Additional information
Weight | 0.235 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.54 $ 2.06
আত্মবিস্মৃত এবং আত্মবিস্মৃতিপ্রবণ এক জনসম্প্রদায়ের নাম ‘বাঙালি’। বাঙালি বারবারই তার আত্মপরিচয় ভুলে গিয়েছে, ভুলে থেকেছে, ভুলতে চেয়েছে এবং ভুলে যেতে চায়। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি কখনো উচ্চাভিলাষী, কখনো হীনমন আবার কখনো-বা বিভ্রান্ত। এই জনসম্প্রদায় আত্ম ভুলে বারবারই অপরের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে, অপরের পরিচয় গায়ে মেখে গৌরব বোধ করেছে ও করছে। এমনকি, তাকে কোথাও বাঙালি বলে চিহ্নিত করা হলে কিংবা বাঙালি বলে চিহ্নিত হয়ে পড়লে সে হীনমন বোধ করেছে এবং করে থাকে। তথাপি ‘বাঙালি’ শব্দটির প্রতি এই জনসম্প্রদায়ের রয়েছে এক অদ্ভুত মোহ। যদিও-বা সে ধার করা পরিচয়টিকেই তার আত্মপরিচয় হিসেবে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু সবকিছুর সাথেই আবার ‘বাঙালি’ শব্দটিকেও জুড়ে রাখতে চায়। হয়তো-বা এটা করেও সে আড়ালে, নিভৃতে একান্তে ভীষণ লজ্জা বোধ করে থাকে আর নিজের কাছে থেকেই নিজের মুখ লুকাতে চায়। এমনই হীনমন এই জনসম্প্রদায়। ইতিহাসের কোনো কালে যদি এমন দেখা যায় যে, এই জনসম্প্রদায় বাঙালিত্বের জয়গান করছে ও নিজেকে সেই নামরূপে জাহির করছে, তবে, তার বহুসহস্রাব্দের ঐতিহাসিক অবস্থান বিচারে মনে হতে পারেজ্জতা নিতান্তই কালের ভ্রান্তি কিংবা দীর্ঘ স্বপ্নের মাঝে সামান্যকালের অঘটনজনিত ছেদ। কিন্তু, এটি তো অকাট্য সত্যি যে, তার বাঙালিত্ব প্রকৃতই তার অস্তিত্বের ভিত্তি, সত্তার আধার। ফলে একে মুছে ফেলাও যায় না। কখনো-বা মুছে ফেলতে চায় কিন্তু, পারে না, এর কারণও এই যে, বাঙালিত্ব তার শিকড় যা তার রক্তে বিস্তৃত এবং ভূমিতে প্রোথিত। এ-ই তার দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের যুপকাষ্ঠ। বাঙালি তার অস্তিত্বের সূত্রপাতে, উত্থানে, বিকাশে ও বিস্তারে সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমাজ বিকাশের কার্যকারণগত জটিলতায় প্রায় জীবন্মৃত। সভ্যতা বিকাশের কালপরিক্রমা ও সংঘটনাসমূহের দ্বিধান্বিত পরিনামমুখ বাঙালিকে এমন এক দ্বিধায় আটকে রেখেছে যে, তার এই অবস্থার একটাই শিরোনাম হতে পারে ‘ত্রিশঙ্কু’। এ-ই তার সংকট।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটই প্রধান প্রতিপাদ্য এই আলোচনায়। কেমন তাদের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ? বাঙালি, একটি জনসম্প্রদায় যাদের আত্মপরিচয় চিহ্নিত হয় ‘বাঙালি’ পারিভাষিক শব্দটি দিয়ে। এই জনসম্প্রদায় কবে বাঙালি বলে চিহ্নিত হলো আর কীরূপে ও কীসের ভিত্তিতেই-বা এই বাঙালিত্ব চিহ্নিত হলো তা যথেষ্ট অনুসন্ধানের বিষয়। তথ্য পাই যে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে ঐতরেয় আরণ্যকে ‘বঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাণিনির অষ্ট্যাধ্যায়ীর ভাষ্যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ‘সুহ্মাঃ, পুণ্ড্রাঃ, বঙ্গাঃ’র উল্লেখ দৃশ্যমান রয়েছে। এবং সহস্রাব্দের পুরোনো চর্যাগীতিতেও বাঙ্গালী, বঙ্গাল (দঙ্গাল?) নামের দেশের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু, সেইকালে বা সেইকাল থেকেই ‘বাঙালি’ নামের কোনো জাতিত্ববোধের জনসম্প্রদায় পাওয়া যায় না, যদিও সেকালে জনসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিরল ছিলো না। ফলে অনুমান সহজ যে আদিতেই ‘বাঙালি’ শব্দটি জাতীয়তা কিংবা জাতিসত্তার পরিচয়জ্ঞাপক কোনো পরিভাষা ছিলো না। বরং এই শব্দটি একটি জনসম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়-পরম্পরার সাক্ষ্য বহন করে। জাতিসত্তা চিহ্নিত করণের ও জাতীয়তা নির্ধারণের নিমিত্তে মানুষের যে চেতনা, জ্ঞানপ্রবণতা ও মনোভঙ্গি তা একেবারেই নতুন; অদূর অতীতের উনিশ, বিশশতকের মানুষের আধুনিক উন্মাদনার ফল হলো জাতীয়তাবোধ। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় যে, তা আসলে পাশ্চাত্যের কিছু দেশ থেকে আসা একটি ধারণা। এ-ও স্বীকার্য যে মানুষের সাংস্কৃতিক, ভাষাতাত্ত্বিক কিংবা নৃতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়ের ঠিকুজি অনুসন্ধান তাদের হাতেই শুরু। আর আমরা তাদের উপনিবেশের থাবায় পড়ে তাদেরই উদ্যোগে প্রায়, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক তৎপরতার কল্যাণ বা অপকল্যাণে আমাদের আত্ম-অহংকারের ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে এই ‘বাঙালি’ পরিভাষাটি পেয়েছি আমাদের জাতি-পরিচয়ের স্মারক রূপে। জ্ঞান সাধক আহমদ শরীফ উল্লেখ করছেন এভাবে যে, ‘সুতরাং আজকের সংহত বাঙালী জাতি গড়ে উঠেছে বিদেশী বিজাতি-বিভাষীর শাস্ত্র-সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকার সম্পৃক্ত জীবনচর্যা গ্রহণ করেই।’১ এ-ই আসলে ভারতবর্ষের মানুষের এবং বাঙালির উপনিবেশ যাপনের ফল। উপনিবেশের কারণে বাহিরের জ্ঞানের সংস্পর্শে বাঙালিরা নিজের জ্ঞানচেতনাও পেয়েছে এবং নিজস্বতায় চিন্তা করতে গিয়ে তার কিছু দ্বিধাও এসেছে অনিবার্যতায়। বাঙালির এখনো দ্বিধাঙ্কিত প্রশ্ন এই যে, এই বাাঙালি জাতিত্বের ভিত্তি কি? ভিত্তি কি তার শিকড়ভূমি, সংস্কৃতি নাকি ভাষা? কেন না, পাশ্চাত্যের জ্ঞান এই বিষয়ক নির্দিষ্টতা দেয় না। বিশ^জুড়েই, জাতিসত্তা কিংবা জাতীয়তার ভিত্তি কী হবে তার কোনো বিষয়গত ও তাত্ত্বিক নির্দিষ্টতা নেই। যদিও বিষয়টি স্থির নয়, তবু, সাংস্কৃতিক ভিত্তিকেই অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে নানা কারণেই। বাঙালির জন্য বিবেচনা এই যেজ্জবঙ্গ বা বঙ্গাল প্রাচীন, তার মানুষের পরম্পরা প্রচীন ফলে তার সংস্কৃতিও প্রাচীন। বঙ্গালের মানুষের ভাষাটির নাম যে বাঙলা ছিলো এই সাক্ষ্য পাওয়া দূরহ। ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ‘বাংলা’ নামে যে ভাষাটির পরিচয় মেলে সেটি অন্তত বাঙালির প্রকরণ পরম্পরার চেয়ে পুরোনো নয়। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে বাংলা নামের ভাষাটির প্রতিষ্ঠিত লিখিত ও কথ্যরূপ পাওয়া যায়। কিন্তু, বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রবাহ ঠিক কতো পুরোনো তা নির্দিষ্ট করে নির্ণয় করা যায় না। সেটি সুনির্দিষ্ট করে নির্ধারণ করা না গেলেও ঐতিহাসিক নিদর্শনগত ভিত্তির গণনা যে তা প্রায় পাঁচ সহস্রাব্দেরও পুরোনো। খ্রিস্টপূর্ব পনের’শ অব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতবর্ষে আর্যগণের আগমনেরও অনেক আগের নানান সাংস্কৃতিক উপাদান, বিশ^াস ও লোকচর্চা বাঙালির বর্তমান সংস্কৃতিতে এখনো বিরাজমান। ফলে, সংস্কৃতিই কি নয় বাঙালির যথার্থ আত্মপরিচয়ের স্মারক? সুতরাং, বলা যায় বাঙালির যথার্থ পরিচয় তার সংস্কৃতিতেই মেলে। তবু ভাষাভিত্তিক পরিচয়টিও অগ্রাহ্য করা যায় না। আর আধুনিককালে এসে জাতিপরিচয়ের ভিত্তিকারণ হিসেবে ধর্মকে গ্রহণ করার প্রবণতাও এই বিষয়ক গ্রাহ্যতা-অগ্রাহ্যতার সীমানা ভেঙেছে। এরই ফলে বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিবেচনাটিই আজ বিভ্রান্তির করালে, হুমকির মুখে। বলা যায় তার আত্মপরিচয়ের ঠিকুজি যেন লুট হয়েছে।
বাঙালির আত্মপচরিয়ের সংকটটি অন্য আর কিছুই নয়, তার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিভ্রান্তির পরিনাম যা বিভিন্ন কালে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব বলয়ে থেকে বাঙালির সমাজচৈতন্যে প্রবেশ করেছে। বাহিরের শক্তি যেমন বাঙালির সাংস্কৃতিক, ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয়টিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে এবং চাইছে, তেমনই বাঙালি নিজেও অনেকাংশেই তার বাঙালিত্বকে আর মনে রাখতে চায় না বা অন্যভাবে চিনতে চায় নিজেকে। তারা অন্য কোনো পরিচয়ের গৌরব…
Weight | 0.235 kg |
---|---|
Published Year |
স্বপঞ্জয় চৌধুরী মূলতঃ কবি, তিনি যখন গদ্য লেখেন কাব্যিক উপস্থাপনাগুণে ভাষা হয়ে ওঠে সতত সঞ্চরণশীল নদীর মতোই উপভোগ্য ও গতিময়। প্রতিভাবান এ তরুণ লেখকের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য লেখা থেকে সাহিত্য সন্দর্শন, কবিতা ও শিল্পকলার নন্দন, নীতিশাস্ত্র, দর্শন, চলচ্চিত্রসহ বহুবিচিত্র বিষয় সুনির্বাচিত আটাশটি নিবন্ধ সমন্বয়ে তার প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলন ” নিগুঢ় শিল্পের কথাচিত্র “-এ প্রাগুক্ত ভাষিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক মূল্যবান তথ্যের সন্নিবেশ এবং যুক্তিনির্ভর সূক্ষ্মদর্শী পর্যালোচনা অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সুলিখিত গ্রন্থটি লেখক, গবেষকসহ সবশ্রেণির সাহিত্যমোদি পাঠকের প্রয়োজন মিটিয়ে তাদের অনুসন্ধিৎসু মনে নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে ।
মাহফুজ আল-হোসেন
