Additional information
Weight | 0.235 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.54 $ 2.06
আত্মবিস্মৃত এবং আত্মবিস্মৃতিপ্রবণ এক জনসম্প্রদায়ের নাম ‘বাঙালি’। বাঙালি বারবারই তার আত্মপরিচয় ভুলে গিয়েছে, ভুলে থেকেছে, ভুলতে চেয়েছে এবং ভুলে যেতে চায়। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি কখনো উচ্চাভিলাষী, কখনো হীনমন আবার কখনো-বা বিভ্রান্ত। এই জনসম্প্রদায় আত্ম ভুলে বারবারই অপরের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে, অপরের পরিচয় গায়ে মেখে গৌরব বোধ করেছে ও করছে। এমনকি, তাকে কোথাও বাঙালি বলে চিহ্নিত করা হলে কিংবা বাঙালি বলে চিহ্নিত হয়ে পড়লে সে হীনমন বোধ করেছে এবং করে থাকে। তথাপি ‘বাঙালি’ শব্দটির প্রতি এই জনসম্প্রদায়ের রয়েছে এক অদ্ভুত মোহ। যদিও-বা সে ধার করা পরিচয়টিকেই তার আত্মপরিচয় হিসেবে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু সবকিছুর সাথেই আবার ‘বাঙালি’ শব্দটিকেও জুড়ে রাখতে চায়। হয়তো-বা এটা করেও সে আড়ালে, নিভৃতে একান্তে ভীষণ লজ্জা বোধ করে থাকে আর নিজের কাছে থেকেই নিজের মুখ লুকাতে চায়। এমনই হীনমন এই জনসম্প্রদায়। ইতিহাসের কোনো কালে যদি এমন দেখা যায় যে, এই জনসম্প্রদায় বাঙালিত্বের জয়গান করছে ও নিজেকে সেই নামরূপে জাহির করছে, তবে, তার বহুসহস্রাব্দের ঐতিহাসিক অবস্থান বিচারে মনে হতে পারেজ্জতা নিতান্তই কালের ভ্রান্তি কিংবা দীর্ঘ স্বপ্নের মাঝে সামান্যকালের অঘটনজনিত ছেদ। কিন্তু, এটি তো অকাট্য সত্যি যে, তার বাঙালিত্ব প্রকৃতই তার অস্তিত্বের ভিত্তি, সত্তার আধার। ফলে একে মুছে ফেলাও যায় না। কখনো-বা মুছে ফেলতে চায় কিন্তু, পারে না, এর কারণও এই যে, বাঙালিত্ব তার শিকড় যা তার রক্তে বিস্তৃত এবং ভূমিতে প্রোথিত। এ-ই তার দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের যুপকাষ্ঠ। বাঙালি তার অস্তিত্বের সূত্রপাতে, উত্থানে, বিকাশে ও বিস্তারে সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমাজ বিকাশের কার্যকারণগত জটিলতায় প্রায় জীবন্মৃত। সভ্যতা বিকাশের কালপরিক্রমা ও সংঘটনাসমূহের দ্বিধান্বিত পরিনামমুখ বাঙালিকে এমন এক দ্বিধায় আটকে রেখেছে যে, তার এই অবস্থার একটাই শিরোনাম হতে পারে ‘ত্রিশঙ্কু’। এ-ই তার সংকট।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটই প্রধান প্রতিপাদ্য এই আলোচনায়। কেমন তাদের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ? বাঙালি, একটি জনসম্প্রদায় যাদের আত্মপরিচয় চিহ্নিত হয় ‘বাঙালি’ পারিভাষিক শব্দটি দিয়ে। এই জনসম্প্রদায় কবে বাঙালি বলে চিহ্নিত হলো আর কীরূপে ও কীসের ভিত্তিতেই-বা এই বাঙালিত্ব চিহ্নিত হলো তা যথেষ্ট অনুসন্ধানের বিষয়। তথ্য পাই যে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে ঐতরেয় আরণ্যকে ‘বঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাণিনির অষ্ট্যাধ্যায়ীর ভাষ্যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ‘সুহ্মাঃ, পুণ্ড্রাঃ, বঙ্গাঃ’র উল্লেখ দৃশ্যমান রয়েছে। এবং সহস্রাব্দের পুরোনো চর্যাগীতিতেও বাঙ্গালী, বঙ্গাল (দঙ্গাল?) নামের দেশের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু, সেইকালে বা সেইকাল থেকেই ‘বাঙালি’ নামের কোনো জাতিত্ববোধের জনসম্প্রদায় পাওয়া যায় না, যদিও সেকালে জনসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিরল ছিলো না। ফলে অনুমান সহজ যে আদিতেই ‘বাঙালি’ শব্দটি জাতীয়তা কিংবা জাতিসত্তার পরিচয়জ্ঞাপক কোনো পরিভাষা ছিলো না। বরং এই শব্দটি একটি জনসম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়-পরম্পরার সাক্ষ্য বহন করে। জাতিসত্তা চিহ্নিত করণের ও জাতীয়তা নির্ধারণের নিমিত্তে মানুষের যে চেতনা, জ্ঞানপ্রবণতা ও মনোভঙ্গি তা একেবারেই নতুন; অদূর অতীতের উনিশ, বিশশতকের মানুষের আধুনিক উন্মাদনার ফল হলো জাতীয়তাবোধ। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় যে, তা আসলে পাশ্চাত্যের কিছু দেশ থেকে আসা একটি ধারণা। এ-ও স্বীকার্য যে মানুষের সাংস্কৃতিক, ভাষাতাত্ত্বিক কিংবা নৃতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়ের ঠিকুজি অনুসন্ধান তাদের হাতেই শুরু। আর আমরা তাদের উপনিবেশের থাবায় পড়ে তাদেরই উদ্যোগে প্রায়, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক তৎপরতার কল্যাণ বা অপকল্যাণে আমাদের আত্ম-অহংকারের ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে এই ‘বাঙালি’ পরিভাষাটি পেয়েছি আমাদের জাতি-পরিচয়ের স্মারক রূপে। জ্ঞান সাধক আহমদ শরীফ উল্লেখ করছেন এভাবে যে, ‘সুতরাং আজকের সংহত বাঙালী জাতি গড়ে উঠেছে বিদেশী বিজাতি-বিভাষীর শাস্ত্র-সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকার সম্পৃক্ত জীবনচর্যা গ্রহণ করেই।’১ এ-ই আসলে ভারতবর্ষের মানুষের এবং বাঙালির উপনিবেশ যাপনের ফল। উপনিবেশের কারণে বাহিরের জ্ঞানের সংস্পর্শে বাঙালিরা নিজের জ্ঞানচেতনাও পেয়েছে এবং নিজস্বতায় চিন্তা করতে গিয়ে তার কিছু দ্বিধাও এসেছে অনিবার্যতায়। বাঙালির এখনো দ্বিধাঙ্কিত প্রশ্ন এই যে, এই বাাঙালি জাতিত্বের ভিত্তি কি? ভিত্তি কি তার শিকড়ভূমি, সংস্কৃতি নাকি ভাষা? কেন না, পাশ্চাত্যের জ্ঞান এই বিষয়ক নির্দিষ্টতা দেয় না। বিশ^জুড়েই, জাতিসত্তা কিংবা জাতীয়তার ভিত্তি কী হবে তার কোনো বিষয়গত ও তাত্ত্বিক নির্দিষ্টতা নেই। যদিও বিষয়টি স্থির নয়, তবু, সাংস্কৃতিক ভিত্তিকেই অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে নানা কারণেই। বাঙালির জন্য বিবেচনা এই যেজ্জবঙ্গ বা বঙ্গাল প্রাচীন, তার মানুষের পরম্পরা প্রচীন ফলে তার সংস্কৃতিও প্রাচীন। বঙ্গালের মানুষের ভাষাটির নাম যে বাঙলা ছিলো এই সাক্ষ্য পাওয়া দূরহ। ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ‘বাংলা’ নামে যে ভাষাটির পরিচয় মেলে সেটি অন্তত বাঙালির প্রকরণ পরম্পরার চেয়ে পুরোনো নয়। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে বাংলা নামের ভাষাটির প্রতিষ্ঠিত লিখিত ও কথ্যরূপ পাওয়া যায়। কিন্তু, বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রবাহ ঠিক কতো পুরোনো তা নির্দিষ্ট করে নির্ণয় করা যায় না। সেটি সুনির্দিষ্ট করে নির্ধারণ করা না গেলেও ঐতিহাসিক নিদর্শনগত ভিত্তির গণনা যে তা প্রায় পাঁচ সহস্রাব্দেরও পুরোনো। খ্রিস্টপূর্ব পনের’শ অব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতবর্ষে আর্যগণের আগমনেরও অনেক আগের নানান সাংস্কৃতিক উপাদান, বিশ^াস ও লোকচর্চা বাঙালির বর্তমান সংস্কৃতিতে এখনো বিরাজমান। ফলে, সংস্কৃতিই কি নয় বাঙালির যথার্থ আত্মপরিচয়ের স্মারক? সুতরাং, বলা যায় বাঙালির যথার্থ পরিচয় তার সংস্কৃতিতেই মেলে। তবু ভাষাভিত্তিক পরিচয়টিও অগ্রাহ্য করা যায় না। আর আধুনিককালে এসে জাতিপরিচয়ের ভিত্তিকারণ হিসেবে ধর্মকে গ্রহণ করার প্রবণতাও এই বিষয়ক গ্রাহ্যতা-অগ্রাহ্যতার সীমানা ভেঙেছে। এরই ফলে বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিবেচনাটিই আজ বিভ্রান্তির করালে, হুমকির মুখে। বলা যায় তার আত্মপরিচয়ের ঠিকুজি যেন লুট হয়েছে।
বাঙালির আত্মপচরিয়ের সংকটটি অন্য আর কিছুই নয়, তার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিভ্রান্তির পরিনাম যা বিভিন্ন কালে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব বলয়ে থেকে বাঙালির সমাজচৈতন্যে প্রবেশ করেছে। বাহিরের শক্তি যেমন বাঙালির সাংস্কৃতিক, ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয়টিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে এবং চাইছে, তেমনই বাঙালি নিজেও অনেকাংশেই তার বাঙালিত্বকে আর মনে রাখতে চায় না বা অন্যভাবে চিনতে চায় নিজেকে। তারা অন্য কোনো পরিচয়ের গৌরব…
Weight | 0.235 kg |
---|---|
Published Year |
আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ-
কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক। জন্ম- ১৬ কার্তিক ১৩৮৪ বাংলা, ফরিদপুর বোয়ালমারী। শিক্ষা- বাংলায় স্নাতকোত্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা- বেসরকারি চাকুরী। লেখালেখি কৈশরেই, ছড়া দিয়ে হাতে খড়ি। এছাড়াও আরো চারটি গ্রন্থ লিখেছেন।
কথাকার ও কথা সাহিত্য
জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৭৮, ভুরুলিয়া, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। একাডেমিক লেখাপড়াÑ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশাÑ শিক্ষকতা। এছাড়াও তার আরো ৭টি গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গ
জন্ম ১২ জুন, ঝিনাইদহ জেলাধীন শৈলকূপা উপজেলার গোলক নগর গ্রাম। লেখাপড়াÑ ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি, গণবিশ্ববিদ্যালয়। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত। আসল নাম আলীনূর রহমান হলেও লিখে চলেছেন কখনো বঙ্গরাখাল, কখনোবা শুভ্রনূর বাবু নামে।
লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ
বঙ্গ রাখাল
জন্ম : ১২ জুন, ঝিনাইদহ।
