Additional information
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.18
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা
সম্পাদকীয়
অনুপ্রাণন: ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়
গত নভেম্বর ২০১২ থেকে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সাহিত্য ও শিল্প বিভাগের বিবিধ সৃজনশীল ও মননশীল লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে নিয়মিত ভাবেই প্রকাশিত হয়ে আসছিল। কিন্তু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাটি বৃহৎ কলেবরে অর্থাৎ নিয়মিত ১৬ ফর্মার বদলে ১৯ ফর্মা আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পরবর্তী ৫ টি সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্পাদকের অসুস্থতা ছাড়াও অলিখিতভাবে সম্পাদনা পরিষদের যে সদস্যবন্ধুটি পত্রিকার কাজে অফিস সমন্বয়কের গুরুদায়িত্ব পালন করছিলেন নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যেতে তিনি নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকলে পত্রিকার কাজে ছেদ পড়তে থাকে। তাছাড়া সম্পাদনা পরিষদের আর একজন বন্ধু অন্য একটি অনলাইন পত্রিকার কাজে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার ফলে তাঁর পক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকায় প্রয়োজনীয় সময় দেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। সম্পাদনা পরিষদের অন্য আর একজন সংগঠক পর্যায়ের সদস্য পত্রিকার চাইতে গ্রন্থ প্রকাশনায় বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশের কাজে লোকবলের এক বিরাট সংকট দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে- ২০১২’এর নভেম্বরে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশ করার উদ্যোগ যারা নিয়েছিলেন তারা প্রত্যেকেই শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যার যার নিজ অবদান ও স্বাক্ষর রাখার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম ও ব্যক্তিগত অনুদানের ভিত্তিতে পত্রিকাটির প্রকাশনার কাজের যাবতীয় কাজ ও ব্যয় নির্বাহ করার অভিপ্রায় গ্রহণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ সংস্কৃতিতে এবং বিশেষ করে তরুণদের মনের মাঝে মানবতা, সহমর্মীতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা, শিল্পরুচি, নান্দনিকতা এবং মুক্তচিন্তার চর্চার জানালাটাকে উন্মূক্ততর করার কাজে নিয়োজিত অনুপ্রাণনের এই প্রচেষ্টা যেন বাধাহীন হয় এবং কোনভাবেই যেন প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদীতার কূট সাংস্কৃতিক আবর্তে পড়ে দিক হারিয়ে না যায়।
যশ ও প্রতিষ্ঠার মোহ যখন শিল্পীকে পেয়ে বসে তখন শিল্পচর্চা তপস্যা অথবা সাধনা থাকে না। কিন্তু, এটাই বাস্তব যে তপস্যা ও সাধনা ছাড়া শিল্পের উৎকর্ষতার শীর্ষ স্পর্শ সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বলয়ে যেসব শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও উদ্যোগ ফেনার মত আমাদের চারদিক ভরিয়ে তুলছে সেসবের স্থায়িত্ব সম্পর্কে কী কোন সন্দেহ থাকা উচিত?
বছরখানেক বন্ধ থাকার পরও যখন আমরা অনুপ্রাণনের এই সংখ্যাটি প্রকাশের উদ্যোগ নেই তখন আমরা আমাদের পত্রিকার পাঠক, লেখক ও শুভান্যুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সারা পেয়েছি। এই সারা থেকে এই বিশ্বাস আমাদের জন্মেছে যে, আমরা যে পথ অবলম্বন করে এগিয়ে চলতে চাই সেই পথে বাস্তবেই সঙ্গ-সাথীর আমাদের কোন অভাব নেই। এখনও আমাদের দেশের তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ মিথ্যা যশ, প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের মানবিক ও নান্দনিক চর্চা অব্যহত রাখতেই অধিক আগ্রহী। তাই, লেখা আহ্বানে যে সংখ্যক মানসম্পন্ন লেখা আমরা পেয়েছি সেগুলো দিয়ে অনায়াসেই দুটো সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল। চলতি সংখ্যার জন্য লেখা বাছাই করতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় দিতে হয়েছে এবং স্থান সংকুলানের অভাবে প্রায় অর্ধেক লেখাই পরবর্তী সংখ্যার জন্য রেখে দিতে হয়েছে।
লেখা বাছাই করতে গিয়ে আবারো আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সাহিত্য আলোচনা ও সমালোচনা বিভাগে আমরা যথেষ্ট সমৃদ্ধ লেখা পাচ্ছি না যেখানে পেশাদার সমালোচকের কলমের স্পর্শ আরো তীক্ষè অথচ আরো গঠনমূলক হতে পারে। বিশেষ করে কবি ও কবিতা নিয়ে আমাদের আরো তীক্ষè, তীব্র ও গঠনমূলক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কেননা সাহিত্য জগতে কবি ও কবিতার সংখ্যা যতই বাড়ছে কিন্তু আগ্রহী কবিতার পাঠকের সংখ্যা যেন সেই তূলনায় বৃদ্ধি হচ্ছে না। মনে হয়, কবি ও পাঠকের মাঝে বোধ, অনুভব ও ভাষার কোন একটা অন্তর থেকে যাচ্ছে যে অন্তরটি ঘুচে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী কেননা বোধ করি, মূলত কবিতার মধ্যেই রয়েছে তরুণ সমাজের জন্য ভবিষ্যতের বিশেষ বার্ত্তা। অর্থাৎ সাহিত্যের সত্যপাঠ।
দেশে এখন হেমন্ত ঋতু। হাওরের অকাল বন্যা ও দেশব্যাপী অতিবৃষ্টির ফলে ফসলহানী ঘটায় এবছর দেশের সামগ্রিক সমাজ জীবনে খাদ্যের ঊর্ধ্বমূল্য সকল মানুষকেই কষ্ট দিয়েছে। হেমন্তের নতুন ফসল যেমন কৃষকের ঘড়ে ঘড়ে জীবনে ঘুরে দাড়ানোর বার্ত্তা দিয়ে যাচ্ছে- দীর্ঘ বিরতির পর অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকের এই সংখ্যাটি এ-বছর অনুপ্রাণনের ঘুরে দাঁড়ানোরই প্রতীক ও স্বাক্ষর হোক- এটাই আশাবাদ।
ষষ্ঠ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা
সম্পাদকীয়
শিল্প-চেতনার ঐক্য
দেশে-বিদেশে সাধারণভাবে এটাই ধরে নেয়া হয় যে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সাধারণ মানুষদের তুলনায় সমাজ সম্পর্কে অধিকতর সচেতন, সক্রিয় এবং অগ্রসর ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এই গোষ্ঠীর সকলেই সমমনা এবং তারা একক কোন সংগঠনে মিলিত অবস্থায় রয়েছেন। এর কারণসমুহ সময়ের সাথে সম্পর্কিত সমাজের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির বাস্তব ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যেতে পারে।
ভাষা, শব্দ, কণ্ঠ, বাদ্যযন্ত্র, রঙ, তুলি অথবা যে কোন উপকরণ ব্যবহার করে সুর ও সুন্দরের চর্চা, অভিব্যক্তি ও নির্মান যা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে, হৃদয়ে আবেগ-অনুভূতি আন্দোলিত করে, মন মুগ্ধ করে অথবা মেধা ও মননে গভীর ছাপ ফেলে যায়- কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সেই কাজেই নিজের প্রতিভা বিকাশের সাধনায় নিয়োজিত থেকে সমাজে সুর ও সুন্দরের সৃষ্টি করে যেতে থাকেন। সুতরাং তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থান কুৎসিত, অন্যায়, অন্যায্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে এবং এটাই একান্তভাবে প্রত্যাশিত। সেখানে বিভেদের কী কোন অবকাশ থাকে? সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করতে চাইলে একজন শিল্পীকে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হবে এবং অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কিন্তু, বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাই? শুদ্ধ শিল্পসিদ্ধি এবং বাস্তবজীবন বীক্ষণ বোধ ব্যক্তি ও ক্ষেত্র বিশেষে যেন সম্পর্কবিহীন দুটো সেতুবিহীন রাজ্যের মতো বিভক্ত রয়ে যায়। কিন্তু, এটা কেন?