কবি ও প্রাবন্ধিক
নিগুঢ় শিল্পের কথাচিত্র
জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৭৮, ভুরুলিয়া, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। একাডেমিক লেখাপড়াÑ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশাÑ শিক্ষকতা। এছাড়াও তার আরো ৭টি গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গ
ভূমিকা
সেই দূর শৈশবেই বজ্রকণ্ঠ’র প্রেমে পড়ে যাই। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান কিংবা ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ তোমার আমার ঠিকানা’ ; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ এসব শুনতে শুনতেই যুদ্ধের ডাক এেেলা। সেই মহানায়কের নির্দেশেই ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এদেশের সর্বস্তরের মানুষ। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হলো। আমরা সগৌরবে গেয়ে উঠলাম ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নামে বইটি এই দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রতি আমার ভালোবাসারই অভিজ্ঞান । হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রস্তুতিপর্বে সারা পৃথিবীর মানুষ এক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায়। কোভিড-১৯ অতি দ্রুত ছড়াতে থাকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। যখন ক্রমশ আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং গোটা পৃথিবী এই অণুজীবের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, ঠিক সেসময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জন্মশতবার্ষিকীর বছরব্যাপী কর্মসূচিকে উৎসবমূখর পরিবেশে না করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুবই সীমিত পরিসরে পালনের নির্দেশ দেন, যাতে কর্মসূচির কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি না পায়।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে আলাদা করে ভাবা যায় না। ’৪৭-এর পরপরই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতে শুরু করেন। আরেকজন বাঙালি, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ^দরবারে পরিচিত করিয়েছেন, যার কবিতা গান গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ-নিরন্ধ এমনকি চিঠিপত্র আমাদের চেতনাকে সবসময় উজ্জীবিত রাখে, ভরসা যোগায়, জীবনকে আলাদাভাবে চিনতে শেখায়, তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার লেখা গান আমাদের জাতীয় সংগীত। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু ভেবে রেখেছিলেন ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেবেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুযারি মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই এই গানটির প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
পূর্ববঙ্গে এসে রবীন্দ্রনাথ যে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের নদী-মাঠ-ঘাট-মানুষ-মাটি এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে, ১৩২৯ সালের ২ বৈশাখ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখলেন ‘শিলাইদহ ঘুরে এলুম- পদ্মা তাকে পরিত্যাগ করেচে’ তাই মনে হলো বীণা আছে, তা’র তার নেই। তার না থাকুক, তবু অনেক কালের অনেক গানের স্মৃতি আছে । ভালো লাগল সেই সঙ্গে মনটা কেমন উদাস হলো।’ সাজাদপুর থেকে চলে যাবার পর বহুদিন বাদে কবি আর এক বার অনেকটা প্রাণের টানেই এখানে এসেছিলেন। ১৩০৪ সালের ৮ আশ্বিন সাজাদপুর ঘাটে বোটের ওপরে বসে লিখেছিলেন ‘যাচনা’ (কল্পনা) । ‘ ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে / আমার নামটি লিখিও তোমার / মনের মন্দিরে।’ পূর্ববঙ্গের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অকুণ্ঠ ভালোবাসার বিষয়টি তাঁর নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়, এমনকি তার রবীন্দ্রবাউল হয়ে ওঠা এই পূর্ববঙ্গে এসেই। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ববঙ্গ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
স্বকৃত নোমান। কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ই নভেম্বর, ফেনির পরশুরাম উপজেলার বেলোনিয়ায়। শৈশবে ঊর্দু, আরবি ও পারসি সাহিত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে সেলিম আল দীনের কাছ থেকে পাশ্চাত্য ও বাংলা সাহিত্যের গভীর পাঠ গ্রহণ করেন। বর্তমানে ঢাকায় সাপ্তাহিক সংবাদ ম্যাগাজিন এই সময় এর সহযোগী সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। ২০১২ সালে এইচএসবিসি কালি কলম সাহিত্য পুরস্কার পান। ‘বেগানা’ ‘হীরকডানা’ ও ‘নিশিররঙ্গিলা’ উপন্যাসসহ মোট প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা
কথাসাহিত্যের অলিগলি
বাংলা ছোটগল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে সম্প্রতি, গল্পে বাস্তববোধকে রূপায়িত সম্ভব, নাকি গল্প ছাড়া ছোটগল্প এগিয়ে যাবে এবং তা নতুন রীতির গল্প বলে আখ্যা পাবে, বাস্তব কথা মেনে চলা বড়ই কঠিন, হয়তো তা সম্ভব নাও হতে পারে, রূঢ় সত্য হলো সময়ই সঠিক মূল্যায়ন করবে।
তাহলে ছোটগল্পের সংজ্ঞা কি? কাকে ছোটগল্প বলবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ছোট কথা ছোট ব্যথা, ছোট-ছোট… অবশেষে শেষ হয়েও হইলো না শেষ’, কেউ বা বলেন, রবীন্দ্রনাথ তো ছোটগল্পকে মাটি আর মানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসে দফারফা করেছেন, আসলে ছোটগল্প মানে জগদীশ গুপ্ত-অমিয়ভূষণ মজুমদার-কমলকুমার মজুমদার-জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কথাশিল্পীদের গল্পকেই বোঝায়। তাহলে তো পথ রুদ্ধ, কেননা এই চিন্তায় বসে থাকো, নতুন গল্প আর লেখো না, কি দরকার তাই না! এই বয়ান খয়রাত করেন বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবী বা সমালোচকগণ। আমার এক বন্ধুবর প্রায়শ বলে, “গল্প কাকে বলে, কীভাবে গল্প লিখতে হয়, এ-গল্পটি গল্পই হয়নি, হয়তো হতে পারতো শেষ ফিনিশিং মাঠে মারা গেছে, রমাপদ চৌধুরী-বিমল কর বা সমরেশ বসুর গল্পই আসলে গল্প আর সব ফালতু জঙ্গল”। লেখকেরা তাদের পেছনে হন্যে হয়ে ধরনা দেয়, অধ্যাপক নামধারী বুদ্ধিজীবী-সমালোচক তাকে নিয়ে একটু লেখেন, তাতেই ধন্য, কৃতার্থ হয়ে বিগলিত হাসি, “আহা কি ফতোয়া দিলেন গুরু, শনির দশা কেটে গেলো” অর্থাৎ প-িতদের শেখানো-দেখানো ছকে শেষঅবধি গল্প নির্মিত হচ্ছে, সমালোচকরা সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা দিলেই তো লেখক, নয়তো জীবনটাই বরবাদ! সময়-স্থান-পাত্র ভেদে যুগের সাথে চিন্তা এবং প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গেই তো আমাদের পথচলা, এই পথচলা নিরন্তর, এখানে কতো নতুন ঘটনা কতো নতুন চিন্তা প্রতিনিয়ত উপস্থিত হচ্ছে, মানুষ কি সামনে যাবে না, পুরোনোর ভেতর দিয়ে নতুনকে চিনবো না, সমস্ত নতুনই তো পুরোনোকে অবলম্বন করে, কথাটা ভুলে গেলেও চলবে না। যুগ-যুগান্তর ধরে সমস্ত পুরোনোর ভেতরেই তো নতুনের জন্ম দেখি, সেই নতুনই আগামীর চলার গন্তব্য।
সেদিক বিচার করলে, মোটা দাগে বলতেই হয়, ছোটগল্পের বিষয়বস্তু খুব একটা পালটায় না, পালটায় শুধুমাত্র লেখকের দৃষ্টিকোণ বা ভঙ্গি-কাঠামো বা আঙ্গিক এবং স্বরভঙ্গি, ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক, একই বিষয় নিয়ে এক শতাব্দী ব্যবধানেও গল্প লেখা যেতে পারে, মানুষ সামাজিক জীব, সমাজের মধ্যে জীবনযাপন, সে সর্বপ্রথম জীবন-জগতের শিক্ষা নেয়, একজন লেখকও পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের ভেতরের তাবৎ অসামঞ্জস্য তাবৎ অনিয়ম এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যাবতীয় ক্ষত-দুঃখ-কষ্ট-ক্ষোভ আনন্দ-ভালোবাসা নিয়ে আপন ভুবন বা বলয়, সে বলয় নিয়ে জীবন, সেখান থেকে শুরু-শেষ, অনেকে জীবনকে ভিন্নভাবে দেখে, কেউ বা সে বলয় থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতেও পারে না, মনে রাখা আবশ্যক যে, ছোটগল্প যুগযন্ত্রণার ফসল, বহু প্রচলিত বক্তব্য মেনে বলতেই হয়, এ-শিল্পটি শুধুমাত্র যুগযন্ত্রণারই নয়, সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনও ছোটগল্পের জন্মকে ত্বরান্বিত করেছে, শিল্পবিপ্লবের ফলে ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ, সামন্ততান্ত্রিক মন্থর জীবনযাত্রার অবসান ঊনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ছোটগল্প রচনার পরিবেশ সৃষ্টি, ইউরোপ-আমেরিকান বুদ্ধিজীবীরা পারিবারিক গ্লানি বা ব্যক্তিগত সমস্যার দিকে তর্জনী উঁচু করলেন। পাশাপাশি ফ্রান্স ও রাশিয়ার সেই সমস্ত কথাসাহিত্যিকগণ সামাজিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তিলাভের জন্য তীব্রভাবে ব্যাকুল হয়েছিলেন, এডগার অ্যালান পো-ফ্লবেয়ার-মোপাসাঁ-তুর্গেনিভ-গোর্কী-গোগোল-পুশকিন-চেখভের গল্পে কঠিন বাস্তবতা ও সামাজিক চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। দুর্গত মানুষের বেদনা-ক্লেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের তীব্র কঠিন বিভীষিকাময় প্রতিচ্ছবি, কখনো বা জীবনের প্রতি অন্যরকম নিবিড় মমতা গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে আসে, তাদের লেখনী শক্তির মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে ছোটগল্প মর্যাদার আসন লাভ। যে যৌনতার মধ্যে টি.