শিক্ষা : ঝিনাইদহের বসন্তপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, দুঃখী মাহমুদ ডিগ্রী কলেজ (ঝিনাইদহ) থেকে এইচ.এস.সি। সাভার গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্নাতক (সম্মান) এবং একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা স্কুল অফ ইকনোমিকস থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ইকোনমিকস ডিগ্রী। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র থেকে গণহত্যার উপর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সদস্য।
কর্মজীবন : লক্ষীপুর, ভবানীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের বাংলার প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও বর্তমানে তিনি সমাজসেবামূলক একটা বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
১. সংস্কৃতির দিকে ফেরা (প্রবন্ধ, ২০১৫)
২. লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ (গবেষণা, ২০১৬)
৩. মানবতাবাদী লালন জীবন অন্বেষণ (প্রবন্ধ, ২০১৭)
৪. হাওয়াই ডাঙ্গার ট্রেন (কবিতা, ২০১৮)
৫. মনীষা বীক্ষণ ও অন্যান্য (প্রবন্ধ, ২০১৮)
৬. অগ্রন্থিত রফিক আজাদ (সম্পাদনা, ২০১৯)
৭. পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত্ব দর্শন (সম্পাদনা, ২০১৯)
৮. লণ্ঠনের গ্রাম (কবিতা-২০১৯)
৯. ছোটবোয়ালিয়া-জয়ন্তীনগর-বসন্তপুর গণহত্যা (অভিসন্দর্ভ)
সম্পাদিত ছোট কাগজ : নিহারণ, বঙ্গস্বর, শঙ্খধ্বনি, শব্দকুঠি ।
ই-মেইল : bangorakhal.bd@gmail.com
কবিতার করতলে
বাংলা ছোটগল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে সম্প্রতি, গল্পে বাস্তববোধকে রূপায়িত সম্ভব, নাকি গল্প ছাড়া ছোটগল্প এগিয়ে যাবে এবং তা নতুন রীতির গল্প বলে আখ্যা পাবে, বাস্তব কথা মেনে চলা বড়ই কঠিন, হয়তো তা সম্ভব নাও হতে পারে, রূঢ় সত্য হলো সময়ই সঠিক মূল্যায়ন করবে।
তাহলে ছোটগল্পের সংজ্ঞা কি? কাকে ছোটগল্প বলবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ছোট কথা ছোট ব্যথা, ছোট-ছোট… অবশেষে শেষ হয়েও হইলো না শেষ’, কেউ বা বলেন, রবীন্দ্রনাথ তো ছোটগল্পকে মাটি আর মানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসে দফারফা করেছেন, আসলে ছোটগল্প মানে জগদীশ গুপ্ত-অমিয়ভূষণ মজুমদার-কমলকুমার মজুমদার-জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কথাশিল্পীদের গল্পকেই বোঝায়। তাহলে তো পথ রুদ্ধ, কেননা এই চিন্তায় বসে থাকো, নতুন গল্প আর লেখো না, কি দরকার তাই না! এই বয়ান খয়রাত করেন বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবী বা সমালোচকগণ। আমার এক বন্ধুবর প্রায়শ বলে, “গল্প কাকে বলে, কীভাবে গল্প লিখতে হয়, এ-গল্পটি গল্পই হয়নি, হয়তো হতে পারতো শেষ ফিনিশিং মাঠে মারা গেছে, রমাপদ চৌধুরী-বিমল কর বা সমরেশ বসুর গল্পই আসলে গল্প আর সব ফালতু জঙ্গল”। লেখকেরা তাদের পেছনে হন্যে হয়ে ধরনা দেয়, অধ্যাপক নামধারী বুদ্ধিজীবী-সমালোচক তাকে নিয়ে একটু লেখেন, তাতেই ধন্য, কৃতার্থ হয়ে বিগলিত হাসি, “আহা কি ফতোয়া দিলেন গুরু, শনির দশা কেটে গেলো” অর্থাৎ প-িতদের শেখানো-দেখানো ছকে শেষঅবধি গল্প নির্মিত হচ্ছে, সমালোচকরা সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা দিলেই তো লেখক, নয়তো জীবনটাই বরবাদ! সময়-স্থান-পাত্র ভেদে যুগের সাথে চিন্তা এবং প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গেই তো আমাদের পথচলা, এই পথচলা নিরন্তর, এখানে কতো নতুন ঘটনা কতো নতুন চিন্তা প্রতিনিয়ত উপস্থিত হচ্ছে, মানুষ কি সামনে যাবে না, পুরোনোর ভেতর দিয়ে নতুনকে চিনবো না, সমস্ত নতুনই তো পুরোনোকে অবলম্বন করে, কথাটা ভুলে গেলেও চলবে না। যুগ-যুগান্তর ধরে সমস্ত পুরোনোর ভেতরেই তো নতুনের জন্ম দেখি, সেই নতুনই আগামীর চলার গন্তব্য।
সেদিক বিচার করলে, মোটা দাগে বলতেই হয়, ছোটগল্পের বিষয়বস্তু খুব একটা পালটায় না, পালটায় শুধুমাত্র লেখকের দৃষ্টিকোণ বা ভঙ্গি-কাঠামো বা আঙ্গিক এবং স্বরভঙ্গি, ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক, একই বিষয় নিয়ে এক শতাব্দী ব্যবধানেও গল্প লেখা যেতে পারে, মানুষ সামাজিক জীব, সমাজের মধ্যে জীবনযাপন, সে সর্বপ্রথম জীবন-জগতের শিক্ষা নেয়, একজন লেখকও পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের ভেতরের তাবৎ অসামঞ্জস্য তাবৎ অনিয়ম এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যাবতীয় ক্ষত-দুঃখ-কষ্ট-ক্ষোভ আনন্দ-ভালোবাসা নিয়ে আপন ভুবন বা বলয়, সে বলয় নিয়ে জীবন, সেখান থেকে শুরু-শেষ, অনেকে জীবনকে ভিন্নভাবে দেখে, কেউ বা সে বলয় থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতেও পারে না, মনে রাখা আবশ্যক যে, ছোটগল্প যুগযন্ত্রণার ফসল, বহু প্রচলিত বক্তব্য মেনে বলতেই হয়, এ-শিল্পটি শুধুমাত্র যুগযন্ত্রণারই নয়, সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনও ছোটগল্পের জন্মকে ত্বরান্বিত করেছে, শিল্পবিপ্লবের ফলে ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ, সামন্ততান্ত্রিক মন্থর জীবনযাত্রার অবসান ঊনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ছোটগল্প রচনার পরিবেশ সৃষ্টি, ইউরোপ-আমেরিকান বুদ্ধিজীবীরা পারিবারিক গ্লানি বা ব্যক্তিগত সমস্যার দিকে তর্জনী উঁচু করলেন। পাশাপাশি ফ্রান্স ও রাশিয়ার সেই সমস্ত কথাসাহিত্যিকগণ সামাজিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তিলাভের জন্য তীব্রভাবে ব্যাকুল হয়েছিলেন, এডগার অ্যালান পো-ফ্লবেয়ার-মোপাসাঁ-তুর্গেনিভ-গোর্কী-গোগোল-পুশকিন-চেখভের গল্পে কঠিন বাস্তবতা ও সামাজিক চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। দুর্গত মানুষের বেদনা-ক্লেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের তীব্র কঠিন বিভীষিকাময় প্রতিচ্ছবি, কখনো বা জীবনের প্রতি অন্যরকম নিবিড় মমতা গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে আসে, তাদের লেখনী শক্তির মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে ছোটগল্প মর্যাদার আসন লাভ। যে যৌনতার মধ্যে টি.এস এলিয়ট দেখেছেন দৈহিক বিকৃতি মানসিক অবমাননা ও আত্মিক অবক্ষয়, সেই যৌনতার মধ্যেই হুইটম্যান দেখেছেন মানসিক ও দৈহিক উৎকর্ষতা ও আত্মিক মুক্তি। এর কারণ অবশ্যই সময় এবং দৃষ্টিভঙ্গি, সময়ের সাথে-সাথে মানুষের চিন্তাভাবনার স্বর মানসিকতা ভাষাগত ব্যাপারখানিক পালটে যায়, হুইটম্যানের আমেরিকা তথা পাশ্চাত্য, টি.এস এলিয়টের আমেরিকা তথা পাশ্চাত্যের সত্তর বছর আগের, অন্যদিকে এলিয়টের অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, এলিয়ট ধরে রেখেছেন সেই সময়কার তছনছ হওয়া মানবিক মূল্যবোধ, পাশাপাশি হুইটম্যান গড়ে তুলেছেন সত্য ও সুন্দরকে। তাই হুইটম্যানের কাছে যৌনতা ও প্রেম মানসিক উৎকর্ষতা ও আত্মিক মুক্তি। আর এলিয়টের কাছে যৌনতা ও প্রেম মানে যান্ত্রিক জীবনের তাৎক্ষনিক উচ্চারণ। কবিতায় হুইটম্যান প্রেমকে অন্যতম শিল্পসৌন্দর্যের ধারক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন, জীবনের প্রতি তার সমান কৌতূহল, দেহ ও আত্মার প্রতি যেমন আগ্রহ, জড়বাদ ও ভাববাদ উভয়বাদেই তার সমান আস্থা। তার কবিতায় রয়েছে অস্তিত্বের প্রশ্ন, কখনো তা দেহে সীমিত, আবার কখনো দেহকে ছাড়িয়ে তা গগনবিহারী। জীবনকে বিভিন্নভাবে দেখতেই তার চরম কৌতূহল। বোদলেয়ার বলেছেন, ‘নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির আকুতি থেকেই সাহিত্যের উন্মেষ, সৌন্দর্য সৃষ্টি ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো উদ্দেশ্যে নেই’। শিল্পসাহিত্যের মাধ্যমে নান্দনিক উপলব্ধির দ্বারা মানুষ আপন আত্মার সত্যে উপনীত হলে যে সামঞ্জস্যের সুষমা প্রতিষ্ঠিত হবে তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টি জীবনে, হয়তো তাতেই প্রকৃত মঙ্গল, টলস্টয়ও বিশ্বাস করতেন, ‘শিল্পসাহিত্যের সার্থকতা এখানেই’।
জীবনানন্দের গল্পের মূল উপজীব্য মানুষ, মানুষের জীবনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিচিত্র অবস্থার পরিবর্তনের ফলে মানুষের উপর প্রতিফলিত প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত কিছুই খুটিয়ে-খুটিয়ে তুলে ধরেছেন গল্পে, ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পাশাপাশি নদী-আকাশ গাছগাছালি-পানি গরু-ছাগল অন্ধকার নৌকা ঝাউবন-প্রেম-ভালোবাসা-যৌনক্ষুধা-অত্যাচার-লালসা কাঁটাঝোপ সকাল-দুপুর গ্রাম-শহর শহরতলী-বসতি ভোরের সোনালি রোদ্দুর তারপর এসেছে বেকারত্ব-দাম্পত্যকলহ-হীনতা প্রভৃতি কোনো কিছুই তার বিশ্লেষণের বাইরে যায়নি, সমস্ত উপাদান নিজের মতো ছকে সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন পাঠকের দরবারে। মৃত্তিকা সংলগ্ন জনমানুষের যে জীবনালেখ্য, যে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের অনুসন্ধান, তাকে কি বলবো, অবশ্যই জীবনের গল্প, জীবন এখানে বৈচিত্র্যময়-অনুভূতিপ্রবল আর তিক্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
