না, সেটাই মানবিক বোধ ধারণ করবে এবং একজন মানবতাবাদীর কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠবে।
পরিশেষে এটা বুঝে নিতে হবে যে, ইতিহাসের অধ্যায়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সত্যেরও পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু সুন্দর তার রূপ পরিবর্তন করলেও বোধ এবং অনুভূতিতে সুন্দরের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই, সত্যের মধ্যে সুন্দর এর অনুসন্ধান অনেক সময় বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান ও প্রতিষ্ঠা করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। কেননা কবি, সাহিত্যিক, নাট্য-কলাবিদ, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কলাকুশলী ও শিল্পী, নৃত্য-কলাবিদ ও নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পী, কারুশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিরা মিলিতভাবে শিল্পের সকল কর্মীরা চিন্তা-চেতনা, আবেগ ও অনুভূতিতে আমাদের সমাজের অগ্রসর অংশেরই প্রতিনিধি।
উদার পুঁজিবাদ ও মুক্ত বাজার, মানুষের মূল্যবোধের জমিনটিতে পচন ঘটিয়ে চলেছে। মাটিতে যখন পচন ঘটে তখন আর কোনো কিছুই নির্মল থাকতে পারে না। মানুষ কষ্টে আছে। তাই, অবশ্যই সমাজের অগ্রসর অংশটির সামনে পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে নান্দনিক অথচ সত্য শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃজনের একটি মহান দায়িত্ব এসে পড়েছে। অনুপ্রাণন এই দায়িত্বের স্থানটিকে মজবুত করে গড়ে তোলার কাজে অবিরাম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে চাই।
নবম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ই এপ্রিল। টাঙ্গাইলের মীরের বেতুকা গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। করটিয়ার সা’দত কলেজ ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। সহকারী সম্পাদক ছিলেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও দৈনিক সংবাদ Ñএ। ১৯৭৮-৮০ সালে ছিলেন গণচীনের রেডিও পেইচিং এর ভাষা বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৪-২০০৪ সালে ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশুতোষসহ গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ এর বেশি।
গল্প সংগ্রহ
জন্ম ১৯৮৬, মেহেরপুর। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। ‘অরনি ছোটগল্প’ পুরস্কার ২০১২ ও ‘বৈশাখি টেলিভিশন তোমার গল্পে সবার ঈদ’ পুরস্কার ২০১৩ পেয়েছেন। দ্বিধা, আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ সহ আরো প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ
কবিতার মিথকে অগ্রাহ্য না করেও, পরম্পরাকে কবিতায় সন্দেহ না করেও কবি চঞ্চল নাঈম কবিতার অন্তঃস্থলের নিরূপিত একরৈখিক ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছেন। দুর্বোধ্যতার অর্থ ওঁর কবিতায় দূরবোধ্যতা। সুদূরের বোধ ওঁর কবিতায় নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে। আমরা সাধারণভাবে বাংলা কবিতার যে আবহমান ভাষার সঙ্গে অতি পরিচিত, সেই ভাষাকে ছাড়িয়ে যায় কবি চঞ্চল নাঈমের কবিতা। এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় যেন রয়েছে এক ভাষা বিদ্রোহ। ‘চুপ’ থাকার বিষয়টিকে ওই বিদ্রোহের জন্যই হয়তো কবি সম্মান করছেন