এস এলিয়ট দেখেছেন দৈহিক বিকৃতি মানসিক অবমাননা ও আত্মিক অবক্ষয়, সেই যৌনতার মধ্যেই হুইটম্যান দেখেছেন মানসিক ও দৈহিক উৎকর্ষতা ও আত্মিক মুক্তি। এর কারণ অবশ্যই সময় এবং দৃষ্টিভঙ্গি, সময়ের সাথে-সাথে মানুষের চিন্তাভাবনার স্বর মানসিকতা ভাষাগত ব্যাপারখানিক পালটে যায়, হুইটম্যানের আমেরিকা তথা পাশ্চাত্য, টি.এস এলিয়টের আমেরিকা তথা পাশ্চাত্যের সত্তর বছর আগের, অন্যদিকে এলিয়টের অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, এলিয়ট ধরে রেখেছেন সেই সময়কার তছনছ হওয়া মানবিক মূল্যবোধ, পাশাপাশি হুইটম্যান গড়ে তুলেছেন সত্য ও সুন্দরকে। তাই হুইটম্যানের কাছে যৌনতা ও প্রেম মানসিক উৎকর্ষতা ও আত্মিক মুক্তি। আর এলিয়টের কাছে যৌনতা ও প্রেম মানে যান্ত্রিক জীবনের তাৎক্ষনিক উচ্চারণ। কবিতায় হুইটম্যান প্রেমকে অন্যতম শিল্পসৌন্দর্যের ধারক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন, জীবনের প্রতি তার সমান কৌতূহল, দেহ ও আত্মার প্রতি যেমন আগ্রহ, জড়বাদ ও ভাববাদ উভয়বাদেই তার সমান আস্থা। তার কবিতায় রয়েছে অস্তিত্বের প্রশ্ন, কখনো তা দেহে সীমিত, আবার কখনো দেহকে ছাড়িয়ে তা গগনবিহারী। জীবনকে বিভিন্নভাবে দেখতেই তার চরম কৌতূহল। বোদলেয়ার বলেছেন, ‘নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির আকুতি থেকেই সাহিত্যের উন্মেষ, সৌন্দর্য সৃষ্টি ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো উদ্দেশ্যে নেই’। শিল্পসাহিত্যের মাধ্যমে নান্দনিক উপলব্ধির দ্বারা মানুষ আপন আত্মার সত্যে উপনীত হলে যে সামঞ্জস্যের সুষমা প্রতিষ্ঠিত হবে তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টি জীবনে, হয়তো তাতেই প্রকৃত মঙ্গল, টলস্টয়ও বিশ্বাস করতেন, ‘শিল্পসাহিত্যের সার্থকতা এখানেই’।
জীবনানন্দের গল্পের মূল উপজীব্য মানুষ, মানুষের জীবনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিচিত্র অবস্থার পরিবর্তনের ফলে মানুষের উপর প্রতিফলিত প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত কিছুই খুটিয়ে-খুটিয়ে তুলে ধরেছেন গল্পে, ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পাশাপাশি নদী-আকাশ গাছগাছালি-পানি গরু-ছাগল অন্ধকার নৌকা ঝাউবন-প্রেম-ভালোবাসা-যৌনক্ষুধা-অত্যাচার-লালসা কাঁটাঝোপ সকাল-দুপুর গ্রাম-শহর শহরতলী-বসতি ভোরের সোনালি রোদ্দুর তারপর এসেছে বেকারত্ব-দাম্পত্যকলহ-হীনতা প্রভৃতি কোনো কিছুই তার বিশ্লেষণের বাইরে যায়নি, সমস্ত উপাদান নিজের মতো ছকে সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন পাঠকের দরবারে। মৃত্তিকা সংলগ্ন জনমানুষের যে জীবনালেখ্য, যে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের অনুসন্ধান, তাকে কি বলবো, অবশ্যই জীবনের গল্প, জীবন এখানে বৈচিত্র্যময়-অনুভূতিপ্রবল আর তিক্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
গ্রামীণ জীবনের বিচিত্র রূপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিলো তারাশঙ্করের, কঠিন ও অসুন্দর কর্কশ সংসারের চিত্র তিনি এঁকেছেন অনেক, গল্পের চরিত্রগুলো বিচিত্র পেশাজীবী-বৃত্তিধারী, গল্প ভাষাও ভিন্ন ধরনের। জীবনানন্দ দাশ বাংলাসাহিত্যে এমনই একজন, গল্পে তিনি চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন, গ্রামীণ জীবন-সমাজচিত্র তার নখদর্পণে, বেশ জমিয়ে বলতে পারেন, ভিন্ন-ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যেতেও জুড়ি নেই, কোথাও-কোথাও বড় বেশি তাড়াহুড়োও দৃষ্টিগোচর হয়। গল্প জমতে না জমতে দেখা গেলো বনফুলের মতো শেষও হয়ে গেলো, তখনই পাঠক কেমন একটু হোঁচট খায় বৈ কি! তারপরও একাধিক বিচিত্র জীবিকা এসেছে গল্পে, তার গল্প বিকৃতির ভাষা ভিন্ন ধরনের, গল্পের উদ্দিষ্ট অভিপ্রায়ের কেন্দ্রীয় ভাববস্তুর উপযোগী আবহবদ্ধ-বিশ্লেষণী ভাষা প্রথম থেকে ব্যবহার করেন, জীবনানন্দের কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে গল্পের শক্তিমত্তা কতোখানি, গল্পের মনস্তাত্ত্বিকতা ও বিষয়বিন্যাস আলোচ্য প্রবন্ধে তুলে ধরা।
‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ শুধুমাত্র অনুভূতির ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠেনি, গল্পটি একটা ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ, এখানে একটা শক্তমক্ত কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে, চরিত্র আছে তিনটি, ঘটনা-উপঘটনার ভেতর দিয়ে কাহিনী এগিয়ে গেছে, ত্রিকোণ প্রেমের একটা সুখানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ, যে কিনা একজন সচ্ছল চাকুরে, তার স্ত্রী শচী শুধুমাত্র গৃহকত্রী, গুছিয়ে সংসার করছে, সন্তান হয়নি বলে কষ্টও নেই তেমন। এদের মাঝে জুটেছে পুরোনো বন্ধু সোমেন, যে কিনা খবরের কাগজে কাজ করে, শচী বিয়ে করেছে প্রকাশকে, সুখের সংসার লক্ষেèৗয়ে থেকে কলকাতায় এসেছে তারা, কলকাতার পরিবেশ তেমন একটা ভালোও লাগে না প্রকাশের, কেমন একটা ঘিনঘিনে স্বভাবের সে, সোমেনকে একদিন রাস্তা থেকে তুলে আনে প্রকাশ, সেই থেকে অবাধ যাতায়াত শুরু হয়ে যায় এ-বাড়িতে সোমেনের, ক্রমে-ক্রমে আবার ভালোবাসা যেন দানা বেঁধে ওঠে, কেউই ভুল করছে না তবুও ভুলের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে শচী। একটা নেশা তাদের হাওয়ায় তুলে নিয়ে যায়, সময়ে-অসময়ে আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে নতুন করে ভালোবাসা জাগ্রত হলে শচী ফিরে যেতে চায় অতীতে, তার কামনা-বাসনা ফুলে-ফেঁপে ওঠে, সোমেন বলে, মনে পড়ে একদিন বকমোহনার নদীর পাড়ে ভাঁট শ্যাওড়া জিউলি ময়নাকাটা আলোকলতার জঙ্গলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম…শচীর মধ্যে গ্রাম্যজীবনের প্রতি যে আকর্ষণ তাতে সোমেন আরো আগুন উসকে দেয়, এই নস্টালজিয়া তাকে কোনোক্রমে আর স্বস্তি দেয় না, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, ভাবাবেগে বলে ওঠে, চলো না পাড়াগাঁয়ে, বকমোহনা নদীর ধারে! সোমেন বললো, সে পাড়াগাঁর জীবন তুমি কোনোদিন ফিরে পাবে না, সেই তেলাকুচো-ফণীমনসা বনধুঁধুল কোনো অন্ধকারে কোনো জ্যোৎস্নার কতো দূরে চলে গিয়েছে, আমরা তো আর সেখানে নেই, কি হবে সেসব দিয়ে? পেছনের স্মৃতিময় জীবনের গল্পগুলো একে একে সামনে এলেও তা যে আর কোনোদিন পুনরাবৃত্তি হবে না, অর্থাৎ মানুষ ইচ্ছে করলেই আর পেছনে ফিরে যেতে পারে না, বর্তমানেই থাকতে হয়, অতীত সে তো মৃত একটা ধ্বংসস্তূপ, তাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, যেমন শচী ইচ্ছে করলেই প্রকাশকে ছাড়তে পারবে না এবং সোমেন ইচ্ছে করলেই শচীকে ফিরে পাবে না, সময় এবং স্মৃতি সর্বদা জ্বলন্ত শিখা হয়ে জ্বালায় বনভূমি-মনভূমি, হয়তো মানুষ দাবানল বলে কিন্তু বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলে তাকে কি বলবে, অন্তর্জ¡ালা, নাকি আত্মার কষ্ট! যে মানুষ একবার চলে আসে, সে কি আর ফিরে যেতে পারে, পাড়াগাঁর মাঠ জঙ্গল কিংবা একটা সন্ধ্যা অথবা একটা রাত্রি, সোমেন বলে, তুমি তো ফিরে চলে আসবে আবার, মেয়েরা ভুলে যায় যতো সহজে, কারণ তারা পরিবর্তিত হতে সময় নেয় না, কিন্তু কি নিয়ে থাকবো আমি, ওই ক্ষতে আর আঘাত দিও না…এ-গল্পে জীবনানন্দের আত্মাকে দেখতে পাওয়া যায়, সোমেন যেন জীবনানন্দ হয়ে রূপান্তিত হয়েছে গল্পের আখ্যানে। নগরজীবনের আনন্দ যেভাবে এসেছে তেমনি পুরোনো স্মৃতি বা ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের যে আকর্ষণ তাও স্পষ্ট জলছবি হয়ে ফুটে উঠেছে ‘গ্রাম ও শহরের গল্পে’। গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে তিনি সুকৌশলে পৌঁছাতে পেরেছেন বলেই তো জীবনশিল্পী। বাংলা ছোটগল্প গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের বিস্তৃত উপাখ্যানে সুসমৃদ্ধ। এমনকি গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সমবায়ী তরঙ্গও দুর্নিরীক্ষা নয়। কিন্তু যান্ত্রিক কোলাহলে সমস্ত স্মৃতি ও ঐতিহ্য আবেগ, কোমল অনুভবময়তা কালের নির্মম পদপাতে পিষ্ট-বিনষ্ট হয়ে গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের ক্রমশ নাগরিক হয়ে ওঠার হৃদয় চুরমার করা হাহাকারে শিল্পিত রূপান্তর বাংলা ছোটগল্পের এলাকার দুর্লভ। পরের গল্পে জীবন যন্ত্রণার ছবি অঙ্কিত হয়েছে।