আমাদের নন্দনবোধের সাগরে প্রকৃতি যেমন একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে, ঠিক তেমনই জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ চেতনা কী বাস্তব পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? এই দুটি বিষয়কে কল্পনা বা বাস্তবে কী কোন প্রভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায়? অসীমের অন্বেষণ ও স্বপ্নচারিতা একজন শিল্পীর থাকতে পারে। সৌন্দর্যের সন্ধানে অসীম ও অনন্তের দিকে যাত্রা করাও দোষের নয়। পরম সত্যের সৃষ্টির রহস্যকে ঘিরে অনুসন্ধান অনুসন্ধিৎসা আলো-অন্ধকারের উজ্জীবনে না হয় ক্লান্তিতে হয়ত হাবুডুবু খাবে। কখনো কখনো অন্ধকারের স্তব্ধতা নৈঃশব্দের দ্যোতকরূপে চেতনায় সংগুপ্ত থাকবে কিন্তু চিন্তায় সংকীর্ণতা, স্বার্থবাদী ও ক্ষমতাশালী উপনিবাশবাদী শক্তি পরিচালিত ভেদ ভাবনা অথবা মৌলবাদ কখনো মানবমুক্তির স্বপ্নের উজ্জ্বল আলোকে স্পর্শ করতে সাহায্য করতে পারবে না।
কালোত্তীর্ণ শিল্প কী জীবন বিচ্ছিন্ন ছিল? মানুষের দেহ ও তার অবয়বকে, তার যাপিত জীবনের সংগ্রাম অথবা উৎসবের বাইরে মানুষকে ছুঁড়ে দিয়ে মৌলবাদী কোন বিশ্বাসে শৃঙ্খলিত করার কোন অপচেষ্টায় সেসব শিল্প কর্ম কী লিপ্ত ছিল? এমন কোন অভিযোগ অথবা এমন কোন বিশেষণে সেসব শিল্প কর্মকে কী বিশেষায়িত করা সম্ভব? মানবসভ্যতার ইতিহাসে কালোত্তীর্ণ শিল্পের আধারে আত্মার মুক্তি কখনোই অধিক যথার্থ প্রশ্ন ছিল না- যতনা ছিল প্রেম, মানবতা ও মানব মুক্তির বিষয়াবলী। আর এ-কারণেই বুঝে নেয়া দরকার যে ক্ষমতার বর্বরতা ও নৃশংসতার সঙ্গী-সমর্থক হয়ে কখনোই প্রেম, মানবতা ও সুন্দরের পূজা সার্থক সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। কেননা যখন ঘৃণা অথবা প্রেম থেকে শিল্পকে যে কোন একটাকে বেঁছে নেয়ার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় তখন মানবতাই শিল্পের ধর্ম হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কেননা- প্রেমই সুন্দর এবং প্রেমই মানবতার বৈশিষ্ট।
যদিও প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সংবেদনশীলতা বিরাজমান কিন্তু এর মাত্রা ও স্বাতন্ত্র্য সবার অস্তিত্বে সমভাবে লালিত হয় না। যারা একটু অধিক মাত্রায় সংবেদনশীল তাদের ইন্দ্রিয় সদা জাগ্রত থাকে, তাঁরা প্রকৃতি থেকে সৃষ্টির চিরন্তনতার নির্যাস পায়, অসীমের অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্বের মহিমা হৃদয়াঙ্গম করতে পারে। শিল্পী সমাজের সদস্যগণ জীবন প্রবাহের সব উপকরণের মধ্যে সত্য, সুন্দর, সততা ও সরলতাকে অবিচ্ছেদ্যতার সাথে তাঁর অস্তিত্ব দিয়ে আকাঙ্খা করেন। মানুষ ও মানবজাতির কল্যাণ চিন্তায় হন সবচেয়ে অগ্রগামী এবং এ-কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈষয়িক জীবনে বঞ্চিত রয়ে যান। বৈষয়িকভাবে তাঁর বঞ্চিত হওয়া অবাঞ্ছিত নয়, কারণ লেখক ভোগবাদের উপাসক নন, তিনি উপাসক প্রেম ও সত্যের- যে প্রেম, যে সহমর্মিতা, যে ভালোবাসা, মানবজাতির চিন্তা-চেতনা ও জীবন যাপনের সেই সত্য ও সুন্দরতা- যে সত্য থেকে, যে সৌন্দর্য থেকে জীবন সত্য- সদা প্রসারিত ও স্পন্দিত।
জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি যাই থাকুক না কেন, ন্যূনতম ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দাবি মিটিয়ে শিল্পী তাঁর মনে কল্পনার একটি সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করেন, যে জগতে অপ্রাপ্তির ইতিহাসও প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। কল্পনাকে সত্য বলে উপলব্ধি করে লেখক বিশ্বের স্বর্ণযুগ কল্পনা করেন। যদিও স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে অন্তহীন শূন্যতা থাকে তবুও শিল্পী যেমন নিজে স্বপ্ন দেখেন তেমনই অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। এসব সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় অন্যদের মনোজগৎও স্বাপ্নিক ও সুন্দর হয়ে ওঠে। অনেকের ধারণা- শিল্পী শুধু কল্পনারাজ্যে বিরাজ করেন কিন্তু হৃদয়রাজ্যেও যে তাঁর অপ্রতিহত অবস্থান সে বিষয়টি ভেবে দেখেন না। একজন শিল্পী যুক্তিকে স্বীকার করেন, গ্রহণ করেন, ব্যবহার করেন হৃদয় দিয়ে এবং সেভাবেই সৌন্দর্য ও সত্যের অভিন্নতাকে প্রত্যক্ষ করেন। শিল্পী তাঁর চারপাশের সমাজ সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্জাত অন্তরের নির্যাসটুকু শিল্পিতরূপে ছেনী-হাতুরী, রং-তুলি অথবা কলমের ডগা থেকে শূন্যতার সময়পটে চিহ্নিত করেন। নৃশংসতা, বর্বরতা, দমন-নিপীড়নের সাথে যেমন সত্য ও সুন্দরের ঐক্য হতে পারে না তেমনই একজন শিল্পী সমকালীন সমাজের শক্তির বিভাজনে অবশ্যই নির্যাতিতের পক্ষেই তার অবিচ্ছেদ্য অবস্থান নিশ্চিত করেন। এটাই শিল্পী সমাজের ঐক্যের মূল সূত্র। অনুপ্রাণন, শিল্প-চেতনার ঐক্যের এই মূল সূত্রের দিকেই সবাইকে ধাবিত করার প্রচেষ্টা করে যেতে চায়।
সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
সম্পাদকীয়-
মহান একুশে- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও এক দুঃখিনী বর্ণমালার ইতিহাস
বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব ও বিবর্তনের একটি স্বতন্ত্র ও মৌলিক ইতিহাস রয়েছে। আমরা জানি যে, প্রাচীন কাল থেকে পাঁচটি স্তর পার হয়ে আধুনিক বর্ণমালা এসেছে। প্রাচীনকালে কোনো বর্ণমালা ছিলো না। গাছপালা-মানুষ-প্রাণী’র ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করা হতো। এটা হচ্ছে বর্ণমালার প্রথম স্তর- “গ্রন্থিলিপি”। আনুমানিক দশ-বারো হাজার বছর আগে মানুষ গ্রন্থিলিপি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতো। এরপর এলো “ভাবলিপি”- সম্পূর্ণ ছবি না এঁকে সংকেত বা চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম। ভাবলিপি ছিলো অনেকটা এমন- দিন বোঝাতে পূর্ণ বৃত্ত, অর্থাৎ সূর্য আঁকা হতো, আর রাত বোঝাতে অর্ধ বৃত্তের সাথে তারকা আঁকা হতো। এরপর এলো তৃতীয় স্তর- “শব্দলিপি”, এই স্তরে ব্যাপক হারে ছবির বদলে চিহ্নের ব্যবহার হতে লাগলো। শব্দলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এলো চতুর্থ স্তর- “অক্ষরলিপি”। অক্ষরলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে পঞ্চম স্তর হিসেবে এলো “ধ্বনিলিপি”। এই ধ্বনিলিপি থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। সেই সময় বিভিন্ন বর্ণে বা রঙে বিভিন্ন অক্ষর লিখা হতো, সেখান থেকেই অক্ষরের নাম হয়েছে বর্ণ, বর্ণমালা।