ক্ষণিক অবসরে। কবির অবসর আর পাঁচটা মানুষের অবসরের সঙ্গে তুলনীয় হয় না কখনোই। কারণ ভাষার ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য ভাষা, বিষয়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য বিষয় সন্ধান করেন কবি। চঞ্চল নাঈমের ‘নুন আর মশলার ঘ্রাণ’ কবিতাগ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশের নাম ‘ধু ধু মুহূর্ত’ আর দ্বিতীয় অংশ ‘উৎস পাঠ’। ’নুন আর মশলার ঘ্রাণ’ নামকরণে কবিতাটি এই গ্রন্থের সামগ্রিক চিহ্নকে ধারণ করে আছে। বাংলা কবিতার আধুনিক প্রবাহ এবং একই সঙ্গে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল টান চঞ্চল নাঈমের এই গ্রন্থের সকল কবিতাকে বিশেষায়িত করছে। দুই তিন চার পাঁচ পংক্তির কবিতায় তীক্ষ্মতা, একেবারে গদ্যের চলনে মনের সংকেতগুলোকে প্রকাশ আর আধুনিক স্মার্টনেস এইসব কবিতাকে স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করে।
অলোক বিশ্বাস
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
নুন ও মশলার ঘ্রাণ - Nun AAR Moshlar Graan
চুরিবিদ্যা- শিল্পিত সুন্দর, যদি হয় বই চুরির দুপুর
বই চুরির দুপুর গড়িয়ে যে-রোদ পাক হতো বিকেল
তোমার জানালা তখন সুরতালে রোদেলা কত্থক
এই এক সম্ভাবনার কাছে বাঁশিটার আসতো জ্বর
হাতে থাকতো পাহাড়ি শরীর ছিঁড়ে আনা বুনোফুল
খেলতে গিয়ে মাঠের অনুমতি নিতে নেই
তাতে ঘাসের বয়স বেড়ে যায়
শিশিরের স্পর্শসুখ হতে বঞ্চিত করে শরীর
সব সম্ভাবনার কাছে অনুমতির প্রশ্ন এলেই, অবলীলায়
জানতে চাইতে- কিছু অসুখী ফুলের নাম
এক একটা গোটা-দুপুর কীভাবে হয় দুখি ফুল
সব আকাক্সক্ষার ফুলবাগানে বিকেল যেন মন্ত্রধাম
মন্ত্র জপি আমি বন্দনার বাগানে তৃষ্ণার্ত আঙুল
মন্ত্র নই তৃষার আঙুল
কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর
শহর মাত্রই একটি নদী। আর শহরে বসবাসকারী মানুষগুলো হচ্ছে নদীর জলে ভাসমান কচুরিপানা। কারো পানায় পাতা গজিয়েছে তো কারো পানায় বায়ুকুঠুরি। নদীতে যেমন জোয়ার-ভাটা হয়, শহরেও তেমনি জোয়ার-ভাটা হয়। জোয়ার কালে কচুরিপানারা সব ভেসে ভেসে চলতে থাকে স্রোতের সাথে। মানুষও সেরকম ভাবেই চলে, যখন বাতাস যেদিকে ধায়। সন্ধ্যায় আবার ভাটার টানে একইভাবে ফিরে আসে আপন ঠিকানায়। এই জোয়ার-ভাটার মাঝেও কখনো কখনো নদী বিশ্রাম নেয়, বুকে ধারণ করা বিশাল জলরাশিকে স্থবির করে রাখে ক্ষণিকের জন্য। আর ঠিক তখনই কচুরিপানারা স্ব স্ব দম্ভে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে মরিয়া হয়ে পড়ে। যদিও কচুরিপানারা এটা জানে, তার কান্ড থেকে বের হওয়া দীর্ঘ, তন্তুময়, বহুধা বিভক্ত মূলগুলো যত দীর্ঘই হোক না কেন, নদীর ছোট্ট একটা ঢেউ উপেক্ষা করার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই হয়তো জলজ এই উদ্ভিদগুলো মাটির সাথে তাদের শিকড়ের সম্পর্ক স্থাপন করে না কখনো।
এই শহরের মানুষগুলোও জানে, নগর নদীর ছোট্ট একটা ঢেউ সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। তবুও মানুষ প্রতিনিয়ত হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ঢেউয়ের মতো ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে এই শহর নামক নদীর বুকে। এই নিশ্চিত অনিশ্চয়তার মধ্যেই কি দিব্যি আগামীকালের স্বপ্ন দেখে। নানা শ্রেণির মানুষ, নানা রকম স্বপ্ন।