‘মেয়ে মানুষ’ জীবনানন্দের গুরুত্বপূর্ণ গল্প, মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানুষ কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন সে নিজেই সৌন্দর্যের একটি রূপ নির্মাণ করে, অথবা কদাচিৎ তুলে ধরে, এখানে তারই প্রকাশ পেয়েছে, হেমেন এবং দ্বিজেন গল্পের প্রধান চরিত্র, হেমেন ছোট্ট একটা ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থের মালিক, কিন্তু দ্বিজেন মূলত আইনজীবী, অথচ দুজনই নিঃসন্তান, সন্তানের হাহাকার সেভাবে কারো মধ্যে না থাকলেও একটা শূন্যতা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, হেমেনের স্ত্রী চপলা স্বামীহৃদয় নারী, আর দ্বিজেন স্ত্রী লীলা অন্যমূর্তির মানুষ, কিন্তু লীলার স্বামী সুদর্শন হলেও হেমেন সুপুরুষ নয়, দু’বন্ধুর জীবনের স্ত্রী প্রভাব নিয়েই গল্পের মূল বিষয়, কঠোর পরিশ্রম এবং সংগ্রামের জীবন অতিবাহিত করবার পর আর্থিক উন্নতি লাভ করে হেমেন, কিন্তু নিঃসন্তান তারা, মানসিকভাবে বিমর্ষ-অবসন্ন, তাই স্বপ্নহীন জীবন যেন, তাদের জীবনে মেয়েমানুষ একটা বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে, মানুষ সত্যি সত্যিই ওই একটা শেকড়ের কাছে বারংবার ফিরে আসে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কের গভীর যে বন্ধন, তা কেবল অর্থবিত্তের উপর দাঁড়িয়ে থাকে না, শ্রদ্ধা-ভক্তি বা বিশ্বাস-ভালোবাসা জীবনের জন্য প্রয়োজন হয়, কিন্তু লীলা ওই সত্যকে মানতে চায় না, জীবনানন্দ প্রত্যক্ষ করেছেন একজন পুরুষের জীবনে হৃদয়বতী নারীর প্রেম কতোটা আবশ্যক, বিবাহিত স্ত্রীর কাছে থেকেই হোক বা পরস্ত্রীর নিকট থেকেই হোক কিংবা অন্য কোনো নারী থেকেই হোক না কেন, প্রতি পুরুষই নারী ভালোবাসা পেতে ইচ্ছুক, জীবনানন্দ সচেতন কথাশিল্পী বলেই হেমেন-চপলা দ্বিজেন-লীলার ভেতরের দ্বন্দ্ব চাক্ষুস করেছেন, প্রকৃতপক্ষে সমাজের বা সংসারের এই টানাপোড়েন মানুষের জীবনকে অতিক্রম করে এবং তারপরও মানুষ নিজের প্রয়োজনে নিজেকে গড়ে তোলে।
‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পে জীবনের লেনদেনের হিসাব বেশ সাবলীলভাবে ধরা দিয়েছে, জীবন সত্যি বিচিত্র বিভীষিকাময় ছবি হয়তো একেই বলে, গল্পের প্রধান চরিত্র প্রমথ, যে গ্রাম থেকে সুদূর কলকাতায় একটা মেসে থাকে, চাকুরী সন্ধান করাটাই যেন তার একটা কাজ, সে বছর দুই আগে বিয়ে করেছে, মেয়েটির নাম শেফালী, জীবনের কোনো মানেই সে বোঝে না, হয়তো বোঝার মতো বয়স তার হয়নি বা পরিস্থিতির মধ্যে সে পড়েনি, শেফালী অন্তঃসত্ত্বা, গ্রাম থেকে স্বামীকে সে চিঠি লেখে পাতার পর পাতা কাকুতি ভরা প্রেমে সিক্ত, কতো গল্প তাতে রঙে রঙিন হয়ে থাকে, দিন দিন সে আসন্নপ্রসবা হয়, গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে প্রমথ বেশ কয়েক মাস গ্রামেই ছিলো, অথচ শেফালী যখন ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেসময় প্রমথ কলকাতা পালিয়ে যায়, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো যাকে বলে, কিন্তু শেফালী নিয়মিত চিঠি লেখে, কয়েকটি টাকা যেন পাঠায়, কারণ গর্ভের শিশুটিকে নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে, দুধ-ডিম-কলা বা ভালো কিছু খাওয়াটা প্রয়োজন, নয়তো সে নিশ্চিত মারা যাবে, এভাবে বাঁচার আর ইচ্ছেও তার নেই, তারপরও সে বাঁচতে চায়, জীবনকে সুন্দরভাবে দেখতে চায়। কিন্তু তার স্বামী প্রমথ বেকার, একটা চাকুরীর জন্য কলকাতায় পড়ে আছে, শাশুড়িও দেখতে পারে না শেফালীকে, ডানা কাটা পরীর মতো শেফালীর মা হবার কোনো সাধ ছিলো না, কারণ সে জানতো, মা হলে তার স্বামী প্রমথকে চাকুরীর সন্ধানে যেতে হবে, খরচের বিষয়টা দেখতে হবে, অর্থাৎ স্বামীকে কাছ ছাড়া করার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না, তারপরও একটা শিশু আসছে এবং সে কারণে প্রমথকে কাজের জন্য অথবা শেফালীর কষ্ট দেখতে না হয় সেজন্য দূরে পালিয়ে থাকতে হয়, নিয়মিত চিঠি আসে এবং সে পড়ে, জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে যায়, সর্বশেষে বারো টাকা পাঠাতে বলে, কলিকাতার মেসের খরচা থেকে বারো টাকা পাঠানো কঠিন, কিন্তু বারো টাকা না হলেই নয়, বাচ্চা হওয়ার জন্য ওই টাকা অতি প্রয়োজনীয়, চিঠির ভাষা রঙের মতো বদলে যায়, ভালোবাসা যেন আরো প্রগাঢ় হয়ে ধরা পড়ে, প্রমথ তবুও নিশ্চুপ থাকে, তার যেন কিছুই করার নেই, দরিদ্রতা এভাবেই মানুষকে কর্তব্যজ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তারপর এক পূর্ণিমার দিন টেলিগ্রাম এলো, শেফালীর মেয়ে হয়েছে মেয়ে, কিন্তু শেফালী চলে গেছে, গল্পে যে মস্ত একটা ধাক্কা, তা হলো দারিদ্র্যে আশাহীন জীবনের জীবন। মানুষ বুঝি এভাবেই হেরে যায়, হারতে-হারতে জীবন হয় ধোঁয়ার ধূসর পা-ুলিপি।
সম্বোধনহীন চিঠির আকারে লেখা গল্প ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’, চিঠি এবং ডায়েরির মতো ভঙ্গি, কখনো মনে হবে কতোগুলো চিঠি পরপর সাজানো, ‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পের মতোই একই আঙ্গিকে নির্মিত রচনা, ঘটনাপ্রবাহে আছে অনেক কবিত্বময়তা, আছে বিরহকাতর উপমা, অনেকটা কবিতার মতো করেই বলা, তবে গল্পের বা চিঠির বিষয় ভিন্ন, পত্রলেখক একজন হতভাগ্য পুরুষ, যার জীবনে অনেক শখ ছিলো, বউ তার পা টিপে দেবে, পাখা দিয়ে বাতাস করবে, কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন, তিন বছরের বিবাহিত জীবন, অথচ স্ত্রী অনুপমা বাপের বাড়ি, বিয়ের পর কয়েক মাস স্বামীর কাছে ছিলো, আজ বাড়ি অন্ধকার, মা কাশী গিয়েছে বিধবা বোন চারুকে নিয়ে, বাপ আর গল্পকথক ছেলে দুই বিঘের উপর বাড়িতে থাকে, বাড়ি-ঘরের প্রাচীনতম অবস্থা, দেখাশোনার কোনো মেয়েমানুষ নাই, তাই চারদিকে জঙ্গল, শিয়ালের চিৎকার, লক্ষ্মীপেঁচা-জোনাকি তো আছেই, ইঁদুর-ছুঁচা-সাপও বাড়ির আনাচে-কানাচে বাসা বেঁধেছে, তেলাপোকা-চামচিকেয় ভরা বাড়ি, কাজের মানুষ হিমাংশুর মা রান্না করে দেয় বটে, তা মুখে দেওয়া না গেলেও খেতে হয় বাধ্য হয়ে, এসব কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে পত্রের মাধ্যমে জানায়, পত্রের ভাষায় স্বভাবতই প্রত্যাশিত রোমান্টিক বা অনন্ত বিকাশিত প্রেমের রূপায়ণ দৃষ্টি কাড়ে, অথচ প্রত্যাশা কখনো পূরণ হয় না, দীর্ঘশ্বাসের একটা কু-ুলী হয়ে সঞ্চিত হয়, অনুপমা পিতাগৃহে গেছে তিন বছর, স্বামী বেচারির কোনো খোঁজ-খবর নেয় না, সে নিজের ভেতর নিজে মৃতপ্রায়, একটা জিজ্ঞাসা এবং হতাশা সর্বসময় কাজ করে, জীবনানন্দের অন্যান্য গল্পের মতোই হতাশা-বিচ্ছেদ মৃত্যু-কষ্ট দুঃখ-দৈন্যতা ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’ গল্পেও ফুটে উঠেছে।
‘কুষ্ঠের স্ত্রী’ গল্পের প্রধান চরিত্র সুশোভন, যার মুখপোড়া দাগ দেখে লোকে কুষ্ঠের দাগ বলে এবং বিয়েও হতে চায় না, অনেক ভালো-সুন্দরী পাত্রী হাতছাড়া হয়, কন্যাপক্ষকে যতোই বোঝানো যায় কিন্তু তারা গঙ্গাযাত্রীর কাছে মেয়ে বিসর্জন দেবে না। অবশেষে বাপ-মা নেই, এমন একটা এতিম মেয়ে অতসীকে পাওয়া গেলো, যে বুড়ো মামার ঘাড়ে আছে, যথারীতি বিয়ে হলেও অতসী প্রথমে চন্দনের ফোঁটা মনে করে কিছু না বুঝলেও পরে শিউরে ওঠে, ভয়ে দূরে সরে যায় এবং সে একসময় বলে যেহেতু তুমি আমার মামাকে ঠকিয়েছো, আমাকে ঠকিয়েছো, তোমার বিষয়-সম্পত্তি আমাকে সব লিখে দেবে, নয়তো মামার সঙ্গে চিরকালের মতো চলে যাবো। পরবর্তী সময়ে সুশোভন দেখে, অতসীর দাঁতের দু’পাটি ক্ষয় ধরেছে, মুখের ভেতরটা পায়খানার গহ্বরের মতো গভীর বিকৃত ছোট-বড় এবড়ো-থেবড়ো খাদ। স্নানের পর মনে হলো যতোটা সুন্দরী ভেবেছিলো প্রকৃতপক্ষে তা সম্পূর্ণ ভুল, হয়তো চোখের ভুল, মানুষ কি এভাবেই নেশায় পড়ে ভালোমন্দ বিচার না করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। গল্পটি একটা দোলাচলের নবদাম্পত্যজীবন কাহিনী, নবজীবনের স্বাদের পূর্বেই একটা ভাঙাগড়া একটা অমীমাংসিত কুহুকের হাতছানি।
‘অশ্বত্থের ডালে’ গল্পে একজন প্রধান চরিত্র নির্মল, যার আর্থিক দৈন্যতা ঘুরেফিরে ফুটে উঠেছে, ওর বাবা-মা আছে, বোনও আছে, একটি মেয়ে এবং মেয়ের মা অর্থাৎ বউও আছে, কিন্তু তারপরও নির্মল সেখানে নেই, দারিদ্র্যের পোড়াকাষ্ঠে প্রতিনিয়ত জর্জরিত, জীবনে শখ-সাধ বলতে বই পড়া, অথচ তাও জোটে না, কলিকাতা থেকে নতুন-নতুন বই কিনে আনার সাধ্য নেই, আর তাই পুরোনো পত্রিকা পড়ে নিজেকে ভুলে থাকতে হয়, পাড়াগাঁর রাত্রি কাটে না, ঘুমও আসে না, পেঁচা-বাদুড়ের ডাক শোনে, জ্যোৎস্নার ভেতর খড়ের মাঠের খেঁকশিয়ালের দৌড় দেখে, জীবনটাকে ছোট নদী ভাবে, আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়, একদিন রাত্রের অন্ধকারে মজুমদারের উঠোনের দিকে যায়, সেখানে বংশলোচন নামের একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, সে কি ভূত নাকি মজুমদারের আত্মা, কিন্তু সে জীবনের অনেক গল্প করে, হয়তো ভৌতিক কিংবা রহস্যজনক কিছু হবে, তবে গল্পে যে মানুষের কথা এসেছে, সে তো জীবনের কাছ থেকে পুরোদস্তুর উপেক্ষিত।