গ্রামীণ জীবনের বিচিত্র রূপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিলো তারাশঙ্করের, কঠিন ও অসুন্দর কর্কশ সংসারের চিত্র তিনি এঁকেছেন অনেক, গল্পের চরিত্রগুলো বিচিত্র পেশাজীবী-বৃত্তিধারী, গল্প ভাষাও ভিন্ন ধরনের। জীবনানন্দ দাশ বাংলাসাহিত্যে এমনই একজন, গল্পে তিনি চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন, গ্রামীণ জীবন-সমাজচিত্র তার নখদর্পণে, বেশ জমিয়ে বলতে পারেন, ভিন্ন-ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যেতেও জুড়ি নেই, কোথাও-কোথাও বড় বেশি তাড়াহুড়োও দৃষ্টিগোচর হয়। গল্প জমতে না জমতে দেখা গেলো বনফুলের মতো শেষও হয়ে গেলো, তখনই পাঠক কেমন একটু হোঁচট খায় বৈ কি! তারপরও একাধিক বিচিত্র জীবিকা এসেছে গল্পে, তার গল্প বিকৃতির ভাষা ভিন্ন ধরনের, গল্পের উদ্দিষ্ট অভিপ্রায়ের কেন্দ্রীয় ভাববস্তুর উপযোগী আবহবদ্ধ-বিশ্লেষণী ভাষা প্রথম থেকে ব্যবহার করেন, জীবনানন্দের কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে গল্পের শক্তিমত্তা কতোখানি, গল্পের মনস্তাত্ত্বিকতা ও বিষয়বিন্যাস আলোচ্য প্রবন্ধে তুলে ধরা।
‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ শুধুমাত্র অনুভূতির ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠেনি, গল্পটি একটা ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ, এখানে একটা শক্তমক্ত কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে, চরিত্র আছে তিনটি, ঘটনা-উপঘটনার ভেতর দিয়ে কাহিনী এগিয়ে গেছে, ত্রিকোণ প্রেমের একটা সুখানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ, যে কিনা একজন সচ্ছল চাকুরে, তার স্ত্রী শচী শুধুমাত্র গৃহকত্রী, গুছিয়ে সংসার করছে, সন্তান হয়নি বলে কষ্টও নেই তেমন। এদের মাঝে জুটেছে পুরোনো বন্ধু সোমেন, যে কিনা খবরের কাগজে কাজ করে, শচী বিয়ে করেছে প্রকাশকে, সুখের সংসার লক্ষেèৗয়ে থেকে কলকাতায় এসেছে তারা, কলকাতার পরিবেশ তেমন একটা ভালোও লাগে না প্রকাশের, কেমন একটা ঘিনঘিনে স্বভাবের সে, সোমেনকে একদিন রাস্তা থেকে তুলে আনে প্রকাশ, সেই থেকে অবাধ যাতায়াত শুরু হয়ে যায় এ-বাড়িতে সোমেনের, ক্রমে-ক্রমে আবার ভালোবাসা যেন দানা বেঁধে ওঠে, কেউই ভুল করছে না তবুও ভুলের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে শচী। একটা নেশা তাদের হাওয়ায় তুলে নিয়ে যায়, সময়ে-অসময়ে আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে নতুন করে ভালোবাসা জাগ্রত হলে শচী ফিরে যেতে চায় অতীতে, তার কামনা-বাসনা ফুলে-ফেঁপে ওঠে, সোমেন বলে, মনে পড়ে একদিন বকমোহনার নদীর পাড়ে ভাঁট শ্যাওড়া জিউলি ময়নাকাটা আলোকলতার জঙ্গলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম…শচীর মধ্যে গ্রাম্যজীবনের প্রতি যে আকর্ষণ তাতে সোমেন আরো আগুন উসকে দেয়, এই নস্টালজিয়া তাকে কোনোক্রমে আর স্বস্তি দেয় না, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, ভাবাবেগে বলে ওঠে, চলো না পাড়াগাঁয়ে, বকমোহনা নদীর ধারে! সোমেন বললো, সে পাড়াগাঁর জীবন তুমি কোনোদিন ফিরে পাবে না, সেই তেলাকুচো-ফণীমনসা বনধুঁধুল কোনো অন্ধকারে কোনো জ্যোৎস্নার কতো দূরে চলে গিয়েছে, আমরা তো আর সেখানে নেই, কি হবে সেসব দিয়ে? পেছনের স্মৃতিময় জীবনের গল্পগুলো একে একে সামনে এলেও তা যে আর কোনোদিন পুনরাবৃত্তি হবে না, অর্থাৎ মানুষ ইচ্ছে করলেই আর পেছনে ফিরে যেতে পারে না, বর্তমানেই থাকতে হয়, অতীত সে তো মৃত একটা ধ্বংসস্তূপ, তাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, যেমন শচী ইচ্ছে করলেই প্রকাশকে ছাড়তে পারবে না এবং সোমেন ইচ্ছে করলেই শচীকে ফিরে পাবে না, সময় এবং স্মৃতি সর্বদা জ্বলন্ত শিখা হয়ে জ্বালায় বনভূমি-মনভূমি, হয়তো মানুষ দাবানল বলে কিন্তু বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলে তাকে কি বলবে, অন্তর্জ¡ালা, নাকি আত্মার কষ্ট! যে মানুষ একবার চলে আসে, সে কি আর ফিরে যেতে পারে, পাড়াগাঁর মাঠ জঙ্গল কিংবা একটা সন্ধ্যা অথবা একটা রাত্রি, সোমেন বলে, তুমি তো ফিরে চলে আসবে আবার, মেয়েরা ভুলে যায় যতো সহজে, কারণ তারা পরিবর্তিত হতে সময় নেয় না, কিন্তু কি নিয়ে থাকবো আমি, ওই ক্ষতে আর আঘাত দিও না…এ-গল্পে জীবনানন্দের আত্মাকে দেখতে পাওয়া যায়, সোমেন যেন জীবনানন্দ হয়ে রূপান্তিত হয়েছে গল্পের আখ্যানে। নগরজীবনের আনন্দ যেভাবে এসেছে তেমনি পুরোনো স্মৃতি বা ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের যে আকর্ষণ তাও স্পষ্ট জলছবি হয়ে ফুটে উঠেছে ‘গ্রাম ও শহরের গল্পে’। গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে তিনি সুকৌশলে পৌঁছাতে পেরেছেন বলেই তো জীবনশিল্পী। বাংলা ছোটগল্প গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের বিস্তৃত উপাখ্যানে সুসমৃদ্ধ। এমনকি গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সমবায়ী তরঙ্গও দুর্নিরীক্ষা নয়। কিন্তু যান্ত্রিক কোলাহলে সমস্ত স্মৃতি ও ঐতিহ্য আবেগ, কোমল অনুভবময়তা কালের নির্মম পদপাতে পিষ্ট-বিনষ্ট হয়ে গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের ক্রমশ নাগরিক হয়ে ওঠার হৃদয় চুরমার করা হাহাকারে শিল্পিত রূপান্তর বাংলা ছোটগল্পের এলাকার দুর্লভ। পরের গল্পে জীবন যন্ত্রণার ছবি অঙ্কিত হয়েছে।
‘মেয়ে মানুষ’ জীবনানন্দের গুরুত্বপূর্ণ গল্প, মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানুষ কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন সে নিজেই সৌন্দর্যের একটি রূপ নির্মাণ করে, অথবা কদাচিৎ তুলে ধরে, এখানে তারই প্রকাশ পেয়েছে, হেমেন এবং দ্বিজেন গল্পের প্রধান চরিত্র, হেমেন ছোট্ট একটা ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থের মালিক, কিন্তু দ্বিজেন মূলত আইনজীবী, অথচ দুজনই নিঃসন্তান, সন্তানের হাহাকার সেভাবে কারো মধ্যে না থাকলেও একটা শূন্যতা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, হেমেনের স্ত্রী চপলা স্বামীহৃদয় নারী, আর দ্বিজেন স্ত্রী লীলা অন্যমূর্তির মানুষ, কিন্তু লীলার স্বামী সুদর্শন হলেও হেমেন সুপুরুষ নয়, দু’বন্ধুর জীবনের স্ত্রী প্রভাব নিয়েই গল্পের মূল বিষয়, কঠোর পরিশ্রম এবং সংগ্রামের জীবন অতিবাহিত করবার পর আর্থিক উন্নতি লাভ করে হেমেন, কিন্তু নিঃসন্তান তারা, মানসিকভাবে বিমর্ষ-অবসন্ন, তাই স্বপ্নহীন জীবন যেন, তাদের জীবনে মেয়েমানুষ একটা বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে, মানুষ সত্যি সত্যিই ওই একটা শেকড়ের কাছে বারংবার ফিরে আসে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কের গভীর যে বন্ধন, তা কেবল অর্থবিত্তের উপর দাঁড়িয়ে থাকে না, শ্রদ্ধা-ভক্তি বা বিশ্বাস-ভালোবাসা জীবনের জন্য প্রয়োজন হয়, কিন্তু লীলা ওই সত্যকে মানতে চায় না, জীবনানন্দ প্রত্যক্ষ করেছেন একজন পুরুষের জীবনে হৃদয়বতী নারীর প্রেম কতোটা আবশ্যক, বিবাহিত স্ত্রীর কাছে থেকেই হোক বা পরস্ত্রীর নিকট থেকেই হোক কিংবা অন্য কোনো নারী থেকেই হোক না কেন, প্রতি পুরুষই নারী ভালোবাসা পেতে ইচ্ছুক, জীবনানন্দ সচেতন কথাশিল্পী বলেই হেমেন-চপলা দ্বিজেন-লীলার ভেতরের দ্বন্দ্ব চাক্ষুস করেছেন, প্রকৃতপক্ষে সমাজের বা সংসারের এই টানাপোড়েন মানুষের জীবনকে অতিক্রম করে এবং তারপরও মানুষ নিজের প্রয়োজনে নিজেকে গড়ে তোলে।
‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পে জীবনের লেনদেনের হিসাব বেশ সাবলীলভাবে ধরা দিয়েছে, জীবন সত্যি বিচিত্র বিভীষিকাময় ছবি হয়তো একেই বলে, গল্পের প্রধান চরিত্র প্রমথ, যে গ্রাম থেকে সুদূর কলকাতায় একটা মেসে থাকে, চাকুরী সন্ধান করাটাই যেন তার একটা কাজ, সে বছর দুই আগে বিয়ে করেছে, মেয়েটির নাম শেফালী, জীবনের কোনো মানেই সে বোঝে না, হয়তো বোঝার মতো বয়স তার হয়নি বা পরিস্থিতির মধ্যে সে পড়েনি, শেফালী অন্তঃসত্ত্বা, গ্রাম থেকে স্বামীকে সে চিঠি লেখে পাতার পর পাতা কাকুতি ভরা প্রেমে সিক্ত, কতো গল্প তাতে রঙে রঙিন হয়ে থাকে, দিন দিন সে আসন্নপ্রসবা হয়, গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে প্রমথ বেশ কয়েক মাস গ্রামেই ছিলো, অথচ শেফালী যখন ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেসময় প্রমথ কলকাতা পালিয়ে যায়, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো যাকে বলে, কিন্তু শেফালী নিয়মিত চিঠি লেখে, কয়েকটি টাকা যেন পাঠায়, কারণ গর্ভের শিশুটিকে নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে, দুধ-ডিম-কলা বা ভালো কিছু খাওয়াটা প্রয়োজন, নয়তো সে নিশ্চিত মারা যাবে, এভাবে বাঁচার আর ইচ্ছেও তার নেই, তারপরও সে বাঁচতে চায়, জীবনকে সুন্দরভাবে দেখতে চায়। কিন্তু তার স্বামী প্রমথ বেকার, একটা চাকুরীর জন্য কলকাতায় পড়ে আছে, শাশুড়িও দেখতে পারে না শেফালীকে, ডানা কাটা পরীর মতো শেফালীর মা হবার কোনো সাধ ছিলো না, কারণ সে জানতো, মা হলে তার স্বামী প্রমথকে চাকুরীর সন্ধানে যেতে হবে, খরচের বিষয়টা দেখতে হবে, অর্থাৎ স্বামীকে কাছ ছাড়া করার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না, তারপরও একটা শিশু আসছে এবং সে কারণে প্রমথকে কাজের জন্য অথবা শেফালীর কষ্ট দেখতে না হয় সেজন্য দূরে পালিয়ে থাকতে হয়, নিয়মিত চিঠি আসে এবং সে পড়ে, জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে যায়, সর্বশেষে বারো টাকা পাঠাতে বলে, কলিকাতার মেসের খরচা থেকে বারো টাকা পাঠানো কঠিন, কিন্তু বারো টাকা না হলেই নয়, বাচ্চা হওয়ার জন্য ওই টাকা অতি প্রয়োজনীয়, চিঠির ভাষা রঙের মতো বদলে যায়, ভালোবাসা যেন আরো প্রগাঢ় হয়ে ধরা পড়ে, প্রমথ তবুও নিশ্চুপ থাকে, তার যেন কিছুই করার নেই, দরিদ্রতা এভাবেই মানুষকে কর্তব্যজ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তারপর এক পূর্ণিমার দিন টেলিগ্রাম এলো, শেফালীর মেয়ে হয়েছে মেয়ে, কিন্তু শেফালী চলে গেছে, গল্পে যে মস্ত একটা ধাক্কা, তা হলো দারিদ্র্যে আশাহীন জীবনের জীবন। মানুষ বুঝি এভাবেই হেরে যায়, হারতে-হারতে জীবন হয় ধোঁয়ার ধূসর পা-ুলিপি।