“নগর নদীর ঢেউ” একটি জীবনমুখী সামাজিক উপন্যাস; যেখানে লেখক তার যাপিত জীবনের সূক্ষ্ম বোধগুলিকে থরে থরে বিন্যস্ত করেছেন সুনিপুণ হাতে। একজন মধ্যবিত্ত অতি সাধারণ মানুষ থেকে পরিশ্রম আর মেধার সঠিক সন্নিবেশ ঘটিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা একজন সফল মানুষের জীবনগল্প এটি। এই উপন্যাসে শহরকেন্দ্রিক জীবন-যাপনের নানা দিকগুলি উঠে এসেছে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। উপন্যাসটির পটভূমি একটি দীর্ঘ কাহিনি। যেখানে শফিক নামের কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে ঘিরে গল্পের ডালপালা ছড়িয়েছে বিস্তর। পাশাপাশি ব্যক্তি জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ঘাত-প্রতিঘাত, আশা-আকাক্সক্ষা, খুনসুটি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, ভালোবাসা-ঘৃণা, প্রতিশোধ পরায়ণতা ইত্যাদি বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায়। উপন্যাসটির প্লট বা আখ্যান খুবই সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত। প্লটের মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রের ক্রিয়াকা-কে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যাতে তা বাস্তব জীবনকে প্রতিফলিত করে এবং কাহিনিকে আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও বাস্তবোচিত করে তোলে।
চলার পথে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে বিষয়গুলি আমরা সাধারণত এড়িয়ে যাই, এই উপন্যাসে লেখক সেই বিষয়গুলিকে খুব গভীর অথচ সহজভাবে মেলে ধরেছেন। এবং প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার পেছনে নিজস্ব একটা ‘দর্শন’ রেখে গেছেন পাঠকের উদ্দেশ্যে, যা আসলে একজন গুণি লেখকের পক্ষেই সম্ভব।
একজন ভাড়াটে মাস্তান কাজের কন্ট্রাকসহ এডভ্যান্স টাকা হাতে নিয়ে যখন তার ক্লায়েন্টের বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটে, তখন সে মনে মনে কী ভাবে বা ভাবতে পারে? সে হয়তো ভাবতে পারে, এই টাকাগুলি সে কোথায় কোথায় ফুর্তি করে কিভাবে উড়াবে। অথবা বিশেষ কোনো খায়েশ মেটানোর কথাও ভাবতে পারে। আর যাই’ই ভাবুক মাস্তান নিশ্চয় তার টাকাগুলি রাস্তায় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে এই ভেবে দুশ্চিন্তা করবে না! সাধারণ মানুষ হয়তো এমনটাই ভাববেন। কিন্তু না, ঔপন্যাসিকের চিন্তা জগত তো সাধারণ মানুষের মতো নয়। একজন মাস্তানও তার টাকা লুট হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক নিয়ে গন্তব্যের দিকে দুরুদুরু বুকে চলতে পারে। লেখকের ভাষায়, “টাকার দুশ্চিন্তায় থাকা পথিকের কখনোই মাথার উপর খোলা আকাশে পূর্ণ চাঁদ দেখা হয়ে উঠবে না, এটাই স্বাভাবিক।”
এই শহরে মূলত দুই শ্রেণির পেশাজীবী মানুষের বসবাস। চাকরিজীবী আর ব্যবসায়ী। এখানে যে বা যারা একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক, সে বা তারা ব্যবসায়ী; হোক সেটা চায়ের একটি টং দোকান বা বহুমুখী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। আর এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে যে বা যারা কাজ করতে আসে তারা চাকরিজীবী, হোক সে কাস্টমারের হাতে চায়ের কাপটি তুলে দেয়া কোনো ছোটু কিংবা গলায় টাই ঝুলিয়ে নয়টা-পাঁচটা ডিউটি করা কোনো কর্মকর্তা। দিনশেষে একদল মানুষ এই শহরে মালিক এবং একদল মানুষ চাকর। আর এই চাকর শ্রেণির মানুষের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লেখকের ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এইভাবে, “যে প্রতিষ্ঠানের মালিকবৃন্দ মাস শেষ হতেই ঠিক সময়ে মাইনে দিতে পারে, তাদের শত অপরাধেও সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার মুরুদ থাকে না চাকুরে নামক মেরুদন্ডহীন প্রাণীগুলোর।”