‘জামরুলতলা’ গল্পেও সেই আর্থিক সংকট প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে, গ্রাম্যজীবনের রোমান্স হিসেবে জামরুলতলাকে দেখেছেন লেখক, হারানি নামের যে মেয়েটিকে কথক একটু-একটু ভালোবেসেছিলো, হয়তো তা পরিপূর্ণ না-ও হতে পারে, দেখাসাক্ষাৎ হতো কখনো-সখনো, সে হারানি কলিকাতায় বি.এ পড়বে, চাকুরী একটা করবে হয়তো, কিন্তু অবনী কি একটা কাজ করেছে, হারানির বাবার বয়সী অবনীর সঙ্গে বিয়ে, জীর্ণ অসুস্থ মানুষ কিনা সুন্দরী-সুশ্রী হারানির সাতপাঁকে বাঁধা কথকের মর্মপীড়ার কারণ হয়, চাকুরিহীন-রোজগারহীন কথক তাই শুধু নির্বাক দর্শক, তার বুকের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই সমাজের কাছে, হারানিকে নিয়ে কিছু স্মৃতি আছে পোড়া দাগের মতো, জামরুলতলায় রোজ দুপুরবেলায় আসতো কিশোরী মেয়েটি, কথক টেবিলের ওপর কলম রেখে চুপচাপ দেখতো, সে দেখার মধ্যে অন্যরকম একটা নির্মল আনন্দ বা আকর্ষণ ছিলো, জীবনানন্দের গল্প ভিন্নধর্মী মেজাজ-স্বর এবং জীবনতৃষ্ণায় লালিত, জীবনের অনেক গভীরে তার গল্পের শেকড়, গল্পটি উত্তমপুরুষে লেখা, আশিরনখ যে কবি এবং গল্প লেখে, কখনো অন্তরের তাগিদে আবার কখনো বা গল্পকার হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষায়, কথক বলে যায়, তার কথা একটানা নয়, কিছু অবিন্যস্ত-অসংলগ্ন এবং খাপছাড়া। ভাষায় যতোই বুনোট থাকুক না কেন, কাব্যিকতাকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠলেও গল্প যেন ভাসা-ভাসা রয়ে যায়, জীবনানন্দের সেই এলোমেলো জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার ফলে জামরুলতলা গল্পে গল্পকথক বলেছে, অনেক বাংলা গল্প অনেক জায়গায় তো পড়েছি, গল্পটা আমার সে সমস্ত গল্পের কোনো একটার মতো হবে নাকি? যে দ্বিধা নিয়ে তার পথ চলা তা যেন আরো স্পষ্ট হয়েছে। গল্পে অভিনতুন আঙ্গিক, কাহিনী উপস্থাপনের স্বতন্ত্রভঙ্গি গ্রামীণ পটভূমি, বিষয় ও ভাষাশৈলী আপাদমস্তক স্বাতন্ত্র্য, স্বতঃস্ফূর্ত তার বর্ণনাবিন্যাস, প্রয়োজনীয় ডিটেলস্ বা প্রতিবেশ বর্ণনায় জীবনানন্দ সার্থক।
‘রক্তমাংসহীন’ মনস্তাত্ত্বিক গল্প, এ গল্পে নির্মম সত্য হলো, দারিদ্র্য স্বামী মানুষটি বড় সহজ-সরল, নিজেকে গুছিয়ে রাখার মতো ক্ষমতাও নেই, দীর্ঘদিন পর স্ত্রী ঊষা বাপের বাড়ি যাবে, কিন্তু যাবে-যাবে করেও ইচ্ছে করেই যায়নি, এদিকে তিন বছর বিয়ে হওয়া, দারিদ্র্যের মধ্যে বাস, কিন্তু বাপের বাড়ি যাবে, সেখানেও বাপ-মা নেই, ভাই-বোন আছে, হয়তো সে কারণে বাপের বাড়ি যাওয়ার কোনো উৎসাহ নেই, স্বামী বেচারী বারংবার ঊষাকে সাবধান করে, স্টিমারে যেন ঠান্ডা না লাগে, বুঝে-শুনে যেতে, তার সঙ্গী আছে যদিও হিমাংশু, ঊষারই ভাই, নিঃসন্তান এক নারীর কষ্ট বেশ ফুটে উঠেছে গল্পে, তার যদি একটা বাচ্চা থাকতো, স্টিমারে স্পিরিট স্টোভ জ্বালিয়ে দুধ গরম করে খাওয়াতে হতো, গম্ভীর হয়ে ঊষা বলে, ছেলেপিলের সুখ আর পেলাম না, আমাদের দুজনের মাঝখানে এই শূন্যতাটা রয়ে গেলো। তারপর স্বামী বেচারী অজ্ঞাতসারেই কিন্তু অনিবার্যভাবেই ঊষাকে তার বাপের বাড়ি ভাই-বোনদের কাছে যেতে দেয়, যেন কয়েকদিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে স্বামী, একটু নিরিবিলি একটু নিজের মতো করে থাকা যাকে বলে, যখন বলে, যাও কিছুদিন গিয়ে থাকো, অনেকদিন তো বাপের বাড়ি যাওনি…ঊষা ক্ষেপে যায়, তাই বুঝি তোমার চক্ষুশূল হয়েছি। স্ত্রী যেন কোনোভাবেই স্বামী ছেড়ে যেতে চায় না, দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে থাকতে-থাকতে স্ত্রী ঊষাও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, সেখান থেকে দূরে যেতে তার মন সায় দেয় না, তারপরও যেতে হয় তাকে, যায় সে। এভাবে কয়েকদিন কেটে যায়, অজ্ঞাত অন্ধকারে হাত তার নিজের নিয়মে চলে, দিন দশেক পরে খবর এলো, ঊষার মৃত্যু! সন্ধ্যার সময় কলেরা…শেষ রাতে চলে গেছে, কলেরায় এ-রকম প্রায়ই হয়ে থাকে। মৃত্যু কি ভয়াবহ, তার কাছে ভালোবাসা বা দারিদ্র্য অথবা সন্তানহীনের কষ্টের কোনো দাম নেই, সে যেন ভয়ংকর একটা দানব, সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার করে সে চলে যায়, তার কোনো হাত নেই, সবই নিয়তি!
‘শাড়ি’ গল্পে এক দারিদ্র্যনিমজ্জিত দম্পতি এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে, দরিদ্রতা যে একটা অভিশাপ তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। স্বামী রণজিৎ অনেক কষ্ট এবং যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেও স্ত্রী ঊষা বুঝেও বুঝতে চায় না, কিংবা কখনো-সখনো ভুলেই যায় যে তারা কতোটা বাস্তবতার মুখোমুখি, জীবনানন্দ হয়তো এভাবেই জীবনকে দেখেছেন, নানান রঙে নানান ভাবনায়, শাড়ি গল্পটিকে প্রতীকধর্মী বললেই হয়তো বেশ ইঙ্গিতবাহী হয়, ঊষার নিকটাত্মীয় রমেন বেড়াতে আসতে চায় কয়েক দিনের জন্য তাদের কাছে কিন্তু রণজিৎ সোজাসাপটা জবাব, নিষেধ করে দাও, নইলে পূর্বের মতো অপমান সহ্য করতে হবে মনে রেখো, মানুষ কতোখানি অসহায় হলে এমন কথা বলতে পারে, শেষাবধি দেখা যায় চিঠি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে ঘরে খিড়কি দিয়ে ফুপিয়ে-ফুপিয়ে কাঁদে ঊষা, হয়তো এছাড়া তার কি বা করার আছে! অথচ যখন দরজায় ফেরিওয়ালা বিশ্বেশ্বর কাপড়ের গাঁটরি নামায় এবং হাঁকে, বউমা কোথায়, নতুন ফ্যাশনের কাপড় এনেছি…তারপর সত্যি অবাক লাগে, কাপড় দেখার জন্য দুজন কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে, নিজের জন্য কিনতে না পারলেও দেখে বা নেড়েচেড়ে শখ মেটায়, বেনারসী-ভাগলপুরী শাড়ির জন্য মন কেমন ছটফট করে, কিন্তু কেনার সমর্থ্য নেই, গাঁটরির প্রতি লোলুপতায় ঊষার মন কেমন করলেও চোখ দুটো ছানাবড়া হয়, তারপরও দেখার যে বিলাস তা থেকে তারা সরতে রাজি নয়, একটা আকাক্সক্ষা মরে গেলেও অবশিষ্ট পড়ে থাকে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে, উভয়ের মধ্যে যে কিছুক্ষণ আগে একতরফা ঝগড়া হয়ে গেছে, তা যেন তাদের কারো স্মরণে নেই, তারা যে শাড়ির নেশায় মগ্ন, সেই মগ্নতার ভেতর দিয়ে মানুষ বাঁচে এবং হাসে অথবা ভালোবেসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। গল্পের পটভূমি নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারকে কেন্দ্র করে, আবহ বেশ রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছে, অনুভূতি সর্বদা কাজ করে, একটা দেয়াল ঘিরে আছে, সে দেয়াল ভাঙতে হবে। সে দেয়াল ভাঙনের ফলেই প্রত্যাশিত সেই সমাজ আসবে। বেঁচে থাকার জন্য সমাজতন্ত্রের চেতনা জাগ্রত আবশ্যক, সমাজকে যে অন্যভাবে দেখতে চায়, গাল্পিক জীবনযাপনের জন্য রাজনৈতিক আবহ-কালচেতনাকে শিল্পের ভাষায় চিত্রায়িত করেছেন, এ গল্পের তার স্বাক্ষর বহমান।
মূলত গ্রামীণ জনপদের ভাঙন-সামাজিক শোষণ, কখনো প্রতিবাদ বা বাঁচার সংগ্রাম, এ সমস্ত বিষয়াদি জীবনানন্দের গল্পজগত। বাংলাসাহিত্যাকাশে কথাশিল্পী জীবনানন্দ দাশ এক অনন্য প্রতিভা বলতেই হয়। তার জীবদ্দশায় গল্পগুলো আলোর মুখ দেখতে পারেনি। গল্পের ভাষা নির্মাণ বাক্যশৈলী ও গল্পের উপস্থাপনায় স্বীকৃত পাওয়া যায়, গ্রামীণ গল্প বাংলাসাহিত্যে প্রাণ, তার গল্পের বিশাল একটা অংশ গ্রামীণ জীবনধারার অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাসাহিত্যে ছোটগল্প গ্রামীণ জীবন অতিক্রম করে ক্রমশ শহরমুখী হয়ে উঠছে, তুলনাসূত্রে উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের ছোটগাল্পিকরা নিম্নবিত্ত বা গ্রামীণ জীবন চিত্রণে যতোখানি সুদক্ষ-স্বচ্ছন্দ-বস্তুনিষ্ঠ অপরদিকে কিন্তু নগরজীবনের মধ্যবিত্ত জীবনযাপন চিত্রণে অতোখানি আগ্রহী বা স্বচ্ছন্দ নয়। জীবনানন্দ দাশের কাব্যে ইউরোপীয় শিল্প মতবাদকে আত্মস্থ করে লোকজ মিথ-রূপকথা-পুরাণ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যুগগত ভাবকে বাণীরূপ দেন অবলীলায়। বিষয়-বিষয়ী ও ভাবের অন্তরে ফল্গুধারার ন্যায় বাহিত হয় অখ- কালচেতনা। এ কারণেই শ্বাশত সত্যের শানিত শরীর ঠেলে কোনো বিশেষ একটি শিল্প মতবাদ তার কাব্যদেহে কুত্রাপি প্রাধান্য বিস্তার করেছে, ফলত জীবনানন্দ দাশের কালচেতনা-উপস্থাপনার কৌশল হিসেবে গ্রামীণ জীবন থেকে আহরিত উপাদান ব্যবহার তাকে ত্রিশোত্তর বাংলাভাষী বা বাঙালি কবিদের দলভুক্ত না করে অভিষিক্ত করেছে স্বতন্ত্র মর্যাদায়।
মূলধারা সাহিত্যের রকমফের
চন্দন আনোয়ার। গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক। জন্ম: ৮ই জানুয়ারি, ১৯৭৮, নাটোর। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত আছেন। লেখকের ‘শাপিত পুরুষ’ ‘ইচ্ছা মুত্যু’ ‘বাংলা ছোট গল্প’ ও ‘তিন গোত্রজ গল্পকার, মানিক-হাসান-ইলিয়াস’ সহ আরো অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে।
এই সময়ের কথাসাহিত্য-১
পশ্চিমের মেঘ ও রৌদ্র-