আমাদের বাঙলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় “ব্রাহ্মীলিপি” থেকে। পৌরাণিক উপ-কথামতে হিন্দু দেবতা ব্রহ্মা ভারতবর্ষের প্রাচীন লিপি আবিষ্কার করেছিলেন এবং ধ্বনির সাথে মানুষকে এই লিপি দান করেছিলেন, তার নামানুসারে ঐ লিপির নাম হয় ব্রাহ্মীলিপি। কেউ কেউ বলেন, বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ পুরোহিত। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মীলিপি। যে যাই বলুক, ভারতবাসী নিজেরাই সৃষ্টি করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপি। ব্রাহ্মীলিপির পেছনে ফিনিশীয় লিপির প্রভাব আছে বলে দাবী করা হয়। তবে প্রাচীন ভারতীয়রা সম্ভবত স্বাধীনভাবেই নিজেদের লিপি উদ্ভাবন করেছিল- কারণ ফিনিশীয় লিপির চেয়ে ব্রাহ্মীলিপির পার্থক্য অনেক। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ব্রাহ্মীলিপি প্রচলিত ছিল। এরপর “অশোক লিপি” বা “মৌর্য লিপি”তে এর বিবর্তন শুরু হয়। এর পরের ধাপে আসে “কুষাণ লিপি”, এগুলি কুষাণ রাজাদের আমলে প্রচলিত ছিল। এরপর ব্রাহ্মীলিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী- এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী লিপিগুলির মধ্যে পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি প্রধান, এটি ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় “কুটিল লিপির”, এটি ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিল লিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপির। প্রাচীন নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ১০ম শতকের শেষভাগে এসে উৎপত্তি হয়েছে বাঙলা লিপির। অর্থাৎ ব্রাহ্মীলিপি > অশোক লিপি বা মৌর্য লিপি > কুষাণ লিপি > উত্তরী গুপ্তলিপি (পূর্বদেশীয়) > কুটিল লিপি > নাগরী লিপি > বাঙলা লিপি।
ব্রাহ্মীলিপি থেকে সৃষ্ট বাঙলা বর্ণমালা দেখতে কিন্তু এখনকার বর্ণমালার মতো ছিলো না, সময়ের পরিবর্তনে বর্ণ’র চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে। তখন যেহেতু ছাপাখানা ছিলো না, শুদ্ধতা বজায় থাকবে কী করে? তখন মানুষ হাতে কাব্য লিখতো, পুঁথি লিখতো। একেকজনের হাতের লেখা একেকরকম, দশজন দশরকম করে “ক” “খ” লিখেছে। এভাবেই পরিবর্তিত হতে হতে পাল্টে গেছে বাঙলা বর্ণমালা। কম্বোজের রাজা নয়পালদেবের ইর্দার দানপত্রে এবং প্রথম মহীপালের বাণগড়ের দানপত্রে সর্বপ্রথম আদি বাংলা বর্ণমালা দেখতে পাওয়া যায়। ব্রাহ্মীলিপি’র প্রথম পাঠোদ্ধার করেন প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ প্রিন্সসেপ। আমাদের দেশের সিলেটের উপভাষারও কিছু বর্ণমালা ছিলো, আধুনিক বাঙলা বর্ণমালা থেকে একটু আলাদা, প্রায় অবিকৃত ‘নাগরী লিপি’র মতো।
এখন পর্যন্ত তিন ধরনের ব্রাহ্মীলিপির নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে ৪৪টি বর্ণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৯টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৫টি। বাঙলা বর্ণমালার “ঔ” ও “ঋ” ব্রাহ্মীলিপির স্বরবর্ণে না পাওয়া গেলেও ব্যঞ্জনবর্ণে এ দুটি বর্ণের নমুনা পাওয়া গেছে। আমরা এখন যে কয়টি স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ দেখি, আগে এর চেয়ে কয়েকটি বেশি ছিলো। এই তো কিছুদিন আগেও স্বরবর্ণতে ৯ ছিলো, এখন আর ৯-এর অস্তিত্ব নেই। এর সাথে ছিলো ঋৃ। ব্যঞ্জনবর্ণতে ছিলো ল (মূর্ধন্য ল), ছিলো হ্ল (মহাপ্রাণ ল), ছিলো ব (অন্তঃস্থ ব)। যুগে যুগে বাঙলা বর্ণমালার আকার-আকৃতি বদলাতে বদলাতে মুদ্রণযন্ত্রের ঢালাই ধাতুতে তৈরি বর্ণের কল্যাণে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বর্ণমালার স্বরূপ মোটামুটি স্থির রূপ পায়।
বাংলা বর্ণমালা একসময় ব্রাহ্মীলিপি থেকে উদ্ভূত হলেও মধ্যযুগে এসে বাংলা বর্ণমালা বাংলার স্বাধীন শাসন ব্যবস্থার মতোই স্বতন্ত্র পথ ধরে বিবর্তিত হয়ে নিজস্ব একটি মৌলিক রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলা বর্ণমালার এসব বিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যেও বাংলার স্বাধীন পরিচয় নির্মাণ ও পরিগ্রহণের আকাক্সক্ষা সম্পৃক্ত রয়েছে।
অথচ ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের অপরাপর প্রাদেশিক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ সিন্ধি, বেলুচি, পাঞ্জাবি ও পশতু ভাষার বর্ণলিপির মতোই বাংলা বর্ণমালা পরিবর্তন করে ফারসি-আরবি অথবা ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখার পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালা তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা ও ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণমালা হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমান অভিজাত শ্রেণির ভাষা ও বর্ণমালা অর্থাৎ উর্দুকেই এবং ফারসি-আরবি লিপিকেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও বর্ণমালা হিসেবে চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সিন্ধ, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উঃ পঃ সীমান্ত প্রদেশে এখনও শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাদেশিক ভাষা স্থান করে নিতে পারেনি। পাকিস্তানের এরকম অসভ্য, আধিপত্যবাদী, অমানবিক এবং অন্যায় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বাঙলায় গর্জে ওঠে প্রতিবাদ কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে বাঙালির এই দাবি এবং প্রতিবাদের যুক্তি অনুধাবন করার চেষ্টা গ্রহণ না করে তৎকালীন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বুলেটের মাধ্যমে জবাব দেওয়ার পথ গ্রহণ করে। বুকের রক্ত দিয়ে সেদিন বাঙালি তাদের মাতৃভাষা ও বর্ণমালার অধিকার আদায় করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং এই বাঙলায় বাঙলা ভাষা ও বর্ণমালা ব্যবহারের দাবি মেনে নিতে পাকিস্তানি শাসকদের বাধ্য করেছিল। এটাই ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