সম্বোধনহীন চিঠির আকারে লেখা গল্প ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’, চিঠি এবং ডায়েরির মতো ভঙ্গি, কখনো মনে হবে কতোগুলো চিঠি পরপর সাজানো, ‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পের মতোই একই আঙ্গিকে নির্মিত রচনা, ঘটনাপ্রবাহে আছে অনেক কবিত্বময়তা, আছে বিরহকাতর উপমা, অনেকটা কবিতার মতো করেই বলা, তবে গল্পের বা চিঠির বিষয় ভিন্ন, পত্রলেখক একজন হতভাগ্য পুরুষ, যার জীবনে অনেক শখ ছিলো, বউ তার পা টিপে দেবে, পাখা দিয়ে বাতাস করবে, কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন, তিন বছরের বিবাহিত জীবন, অথচ স্ত্রী অনুপমা বাপের বাড়ি, বিয়ের পর কয়েক মাস স্বামীর কাছে ছিলো, আজ বাড়ি অন্ধকার, মা কাশী গিয়েছে বিধবা বোন চারুকে নিয়ে, বাপ আর গল্পকথক ছেলে দুই বিঘের উপর বাড়িতে থাকে, বাড়ি-ঘরের প্রাচীনতম অবস্থা, দেখাশোনার কোনো মেয়েমানুষ নাই, তাই চারদিকে জঙ্গল, শিয়ালের চিৎকার, লক্ষ্মীপেঁচা-জোনাকি তো আছেই, ইঁদুর-ছুঁচা-সাপও বাড়ির আনাচে-কানাচে বাসা বেঁধেছে, তেলাপোকা-চামচিকেয় ভরা বাড়ি, কাজের মানুষ হিমাংশুর মা রান্না করে দেয় বটে, তা মুখে দেওয়া না গেলেও খেতে হয় বাধ্য হয়ে, এসব কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে পত্রের মাধ্যমে জানায়, পত্রের ভাষায় স্বভাবতই প্রত্যাশিত রোমান্টিক বা অনন্ত বিকাশিত প্রেমের রূপায়ণ দৃষ্টি কাড়ে, অথচ প্রত্যাশা কখনো পূরণ হয় না, দীর্ঘশ্বাসের একটা কু-ুলী হয়ে সঞ্চিত হয়, অনুপমা পিতাগৃহে গেছে তিন বছর, স্বামী বেচারির কোনো খোঁজ-খবর নেয় না, সে নিজের ভেতর নিজে মৃতপ্রায়, একটা জিজ্ঞাসা এবং হতাশা সর্বসময় কাজ করে, জীবনানন্দের অন্যান্য গল্পের মতোই হতাশা-বিচ্ছেদ মৃত্যু-কষ্ট দুঃখ-দৈন্যতা ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’ গল্পেও ফুটে উঠেছে।
‘কুষ্ঠের স্ত্রী’ গল্পের প্রধান চরিত্র সুশোভন, যার মুখপোড়া দাগ দেখে লোকে কুষ্ঠের দাগ বলে এবং বিয়েও হতে চায় না, অনেক ভালো-সুন্দরী পাত্রী হাতছাড়া হয়, কন্যাপক্ষকে যতোই বোঝানো যায় কিন্তু তারা গঙ্গাযাত্রীর কাছে মেয়ে বিসর্জন দেবে না। অবশেষে বাপ-মা নেই, এমন একটা এতিম মেয়ে অতসীকে পাওয়া গেলো, যে বুড়ো মামার ঘাড়ে আছে, যথারীতি বিয়ে হলেও অতসী প্রথমে চন্দনের ফোঁটা মনে করে কিছু না বুঝলেও পরে শিউরে ওঠে, ভয়ে দূরে সরে যায় এবং সে একসময় বলে যেহেতু তুমি আমার মামাকে ঠকিয়েছো, আমাকে ঠকিয়েছো, তোমার বিষয়-সম্পত্তি আমাকে সব লিখে দেবে, নয়তো মামার সঙ্গে চিরকালের মতো চলে যাবো। পরবর্তী সময়ে সুশোভন দেখে, অতসীর দাঁতের দু’পাটি ক্ষয় ধরেছে, মুখের ভেতরটা পায়খানার গহ্বরের মতো গভীর বিকৃত ছোট-বড় এবড়ো-থেবড়ো খাদ। স্নানের পর মনে হলো যতোটা সুন্দরী ভেবেছিলো প্রকৃতপক্ষে তা সম্পূর্ণ ভুল, হয়তো চোখের ভুল, মানুষ কি এভাবেই নেশায় পড়ে ভালোমন্দ বিচার না করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। গল্পটি একটা দোলাচলের নবদাম্পত্যজীবন কাহিনী, নবজীবনের স্বাদের পূর্বেই একটা ভাঙাগড়া একটা অমীমাংসিত কুহুকের হাতছানি।
‘অশ্বত্থের ডালে’ গল্পে একজন প্রধান চরিত্র নির্মল, যার আর্থিক দৈন্যতা ঘুরেফিরে ফুটে উঠেছে, ওর বাবা-মা আছে, বোনও আছে, একটি মেয়ে এবং মেয়ের মা অর্থাৎ বউও আছে, কিন্তু তারপরও নির্মল সেখানে নেই, দারিদ্র্যের পোড়াকাষ্ঠে প্রতিনিয়ত জর্জরিত, জীবনে শখ-সাধ বলতে বই পড়া, অথচ তাও জোটে না, কলিকাতা থেকে নতুন-নতুন বই কিনে আনার সাধ্য নেই, আর তাই পুরোনো পত্রিকা পড়ে নিজেকে ভুলে থাকতে হয়, পাড়াগাঁর রাত্রি কাটে না, ঘুমও আসে না, পেঁচা-বাদুড়ের ডাক শোনে, জ্যোৎস্নার ভেতর খড়ের মাঠের খেঁকশিয়ালের দৌড় দেখে, জীবনটাকে ছোট নদী ভাবে, আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়, একদিন রাত্রের অন্ধকারে মজুমদারের উঠোনের দিকে যায়, সেখানে বংশলোচন নামের একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, সে কি ভূত নাকি মজুমদারের আত্মা, কিন্তু সে জীবনের অনেক গল্প করে, হয়তো ভৌতিক কিংবা রহস্যজনক কিছু হবে, তবে গল্পে যে মানুষের কথা এসেছে, সে তো জীবনের কাছ থেকে পুরোদস্তুর উপেক্ষিত।
‘জামরুলতলা’ গল্পেও সেই আর্থিক সংকট প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে, গ্রাম্যজীবনের রোমান্স হিসেবে জামরুলতলাকে দেখেছেন লেখক, হারানি নামের যে মেয়েটিকে কথক একটু-একটু ভালোবেসেছিলো, হয়তো তা পরিপূর্ণ না-ও হতে পারে, দেখাসাক্ষাৎ হতো কখনো-সখনো, সে হারানি কলিকাতায় বি.এ পড়বে, চাকুরী একটা করবে হয়তো, কিন্তু অবনী কি একটা কাজ করেছে, হারানির বাবার বয়সী অবনীর সঙ্গে বিয়ে, জীর্ণ অসুস্থ মানুষ কিনা সুন্দরী-সুশ্রী হারানির সাতপাঁকে বাঁধা কথকের মর্মপীড়ার কারণ হয়, চাকুরিহীন-রোজগারহীন কথক তাই শুধু নির্বাক দর্শক, তার বুকের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই সমাজের কাছে, হারানিকে নিয়ে কিছু স্মৃতি আছে পোড়া দাগের মতো, জামরুলতলায় রোজ দুপুরবেলায় আসতো কিশোরী মেয়েটি, কথক টেবিলের ওপর কলম রেখে চুপচাপ দেখতো, সে দেখার মধ্যে অন্যরকম একটা নির্মল আনন্দ বা আকর্ষণ ছিলো, জীবনানন্দের গল্প ভিন্নধর্মী মেজাজ-স্বর এবং জীবনতৃষ্ণায় লালিত, জীবনের অনেক গভীরে তার গল্পের শেকড়, গল্পটি উত্তমপুরুষে লেখা, আশিরনখ যে কবি এবং গল্প লেখে, কখনো অন্তরের তাগিদে আবার কখনো বা গল্পকার হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষায়, কথক বলে যায়, তার কথা একটানা নয়, কিছু অবিন্যস্ত-অসংলগ্ন এবং খাপছাড়া। ভাষায় যতোই বুনোট থাকুক না কেন, কাব্যিকতাকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠলেও গল্প যেন ভাসা-ভাসা রয়ে যায়, জীবনানন্দের সেই এলোমেলো জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার ফলে জামরুলতলা গল্পে গল্পকথক বলেছে, অনেক বাংলা গল্প অনেক জায়গায় তো পড়েছি, গল্পটা আমার সে সমস্ত গল্পের কোনো একটার মতো হবে নাকি? যে দ্বিধা নিয়ে তার পথ চলা তা যেন আরো স্পষ্ট হয়েছে। গল্পে অভিনতুন আঙ্গিক, কাহিনী উপস্থাপনের স্বতন্ত্রভঙ্গি গ্রামীণ পটভূমি, বিষয় ও ভাষাশৈলী আপাদমস্তক স্বাতন্ত্র্য, স্বতঃস্ফূর্ত তার বর্ণনাবিন্যাস, প্রয়োজনীয় ডিটেলস্ বা প্রতিবেশ বর্ণনায় জীবনানন্দ সার্থক।
‘রক্তমাংসহীন’ মনস্তাত্ত্বিক গল্প, এ গল্পে নির্মম সত্য হলো, দারিদ্র্য স্বামী মানুষটি বড় সহজ-সরল, নিজেকে গুছিয়ে রাখার মতো ক্ষমতাও নেই, দীর্ঘদিন পর স্ত্রী ঊষা বাপের বাড়ি যাবে, কিন্তু যাবে-যাবে করেও ইচ্ছে করেই যায়নি, এদিকে তিন বছর বিয়ে হওয়া, দারিদ্র্যের মধ্যে বাস, কিন্তু বাপের বাড়ি যাবে, সেখানেও বাপ-মা নেই, ভাই-বোন আছে, হয়তো সে কারণে বাপের বাড়ি যাওয়ার কোনো উৎসাহ নেই, স্বামী বেচারী বারংবার ঊষাকে সাবধান করে, স্টিমারে যেন ঠান্ডা না লাগে, বুঝে-শুনে যেতে, তার সঙ্গী আছে যদিও হিমাংশু, ঊষারই ভাই, নিঃসন্তান এক নারীর কষ্ট বেশ ফুটে উঠেছে গল্পে, তার যদি একটা বাচ্চা থাকতো, স্টিমারে স্পিরিট স্টোভ জ্বালিয়ে দুধ গরম করে খাওয়াতে হতো, গম্ভীর হয়ে ঊষা বলে, ছেলেপিলের সুখ আর পেলাম না, আমাদের দুজনের মাঝখানে এই শূন্যতাটা রয়ে গেলো। তারপর স্বামী বেচারী অজ্ঞাতসারেই কিন্তু অনিবার্যভাবেই ঊষাকে তার বাপের বাড়ি ভাই-বোনদের কাছে যেতে দেয়, যেন কয়েকদিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে স্বামী, একটু নিরিবিলি একটু নিজের মতো করে থাকা যাকে বলে, যখন বলে, যাও কিছুদিন গিয়ে থাকো, অনেকদিন তো বাপের বাড়ি যাওনি…ঊষা ক্ষেপে যায়, তাই বুঝি তোমার চক্ষুশূল হয়েছি। স্ত্রী যেন কোনোভাবেই স্বামী ছেড়ে যেতে চায় না, দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে থাকতে-থাকতে স্ত্রী ঊষাও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, সেখান থেকে দূরে যেতে তার মন সায় দেয় না, তারপরও যেতে হয় তাকে, যায় সে। এভাবে কয়েকদিন কেটে যায়, অজ্ঞাত অন্ধকারে হাত তার নিজের নিয়মে চলে, দিন দশেক পরে খবর এলো, ঊষার মৃত্যু! সন্ধ্যার সময় কলেরা…শেষ রাতে চলে গেছে, কলেরায় এ-রকম প্রায়ই হয়ে থাকে। মৃত্যু কি ভয়াবহ, তার কাছে ভালোবাসা বা দারিদ্র্য অথবা সন্তানহীনের কষ্টের কোনো দাম নেই, সে যেন ভয়ংকর একটা দানব, সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার করে সে চলে যায়, তার কোনো হাত নেই, সবই নিয়তি!