দীঘদিন জীবনযাপন পশ্চিমে। কত সব লেখা, বই, পড়া, কতসব সিনেমা, থিয়েটার নাটক দেখা, কতসব টেলিভিশনের রাতজাগা প্রোগ্রামে নিদ্রাহীন। এইসব দেখতে দেখতে পড়তে পড়তে কতসব লেখালিখির মানুষের কথা জানা। জেনে চুপ করে বসে থাকবেন তাই কি হয়। সেসব নিয়ে লেখালেখি। সিলভিয়া প্লাথ, ডিলোন টমাস, ডিকেন্স, মার্ক ডি সাদ, জেফানাইয়া, ভ্যান গফ, গঁগা আরো কত কে। মনে কত প্রশ্ন। – কেন কান কাটলেন ভ্যান গফ, কেন তাহিতিতে পালানের গাঁগা, কেন ডিকেন্সকে দেখা দিলেন না প্রথম প্রেম বৃদ্ধা মারিয়া বিডনেল, কেন জন ফাাওলস নোবেল পেলেন না, কেন বিয়ট্রিক্স পটার সারাজীবন নরম্যান ওয়েনের আংটি পরে রইলেন, স্বামী তাঁকে সে আংটি খুলতে দিলেন না? কেন কেটলিন ম্যাকনামারা সুখ খুঁজে পেলেন একজন সাধারণ মানুষে ডিলোন টমাসে নয়। ভিভিয়েন হে উড কেন কাটালেন জীবনের অনেকগুলে বছর পাগলা গারদে একা? এমনি সব অসংখ্য প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজা। যে দেশে জলভরা মেঘ আর হঠাৎ নামা ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। সেগুলো ছাপা হলো নানা জায়গায়। দেশের ও বিদেশের পত্রপত্রিকায়। সেগুলো কুড়িয়ে দেখলেন পরিমান একমুঠো। সেগুলো মালার মত গেঁথে রচনা করলেন একটি বই। সুহ্রদ উদয় শংকর দূর্জয় সেগুলো পাঠিয়ে দিল ঢাকার অনুপ্রাণন প্রকাশনীতে। যেখান থেকে ওর দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার সেইসব লেখা এবার দুই মলাটে বন্দী হবে। একটি বই হবে। ভাবতেও আনন্দ।
চলুন পাঠক লন্ডনের বৃষ্টিভেজা ঘাসোর মাঠে একবার। দেখা যাক কি আছে সেখানে। এলিয়টের ভাষায় বলি- লেটস গো দেয়ার দেন ইউ এ্যান্ড আই।
পশ্চিমের মেঘ ও রৌদ্র
ফরিদ আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতা করেছেন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে টরেন্টোতে ।
ফরিদ আহমেদ
জন্ম ১৯৮৬, মেহেরপুর। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। ‘অরনি ছোটগল্প’ পুরস্কার ২০১২ ও ‘বৈশাখি টেলিভিশন তোমার গল্পে সবার ঈদ’ পুরস্কার ২০১৩ পেয়েছেন। দ্বিধা, আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ সহ আরো প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ
ভূমিকা
কবিতার ভেতর ঘুমিয়ে থাকে এক অদ্ভুত জীবন কিংবা জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত কবিতা। সে গভীর আর অদ্ভুতের উপলব্ধিই আমার তপস্যা। সে তপস্যা জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে কোনো কোনো মুহূর্তে যখন প্রাত্যহিক জীবনের আর সব কাজ ঘর গেরস্থালি তুচ্ছ হয়ে পড়ে। এ আমার বহুকালের যাপন। কিন্তু তা নিয়ে লিখবো কখনও এমন সাহস ছিল না। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশের প্ররোচনায় প্রথমবারের মতো সৈয়দ শামসুল হকের পরানের গহীন ভিতর, আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণের কবিতাগুলো নিয়ে লেখা গড়গড় করে বেরিয়ে যায় আমার কলম ধরে যা সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪/২০১৫ সালে। পরবর্তীতে কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হকের আস্কারায় রফিক আজাদের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মৃত্যু চেতনা ও নিজেরই আগ্রহে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের যে কবিতাগুলো স্টেজে উপস্থাপিত হয়েছিল সেগুলো নিয়ে লিখে ফেলি অনায়াসে। তাই এ গ্রন্থের সকল লেখা আমার কাছে অনুভবের সহজ বর্ণনার গদ্য হিসেবে স্বীকৃত যা উপরে উল্লেখ করা দুজনের কারণে না হলে হয়তো কোনোদিন লিখিত হতোই না। এই লেখাগুলো সংকলিত করে গ্রন্থ হিসেবে সাদরে প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে অগ্রজ লেখক ও প্রকাশক আবু এম ইউসুফ ভাই কৃতজ্ঞতার চেয়ে মায়ার বাঁধনে বেঁধে নিলেন।
মগ্নচৈতন্যের কবি ও কবিতা
বিশিষ্ট ছড়াকার, উপন্যাসিক, গবেষক, সম্পাদক প্রবীর বিকাশ সরকার এর জন্ম ১৯৫৯ সালে, বাংলাদেশের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে। ১৯৭৬ সালে চাঁদের হাট সংগঠনের সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালীন সাহিত্যচর্চার সূচনা। ১৯৮৪ সালে জাপান গমন। তার আরো ১১টি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
জানা অজানা জাপান (তৃতীয় খণ্ড)
ফকির ইলিয়াস৷ মূলত: কবি৷ এছাড়া অবাধ যাতায়াত আছে প্রবন্ধ ও গ্রন্থসমালোনায়৷ সাংবাদিক হিসাবেও ব্যাপক পরিচিতি আছে৷ প্রবাসে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-লালন ও চর্চায় তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন৷ এযাবত্ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা তেরটি৷ বিভিন্ন দেশের সাহিত্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখা ছাপা হচ্ছে৷ ‘ঠিকানা শ্রেষ্ট গ্রন্থ পুরস্কার’ ‘ফোবানা সাহিত্য পুরস্কার’সহ আরও অকে পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন দেশে ও বিদেশে৷ বর্তমানে স্বপরিবারে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন৷
সাহিত্যের শিল্পঋণ
একটা বিড়াল ছানা
কিভাবে সবার মন জয় করে একটা পরিবারের সদস্য হিসাবে নিজেকে মানিয়ে নেয় তাই প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই গল্পে।
ক্লাস সিক্স পড়ুয়া নীলার বাবা বাদামী রংয়ের ঠোঙায় করে কদম ফুলের মত একমুঠ পরিমান বিড়ালছানা নিয়ে এলেন। সেই সুন্দর বিড়ালছানার মজার মজার সব কান্ডকারখানা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বিড়ালের নামকরণ বিশ্লেষণ, মেহমান মুদ্রাদোষ বশতঃ পা নাড়লেই পাক্কা শিকারীর মত বিড়ালছানার সেই পা জাপটে ধরা, বিড়ালের উলের বল নিয়ে খেলা, ক্যালকুলেটর টিপে ভিতরের সংখ্যাগুলোর নড়াচড়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখা ইত্যাদি খুটিনাটি কিছুই বাদ পড়ে নি লেখিকার চোখ থেকে। একজন শিশুর চোখেই তিনি পুরো বিষয়টা দেখেছেন।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সুদীর্ঘ কাল চাকরি করার সুবাদে মজার মজার অভিজ্ঞতা তিনি প্রায়ই শেয়ার করেন। লেখিকা বাচ্চাদের চাইল্ড সাইকোলজি বেশ ভালো ভাবেই বুঝেন। গল্প লিখতে গেলে একজন শিশুর চোখেই বিষয়টা দেখার চেষ্টা করেন।
বিড়াল ছানা স্ন্যাফার
সমাজ, দেশ এবং বৈশ্বিক সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহকে কবি মনিরুল হক এমরান কবিতার শৈল্পিক ভাষায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই কাব্য গ্রন্থে কবি প্রেম-দ্রোহ, কষ্ট-ক্ষোভ ও মনের মাধুরী মিশিয়ে জীবনের চিত্র এঁকেছেন। তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উপজীব্য। হিংসা-প্রতিহিংসা, বকধার্মিকদের ধর্মাধর্মের বাড়াবাড়ি, মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতাকে প্রতিবাদ করেছেন কবিতার মাধ্যমে শব্দের দক্ষ কারিগরের হাতে। পাঠকের জন্য সুখপাঠ্য করে তুলেছেন প্রতিটি কবিতা। এই গ্রন্থে পাঠকের মনকে আনন্দে আন্দোলিত করার মত রয়েছে তাঁর তের্জারিমা ছন্দে লেখা পনেরটি তের্জারিমা কবিতা। দুই খ-ের তের্জারিমা বই প্রথম প্রকাশিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে। যা পরবর্তীতে পাঠক ও কবিদের মাঝে সমাদৃত হয় এবং অনেক নবীন কবি চর্চা করতে শুরু করেন। এবারের কবিতার বইটি খানিকটা ভিন্নভাবে, কবির নিজস্ব ছন্দের কয়েকটি কবিতা রয়েছে। আশা করি পাঠক বইটি পড়ে নির্মল আনন্দ পাবেন। -প্রকাশক
ঠোঁটের কারফিউ ভাঙ্গে নিষিদ্ধ আঙুল
মানুষের কখন যে কী হয়―তা হিসাব করে কেউ কখনো বলতে পারে না! হঠাৎ করেই মানুষ অন্যরকম হয়ে ওঠে। এই যে শফিকের সঙ্গে একই অফিসে কতদিন একসঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করেছে নমিতা―কোনোদিন তাকে এত মনোযোগ দিয়ে দেখেনি শফিক। কিন্তু আজ যে তার কী হলো!
নমিতা আজ খুব সুন্দরভাবে একটা শাড়ি পরে অফিসে এলো। আর আজই শফিকের খুব ভালো লেগে গেল নমিতাকে। তাই, অফিস-ছুটির পর সে তাকে রেস্টুরেন্টে চা-কফির আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু নমিতা তাকে জানালো, আজ তার হাতে একদম সময় নেই। আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বাসায়। আর তাকে, তাদের পছন্দ হলে আজই বিয়ে হয়ে যেতে পারে!
নমিতা একরকম বাধ্য হয়ে চলে যায় শফিককে পাশ কাটিয়ে। কিন্তু শফিকের খুব মনখারাপ হয়। আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না তার। মনটা তার ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে নমিতার জন্য। সে একমুহূর্তে কেমন যেন হয়ে যায়! নমিতাকে কিছুতেই সে ভুলতে পারে না।
সে নমিতাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। আর ভাবে―নমিতাকে ছাড়া তার চলবে না। আজ নমিতাকে খুব ভালো লেগেছে তার। ভাবতে-ভাবতে নমিতার জন্য শফিক যেন একেবারে পাগল হয়ে যায়! কিন্তু নমিতার যে আজই বিয়ে হয়ে যেতে পারে!