পুরো উপন্যাস জুড়েই নানা ঘটনার পাশাপাশি প্যারালালভাবে এমন সব দর্শনের বিস্তার ঘটিয়ে গেছেন লেখক, যা পাঠকের ভাবনা জগতে একটু হলেও নাড়া দিয়ে যাবে। ব্যাপারটি আবার এমনও নয় যে, লেখক বিনা কারণে শুধু তার নিজস্ব দর্শন কপচিয়ে গেছেন, বরং এই দর্শনগুলোই প্রতিটি ঘটনাকে একটি সঠিক উপলব্ধিতে এনে দাঁড় করিয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, মানবজীবন সংক্রান্ত যে সত্যের উদঘাটন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পরিষ্ফূট হয় সেটাই লেখকের জীবনদর্শন। আমরা একটি উপন্যাসের মধ্যে একই সঙ্গে জীবনের চিত্র ও জীবনের দর্শন এই দুইকেই খুঁজি। এর ফলে সার্থক উপন্যাস পাঠ করলে পাঠক মানবজীবন সংক্রান্ত কোনো সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। এই উপন্যাসটি পাঠ শেষেও পাঠকের তেমনই এক উপলব্ধি হবে।
তুষার অপু
মহাখালী, ঢাকা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
নগর নদীর ঢেউ
লেখক পরিচিতি :
সরসিজ আলীম। জন্ম: ৩রা ভাদ্র ১৩৭৪, ১৭ই আগস্ট ১৯৬৭। ঢাকায় বসবাস। পেশা হিসেবে লেখালেখি প্রথম আগ্রহ। সম্পাদনা করছেন ‘ভনে’Ñ একটি গ্রন্থচিন্তার কাগজ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো- ‘পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক’ ‘একঝাঁক পাখি ডাকাডাকি’ ‘বাঙালি আর বাউল পরান থৈথৈ জল’ ‘ঝমঝমানো’ ও ‘ঘোড়দৌড়’।
কুমীরের ডিমবসতি
সমুদ্র ও অচল কয়েনগুলি
ভূমিকা-
১৯৭১সাল। তখন আমি খুবই ছোট।চারিদিকে অবিরাম গুলাগুলির শব্দ।নারকেল গাছের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধ বিমান।বড়দের কাছে শুনেছি- শেখসাবকে বন্ধি করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে।শান্তি প্রিয় বাঙ্গালিরা সেদিন- যতটাই না হয়েছিলো আতঙ্কিত!ততবেশিই হয়েছিলো ক্ষুব্ধ এবং অপ্রতিরোধ্য। চাপা ক্ষোভে ছিলো দাবানলের তীব্রতা।
মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসছে- অগ্নি সংযোগ,ধর্ষণ লুন্ঠন আর বিবর্ষ অত্যাচারের গন্ধ।আর রক্তহিম করা মানুষের করুণ চিৎকার! । চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায়- অসহায় মানুষের অসহায় হাহাকার! শক্ত মনেও ধরেছিলো,মাঘের কাঁপুনি। মানসিকভাবে অনেকেরই ভেঙে পড়েছিলো সেদিন।মান আর প্রাণ বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ,বাধ্য হয়েছিলো,দেশ ছাড়তে।কারণ সেদিন দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ, দেশের সাথে এবং দেশের মানুষের সাথে বেইমানি করেছিলো।তারা বিশেষ এক সম্প্রদায়কে টার্গেট করে,চালাছিলো-তাদের অপারেশন ব্লু-প্রিন্ট।
সেদিনের আতঙ্কগ্রস্থ দিনগুলোর ঘটানারই একটা সরল চিত্র, এই লেখার উপকরণ। যা আমারই চোখের সামনে ঘটেছে।সেদিন যেমনটা দেখেছিলাম- তেমনটাই বলার চেষ্টাই-এই লেখার প্রেক্ষাপট।বিবেকের তাড়নাই- আমাকে এই লেখা লিখতে প্উৎসাহ যোগিয়েছে।