সভ্যতা, মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষে ১৯৫২ সনে বাঙালির এই ভাষা সংগ্রাম প্রতিষ্ঠিত মানবিকতার ন্যায্য যুক্তির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে পরিচালিত ছিল বলেই এই আন্দোলন সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে আজ পৃথিবীতে প্রত্যেক মাতৃভাষার মর্যাদাবোধ জাগ্রত হয়েছে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালনের জন্য জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সপ্তম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা
সম্পাদকীয়, নবম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা-
কবি ও কবিতার অনুপ্রাণন—
সূচনা লগ্ন থেকেই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন, সাহিত্যের এই বিশেষ শাখা অর্থাৎ কবিতা বিভাগটির উপর বিশেষ যত্ন দিয়ে এসেছে। কেননা সাহিত্য রচনায় কবিতাই একমাত্র শাখা যেখানে কবির অন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা অনুভূতিটি উপচে বের হয় কবিতায়। যেখানে কোনো প্লট-পরিকল্পনা বা পূর্বপ্রস্তুতির চিহ্ন খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। হতে পারে কবির সেই কথাগুলো নির্গত হয়েছিল কোনো অস্থির অথবা কোনো বেদনার অথবা কোন শান্ত-সমাহিত ধ্যানের মুহূর্তে। হৃদয় মথিত কোনো নান্দনিক অথবা কোনো মানবতবাদী ভাব সৃষ্টি ও রচনার গভীর অনুপ্রেরণায়। কিন্তু স্বতস্ফুর্তভাবে নির্গত শক্তিশালী কোনো অনুভূতি যে কোনো আকারে প্রকাশিত হলেই কী সেটা কবিতা হয়ে উঠতে পারে? কবিতা—সাহিত্য রচনাশৈলীর এমনই একটি বিশেষ ধারা যেখানে শব্দ ও ছন্দ পার¯পরিকভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখা যায়। কবিতায় শব্দগুলো একসাথে জুড়ে থেকে কোনো প্রকার উচ্চারণ, ধ্বনি, চিত্র অথবা চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে থাকে যা কি-না সরাসরি বর্ণনা করতে গেলে হতে পারে অনেক জটিল অথবা বিমূর্ত। কবিতা রচনায় প্রচ্ছন্ন থাকে ছন্দ ও মাত্রা অর্থাৎ অক্ষর অথবা শব্দাংশের সংখ্যার সম্মিলন অথবা বিন্যাস। কিন্তু, কবিতার এসব গঠন প্রক্রিয়া সবসময় সচেতনভাবে কতটুকু কবির মনে ঘটে থাকে, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমান করা কঠিন।
বাংলা ভাষার হাজার বছরের ইতিহাসে সাহিত্যের আরম্ভ অনেকটাই গীতিকবিতা দিয়েই। যেখানে উচ্চারণ ও ছন্দের মিলের সাথে যুক্ত ছিল সুর। বিষয়বস্তুতে গভীর ব্যক্তি অনুভূতির থেকে অগ্রাধিকার পেল সামাজিক-রাজনৈতিক কাহিনী। কেননা, তখন সমাজই ছিল সব, ব্যক্তির অস্তিত্ব একপ্রকার ছিল না বললেই চলে। তাই সেসব কাহিনীতে ছিল সমাজ ও রাজনীতি, ক্ষেত্রবিশেষে শাসকের গুনকীর্তন আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা, রোমান্টিক প্রেমের জনপ্রিয় আখ্যান, যৌনতা, অথবা বীরের শৌর্য-বীর্য, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম অথবা বিবাহ।
চর্যাপদ দিয়েই বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন। চর্যাপদ কতগুলো আশ্চর্য বিপরীতধর্মী কবিতার সমাহার। তাই চর্যাপদের আরেক নাম—চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়। চর্যাপদে বর্ণিত সাধন তত্ত্ব, তৎকালীন বাংলার সমাজ জীবনের চিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশের অপরূপ বর্ণনা, সকলই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে প্রমাণিত ও গৃহীত। কিন্তু, চর্যাপদের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধীতা, অভিজাতদের ধর্মদর্শন ও ধর্মানুষ্ঠানের প্রতি বিদ্রুপ উচ্চারণ ইত্যাদী’তে লোকায়তিক বৌদ্ধ ও জৈনরা যে সেই খ্রিস্টপূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণ্য-বিধানকে অমান্য করে এসেছে, তারই কতক প্রতিচ্ছবি মেলে চর্যাপদের কোনো কোনো পদ্যে। বাঙালি জাতিসত্ত্বার মূলে রয়েছে—হিন্দু লৌকিক, বৌদ্ধ লৌকিক, ইসলাম লৌকিক; এরকম সকল লৌকিকগণ। এই লৌকিক অনভিজাত বা প্রাকৃত বাঙালিই হচ্ছে প্রকৃত বাঙালি। আঠারো শতক পর্যন্ত রচিত সাহিত্য এই প্রাকৃত বাঙালির উপভোগ্য ছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, বাংলায় রূপান্তরিত রামায়ণ-মহাভারত-ভগবত, বৈষ্ণব পদাবলি, চৈতন্যের জীবনী, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, ইত্যাদী সকল সাহিত্যের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। সে সময়ের লোকসাধারণের কবিরা এই ‘লৌকিক করিয়া’ ‘লৌকিকের মতে’, মূলধারায় কবিতা তথা সাহিত্য রচনা করতেন।