শফিক রাস্তায় হাঁটতে থাকে উদভ্রান্তের মতো। সে কি আজ বাসায় ফিরতে পারবে? শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল―তা জানতে হলে পড়তে হবে এই অনবদ্য একটি বালিকার গল্প।
এটি ১০০% রোম্যান্টিক প্রণয়োপাখ্যান।
একটি বালিকার জন্য
রবীন্দ্র-গল্পগুচ্ছে নারী বিষয়ক গ্রন্থটি একটি এম.ফিল গবেষণা-অভিসন্দর্ভ। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে যার ডিগ্রি অর্জিত হয়। অর্থাৎ প্রায় একত্রিশ বছর আগে এর রচনাকাল। এটা অবিসংবাদিত যে, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। তাঁর পঁচানব্বইটি গল্প-সংকলনের নাম গল্পগুচ্ছ। সমগ্র গল্পগুচ্ছ এক বিশাল চরিত্রশালার অন্তঃরাজ্য। গল্পগুলো তাঁর অন্যান্য রচনাবলি থেকে ব্যতিক্রম এজন্যে যে, এখানে আছে ‘মাটির কাছাকাছি’ মানুষের জীবন-যাপন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত Ñ এসব সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, রাষ্ট্রীয় সংঘাত, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, রক্ষণশীলতার সঙ্গে প্রগতিশীলতার সংঘর্ষ, এমনকি সমাজের পতিত নারীর জীবন-চিত্রণও এখানে বাদ যায় নি। ‘শাস্তি’-র দুখি-ছিদাম-রাধা-চন্দরা বা ‘সমাপ্তি’-র মৃন্ময়ী, ‘দিদি’ গল্পের দিদি অথবা ‘বিচারক’-এর রক্ষিতা ক্ষিরোদাকে রবীন্দ্র-সাহিত্যের আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে, গল্পগুচ্ছে আছে নারী-চরিত্রের প্রাধান্য। পুরুষ-চরিত্রের চেয়ে নারীচরিত্রগুলো অনেক বেশি উজ্জ্বল, অনেক বেশি শক্তিশালী ও জীবনঘনিষ্ঠ। ক্ষেত্র-বিশেষে নারীচরিত্রগুলো উপন্যাসের নারীচরিত্রের চেয়েও অধিক তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যঞ্জনাময়। ‘হৈমন্তী’ গল্পের হৈমন্তী, ‘স্ত্রীর পত্র’-এর মৃণাল, ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতা, ‘পয়লা নম্বর’-এর অনিলা, ‘রবিবার’-এর বিভা এবং ‘ল্যাবরেটরি’-র সোহিনী একেকটি যুগের একেকটি স্মারক। অভিসন্দর্ভটিতে সমকালীন জীবন ও সমাজকে যেমন বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তেমনি চরিত্রগুলোকেও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। আশা করা যায়, পাঠক এবং গবেষক উভয়েই এর দ্বারা উপকৃত হবেন।
রবীন্দ্র-গল্পগুচ্ছে নারী
আর্থিক সংকট হতাশার জন্ম দেয়। হতাশাগ্রস্ত সরল মানুষ কখনো কখনো মনের অজান্তে অপরাধী হয়ে ওঠে- পরিবার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা জসিম, সবিতা, বিপ্লবের গল্প এটি। ভরা যৌবনে এসে বিপ্লব আবার ফিরে পায় বাল্যবন্ধু জসিম ও তার বোন সবিতাকে। বিপ্লব-সবিতার আবছায়া বাল্যপ্রেম পূর্ণতা পায় এবার। কিন্তু শাহবাগের গণজাগরণ শুরু হলে চেতনাগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে তারা। চেতনাগত দ্বন্দ্বে কি প্রেম টিকে থাকে? আবার প্রকৃত প্রেম কি নিঃশেষ হয়ে যায় কখনো হৃদয় থেকে?
কাহিনি নির্মাণে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক চরিত্র। বিপ্লব, সবিতা, জসিম চরিত্র যেভাবে পাঠককে ভাবাবে- সাদিয়া, সাইদ, জব্বার চরিত্রও পাঠককে নাড়া দেবে।
শাহবাগের গণজাগরণ নিয়ে লেখা উপন্যাস বিষমায়া।
বিষমায়া
“ও ঘুমায়
আমার ত্বকের নিচে সারাদিন
রাতে
ওকে ডেকে তুলি
আমি বাঁচি
আমার কুকুরগুলোর জন্য
ওরা
অশান্ত হয়ে উঠেছে
ওরা
আমার ত্বক
চেটে
ফুটো করে ফেলবে”
Girls of Hongkong, A collection of Bangla Poems By Shishir Azam
সাঈদা মিমি। জন্ম ২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৮। বরিশালে। পেশাগত দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনের সাহিত্য সম্পাদক। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি। শ্রাবন প্রকাশনী থেকে ২০০৮ এ প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘সব নিয়ে গ্যাছে এক সময়ের লুটেরা বাতাস।’ দীর্ঘ বিরতির পর আগুনমুখা থেকে ‘ফারাও কুমারী’ Ñ২০১৪ সালে। বাংলার ই-বুক থেকে ই-বই ‘কীর্তনখোলা।’ -২০১৫ সালে। ২০১৬ তে অনুপ্রাণন থেকে কাব্যগ্রন্থ ‘একজন মৃতের ডায়েরী’ এবং কালজয়ী প্রকাশ থেকে ‘শুশুনিয়া পাহাড়’।
ঔরঙ্গজেবের নীল ঘোড়া
ভূমিকা-
কবিতার ভিতর দিয়ে বহুবিধ বহুকালের অমীমাংসিত জটিল সমীকরণের সমাধান খুঁজে চলা কবির নাম সালাহউদ্দিন সালমান, কবি যেন কলমের ডানায় আর খাতার বাতিঘরে লুকিয়ে রাখে বেঁচে থাকার মৌলতম রসদ, তার কবিতায় পাঠক খুঁজে পায় অনন্য স্থির নির্ভেজাল ধনাত্মক-ঋণাত্মক ডান বাম, ভালো মন্দ সুখ দুঃখ, অনুভূতি চিন্তা ভাবনা বোধের শৈল্পিক নিরপেক্ষতা। মানুষের সাধ্যাতীতের বিপরীতে কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলে নরম জীবনের কারুকাজ, কবি তার কবিতায় দ্রোহের রক্ত নিয়ে আলো খুঁজে অসম্ভব অনিশ্চয়তার নিঃসীম অন্ধকারে, তার একেকটি কবিতা মূর্তিমান জীবনের একেকটি দীর্ঘশ্বাস, সমাজ সংস্করণে এই জীবনমুখী কবির কবিতা যেন প্রয়োজনীয় বিদ্রোহের প্রতীক। কবির প্রেমময় কবিতাগুলো যেনও প্রেমিক প্রেমিকার বুকপকেটে ভরে রাখা কখনো কালো মেঘের আহাজারী, কখনো শূন্যতার নিঠুর মহামারী, আবার কখনো কখনো চালচুলোহীন স্বপ্নাতুর লালিত সঞ্চয়ের সমুদ্রখচিত বিশাল আকাশ। কবির একটি কবিতা পড়েছিলাম পোড়ামাটি নামক- শুইয়ে থাকা নীরব জ্যোৎস্না কে ছুঁতেই /নিজের ছায়া ছুটে চলে অন্ধকারের দিকে/ মেঘঘন আকাশের ফিকে বিছানায়/অগণিত জোনাকিদের সদ্য ঘুম মুখে/আঙুল রাখতেই খলবলিয়ে উঠে নিস্তরঙ্গ নদী/ ভাঙি দ্রোহ আর আকাক্সক্ষার জড়ানো ইমারত/ অনিবার্য পিপাসা ফুরায় অন্তর্গত অভিবাসী জলে/ অবাধ্য হাতের অকুতোভয় আঙুলগুলো বোটা ছুঁতেই/ অঝোর আষাঢ় আসে থই থই লুণ্ঠিত হয় ঘরবাড়ি/ ঘাম শুকায় ঘামে কাঁচা দেহ হয় পোড়ামাটি/ -সশরীরে দেখে মনেই হবে না সালাহউদ্দিন সালমান এমন অসংখ্য কবিতার কবি, কবির নিজের একটি উক্তি আছে কবিতাকে নিয়ে কবি প্রায় বলেন-কবিতা সত্য সুন্দর স্বপ্নিল জীবনের সাথে চলে আমরা কবিতার সাথে চলি। বিশ্বব্যাপী কবিতার মিছিলে কবি সালাহউদ্দিন সালমান এর উজ্জ্বল পদচারণ তারই দৃপ্ত প্রমাণ।
পকেট সেলাই করি ছেঁড়া জামার
স্বাগতম
আমার পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগতম হে মান্যবর ;
আমি জানি আপনার ব্যস্ততা সীমাহীন,
আবার এ-ও জানি আপনার হৃদয় আকাশের মতো
আর হৃদয়ের ভালোবাসা সাগরের মতো ;
আরো জানি,আপনার ইচ্ছেরা উড়ে বেড়ায়
প্রজাপতি আর সহস্র পাখির মতো,
আমি জানি, আপনার সেই ইচ্ছেপাখির ডানায় চড়েই
আপনি আজ এসেছেন আমার পৃথিবীতে ;
আপনার ওই নিষ্পাপ হৃদয়ে
আমাকে দিয়েছেন এক চিম্টি জায়গা,
আপনার এক পৃথিবী ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে
আমার পৃথিবীতে রেখেছেন আপনার স্বর্ণপা,
আপনাকে পেয়ে, আপনার ব্যবহারে
আমি আবেগে উদ্বেলিত,
সাথে সাথে আমি লজ্জিত
কারণ, আপনাকে সমাদর করার মতো যথেষ্ট ভদ্রতা
আমার জানা নেই,
আমি লজ্জিত, আমি নাদান,
আমার এ অজ্ঞতা,
আমার এ অনাকাঙিক্ষত অপরাধ,
আপনি মার্জনা করুন হে মান্যবর,
আসুন, আপনি আসুন।
বিলম্বিত প্রসব
এক ফোঁটা নিশ্চুপ জলবিন্দু থেকে ওর পায়ের দূরত্ব ছিল অল্প একটু। ঐ অল্প একটু দূরত্ব যাতে ও একা একা অতিক্রম করে চলে না যায়, এজন্যে আমার ভীষণ উন্মত্ততা ছিল!
সেই উন্মত্ততা পাথরে পাথরে, সেই উন্মত্ততা স্মৃতিমিনারের শীর্ষতায়, সেই উন্মত্ততার তির্যক ছোঁয়া কিছুটা পেল এই কাচের পুতুল। কে এই কাচের পুতুল? এই প্রশ্নটা তুললেই…
অচেনা বাতাস বরাবরই শুনিয়ে যায়
‘মাঝেমাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না…!’
এভাবেই শুনে যেতে থাকবো?
ঠিক এভাবেই?
প্রিয়মুখের মতন এই সূর্যাস্ত
সম্পাদকীয়-
শিল্পী গোষ্ঠীর সমাজ-সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন
শিল্পী ও সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধভাবে একমাত্র নান্দনিক সৃজনের ঘেরাটোপে বন্দী না থেকে সমাজে বসবাসের শর্তাবলী ও পরিবেশ একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক’কে অন্য যে কোন সচেতন নাগরিকের মতোই একান্তভাবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উৎসারিত ও গৃহীত সকল মতামত প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তাঁর কাজে প্রকাশ করতে দেখা যেতে পারে। বিশেষতঃ একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক পরিবেশ ও সমাজের ক্ষেত্রে গভীরভাবে সংবেদনশীল হওয়ার কারনে তাদের সৃজনশীল কাজে ও রচনায় সমাজের রীতি-নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাল-মন্দ এবং দোষ-গুণের প্রতিফলন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না বরঞ্চ এই থাকাটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্র মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকম সীমা বেঁধে দেয়। এসব সীমার মধ্য থেকেই শিল্প চর্চার বিভিন্ন মাধ্যম ও অবলম্বনের সাহায্য নিয়ে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের যেমন প্রচ্ছন্নভাবে নিজের মতটি প্রকাশ করার প্রচেষ্টা থাকে তেমনই আবার শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ দ্রোহী হয়ে মত প্রকাশের ফলে রাষ্ট্রের অথবা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কোপানলে পড়ে নির্যাতিত হওয়া এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে তাদের সহিংস আক্রমণের শিকার হতেও আমরা দেখেছি।
তাই, এখানে প্রশ্ন এটা নয় যে, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সৃজনশীল কাজে ও রচনায় সমাজের রীতি-নীতি, পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাল-মন্দ এবং দোষ-গুণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে তাদের ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন থাকবে কি-না? বাস্তবে প্রশ্নটা হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে রাষ্ট্র ও জনগণকে সচেতন করা এবং সেসব সমস্যা দূর করার জন্য সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা কীভাবে নির্ধারিত হবে? বরঞ্চ, প্রশ্নটা দুটো হচ্ছে-
ক. শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ নিজেরাই কোন সামাজিক সংগঠন করবে কি-না অথবা পেশাজীবীদের অন্য কোন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হবে কি-না? এবং
খ. স্রেফ শিল্পীদের নিজস্ব অথবা অন্য কোন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে সমাজের কোন ন্যায্য দাবী অথবা সমাজের কোন বাস্তব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত রাজপথের আন্দোলনে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে নিজেরা সম্পৃক্ত হবে কি-না? এবং
গ. যদি শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ নিয়মিতভাবে কোন সামাজিক সংগঠনমূলক কার্যক্রমে সক্রিয় হয়ে যায় এবং সামাজিক ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলনে নেমে পড়ে অথবা সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে যায় তাহলে সময় ও মনোসংযোগ দ্বিধান্বিত হয়ে বাধা পড়ে শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মান ও গুণাগুণের ক্ষেত্রে শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা কোন ক্ষতি বা সমস্যার সম্মুখীন হবে কি-না?