‘শাড়ি’ গল্পে এক দারিদ্র্যনিমজ্জিত দম্পতি এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে, দরিদ্রতা যে একটা অভিশাপ তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। স্বামী রণজিৎ অনেক কষ্ট এবং যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেও স্ত্রী ঊষা বুঝেও বুঝতে চায় না, কিংবা কখনো-সখনো ভুলেই যায় যে তারা কতোটা বাস্তবতার মুখোমুখি, জীবনানন্দ হয়তো এভাবেই জীবনকে দেখেছেন, নানান রঙে নানান ভাবনায়, শাড়ি গল্পটিকে প্রতীকধর্মী বললেই হয়তো বেশ ইঙ্গিতবাহী হয়, ঊষার নিকটাত্মীয় রমেন বেড়াতে আসতে চায় কয়েক দিনের জন্য তাদের কাছে কিন্তু রণজিৎ সোজাসাপটা জবাব, নিষেধ করে দাও, নইলে পূর্বের মতো অপমান সহ্য করতে হবে মনে রেখো, মানুষ কতোখানি অসহায় হলে এমন কথা বলতে পারে, শেষাবধি দেখা যায় চিঠি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে ঘরে খিড়কি দিয়ে ফুপিয়ে-ফুপিয়ে কাঁদে ঊষা, হয়তো এছাড়া তার কি বা করার আছে! অথচ যখন দরজায় ফেরিওয়ালা বিশ্বেশ্বর কাপড়ের গাঁটরি নামায় এবং হাঁকে, বউমা কোথায়, নতুন ফ্যাশনের কাপড় এনেছি…তারপর সত্যি অবাক লাগে, কাপড় দেখার জন্য দুজন কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে, নিজের জন্য কিনতে না পারলেও দেখে বা নেড়েচেড়ে শখ মেটায়, বেনারসী-ভাগলপুরী শাড়ির জন্য মন কেমন ছটফট করে, কিন্তু কেনার সমর্থ্য নেই, গাঁটরির প্রতি লোলুপতায় ঊষার মন কেমন করলেও চোখ দুটো ছানাবড়া হয়, তারপরও দেখার যে বিলাস তা থেকে তারা সরতে রাজি নয়, একটা আকাক্সক্ষা মরে গেলেও অবশিষ্ট পড়ে থাকে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে, উভয়ের মধ্যে যে কিছুক্ষণ আগে একতরফা ঝগড়া হয়ে গেছে, তা যেন তাদের কারো স্মরণে নেই, তারা যে শাড়ির নেশায় মগ্ন, সেই মগ্নতার ভেতর দিয়ে মানুষ বাঁচে এবং হাসে অথবা ভালোবেসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। গল্পের পটভূমি নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারকে কেন্দ্র করে, আবহ বেশ রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছে, অনুভূতি সর্বদা কাজ করে, একটা দেয়াল ঘিরে আছে, সে দেয়াল ভাঙতে হবে। সে দেয়াল ভাঙনের ফলেই প্রত্যাশিত সেই সমাজ আসবে। বেঁচে থাকার জন্য সমাজতন্ত্রের চেতনা জাগ্রত আবশ্যক, সমাজকে যে অন্যভাবে দেখতে চায়, গাল্পিক জীবনযাপনের জন্য রাজনৈতিক আবহ-কালচেতনাকে শিল্পের ভাষায় চিত্রায়িত করেছেন, এ গল্পের তার স্বাক্ষর বহমান।
মূলত গ্রামীণ জনপদের ভাঙন-সামাজিক শোষণ, কখনো প্রতিবাদ বা বাঁচার সংগ্রাম, এ সমস্ত বিষয়াদি জীবনানন্দের গল্পজগত। বাংলাসাহিত্যাকাশে কথাশিল্পী জীবনানন্দ দাশ এক অনন্য প্রতিভা বলতেই হয়। তার জীবদ্দশায় গল্পগুলো আলোর মুখ দেখতে পারেনি। গল্পের ভাষা নির্মাণ বাক্যশৈলী ও গল্পের উপস্থাপনায় স্বীকৃত পাওয়া যায়, গ্রামীণ গল্প বাংলাসাহিত্যে প্রাণ, তার গল্পের বিশাল একটা অংশ গ্রামীণ জীবনধারার অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাসাহিত্যে ছোটগল্প গ্রামীণ জীবন অতিক্রম করে ক্রমশ শহরমুখী হয়ে উঠছে, তুলনাসূত্রে উল্লেখ করা আবশ্যক, আমাদের ছোটগাল্পিকরা নিম্নবিত্ত বা গ্রামীণ জীবন চিত্রণে যতোখানি সুদক্ষ-স্বচ্ছন্দ-বস্তুনিষ্ঠ অপরদিকে কিন্তু নগরজীবনের মধ্যবিত্ত জীবনযাপন চিত্রণে অতোখানি আগ্রহী বা স্বচ্ছন্দ নয়। জীবনানন্দ দাশের কাব্যে ইউরোপীয় শিল্প মতবাদকে আত্মস্থ করে লোকজ মিথ-রূপকথা-পুরাণ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যুগগত ভাবকে বাণীরূপ দেন অবলীলায়। বিষয়-বিষয়ী ও ভাবের অন্তরে ফল্গুধারার ন্যায় বাহিত হয় অখ- কালচেতনা। এ কারণেই শ্বাশত সত্যের শানিত শরীর ঠেলে কোনো বিশেষ একটি শিল্প মতবাদ তার কাব্যদেহে কুত্রাপি প্রাধান্য বিস্তার করেছে, ফলত জীবনানন্দ দাশের কালচেতনা-উপস্থাপনার কৌশল হিসেবে গ্রামীণ জীবন থেকে আহরিত উপাদান ব্যবহার তাকে ত্রিশোত্তর বাংলাভাষী বা বাঙালি কবিদের দলভুক্ত না করে অভিষিক্ত করেছে স্বতন্ত্র মর্যাদায়।
মূলধারা সাহিত্যের রকমফের
স্বকৃত নোমান। কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ই নভেম্বর, ফেনির পরশুরাম উপজেলার বেলোনিয়ায়। শৈশবে ঊর্দু, আরবি ও পারসি সাহিত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে সেলিম আল দীনের কাছ থেকে পাশ্চাত্য ও বাংলা সাহিত্যের গভীর পাঠ গ্রহণ করেন। বর্তমানে ঢাকায় সাপ্তাহিক সংবাদ ম্যাগাজিন এই সময় এর সহযোগী সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। ২০১২ সালে এইচএসবিসি কালি কলম সাহিত্য পুরস্কার পান। ‘বেগানা’ ‘হীরকডানা’ ও ‘নিশিররঙ্গিলা’ উপন্যাসসহ মোট প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা
কথাসাহিত্যের অলিগলি
জন্ম : ০২ জানুয়ারি, ১৯৮৩-তিতাহাজরা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী। বেড়ে ওঠা পাহাড়তলী, চট্টগ্রামে। লেখাজোখার প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই।
প্রথম লেখা ছাপা হয় মাসিক রহস্যপত্রিকায়। ২০০০ সালের মাঝামাঝি লেখালেখিতে সচেতনভাবে মনোযোগী হন। তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিকসহ অজস্র পত্রপত্রিকায়। সমানতালে লিখেছেন লিটল ম্যাগাজিনেও। দীর্ঘদিন যাবত সম্পাদনা করছেন পাঠকপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রকাশ’। গল্প লিখতে এবং গল্পকার পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সিরিয়াস লেখার পাশাপাশি রম্য ধাঁচের রচনায়ও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মাসিক উন্মাদ অতঃপর দৈনিক প্রথম আলোর তুমুল জনপ্রিয় ফান ম্যাগাজিন আলপিন-এর মাধ্যমে রম্যচর্চার হাতেখড়ি। এরপর থেকে লিখেছেন দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র হিসেবে প্রকাশিত বিভিন্ন রম্য-বিদ্রƒপ সাময়িকীতে।
পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন পা-ুলিপি সম্পাদনা, লেখালেখি এবং সাংবাদিকতাকে। বর্তমানে একটি জাতীয় দৈনিকে সাব এডিটর হিসেবে কর্মরত।
প্রকাশ (নির্বাচিত গল্প বিষয়ক প্রবন্ধ)
জন্ম: ১ জানুয়ারি, ১৯৭৪।
জন্মস্থান- মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার রাজারচর কাজিকান্দি গ্রামে।
প্রকাশিত বই-
১. কাব্যগ্রন্থ- বিরুপা’র শূঁড়িবাড়ি(২০১৪)
২. অণুগল্প সংকলন- পঞ্চাশ(২০১৫)
৩. মহাপ্রভু ও অন্যান্য অণুগল্প(২০১৬)
৪. কাব্যগ্রন্থ- একজ্বলাপঙক্তি(২০১৬)
অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে
কামরুল ইসলাম
জন্ম: কুষ্টিয়ার ফিলিপ নগর গ্রামের গোলাবাড়ি পাড়ায়। পেশা: অধ্যাপনা (ইংরেজির অধ্যাপক)। বর্তমানে এইচ এস টি টি আই, রাজশাহীতে পরিচালক পদে ( প্রেষণে) কর্মরত আছেন। নব্বইয়ের দশকে চ‚ড়ান্তভাবে কবিতার জগতে প্রবেশ। তিনি একজন দ্বি-ভাষিক কবি। শালুক, একবিংশ, কবিতাপত্র, উলুখাগড়া, চিহ্ন, কালি ও কলম, অনুপ্রাণনসহ বিভিন্ন লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করে থাকেন। এছাড়াও বাক, শব্দকুঞ্জ, শিল্পচিন্তা, ঐহিক, তীরন্দাজসহ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক ওয়েব ম্যাগাজিনেও তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
তার ইংরেজিতে লেখা কবিতা পৃথিবীর নানা দেশের ওয়েব ম্যাগাজিন ও অ্যান্থলজিতে প্রকাশিত হয়ে আসছে। ভারত ভিশন, অতুনিস পোয়েট্রি, ওয়ার্ল্ডপোয়েট্রি ম্যাগাজিন, পোয়েটস আনলিমিটেড, টাইফাস, কালচারাল রেভারেন্স, স্টার কাউন্টার ম্যাগাজিনসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। স্প্যানিশ, ফরাসি, ইতালীয় ও রোমানীয় ভাষায় অন‚দিত হয়েছে তার অনেক কবিতা ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-
দ্বিধাান্বিত সুখে আছি যমজ পিরিতে (১৯৯৯), ঘাসবেলাকার কথা (২০০১), যৌথ খামারের গালগল্প (২০০৬)
সেইসব ঝড়ের মন্দিরা (২০০৮), চারদিকে শব্দের লীলা (২০১০) অবগাহনের নতুন কৌশল (২০১১),
মন্ত্রপড়া সুতোর দিকে হাওয়া, (২০১৪)।
প্রবন্ধগ্রন্থ-
কবিতার বিনির্মাণ ও অন্যান্য (২০০৯), রবীন্দ্রনাথ: বিচিত্রের দ‚ত (২০১৩)
কবিতার স্বদেশ ও বিশ্ব
ফরিদ আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতা করেছেন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে টরেন্টোতে ।
ফরিদ আহমেদ
-দাসী প্রথা আদিকাল থেকেই চলে আসছে। সব দেশে সব জাতিতেই দাস-দাসীর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। হিন্দু সামাজিক আইনে ১৫ প্রকার দাস-দাসীর উল্লেখ আছে। মুসলিম সমাজে দাসীপুত্র, যুদ্ধবন্দী, পেটের দায়ে বিকিয়ে দেয়া শিশু, নারী-পুরুষ দাস অর্থাৎ ক্রীতদাস হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবে আরবীয় সমাজে দাসকে মুক্তি দেয়ার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তবুও দাসবৃত্তি পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়নি। যুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের দাস হিসেবে বিদেশে বিক্রি করে দেয়ার নিয়ম ছিল। ইসলামের আদর্শে দাস-দাসীকে পারিবারিক সদস্যদের মতো সম্মান দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।
ভারতীয় সমাজে দাস ব্যবসা প্রচলন ছিল। খোজা দাসদের মধ্যে কেউ কেউ দিল্লির সুলতান ও বাংলার সুলতানের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। বাংলার সুলতান আলী মর্দান ও সুবেদার মুর্শিদ কুলী খাঁ ক্রীতদাস জীবন থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্ব বিস্তারকারী উসমানীয় সম্রাট প্রথম সুলাইমান এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হুররেম সুলতানের ক্রীতদাসী হয়েও পরে তাঁর প্রধান স্ত্রী বা সুলতানা হিসেবে সম্মানিত হন।
উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আফ্রিকার কৃষ্ণকায় মানুষগুলো দাস বৃত্তিতে নিয়োজিত ছিল। কাফ্রি মা-বাবা তাদের আর্থিক প্রয়োজনে শিশু-কিশোর বয়েসীদের বিক্রি করতো। মাদ্রাজ ও কলকাতার দাসবাজার থেকে সম্পদশালী লোকেরা তাদের ইচ্ছেমতো দাস ক্রয় করতেন। সুলতানি, মুঘল ও ইংরেজ শাসনামলে বিভিন্ন দাসবাজারে কাফ্রি দাস সহজে পাওয়া যেতো। কাফ্রিদের একই অংশকে খোজা তৈরি করা হতো। মুঘল সরকারের অনুমতি নিয়ে পর্তুগিজসহ বিভিন্ন জাতির লোকেরা ব্যবসায়ে সুবিধা পায়। পর্তুগিজ ও মগ দস্যুরা বাঙালি নর-নারীদের পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দাস-দাসী হিসেবে বিক্রি করেছে।
বাসাবাড়ির ভেতরে ঘর-গৃহস্থালি কাজের তদারকির জন্য দক্ষ একজন কাজের মানুষ বা গৃহভৃত্যের প্রয়োজন হয়। সব কাজের জন্য নিযুক্ত কাজের ঝি’রা কখনো সমাজের মানুষের চোখে হেয়প্রতিপন্ন হয়। গৃহকর্তা বা কর্ত্রীরা এদের অবজ্ঞার ছলে চাকর-চাকরানী বা গধরফ ঝবৎাধহঃ বলে থাকে। চাকর-বাকরদের খাবার দাবার কষ্ট, দৈহিক নির্যাতন ও অমানুষিক খাটুনি খাটতে হয়। অসুস্থ হলে ছুটি নেই। কোনো সময় ভালো না লাগলে বিদায় করে দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। টাকা দিয়ে কেনা ক্রীতদাসের মতোই ব্যবহার করছে মনিবরা। আবার অধিকাংশ মনিব গৃহভৃত্যদের আচরণে সন্তুষ্ট নয়। মনিব কর্তৃক গৃহভৃত্য নির্যাতনের খবর প্রায়ই ঘটে। পাশাপাশি মনিব নির্যাতনের খবরও চোখে পড়ে। বহির্মুখী মানুষগুলোর অবশ্য কাজের মানুষের প্রয়োজন হয়। এই জন্য যে তারা বাড়ি ফিরে খাবারটুকু নিশ্চিন্তে খেতে সক্ষম হয়। এসব ক্ষেত্রে কাজের মানুষ ছাড়া উপায় নেই। গৃহভৃত্য শ্রেণিকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন একটা মানবীয় দৃষ্টিকোণ এদের বেলায় প্রযোজ্য। মনিব-ভৃত্যের সম্পর্ক অভিন্ন থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবীন্দ্রনাথ ভৃত্যশাসিত তোষাখানার মধ্যে রুদ্ধ হয়ে ছোটবেলায় চাকর-বাকরদের কাছে হেলাফেলার মানুষ বলে খুব বেশিদিন সেবা-যতœ পাননি। তিনি যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সমাজে সাধারণের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন একরূপ অসম্ভব ও অসাধ্য ছিল। পরবর্তীতে তিনি লক্ষ করেছেন ভৃত্যদের মধ্যে কেউ কেউ পেট খোরাকী, কেউ কেউ মাইনেভোগী। মাইনেভোগীদের মধ্যে যৎসামান্য মাইনের চাকর-বাকররা কী রূপ দিনাতিপাত করেছে—তাদের সংসারের কথা—তাদের জীবনের আবেগ-অনুভূতির খুঁটিনাটি বিষয় রবীন্দ্রনাথ জানতে সক্ষম হয়েছেন। এ গ্রন্থে চাকর-বাকরদের সাথে সংলাপপটু রবীন্দ্রনাথ কতটুকু অসাধারণ ছিলেন সে সম্পর্কে পাঠকবর্গ ধারণা লাভে সক্ষম হবে বলে প্রত্যাশা করি।
বিনয়াবনত
এস.এম. আফজাল হোসেন
শিলাইদহ, কুষ্টিয়া
রবীন্দ্রনাথের চাকর-বাকর
লেখকের কথা
জাপানের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা (কাকুজোও) তেনশিন বলেছিলেন, জাপান এশিয়ার জাদুঘর। আমি বলি, জাপান একটি বৈশ্বিক দর্পণ। বিশ্বের চতুর্দিক তথা চারটি মহাদেশের ছবি এই দর্পণে প্রতিফলিত হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে। বিশ্বের প্রায় সব সংস্কৃতিরই ধারা এসে মিলিত হয়েছে জাপানের মূলধারার সঙ্গে। বিশেষ করে ধর্ম ও সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে এই দেশের জনধারায়। সন্দেহ নেই যে, চীন ও ভারতের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। মধ্য যুগ পর্যন্ত ক্রমাগত জাপান প্রভাবিত হয়েছে প্রাচীন চীন ও ভারতের ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, পুরাণদ্বারা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, গোত্রের মানুষ প্রাচীনকালেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবর্তী জাপানের ভূখণ্ডে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। যে কারণে জাপানিরা সংকর জাতির লোক। আর এর ফলেই জাপান হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির মনোরম বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি দেশ। যার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না। যে সংস্কৃতির টানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচবার ভ্রমণ করেছেন জাপান। প্রতিবারই তিনি জাপানকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন।
জাপানে যারা আসেন প্রথমে তাদের কাছে সবকিছুই অদ্ভুত প্রতিভাত হয়। কেননা জাপানিদের জীবনধারাটাই স্বাতন্ত্রিক। কিন্তু দীর্ঘদিন এ দেশে বসবাস করলে পরে তাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তারা সঠিক দেশেই এসে পড়েছেন! এখানে জীবনযাপন যেমন খুব বাস্তব ও কঠিন তেমনি স্বপ্নের বাস্তবায়ন বা ইচ্ছেপূরণের সমূহ সম্ভাবনাও বিদ্যমান। বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা। কাজের দেশ জাপান, ইচ্ছে করলে কাজ জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। আর রয়েছে উচ্চশিক্ষার বিস্তর সুযোগ। তবে, অবশ্যই জাপানিদের নিয়মনীতি মেনে চলা প্রথম ও শেষ শর্ত। কেননা, যতোই তারা বহির্বিশ্বের প্রভাব গ্রহণ করে একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি ও বাতাবরণ নির্মাণ করে থাকুন না কেন, জাপানিরা কিন্তু মনেপ্রাণে ও আদর্শে জাপানিই। “জাপানিজম” বা “জাপানিত্ব” তাদের মধ্যে সর্বক্ষণ সর্বক্ষেত্রে জাগরুক। শান্তি ও বিশ্বাস এই দেশের মূল ভিত্তি। বিশ্বাস হারালে জাপানে আর বসবাস সম্ভবপর নয়, শান্তি বিঘিœত হওয়ার মতো কাজ জাপানিরা প্রশ্রয় দেন না। আস্থা, বিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম, মহাধৈর্যগুণ, অনুচ্চকণ্ঠ, সময়ানুগ, প্রতিবেশী-সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, সমবায়মনস্কতা, অনুসন্ধিৎসা জাপানিদের চারিত্রিক পরিচয়। আর এইসব গুণাগুণ জাপানি সংস্কৃতি, সৃজনশীলতা ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিহিত আছে।
জাপান প্রবাসের চার দশক হতে চললো। এই দীর্ঘ সময়ে জাপানকে দেখা, জানা ও পড়ার মধ্য দিয়ে যে ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তারই প্রতিফলন রয়েছে এই গ্রন্থের ২৫টি ছোটবড় প্রবন্ধের পরতে পরতে। প্রবন্ধগুলো ২০১৫ থেকে ২০০২১ পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয়, সাহিত্য সাময়িকী, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন এবং সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সংকলনভুক্ত করার তাগিদে নতুন করে তথ্য-উপাত্ত সংশোধিত ও সংযোজিত করার প্রয়াস নিয়েছি। আশা করি পাঠক বহুকিছু জানতে পারবেন এই প্রবন্ধগুলো থেকে যা বাঙালির ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনকে উন্নত করার জন্য শিক্ষণীয় বলে বিশ্বাস করি। সেইসঙ্গে জানা যাবে বাংলাদেশ ও জাপান সম্পর্কবিষয়ক তথ্যসমূহ যা দুর্লভ বলেই বিবেচিত।
উদীয়মান “অনুপ্রাণন প্রকাশন” কর্তৃপক্ষ এর আগে “জানা অজানা জাপান” ৩য় খণ্ড প্রকাশ করে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। এবারও ৪র্থ খণ্ড প্রকাশ করে আমাকে চিরঋণী করছেন। এজন্য জানাই আনত ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। যেহেতু প্রবন্ধগুলো গবেষণামূলক, তাই ভুলভ্রান্তি যেমন থাকবে, তেমনি লেখকের মতামতের সঙ্গে পাঠকের মতভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। তার জন্য সকল দায়দায়িত্ব লেখকেরই, প্রকাশকের নয়।
Jana Ajana Japan Part-4 By Probir Bikash Sarkar
ভূমিকা
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদল চিকিৎসার জন্যে কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের ভেলোর শহরে গিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন তার আজীবন সহযাত্রী, সহযোদ্ধা আমাদের প্রিয় সুলতানা ভাবী। বাদল ভাই ভাবীর সাথে নানান জায়গার ছবি তুলছেন আর তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা লিখে পোস্ট দিচ্ছেন। আমিও মজা করে কমেন্ট করে যাচ্ছি সেইসব পোস্টে। প্রথমদিকে সাদামাটা পোস্ট ভেবেই গভীরে তেমন ঢোকার চেষ্টা করিনি। কিন্তু সময় যতোই যেতে থাকে পোস্টগুলো আমাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে। একসময়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাদল ভাইয়ের ভ্রমণবৃত্তান্তের অপেক্ষায় থাকি, কখন তিনি পোস্ট দিবেন, কখন সেই আখ্যানগুলো পড়বো। অবস্থা যখন এমন পর্যায়ে একদিন বলেই ফেললাম যে লেখাগুলোকে মলাটবদ্ধ করলে একটি ভালো বই হতে পারে। উপযাচক হয়ে এটাও বললাম যে যদি কখনো লেখাগুলো মলাটবদ্ধ হয় আমিই লিখবো এর মুখবন্ধ।
বলেতো দিয়েছি কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে এই গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপবে! সেদিন হঠাৎই বাদল ভাইয়ের ফোন, ‘কমরেড, ভারতে কয়েকদিন নামের বইটি আসছে আগামী বইমেলায়। ভূমিকা কিন্তু আপনাকেই লিখতে হবে।’ আমিতো সপ্তম আসমান থেকে পড়লাম একেবারে জমিতে।
যাইহোক, সচরাচর ভ্রমণকাহিনী বলতে আমরা যা বুঝি আনোয়ার হোসেন বাদল এর ‘ভারতে কয়েকদিন’ সে অর্থে কিন্তু কোনো ভ্রমণকাহিনী নয়। বরং এটি হচ্ছে সাদা চোখে দেখা সাদামাটা অভিজ্ঞতার এক নির্মোহ বিবরণ, কিছু জানা কথা, কিছু অজানা তথ্যের প্রকাশ।
বইটি এমন সহজ-সরল ভাষায় লিখিত যে—পড়ার সময় মনে হতে পারে পাঠক বই পড়ছেন না বরং লেখকের সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভারতের নানান শহর। নিজের চোখেই পাঠক দেখছেন ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থাপনা আর বিচিত্র প্রকৃতি।
আলোচ্য বইটিতে পাঠকের পরিচয় ঘটবে ভারতের ঐতিহাসিক শহর কোলকাতা, তৃতীয় বৃহত্তম শহর দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই আর ভেলোরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্পসংস্কৃতি ও স্থাপত্যকর্মের সাথে।
বইটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমরকীর্তি হিসেবে স্বীকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
কবি হানিফ মোহাম্মদ
তালেপুর, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।
ভারতে কয়েকদিন
মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়
বিভিন্ন দেশ, জাতি ও সমাজের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় মুছে দিয়ে চিরকালের জন্য নিজ শাসন ও শোষণের আওতায় নিয়ে আসার জন্য এক একটি জাতি ও উপজাতির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে দুর্বল করে দিয়ে সুকৌশলে একক একটি ভাষা ও সংস্কৃতি জাতিতে জাতিতে চাপিয়ে দেয়া- সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বিস্তারের প্রাথমিক পরিকল্পনারই একটি অপকৌশল। আধুনিক বিশ্বে বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করা ও বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যে অধ্যায়ের মধ্যে আমাদের ভাষা, সাহিত্য শুধু নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মহান সংগ্রামেরই ঐতিহাসিক সূত্রপাত। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মরণে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলা- বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তথা বাঙালী চেতনাকে সম্প্রসারিত ও সুদৃঢ় করে তোলার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের জাতীয় জীবনে অমর একুশে বইমেলার অপরিসীম ভূমিকাকে গুরুত্বের সাথে আমাদের অনুধাবন করতে হবে এবং এই বইমেলার গুণগত মান এমনভাবে পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত করতে হবে যেন এর সুফল সারা বছর জুড়ে আমাদের জাতীয় জীবনে সফলভাবে কার্যকরী থাকে।
ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির উৎকর্ষ সাধনের যে কোন প্রচেষ্টায় দেশের গণমানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে মানসম্পন্ন কাজে রূপান্তরিত করাটাই জরুরী। তাছাড়া, প্রতিনিয়ত নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটানো এবং সেসব নতুন নতুন চিন্তার বাস্তবায়ন একটি জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সুদৃঢ়ভাবে সচল রাখতে এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন মোকাবেলা করতে সবল ও সক্ষম করে তুলতে পারে। একুশে বইমেলাকে ঘিরে সেসব কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর ঘটাতে আমরা কতটুকু সক্ষম হচ্ছি- এটাই আমাদের সামনে মূল প্রশ্ন। গণমানসের অনুবাদই প্রতিভার একমাত্র ধর্ম নয়। গনমানসের সংগঠনে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে উপযোগী রূপান্তর ঘটানোর প্রচেষ্টাই একুশে বইমেলার মতো এই বিরাট কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কিন্তু, আমরা এই বিরাট কর্মযজ্ঞের মাঝে গনমানসের সংগঠনে রূপান্তর ঘটার মত সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখি না। আত্মকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্তির মধ্যে একুশে বইমেলাকে বন্দী রাখার মত অপচয় কীভাবে বন্ধ করার যায়- এ নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। সত্যের এই পরিণতি মনে রাখাটা খুবই জরুরী- যে সাধনার অগতি বন্ধ্যত্ব আনে, সেই বন্ধ্যত্বের মাঝেই স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য, আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের বিনাশ ঘটে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে, একটি জাতির নিজস্ব প্রতিভা ও সৃজনশীলতার চর্চাকে বিপথে পরিচালিত করার অপচেষ্টা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ সবসময় চটকদার কর্মসূচি আমাদের মাঝে হাজির করবে।
গত শতাব্দীর শেষভাগে, নিয়ন্ত্রিত শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা বনাম মুক্ত ও স্বাধীনভাবে শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুফলতা ও কুফলতা নিয়ে বিতর্কের এক রকম অবসান ঘটায় এখন দেশে দেশে মুক্ত ও স্বাধীন শিল্প ও সাহিত্যের চর্চার পক্ষেই জনমত গড়ে উঠেছে। কিন্তু, মুক্তচিন্তার প্রকাশের কারনে শাসক শ্রেণি বিব্রত হয় বলে শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও নিয়ন্ত্রণ একেবারে উঠে যায় নি। সেন্সরশিপ আরোপ এবং গত কয়েক দশকে মুক্তচিন্তা চর্চাকারীদের উপর কট্টরপন্থীদের সশস্ত্র আক্রমণ ছাড়াও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ হতে দেখা যাচ্ছে। এসব প্রচেষ্টা শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথে বাধা। শত শত বছরের ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে নতুন ও মুক্ত চিন্তার চর্চা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গনমানুষের নান্দনিক অভিব্যক্তি বাধাহীন বিকাশ লাভ করে না। নিয়ন্ত্রিত বিকাশ যে বাস্তবে ঘটে না এবং অবশেষে বন্ধ্যত্ব ও স্থবিরতার কবলে পরে ধ্বংস হয়ে যায় এর ঐতিহাসিক প্রমাণ যেমন দুঃখজনক তেমনই বাস্তব।
কিন্তু, এটাও মনে রাখতে হবে যে মুক্ত, স্বাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার নামে নৈরাজ্য একেবারেই কাম্য নয়। বলতে গেলে, দেখা যাচ্ছে যে সাহিত্য চর্চা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে দুধরনের প্রবণতা এই ক্ষেত্রটিকে দারুণ ক্ষতির সামনে দাড় করিয়েছে। কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা যতই মান বিচারে নিরপেক্ষতার কথা বলুক না কেন, বাস্তব কিন্তু তা বলে না। ফলে এমন একটি সুবিধাভোগী শিল্পী ও সাহিত্যিক চক্র তৈরি হচ্ছে যাদের তৈরি শিল্প-সাহিত্যের মান সম্পর্কে ক্রমাগতভাবে ভুল বার্তা দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একটি গড় মানের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মাঝে এমন একটা হতাশা তৈরি হচ্ছে যে তাদের হাত দিয়ে বাংলা শিল্প ও সংস্কৃতিতে যে উচ্চ স্তরের বিকাশ ঘটানো সম্ভব ছিল সেই পথ দুঃখজনকভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটছে, সেটাও খুব দুঃখজনক। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে এর উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে একদল শিক্ষানবিস লেখক নিজ খরচে বই প্রকাশ করে এবং তাঁর পক্ষে দল পাকিয়ে নিজেকে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রচারনায় লিপ্ত হচ্ছেন। এসব সাহিত্যকর্ম একেবারেই মানসম্পন্ন নয় ফলে প্রজন্ম বাংলা সাহিত্যের মান সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রাপ্ত হচ্ছেন। অনুপ্রাণন আশা করে যে, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে মননশীল, সৃজনশীল ও মানসম্পন্ন শিল্প ও সাহিত্যের চর্চা ও সাধনার পক্ষে গভীর সচেতনতা নিয়ে একটি মুক্ত ও স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠবে।
সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
লেখক পরিচিতি :
এ.টি.এম মোস্তফা কামাল। জন্ম: ১লা জানুয়ারি, ১৯৬৬। নোয়াখালিতে পৈত্রিক নিবাস। চাকুরির সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করেছেন। এখন ঢাকায় বসবাস করছেন। লেখকের মূল ভালোবাসা কবিতার জন্যে, তেত্রিশ বছর হয়ে গেলো কবিতার আরাধনায়। মাঝে মধ্যে গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকথা লিখেন। এটি লেখকের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বাঙ্গালা রুবাইয়াৎ’।
হৃদয়পুরে দেশান্তরী
ভূমিকা-
কবিতার ভিতর দিয়ে বহুবিধ বহুকালের অমীমাংসিত জটিল সমীকরণের সমাধান খুঁজে চলা কবির নাম সালাহউদ্দিন সালমান, কবি যেন কলমের ডানায় আর খাতার বাতিঘরে লুকিয়ে রাখে বেঁচে থাকার মৌলতম রসদ, তার কবিতায় পাঠক খুঁজে পায় অনন্য স্থির নির্ভেজাল ধনাত্মক-ঋণাত্মক ডান বাম, ভালো মন্দ সুখ দুঃখ, অনুভূতি চিন্তা ভাবনা বোধের শৈল্পিক নিরপেক্ষতা। মানুষের সাধ্যাতীতের বিপরীতে কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলে নরম জীবনের কারুকাজ, কবি তার কবিতায় দ্রোহের রক্ত নিয়ে আলো খুঁজে অসম্ভব অনিশ্চয়তার নিঃসীম অন্ধকারে, তার একেকটি কবিতা মূর্তিমান জীবনের একেকটি দীর্ঘশ্বাস, সমাজ সংস্করণে এই জীবনমুখী কবির কবিতা যেন প্রয়োজনীয় বিদ্রোহের প্রতীক। কবির প্রেমময় কবিতাগুলো যেনও প্রেমিক প্রেমিকার বুকপকেটে ভরে রাখা কখনো কালো মেঘের আহাজারী, কখনো শূন্যতার নিঠুর মহামারী, আবার কখনো কখনো চালচুলোহীন স্বপ্নাতুর লালিত সঞ্চয়ের সমুদ্রখচিত বিশাল আকাশ। কবির একটি কবিতা পড়েছিলাম পোড়ামাটি নামক- শুইয়ে থাকা নীরব জ্যোৎস্না কে ছুঁতেই /নিজের ছায়া ছুটে চলে অন্ধকারের দিকে/ মেঘঘন আকাশের ফিকে বিছানায়/অগণিত জোনাকিদের সদ্য ঘুম মুখে/আঙুল রাখতেই খলবলিয়ে উঠে নিস্তরঙ্গ নদী/ ভাঙি দ্রোহ আর আকাক্সক্ষার জড়ানো ইমারত/ অনিবার্য পিপাসা ফুরায় অন্তর্গত অভিবাসী জলে/ অবাধ্য হাতের অকুতোভয় আঙুলগুলো বোটা ছুঁতেই/ অঝোর আষাঢ় আসে থই থই লুণ্ঠিত হয় ঘরবাড়ি/ ঘাম শুকায় ঘামে কাঁচা দেহ হয় পোড়ামাটি/ -সশরীরে দেখে মনেই হবে না সালাহউদ্দিন সালমান এমন অসংখ্য কবিতার কবি, কবির নিজের একটি উক্তি আছে কবিতাকে নিয়ে কবি প্রায় বলেন-কবিতা সত্য সুন্দর স্বপ্নিল জীবনের সাথে চলে আমরা কবিতার সাথে চলি। বিশ্বব্যাপী কবিতার মিছিলে কবি সালাহউদ্দিন সালমান এর উজ্জ্বল পদচারণ তারই দৃপ্ত প্রমাণ।
পকেট সেলাই করি ছেঁড়া জামার
যদি কখনো আসে, যত্নে ধরে লালন করি তারে। শুধু হৃদয়ে নয়, সর্বদেহে।
তোমরা তাকে যে রূপে দেখতে পাও, হয়তো তার নাম ই কবিতা।
যেমনঃ
আমার তেইশ ফুরায় না ||
আমি আজও তেইশে ই
যে তেইশে কাব্যের বুকের পাজর হয়েছি
পদ্মার তলে শ্যাওলা— মাটির প্রেম দেখেছি।
তেইশের তাপে মন উথলে ওঠে এই সকালেও
তেইশে বাকদত্তা চুল খোলা
তেইশে বসন্ত ভাব জাগা
তেইশে ই কেবল ভুল করে ভুলের প্রেমে পড়া!