কিন্তু তারপর পরে একটি দীর্ঘ ছেদ। বাংলা সাহিত্যে কথিত অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে বড়ু চণ্ডীদাস নিয়ে আসেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলাচ্ছলে জীবাত্মা-পরমাত্মা লীলা লীলায়িত হলেও মধ্যযুগের শুরুতে একাব্য অনবদ্য ভূমিকা রাখে। তবে মধ্যযুগ বিশেষভাবেই বিখ্যাত মঙ্গলকাব্যের জন্য। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শ্রেণির মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। যদিও মঙ্গলকাব্যগুলোর রূপ প্রায় একই রকম। কতিপয় মঙ্গলকাব্যে কবিতার ভারী যাদু থাকলেও সবচেয়ে বেশি ছিল সমকালীন সামাজিক জীবনের বোধ ও পরিচয়। বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাস জানতে হলে মঙ্গলকাব্য অবশ্যপাঠ্য। বৈষ্ণব পদাবলি আমাদের স্বপ্নে বিভোর করে। বৈষ্ণব পদাবলির পাত্র-পাত্রী কৃষ্ণ-রাধাকে কেন্দ্র করে যে কবিতাগুলো রচিত হয়েছিলো সেগুলো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
রাজসভায় রচিত হলেও মধ্যযুগের সাহিত্য কেবল অভিজাতদের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। মধ্যযুগে সামাজিক বৈষম্য প্রকট থাকলেও, পুরোহিত-মোল্লাদের দাপট থাকলেও, অভিজাত কর্তৃক উৎপীড়ন থাকলেও, সে যুগের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাংলার প্রাকৃতজনেরই প্রাধান্য ছিল। যারা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসবিদ, তাদের অনেকের মতে, মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি হলেন ভারতচন্দ্র আর আধুনিক যুগের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন। মাঝখানে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হলো ‘যুগসন্ধির কবি’।
মধ্যযুগের বিদায়ী দামামা বেজে ওঠে, যখন ১৭৫৭-তে আমরা স্বাধীনতা হারাই। বণিক শাসক হয়। অনেক পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের পরিবর্তন বা পতন ঘটে। ভারতচন্দ্রের রচনায় দেখা যায় পতনের ছাপ। বলা হয়ে থাকে ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ এই সত্তর বছর বাংলা সাহিত্যের পতন ঘটেছিল। সে সময় কবিয়াল ও শায়েরদের উদ্ভবে এক নিম্নরুচি সম্পন্ন সাহিত্য রচিত হয়। অর্থাৎ, কবিগান। কবিগানকে গর্ব করার মতো সাহিত্য বলতে অনেকে নারাজ। কবিয়াল ও শায়েররা বিকিয়ে গেলেও কোনো কোনো কবিগান বা শায়েরি আজো বাংলার প্রাকৃতজনের মনে শেকড় গেড়ে আছে সেসবের অনবদ্য ছন্দ ও সুরের নান্দনিকতার কারণে।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা আনেন মাইকেল মধুসূদন। মহাকাব্য রচনা করে বাংলা কবিতার রূপ বদলে দেন। শুধু তাই নয় তিনি বাংলা পয়ারকে এক নতুন রূপে উপস্থাপন করেন। ব্যবহার ক্লান্ত ছন্দরীতিকে মধুসূদন করে তোলেন প্রবাহমান (অমিত্রাক্ষর)। এর আগে অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় আধুনিকতার হাল্কা আলোকচ্ছটা দেখা যায়। তবে মধুসূদন একাই এক ধাক্কায় বাংলা সাহিত্যকে অনেক এগিয়ে দিয়ে গেছেন। মধুসূদনের দেখাদেখি অনেকে (হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, কায়কোবাদ) মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেন। কিন্তু, শেষপর্যন্ত ওগুলো মহাকাব্য না হয়ে আখ্যানকাব্য হয়ে ওঠে।
বাংলা কবিতায় মহাকাব্যের ধুমধাম চলাকালে রোমান্টিকতা নিয়ে উঁকি দেন বিহারীলাল। বাংলা কবিতার তিনি-ই প্রথম রোমান্টিক ও খাঁটি আধুনিক কবি। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘ভোরের পাখি’ বলেছেন। আত্মভাবপ্রধান কবিতার জন্ম বিহারীলালের হাতে হলেও বিকাশ ঘটে রবীন্দ্রনাথের হাতে। অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতনের মত বিহারীলাল চলে গেলেও তার কবিতার পথ ধরে আসে—সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অক্ষয়কুমার বড়াল, ডিএল রায় ও রবীন্দ্রনাথ। প্রথম মহাযুদ্ধের মাধ্যমে বদলে যাওয়া ইউরোপীয় চেতনার প্রভাব পড়ে আমাদের জীবন ও সাহিত্যে। দু’দণ্ড দেরিতে হলেও সেই প্রভাব আমাদের কবিতায় এসে ভালভাবেই পড়ে। আধুনিক কবিতাগুলো বিশশতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে ওঠে।
বিশশতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-যুগ চলাকালে রবীন্দ্রাগুনে পুড়েছেন অনেকেই। তবে রবীন্দ্র-বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি একইসাথে প্রেম ও দ্রোহের কবি। তার কবিতায় যেমন বিদ্রোহ আছে তেমনি আছে কৈশোরিক প্রেমের কাতরতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক কবিতার রমরমা হাট বসে বাংলা সাহিত্যে। বাংলা কবিতায় বাঙালির প্রথাগত বিশ্বাস, সুন্দর, কল্যাণ, আবেগ, স্বপ্ন, সুখ-দুঃখ ও কাতরতা বিসর্জন দিয়ে আধুনিক কবিগণ নগরের কথা ও ক্লান্তি, অবিশ্বাস, নিরাশার কথা ফুটিয়ে তোলেন কবিতায়। কবিতায় পাল্টে যায় বাঙালির চেতনা। বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু ও অমিয়, এই পাঁচজন কবিকে রবীন্দ্রনাথের পর আধুনিক কবিতা সৃষ্টিকারী বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু তারপর অচিরেই এই পঞ্চকবিকে অনুসরণ করে আসলেন সমর ও সুকান্ত।
সাহিত্যে রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতা মুখোমুখী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় প্রায়শই। বিশ শতকের গোড়াতেই আধুনিক সাহিত্যকে অশালীন বলে গালিগালাজ করে প্রবন্ধ ও বই ছাপেন ঊনিশ শতকের বিভিন্ন রক্ষণশীলেরা। আসলে সাহিত্য কখনো অশালীন বা অশ্লীল হয় না। বিশেষ করে কবিতা। কবিতায় সব বলা যায় সব রকম ভাবে। এছাড়া অশ্লীল কথাটি আপেক্ষিক। শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে বাগ-বিতণ্ডা না করে বরং সাহিত্যকে নিরপেক্ষ মন ও মননেই দেখা উচিত। ইতিহাস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যখনই রাষ্ট্রযন্ত্র বা শাসকশ্রেণি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে তখনই যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখচ্ছবি, অর্থাৎ কবি-সাহিত্যিকরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবিতা অথবা নানা ধরনের গদ্য রচনার মাধ্যমে। যে সাহিত্যগুলো নানাভাবে বিভিন্ন আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে। ঊনবিংশ শতককে কখনো বলা যায় বাংলা গণসংগীতের স্ফুরণকাল। সেভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও দেশ ভাগের পর পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনের হাত ধরে রচিত হয়েছে বহু প্রতিবাদী সাহিত্য, কবিতা ও গণসংগীত। পাকিস্তানিরা প্রথম যখন আমাদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানলো, শুরু হলো আন্দোলন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন একুশের প্রথম এবং অমর এক কবিতা—‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’। তবে একুশের প্রথম কবিতাটি ইতিহাস থেকে প্রায় হারিয়েই গেছে। অর্থাৎ, হানাদারদের বহু হয়রানি ও তল্লাশির দাপটে কবিতাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিসহ কবির বাসা কয়েকবার সার্চ করে লুকানো দু’একটি কপি পর্যন্ত নিয়ে যায় পুলিশ। পরবর্তীতে কবিতাটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে লিখলেন শামসুর রাহমান, যা আন্দোলনকে বেগবান ও সফল করে তুললো। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত হয়েছে বহু প্রতিবাদী ও প্রেরণাদীপ্ত কবিতা, সাহিত্য এবং গণসংগীত। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্মলেন্দু গুণ সামরিক শাসনের কড়া পাহারার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে (১৯৭৭) বীরদর্পে পড়ে শোনালেন তার অগ্নিঝরা কবিতা—
“সমবেত সকলের মত আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায়
শেখ মুজিবের কথা বলি।”
নির্মলেন্দু গুণ-ই প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কবিতার বিষয় করে তুললেন। তারপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখলেন জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামালসহ আরো অনেকে। অর্জুনের মত বীর সময় দোষে নপুংসক সাঁজলেও কবি কখনো তেমনটি হয় না বা হওয়া উচিত না। কবি হবে মজলুম, প্রয়োজনে নির্বাসিত। বলবে মানুষের (সংখ্যাগরিষ্ঠ) কথা, মানবতার কথা। রুদ্র পেলেন বাতাসে লাশের গন্ধ আর তসলিমা সব বয়স্কা বালিকাদের গোল্লা হতে ছুটে বেরুনোর আহ্বান জানালেন কবিতায়। তারপর ’৯০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় কিছু প্রতিবাদী কবিতা ও গণসংগীত।
ইতিহাসের একটি বিশ্লেষণে প্রতিভাত হয় যে, ’৯০-এর দশকের পর থেকে কবিতার পাঠক সংখ্যায় যেন ভাটা পড়েছে। ইদানীং কবি দেখলেই বলাবলি শুরু হয়—কবিতার এখন আর দিন নেই, কবিতা এখন পাঠক খায় না, কবিতার বই বাজারে কাটে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এখানেই ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে যে তথাপি কবির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশেষতঃ কবিতা প্রকাশ করতে এখন আর প্রকাশকের পেছনে লাইন দিতে হয় না। চাইলেই ফেসবুক ওয়ালে কবিতা ছুড়ে দেয়া যায়। হাইকোর্টের সামনে থেকে মূর্তি সরানো ও অন্যত্র স্থাপন নিয়ে এখনি সহস্র কবিতা ছুড়ে দেয়া যায়। এখন মিনিটে মিনিটে রচিত হচ্ছে কবিদের ভ্রুণের চেয়েও বেশি সংখ্যক কবিতা। প্রযুক্তির কল্যাণে কবি ও কবিতার পাঠক এখন একবারে মুখোমুখী দণ্ডায়মান। এটা ভাল। কিছুদিন পূর্বেও যেটা সম্ভব ছিল না খুব বেশি। শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন বা আগ্রাসন কি এখন হচ্ছে না? তবে আমরা সে রকম কোনো কবিতা পাচ্ছি না—কিন্তু কেন?
আজকাল কবিতার বিষয় কী কী, সেটা কিন্তু আমরা হাতের মুঠোয়-ই দেখতে পাচ্ছি। আমরা আজ যা হাতের মুঠোয় দেখতে পাচ্ছি তা যদি নজরুল আগেই বলে যেতে পারেন তার কবিতায়, তাহলে কী আমাদের এখনকার কবিগণ আগামী বিশ্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাদের কবিতায়, অথবা এর চেয়েও পরবর্তী কিছু। আজকাল কবিতায় নারীকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, বিদ্যমান প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র কবিতায় কতোটা স্থান পাচ্ছে নিশ্চয়ই চর্যাপদে বর্ণিত বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর এখনকার সৌন্দর্য এক হবে না। মঙ্গলকাব্য পড়ে যদি বাংলাদেশের মধ্যযুগের সামাজিক অবস্থা (ইতিহাস) জানা যায়, তবে আমাদের আজকের কবিদের কবিতা বা সাহিত্যে সমকালীন পঁচনশীল পুঁজিবাদের ভোগসর্বস্ব কায়েমী স্বার্থবাদী ও পাশাপাশি আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানসিকতার যে সমকালীন সমাজ বাস্তবতা, সেই সমাজ বাস্তবতার ঠাঁই পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাঙালির জমিতে কলের লাঙল পড়েছে, ছনের চাল হয়েছে টিনের এবং সেই চালে বসেছে কাক, শাদা কাক। মোড় নিচ্ছে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা। নেওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। সময়কে তো আর অস্বীকার করা যায় না। কালে কালে মহাকাল অবধি কবিগণই মানুষের সমস্ত অনুভূতি কে বাঁচিয়ে রাখে। কবিদের গর্ভেই বাঁচে মানুষ। আমাদের এই কবিসকল কি পারবেন মানুষের মানবিক অনুভূতিগুলোকে কবিতায় বন্দি করে মহাকাল অবধি দীর্ঘজীবন দিতে নাকি ফেসবুক বা প্রযুক্তি নামক কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন কাক ও কাল যত কিছুকেই আমরা আপন করে নিই না কেন? তাতে কোনো দোষ নেই, তবে লৌকিক বাংলার গভীর মানবিক চেতনার স্বকীয়তা কতটুকু বজায় থাকছে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে বাংলা সাহিত্যের দেবী চিরকাল কাব্যজীবি, কবিতার স্বাদ ছাড়া সে বাঁচবে কী করে। আমরা কি কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি?
নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
সুন্দরীদের উপর একক কোনো মালিকানা থাকে না- কোনো একক যুবকের…
একজন তরুণ ও একজন নারীর সম্পর্কহীন- সম্পর্কে’র, নামটা কী?