আজ যাদের অনুপ্রেরণা আর আত্মিক প্রচেষ্টায় এই লেখাটা আলোর মুখ দেখতে প্রয়াস পেয়েছে! তাদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।আর তারা হলেন- আমারই অতি প্রিয় বোন লিনা ফেরদৌস।আরো আছেন- মনির ভাই।যাঁরা আমাকে উৎসাহ ও সাহস যোগিয়ে এগিয়ে আসতে অনুপ্রানিত করেছেন।পরিচয় করিয়েছেন-অনুপ্রাননের কর্ণধার আবু,ম ইউনুস ভাইয়ের সাথে।তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।আজ তাঁর আত্মিক উৎসাহেই আমার লেখা জীবন পেলো।
আরো অনেকের কাছেই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।যারা সর্বদা আমার পাশে থেকেছেন,সাহস যোগিছেন।ভরসা দিয়েছেন।তারা যে আমার কতটা আত্মীয়! এবং আপনার আর আপন জন! প্রকাশের ভাষা নেই।সকলকেই আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বরণ করছি।এই লেখা কারো মনে একটুও দাগ ফেলতে পারলেই- মনে করবো,আমার লেখা কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে।পরিশেষে সকল পাঠকদের প্রতি থাকলো- আমার শুভেচ্ছা ও আন্তরিক ভালোবাসা।
— লেখক
৭১ এর এক সন্ধ্যায়
ভূমিকা
সেই দূর শৈশবেই বজ্রকণ্ঠ’র প্রেমে পড়ে যাই। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান কিংবা ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ তোমার আমার ঠিকানা’ ; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ এসব শুনতে শুনতেই যুদ্ধের ডাক এেেলা। সেই মহানায়কের নির্দেশেই ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এদেশের সর্বস্তরের মানুষ। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হলো। আমরা সগৌরবে গেয়ে উঠলাম ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নামে বইটি এই দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রতি আমার ভালোবাসারই অভিজ্ঞান । হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রস্তুতিপর্বে সারা পৃথিবীর মানুষ এক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায়। কোভিড-১৯ অতি দ্রুত ছড়াতে থাকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। যখন ক্রমশ আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং গোটা পৃথিবী এই অণুজীবের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, ঠিক সেসময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জন্মশতবার্ষিকীর বছরব্যাপী কর্মসূচিকে উৎসবমূখর পরিবেশে না করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুবই সীমিত পরিসরে পালনের নির্দেশ দেন, যাতে কর্মসূচির কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি না পায়।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে আলাদা করে ভাবা যায় না। ’৪৭-এর পরপরই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতে শুরু করেন। আরেকজন বাঙালি, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ^দরবারে পরিচিত করিয়েছেন, যার কবিতা গান গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ-নিরন্ধ এমনকি চিঠিপত্র আমাদের চেতনাকে সবসময় উজ্জীবিত রাখে, ভরসা যোগায়, জীবনকে আলাদাভাবে চিনতে শেখায়, তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার লেখা গান আমাদের জাতীয় সংগীত। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু ভেবে রেখেছিলেন ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেবেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুযারি মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই এই গানটির প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