এখানে উল্লেখ্য যে, অন্য সামাজিক সংগঠনের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা অথবা সংহতি প্রকাশ, ঘড়ে বসে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিজস্ব সংগঠন করা অথবা ফেস্টুন ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদী নানা উপায়ে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের পক্ষে সামাজিক আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক সামাজিক আন্দোলনের সাথে কীভাবে যুক্ত হবেন সেটা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এবং এটাও বাস্তব সত্য যে একজন সংবেদনশীল ও সচেতন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক ন্যায্য দাবী ও বক্তব্য নিয়ে পরিচালিত চলমান সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তায় আবদ্ধ হয়ে কোনভাবেই নিষ্ক্রিয় এবং নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না।
১৯৬৯ এর গণভ্যুত্থান অথবা ১৯৭১ এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে শিল্পী সমাজের সদস্যবৃন্দকে সংগঠিতভাবে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে-সংগ্রামে-মিছিলে যুক্ত হতে আমরা দেখেছি। ৭১’এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এমনকি প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মুক্তিযুদ্ধে সংযুক্ত হতে আমরা দেখেছি। এর পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছেন। এসব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র।
স্বাধীনতার পর শিল্পী ও সাহিত্যিকদের যেসব সংগঠন গঠিত হয়েছে সংগঠনভেদে সেগুলোর মূল লক্ষ্যই ছিল জোটবদ্ধভাবে শিল্প চর্চা, আলোচনা-সমালোচনা, শিল্পের প্রচার-প্রসার, পরোক্ষভাবে ব্যক্তির প্রচার ও প্রসারলাভের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা থেকে বিপণন কৌশল অবলম্বন করা পর্যন্ত। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয়, সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংবাদ-মাধ্যম, কর্পোরেট অথবা নন-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পদক-পুরস্কার অথবা আনুকূল্য লাভের জন্য এসব কোন কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগঠন ও জোটের তৎপরতার সুযোগ গ্রহণ করতেও আমরা দেখেছি। শিল্প ও সাহিত্যকেন্দ্রিক নানা তৎপরতা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও এসব সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে সৃজনশীল অথবা মননশীল শিল্পগুণের মান ও রুচির উৎকর্ষতা লাভের ক্ষেত্রে এসব সংগঠন বিশেষ কোন অবদান রাখতে বিশেষ কোন সাহায্য করেছে বলে এরকম উদাহরণ পাওয়া যায় না। দলীয় অথবা ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়গুলো সেখানে খুবই নগ্নভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে এবং যার ফলে দেশে মাঝারী মানের শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতাই হয়েছে অত্যন্ত অধিকহারে। অন্যদিকে প্রচার, প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মৌলিক, মননশীল ও উচ্চতর মানসম্পন্ন শিল্প ও সাহিত্যকর্ম পাঠকদের কাছে ব্যপকভাবে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করতে পারেনি। এবং যার ফলে সত্যিকার প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা হতাশা থেকে প্রচারবিমুখতা ও আত্মকন্দ্রিকতার ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা এবং তাঁদের সাহিত্যকর্মকে আধুনিক শিশু-কিশোর ও তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশে কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী সংগঠন কাজ করছেন। কিন্তু, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্যকর্মের আক্ষরিক পঠন ও মুখস্থ করার উপরই এসব সংগঠনকে বেশী জোর দিতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের মাঝে যে মানবিক চেতনা ও যে দার্শনিক নির্যাস রয়েছে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সাথে অধিকহারে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণদের পরিচয় করিয়ে দেয়া খুব জরুরী। কেননা এতে করে দেশের নতুন প্রজন্মের মনের মাঝে মানবিক চেতনা ও সুন্দর রুচিবোধ স্থান করে নিতে পারে। এসব বিবেচনা করে রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য চর্চা ও গবেষণার জন্য যেসকল সংস্থা ও সংগঠন কাজ করছেন সেসকল সংগঠন দক্ষতার সাথে তাঁদের কাজের পরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে চলুক- এটাই প্রত্যাশা করি।
প্রথম থেকেই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, ব্যক্তি, দলীয়, গোষ্ঠী অথবা কর্পোরেট তৎপরতার বাইরে নিজের স্বাধীন অবস্থান রক্ষা করে দেশের নবীন ও তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যকদের পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন শিল্প-চর্চার জন্য অনুপ্রেরনা যুগিয়ে এসেছে। সপ্তম বর্ষে পদার্পন করে ‘অনুপ্রাণন’ অবিচলভাবেই ঐ ঘোষিত পথেই তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়। অনুপ্রাণন-এর মূল পৃষ্ঠপোষক অনুপ্রাণন-এর পাঠকেরাই। তাই, বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করতে পেরে অনুপ্রাণন-এর লেখক এবং পাঠকেরা অবশ্যই বিশেষ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
জন্ম বিক্রমপুরের দিঘলী গ্রামে। ছোটবেলা থেকে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত। বর্তমানে বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের কার্যকরী সদস্য। দৈনিক আমাদের সময়ের প্রাক্তন সাব-এডিটর।
গন্তব্যহীন দুঃখবিলাস
আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ-
কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক। জন্ম- ১৬ কার্তিক ১৩৮৪ বাংলা, ফরিদপুর বোয়ালমারী। শিক্ষা- বাংলায় স্নাতকোত্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা- বেসরকারি চাকুরী। লেখালেখি কৈশরেই, ছড়া দিয়ে হাতে খড়ি। এছাড়াও আরো চারটি গ্রন্থ লিখেছেন।
কথাকার ও কথা সাহিত্য
আয়নায় বিধ্বস্ত মুখ
গতরাতে যে স্বপ্ন তুমি এঁকে দিলে স্বরন্দ্র চোখের ভেতর
তারপর থেকে আমি বুঝে গেছি, ভালোবাসা কোনো ভেড়ার
পাল নয়
যখন যেদিকে খুশি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
যারা এসেছিল জীবনে, হাতে নিয়ে আলোকবর্তিকা
হয়তোবা আমি-ই করেছি তাদের বিতাড়িত
আর পাহাড়ের ঝরনার মত বয়ে যাওয়া কতগুলো
ব্যথা বহন করেছি নিজেই, তাঁরা তা টেরও পায়নি
কখনো-
এখনো কোনো কোনো দিন আয়নায় তাদের বিধ্বস্ত মুখগুলো
ভেসে ওঠে নিকষ অন্ধকারে, যতটা না আমি চাই
ভাবি, বুকের ভেতর অতীত বহন করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
আয়নায় বিধ্বস্ত মুখ
উপন্যাস ত্রয়ীর চরিত্র, এলাকা, প্রেক্ষাপট, নিসর্গ—সবই কাল্পনিক। লেখকের তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির শস্ত্রে ব্যবচ্ছেদ করা সমাজের নিগূঢ় সত্য বাস্তবতার ক্যানভাসে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তিনটি উপন্যাস দখল করেছে তিন ধরনের উপচার। ফাঁদ উপন্যাসটির ব্যাপক সংস্করণ হয়েছে। পরিবর্তন, পরিমার্জন ছাড়াও কলেবরও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রথম মুদ্রণের পর এই মলাটের উপন্যাসটি একই পাঠক পাঠ করলে হোঁচট খাবেন। ত্রয়ীর মলাটের বাকি দুটি উপন্যাসের সামান্য সংশোধন হয়েছে।
ফাঁদ
পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নারীর শরীরই প্রধান মাধ্যম। যুগ যুগ ধরে পুরুষের মর্ষকামিতা, ভোগ-বিলাস ও নিষ্পেষণের শিকার নারীদেরকে খাঁচায় বন্দি করতে শুধু পুরুষই নয়, বরং স্খলিত ও হীন চরিত্রের নারীরাও সেই ক্ষেত্র তৈরি করায় ভূমিকা রাখে। এমনই এক নারী সাবরিনা তার বাসায় কিশোর বয়সী মেয়েদের ফাঁদে ফেলে পতিতাবৃত্তিতে লাগিয়ে বিত্তবৈভবের মালিক হয় সে। সাবরিনার মতো অনেক মাধুকরীর প্ররোচনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় শহরের অনেক বাসায় পতিতাবৃত্তির বিস্তার লাভ করে। শিকার হয় পুষ্পর মতো নিষ্পাপ কিশোরীরা। সাবরিনার যোগসাজশে আপন ভগ্নিপতি নওয়াব আলী পুষ্পকে দেহ-ব্যবসায় বাধ্য করায়। এক রাতের ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙেপড়া পুষ্প প্রতিশোধ স্পৃহায় নওয়াব আলীর ছোট বোন টুনিকে এই ফাঁদে ফেলে ঢাকায় নিয়ে আসে। টুনিকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে গড়ায়। এই উপন্যাসের মূল কাহিনি থেকে একটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচিত্র (প্রিয়াংকা) নির্মাণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
শেষ কথাটি যাও বলে
একটি অভিজাত, নিপাট ও নিষ্কাম প্রেমের আখ্যান। শুরুর দিকে ত্রিভুজ প্রেমের ইঙ্গিত থাকলেও ঘটনাক্রমে প্রথম প্রেমিকার নিরাসক্তির কারণে দুজনের প্রেমই পরিণতির দিকে গড়ায়। বাংলাদেশের ছয়জন পেশাজীবীর কিছুদিনের প্রণোদনা প্রশিক্ষণের সময় দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি নির্মিত হয়। প্রেমের গভীর স্পন্দন অনুভূত হয় বাংলাদেশের নির্ঝর এবং দক্ষিণ ভারতের ট্যুরিস্ট গাইড অধরার বুকের গহিনে।
জলের লিখন
যুদ্ধকন্যা মারিয়াকে ঘিরে নির্মিত হয় জলের লিখন। কোনো এক অশুভ মুহূর্তে কলহপ্রিয় মাকে আতিকের বাবা তালাক দেওয়ার পর যখন হিল্লা বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল তখন, এরূপ হিল্লা বিয়ের মতো ন্যক্কারজনক ও অপমানজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেতে মেধাবী কিশোর গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে সার্টিফিকেটবিহীন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে একটি এনজিওতে চাকরি পায় এবং যুদ্ধকন্যা মারিয়ার দোভাষীর কাজ করার সময় উভয়ের মধ্যে সরল প্রেম-রসায়নের সৃষ্টি হয়। অবৈধ সন্তানের মা পারভিনের সঙ্গে প্রেমের কলি ফুটলেও পাপড়ি মেলেনি। উপন্যাসটির বিস্তর ক্যানভাস জুড়ে খোদিত হয়েছে এনজিওর কুহনিকা।
জনপ্রিয় লেখক না হলে তিনটি উপন্যাসকে একটি মলাটে মুদ্রণ নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যবসায়িক দিক থেকে অসাফল্যের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনেও এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ বোঝার কঠিন দায় নিয়ে অনুপ্রাণন প্রকাশনের পক্ষ থেকে আবু ইউসুফ ভাই বড় ঋণী করলেন। সীমাহীন আন্তরিকতা, অত্যন্ত যত্ন ও দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘উপন্যাস ত্রয়ী’ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রতি রইল অশেষ কৃতজ্ঞতা।
উপন্যাস ত্রয়ী
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.