নারী’র, কান্না’র, নামটা কী? এ কান্না’র নাম উদ্ধারের দায়় কারো না কারো’র, উপর বর্তায়়। এটা কারো না কারো’র জানার/ জানাবার প্রয়োজন আছে। এজন্যই আমার কবিতা লেখা দিদি…
শরীফ শামিলের এ গল্প গ্রন্থ’র অধিকাংশ গল্প ভালোবাসার তবে অন্যান্য গল্পগুলোও বেশ ভালো। সবশ্রেণির পাঠকদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাবে।
আবু এম ইউসুফ
প্রকাশক
ভালোবাসার গল্প
তোমার নন্দনে ক্রন্দিত আমি একাকিত্বে লুণ্ঠিত দাস
কণ্টকিত গোলাপে পোষণ করিনি আজও লালিত আশ্রয়
এই নিঃসঙ্গতা কেবল আমার এক অগ্নিদগ্ধ অধ্যায়
তবু জানো রক্ষিত অরণ্যে এখনও থমকে আছে সময়
তাকে ছোঁয় অসময়ের পলাতক–বীণায় অচেনা ঢেউ
পেছনে যে ধায় সে অন্য কেউ নয়–আত্মসুখী পথঘোর
বিনিদ্র আমি জখমের কাছে অসম্ভবে খুলি বাহুভাঁজ
তুমিই আগুন বদলে দাও এই ডানা মেলার জন্মান্তর
পুনশ্চ অদম্য অর্জুন
এইসব গদ্যের জন্ম পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে। যেখানে পূবের বাতাস উড়ে যেতে যেতে পারি দেয় দু দুটি মাহাসাগর- আটলান্টিক ও প্যাসিফিক। সেখানে বসে ফেরদৌস নাহার কবিতার পাশাপাশি লিখছেন গদ্য। সেসব থেকে নির্বাচিত আটটি লেখা নিয়ে পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য । গদ্যগুলো তিনটি পর্বে: চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে, কবিতায়।
পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য
মোট ছোটগল্প তেরোটি। প্রথম পাঁচটি সারমেয়দের নিয়ে রূপক-গল্প। বিগত করোনাকালের নির্মমতার শিকার এরাও। হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ, বাজারগুলো ক্রেতাহীন, রাস্তাঘাট আর গলিগুলো জনশূন্য। রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো খাবার পাবে কোথায় ? ওরা মানুষ-ঘেঁষা সংবেদনশীল এক প্রাণী, মানুষ ওদের কাছে প্রভু তুল্য, মানুষই ভালোবাসা-করুণায় ওদের বাঁচিয়ে রাখে আবার ওদের জীবনে যতো পীড়ন-দমন সব মানুষের কারণেই ঘটে ; লেখক তাই ওদের চোখ দিয়ে এ সমাজের মানুষগুলোর ভাব-ভালোবাসা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নিষ্ঠুরতার খণ্ড খণ্ড চিত্র আঁকতে চেয়েছেন গল্পগুলোয়। করোনাকালের ছায়া, একলা ফুলি, একলা হিল্লি, গভীর অন্ধকারের ঘুম, মানুষ বোঝা দায়, মেঘের মতো কোমল সে-কথাই জানান দেয়। অন্যদিকে করোনা কথা, করোনা বিভ্রম, আজকাল খুনিকে চেনা যায় না, বন্ধঘরের লড়াই গল্পগুলো কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিপন্ন সময়কে ঘিরে আবর্তিত; এসময়ের মানসিক টানাপোড়েন, নানাবিধ আর্থ-সামাজিক দৈন্য ও দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও সন্দেহ বারবার ঘুরেফিরে গল্পগুলোর পরতে পরতে ছায়া ফেলেছে। যে বিপন্নতাবোধ থেকে মানুষের অন্তরে অসহায়তার সূত্রপাত, লেখক যেনো গল্পগুলোয় নানাভাবে-নানারঙে আখ্যানের ভেতর দিয়ে জীবনের সেই গভীর সত্যকে ধরতে চেয়েছেন । দেশান্তরী আমলকী, অন্তিম, জীবন একফোঁটা মধু মানুষের সেইসব বোধ ও উপলব্ধিকে তুলে ধরে। গল্পগুলোর বিষয়, নির্মাণ-শৈলী ও মেজাজের ভিন্নতাও লক্ষণীয় ।
করোনাকালের ছায়া - Koronakaler Chaiya
লেখক পরিচিতি :
সরদার ফারুক। জন্ম: ৯ই নভেম্বর, ১৯৬২। কপোতাক্ষ নদের তীর খালিশপুরে, পৈত্রিক নিবাস বরিশালের খালিশপুর। পেশায় বিশষজ্ঞ চিকিৎসক। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। বরিশালে ঘাট শ্রমিকদের আন্দোলন, ডেমরায় শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সংগ্রাম ও বাজিতপুরের জেলেদের লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’ সহ মোট ৭টি।
অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি
শিমুল মাহমুদ তথাকথিত প-িতগণের একাডেমিক ট্র্যাশ থেকে ঘোষণা দিয়েই দূরে সরিয়ে রেখেছেন নিজেকে; সেইসাথে অস্বীকার করেছেন যাবতীয় লিয়াজোবাদি পুরস্কার ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক পিঠ-চাপড়ানো অসভ্যতা। কবিতার সাথে তাঁর সখ্য স্বৈরশাসনের দুঃসহকাল গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে। সমান্তরালে কথাসাহিত্যে রেখেছেন নির্মোহ ছাপ; সেইসাথে সক্ষম হয়েছেন নিজেকে একজন সিদ্ধহস্ত সমালোচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। সহজাত বৈশিষ্ট্যে শিমুল মাহমুদের গদ্যমাত্রই হয়ে ওঠে মুক্তকণ্ঠ ও মুক্তচিন্তার বাহন; যা অবশ্যই সিরিয়াস পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
শিমুল মাহমুদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে ইউজিসি-র স্কলার হিসেবে পৌরাণিক বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, চেয়ারপারসন ও কলা অনুষদের ডিন-এর দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের কাগজ ‘কারুজ’। লেখকের জন্ম : ১৯৬৭ সালের ৩ মে
প্রকাশিত গ্রন্থ: ২৫টি
কাব্যকথা কাকবিদ্যা
“ও ঘুমায়
আমার ত্বকের নিচে সারাদিন
রাতে
ওকে ডেকে তুলি
আমি বাঁচি
আমার কুকুরগুলোর জন্য
ওরা
অশান্ত হয়ে উঠেছে
ওরা
আমার ত্বক
চেটে
ফুটো করে ফেলবে”
Girls of Hongkong, A collection of Bangla Poems By Shishir Azam
প্রেমের গল্প
—একটা লতা চাই, যাকে বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে পারি। তুই হবি সেই লতা, বল?
এই বলে চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সূর্য। যার দিকে সে তাকিয়ে ছিল তার মাথায় দুই বিনুনি। চোখে কাজল। লম্বা গলা আর তিরতির করে কাঁপতে থাকা নাকের বাঁশি। থুঁতনিতে তিল।
সূর্য থুঁতনি ধরে আবার বলল—এই লতা, তুই আমার লতা হবি?