পূর্ববঙ্গে এসে রবীন্দ্রনাথ যে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের নদী-মাঠ-ঘাট-মানুষ-মাটি এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে, ১৩২৯ সালের ২ বৈশাখ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখলেন ‘শিলাইদহ ঘুরে এলুম- পদ্মা তাকে পরিত্যাগ করেচে’ তাই মনে হলো বীণা আছে, তা’র তার নেই। তার না থাকুক, তবু অনেক কালের অনেক গানের স্মৃতি আছে । ভালো লাগল সেই সঙ্গে মনটা কেমন উদাস হলো।’ সাজাদপুর থেকে চলে যাবার পর বহুদিন বাদে কবি আর এক বার অনেকটা প্রাণের টানেই এখানে এসেছিলেন। ১৩০৪ সালের ৮ আশ্বিন সাজাদপুর ঘাটে বোটের ওপরে বসে লিখেছিলেন ‘যাচনা’ (কল্পনা) । ‘ ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে / আমার নামটি লিখিও তোমার / মনের মন্দিরে।’ পূর্ববঙ্গের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অকুণ্ঠ ভালোবাসার বিষয়টি তাঁর নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়, এমনকি তার রবীন্দ্রবাউল হয়ে ওঠা এই পূর্ববঙ্গে এসেই। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ববঙ্গ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
লেখক পরিচিতি :
মোহাম্মদ হোসাইন। জন্ম: ৩১শে অক্টোবর। বিএসসি ও এমএসসি’র শিক্ষা সমাপন শেষে এখন শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত আছেন। লেখকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মোট ১১টি। ‘ভালোবাসা নির্বাসনে গেছে’ ‘মেঘগুলো পাখিগুলো’ ‘অরণ্যে যাবে অস্তিত্বে পাপ’ উল্লেখযোগ্য বইয়ের শিরোনাম।
অনুদিত রোদের রেহেল
লেখক পরিচিতিঃ
নিজেকে ঘটা করে পরিচয় করিয়ে কি লাভ । আমার এই উপন্যাস পছন্দ হলে এতেই আমার স্বার্থকতা। সবাই ভালবাসুক এই গল্পটা।সবাই ধারণ করুক এই বইটা।
এই পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা ৯টি
১) আমার মা(ভোরের শিশির প্রকাশন
২) বার্লিনে বন্ধুত্ব(ভোরের শিশির প্রকাশন)
৩) ভুতের স্বর্নতাবিজ( বেহুলা বাংলা প্রকাশন)
৪) অল্প কথার গল্প (দ্যুপ্রকাশন)
৫) লাভার্স পয়েন্ট (বেহুলা বাংলা)
৬)তিন প্রজন্মের কাব্য (ছায়ানীড়)
৭) দার্জিলিং কনফেশন (ছোট গল্প) অনুপ্রাণন
৮) উইনিং সেলস এন্ড মার্কেটিং (বেহুলা বাংলা)
৯) পূর্বজদের গুহায় বুদ্ধের দর্শন।(অনুপ্রাণন)
পূর্বজদের গুহায় বুদ্ধের দর্শন
কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে, যার কোনো নাম হয় না; নামকরণও করা যায় না। এই নামহীন সম্পর্কগুলো আয়নায় লাগা জলের দাগের মতো লেগে থাকে। জল দিয়ে সেই দাগ মুছতে গেলে লেগে যায় আরো জলের দাগ। প্রতিবিম্বের গায়ে সেইসব জন্মদাগের মতো চিহ্ন রেখে যায়—সম্পর্ক এমনও হয়।
গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক নয়। কারো সঙ্গেই কোনো ঐক্য নেই। তবে এ অনৈক্যের মাঝেও এক আন্ত আছে বৈকি! ওরা সকলেই শিরোনামহীন-সম্পর্কে আবদ্ধ।
নামহীন মৃত্যুর শিরোনাম
মায়ের জঠরে রক্তের নদীতে
সাঁতরে সাঁতরে
জন্মাতে চাইনি রক্তপাতে
অস্থির এই পৃথিবীতে
জন্মাতে চাইনি বলে
মা’র সাথে তর্কবিতর্কে-
অপেক্ষা করেছি নয় মাস
মা একদিন পৃথিবীর সব ব্যাথা
গোপনে শুষে বললো
বাছা, ন’মাস তো শেষ,
এবার জন্ম হও
আজ ১৬ ডিসেম্বর
একা এক দারুগাছ
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.