বিকেলের আলো যাই যাই করেও যেন যেতে পারছে না, লতা কি বলে, সেটা সে দেখবে—দেখবেই। ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বিন্দুপাখি। প্রশ্নটা তাদের কানেও পৌঁছেছিল কি না কে বলবে—কিন্তু তারা অনেকখানি নেমে এল নিচে। তারপর আরও কত জায়গায় কুজায়গায় যে প্রশ্নের এই রেশ চলে গিয়েছিল বিকালবেলাটি তার হিসাব দিতে পারবে না। যেমন—লতাদের ছাদের একপাশে কবুতরের ঘর। তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। পুবকোণার দেয়ালের পাশে কয়েকটি সন্ধ্যামালতি ফুটব ফুটব করছিল কিন্তু সূর্যর প্রশ্নে লতা কি উত্তর দেয় তা শোনার জন্যে আগেভাগেই ফুটে গেল।
সূর্য থুঁতনি ধরেই ছিল। লতা মুখ নিচু করেই ছিল। ছাদের ভেতরে এত বাতাসের যাওয়া আসা তবু লতার গরম লাগতে লাগল। নাকের ডগায় চিকচিক করতে লাগল ঘাম।
ধীরে ধীরে চোখ তুলে লতা যখন কথা বলবে, হয়েছে কি, গলা দিয়ে আর কথা বের হয় না। জিব শুকিয়ে গেছে। গলা দিয়ে ফিসফিসানো শব্দ বের হল। আর সেই শব্দের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে—সূর্য ভাইয়া! আমার খুব ভয় করে।
সূর্য কলেজ। লতা নাইন। কিন্তু এই মুহূর্তে সূর্য যেন আরও বড় হয়ে গেল। ভয় করে? আমি ত আছি।
বলে লতাকে বুকের ভেতরে লুকিয়ে ফেলল।
সিঁড়ির কাছে চামেলি ফুলের ঝাড়। ঝাড়ের ভেতরে অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতরের কে ফুঁপিয়ে উঠল—
পাতা। লতার বোন। হাতে ধরা প্রেমপত্র। সূর্য ভাইয়া—I Love You।
যুগলবন্দী
লেখক পরিচিতি :
আশরাফ জুয়েল। জন্ম: ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, চাপাইনবাবগঞ্জ, বাংলাদেশ। বাবার চাকরির সুত্রে শৈশব কেটেছে যাযাবরের মতো। জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ, বগুড়া থেকে এমবিবিএস পাশের পর ঢাকাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পোস্ট গ্রজুয়েশন করে বর্তমানে চিকিৎসা পেশায় কর্মরত। ‘মস্তিষ্ক নাকি হৃদয়’। মূলত এই প্রশ্নের উত্তর খুজতেই লেখালেখিতে পুনর্জন্ম।
যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব
লেখক পরিচিতি :
নিখিল নওশাদ। জন্মসন: ১৯৮৯ইং। বড়িয়া, ধুনট, বগুড়া, বাংলাদেশ। ‘বিরোধ, ‘নিওর’ ও ‘নীড়’ পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদের সাথে যুক্ত। এটি লেখকের প্রথম প্রকাশিত বই। এছাড়া ছোটগল্প বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন।
এটি একটি চিৎকার
কিছু আগুন ফুল ফুটে আছে দিগন্তে, আমি তার নাম দিলাম কবিতা। অথচ তুমি বললে,
অন্য কোনো নাম দিতে পারতে কবি। আমি অজান্তে আড়ালে অসংখ্য নাম খুঁজে বেড়াই
প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। এই যে জোনাকজ্বলা মধ্যরাত। শিমুল বিছানো বসন্ত। আজ সবই
যেন তোমার মুখ। আজও দূর আকাশ দেখতে তোমায় দেখি। জানালায় উঁকি দেওয়া
চাঁদ দেখে তোমায় ভাবি।
TAPASI PAHAN by Latif Joardar
ভূমিকা-
কেবলি ভেঙে টুকরো হয়ে যায় মৃত্যু, অপরূপা মেয়ে!
বাতাসের ঘরে জন্মায় অদ্ভুত; যৌন তাড়িত অব্যয়ে…
বাতাসের বীজতলা
এতো মানুষ অথচ বনের বৃক্ষ ধরেই একদিন খুব কেঁদেছিলাম
মানুষ হয়ে গাছের কাছেই বলেছিলাম আরেকজন মানুষের দেওয়া
আমার অযাচিত নষ্ট হওয়া অফুরান কষ্টের কথা
বোবা বৃক্ষ চোখের থৈ-থৈ জল বুকের অন্ধগলির দ্বন্দ্ব আঁধার
সেদিন মুছে দিতে পারেনি তবুও প্রায় ছুটে যেতাম বৃক্ষের কাছে
সমস্ত মনস্তাপ ক্রুশবিদ্ধ স্বপ্নিল রামধনু তথা সুখে অসুখে
সেই বৃক্ষই ছিলো আমার একান্ত আপন সহচর;
জীবনভর কতশত-বার ফিসফিস শব্দে বুকে জাবের বলেছি মনের কথা
স্থির কোন পরিত্রাণ পাইনি, কিন্তু কোনদিন বলেনি
আর কখনো এসো না আমি বনের বৃক্ষমাত্র মানুষজাতের ভাষা বুঝি না
চোখের সামনে আমার সহচর বৃক্ষটি তিলে তিলে মরে যাচ্ছে দেখে
আজ আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক কাঁদলাম;
তুমি অকাল প্রয়াত হতে পার না কিন্তু হতে যাচ্ছ আমারই কারণে
আমার ব্যথার ভার তোমাকেও ব্যথাতুর করেছে মনে প্রাণে
তুমি বনের বৃক্ষ হয়েও আমাকে ধারণ করেছ বুকে
অথচ মানুষ হয়ে মানুষের ভাষা বোঝে না অনেক মানুষ আছে এ সংসারে।
কবিতা বুক ব্যান্ডেজ করে
বাংলা সাহিত্যে অনেক কবিতা আছে যার ভেতরে গল্প আছে, কাহিনি আছে। আবার অনেক কবিতা এমন কিছু অনুভূতি বা ভাবে ডুবিয়ে দেয় যা থেকে গল্প বা কথাসাহিত্য নির্মাণ করা যেতে পারে। এমনকি কিছু কবিতা আছে যার ভেতরে এমন কিছু চরিত্র আছে, যে চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে গল্প দাঁড় করানো যায়। যেমন, এক বনলতা সেনকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। কবিতাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা বেশ কিছু গল্প এক মলাটে আনার প্রয়াসেই এ সংকলনের পরিকল্পনা।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে—কেন এমন সংকলন? কেন কবিতাকে গল্পে রূপান্তরের প্রয়াস? গল্প লেখার বিষয় বা প্লট কি এতই অপ্রতুল হয়ে পড়ল যে কবিতার আশ্রয় নিতে হবে, কবিতাকে অবলম্বন করতে হবে? কবিতা কবিতার মতো থাক কবিতার জগতে, গল্প গড়ে তুলুক গল্পের জগৎ। দুটো জগতকে এক জগতে একাকার করার যৌক্তিকতা কী? প্রশ্নগুলো আকাশ-বাতাস থেকে আসে নি, আমাদের ভেতর থেকেই এসেছে। আসলে আমার কাছে যে উত্তর আছে তাকে শক্ত কোনো যৌক্তিক উত্তর দাবি করছি না। আর প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গে যাবই না। এতটুকু বলতে পারি—ভাবনাটা যখন মাথায় এসেছিল তখন একটা বিষয় আমাকে প্রভাবিত করেছিল, তা হলো ‘বন্ধন’। কবিতাকে গল্পে রূপান্তর—কবিতা আর গল্পের মাঝে কি একটা বন্ধন তৈরি করছে না? সাহিত্যের অন্যতম দুটি শাখা হিসেবে কবিতা এবং গল্পের মাঝে গড়ে ওঠা এমন বন্ধন সাহিত্যের কোনো ক্ষতি অন্তত করবে না—এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। জোর দিয়ে এ-ও বলা যায়, কবিতার বীজে গড়ে ওঠা গল্প বরং কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করবে কথাসাহিত্যকে—এ সংকলনে লিপিবদ্ধ গল্পগুলো সে স্বাক্ষরই বহন করছে।
এ সংকলনের পাঠকদের জন্য আগাম শুভকামনা।
গল্পরূপে প্রিয় কবিতা
লেখক পরিচিতি :
সাবরিনা সিরাজী তিতির। জন্ম: ২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫। বেড়ে ওঠা ফরিদপুরে। শিক্ষকতা করেছেন ফরিদপুরেই। বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রকাশিত হয়েছে দু’টি কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ হয়ে যাই’ ও ‘আগুনজল’। একটি গল্পগ্রন্থ ‘রঙের ওপারে’।
সত্যি মুখোশ মিথ্যে মুখোশ
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.