তেইশের ঘোরে উড়ছি আজো আরো তেইশ ধরে
তেইশের ঘরে জমা করেছি গোপন আত্মা আহারে!
আমার তেইশ দুলছে আজও
পদ্মার জলে— ধরলার চড়ে
চন্দ্র সভার—আলো আকাশে
মাঝিহীন নৌকার খোলা পাটাতনে
তোমার লুকোচুরি ছোঁয়া-ছুঁয়ি পরানে।
প্রণয় মল্লার- Pranoy Mollar
এক ফোঁটা নিশ্চুপ জলবিন্দু থেকে ওর পায়ের দূরত্ব ছিল অল্প একটু। ঐ অল্প একটু দূরত্ব যাতে ও একা একা অতিক্রম করে চলে না যায়, এজন্যে আমার ভীষণ উন্মত্ততা ছিল!
সেই উন্মত্ততা পাথরে পাথরে, সেই উন্মত্ততা স্মৃতিমিনারের শীর্ষতায়, সেই উন্মত্ততার তির্যক ছোঁয়া কিছুটা পেল এই কাচের পুতুল। কে এই কাচের পুতুল? এই প্রশ্নটা তুললেই…
অচেনা বাতাস বরাবরই শুনিয়ে যায়
‘মাঝেমাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না…!’
এভাবেই শুনে যেতে থাকবো?
ঠিক এভাবেই?
প্রিয়মুখের মতন এই সূর্যাস্ত
মানুষের কখন যে কী হয়―তা হিসাব করে কেউ কখনো বলতে পারে না! হঠাৎ করেই মানুষ অন্যরকম হয়ে ওঠে। এই যে শফিকের সঙ্গে একই অফিসে কতদিন একসঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করেছে নমিতা―কোনোদিন তাকে এত মনোযোগ দিয়ে দেখেনি শফিক। কিন্তু আজ যে তার কী হলো!
নমিতা আজ খুব সুন্দরভাবে একটা শাড়ি পরে অফিসে এলো। আর আজই শফিকের খুব ভালো লেগে গেল নমিতাকে। তাই, অফিস-ছুটির পর সে তাকে রেস্টুরেন্টে চা-কফির আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু নমিতা তাকে জানালো, আজ তার হাতে একদম সময় নেই। আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বাসায়। আর তাকে, তাদের পছন্দ হলে আজই বিয়ে হয়ে যেতে পারে!
নমিতা একরকম বাধ্য হয়ে চলে যায় শফিককে পাশ কাটিয়ে। কিন্তু শফিকের খুব মনখারাপ হয়। আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না তার। মনটা তার ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে নমিতার জন্য। সে একমুহূর্তে কেমন যেন হয়ে যায়! নমিতাকে কিছুতেই সে ভুলতে পারে না।
সে নমিতাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। আর ভাবে―নমিতাকে ছাড়া তার চলবে না। আজ নমিতাকে খুব ভালো লেগেছে তার। ভাবতে-ভাবতে নমিতার জন্য শফিক যেন একেবারে পাগল হয়ে যায়! কিন্তু নমিতার যে আজই বিয়ে হয়ে যেতে পারে!
শফিক রাস্তায় হাঁটতে থাকে উদভ্রান্তের মতো। সে কি আজ বাসায় ফিরতে পারবে? শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল―তা জানতে হলে পড়তে হবে এই অনবদ্য একটি বালিকার গল্প।
এটি ১০০% রোম্যান্টিক প্রণয়োপাখ্যান।
একটি বালিকার জন্য
ভূমিকাঃ
‘সন্ধ্যার পিদিম’ হাতে কেউ কখনও উলুবনে গেছে কিনা আমার জানা নেই। ব্যাখ্যাহীন আঙুলে কীসের গোপন- এমন প্রশ্নের উত্তর জানারও অবকাশ থাকে না, যখন ‘তারার হাটে মুদ্রিত কিছু শাদাকে’ খুঁজে পেতে ‘ঐতিহ্যের বড়শিতে ঝুলে থাকা শতাব্দীর মাছ’ হয়ে জীবনযাপন করতে হয় আমাদের। বস্তুত নাগরিক ব্যস্ততার কিঞ্চিত অবসরে দ্বীপ সরকারের কবিতা নস্টালজিক এক ঘোরে তলিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। ‘বোধশূন্য শব্দক্রীড়ার কাব্যচর্চার’ ডামাডোলে দ্বীপ সরকারের কিছুটা অনাড়ষ্ট প্রকাশভঙ্গিমা মুগ্ধতা জাগায়। কিন্তু ‘শিশিরের জিবের ভেতর গুঁজিয়ে দিলো টেরাকাঁটা (!) মাছ’ জাতীয় পঙ্ক্তিগুলো নির্দিষ্ট কোনও অর্থময়তা বা কোনও ধরনের চিত্রকল্প নির্দেশ করে কিনা- বোধগম্য নয়। হতে পারে, এটা আমার অনভিজ্ঞতা। তবে তার ভাষাবুদ্বুদে খুব একটা জটিলতা নেই; বিপরীতে, ছন্দহীনতাও পীড়াদায়ক। তিনি তার সময়ের অন্যদের মতন ‘অনর্থময়তার’ গান গেয়েছেন; তবে সে স্বর খানিকটা পেলব- মোহন সৌন্দর্যখচিতও বলা যায়।
রুচির পৃথকতার কারণে যে ধরনের কবিতার প্রতি আমার দুর্বলতা, দ্বীপ সরকারের কবিতা ঠিক তেমন নয়। শিল্পবিচার কিংবা আলোচনার ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তির রুচি আর শিল্পের নৈর্ব্যক্তিকতা পরস্পরের কাছে দুরাত্মা নয়, দুরাত্মীয়’- এটা মনে রেখেই দ্বীপ সরকারের ‘ডারউইনের মুরিদ হবো’ পাণ্ডুলিপি আমি একজন সাধারণ পাঠক। ফলে তার কবিতার পাঠকে নিবিড়তম পাঠ হয়ত বলা যায় না, কিন্তু সর্বাংশে খণ্ডিত নয়- আমার বিশ্বাস। তা ছাড়া আমি পণ্ডিত নই। শাদাকে শাদা আর কালোকে উচ্চৈঃস্বরে কালো বলি। কবিতার শব্দজট, অর্থহীনতা, উপদেশ; আবার, কখনও-কখনও দায়বদ্ধতার চাকচিক্যে আটকে যায় পাঠরুচি। নিজের অক্ষমতার বিষয়টিও ভুলি না। এসব টোটকা বিবেচনায় দ্বীপ সরকারের কবিতা আমার পাঠরুচি টপকাতে না পারলেও; কাব্যবোধের ক্ষেত্রে তার এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কখনও কখনও লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে।
‘কবিতার মৌলদায় কী’- এমন জিজ্ঞাসা আমার চিরকালীন। দ্বীপ সরকারের কবিতার পাঠ শেষে এ প্রশ্ন আবারও বেগবান হয়েছে। মোটাদাগে, দ্বীপ সরকারকে ‘কবিতা কারিগর’ হিসেবে দেখতে চাই; তবে মনে রাখা দরকার, এ-পথ সাধনায় সিদ্ধি অর্জনের, পরম অধ্যবসায়ের। পাশাপাশি সৃজনীদক্ষতার মাধ্যমে পঙ্ক্তিগুলো ইঙ্গিতময় করে তোলার ব্রত নিয়ে পরিশিষ্টের পথে এগিয়ে যাওয়ার। শোচনীয়ভাবে স্বীকার করছি, এ-পথে এগিয়ে যেতে বেশিরভাগই ব্যর্থ হন। কবিতার ভেতর কার্যসিদ্ধির কোনও ধরনের প্রচেষ্টা না রাখলে দ্বীপ সরকারও এগিয়ে যেতে পারেন, এ আভাস কিছুটা হলেও তার কবিতার অন্তঃপুরে দুল্যমান। ‘ডারউইনের মুরিদ হবো’ পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো পাঠকের ভালো লাগবে, এমন প্রত্যাশাও জিইয়ে রাখছি।
বীরেন মুখার্জী
কবি ও প্রাবন্ধিক
ঢাকা
১৪ অক্টোবর, ২০১৮।
ডারউইনের মুরিদ হবো
রবিউল ইসলাম। হাস্যরসের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রসিক আর আড্ডাপ্রিয়। হাস্যরসিক বন্ধুপ্রিয় এ মানুষটির জন্ম ১৯৭৭ সালেÑ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাধীন গোমস্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী শিবরামপুর গ্রামে। লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর অনেক প্রবন্ধ, কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ইতোপূর্বে লেখকের ‘কই মাছটি এখনো নড়ছে’ (২০১৯) এবং ‘বিরুদ্ধ বাতাসে বালক’ (২০২০) শিরোনামে দুটি রম্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে উৎসারিত তাঁর রম্যগল্পগুলো। গল্পগুলোতে ভারত সীমান্তের কোল ঘেঁষে বিরাজমান শিবরামপুর গ্রামের প্রকৃতি ও মানুষের সহজাত ঘটনা বর্ণিত হলেও এটি মূলত আবহমান গ্রামবাংলার রসময় চিত্র ।
রবিউল ইসলাম ২৬তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০০৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজে প্রভাষক বাংলা পদে যোগদানের মাধ্যমে চাকুরিজীবন শুরু করেন। ইতোপূর্বে তিনি সহকারী অধ্যাপক, বাংলা পদে চাকুরি করেছেনÑ রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী, বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজ, বদলগাছী, নওগাঁ ও ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজে। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পি-এইচ.ডি গবেষণারত।
বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র বিষয়ের তিনি একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন ছাত্রজীবন থেকেই।
‘চেরাগ আলীর ফুটবল কাল’ লেখকের প্রথম শিশুতোষ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলো শিশুদের উপযোগী করে লেখা হলেও যে কোনো বয়সের পাঠক এর গল্পরস থেকে বঞ্চিত হবেন না। গল্পগুলোতে লেখকের শৈশবকালীন স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা শিশুমনের উপযোগী করে ব্যক্ত করা হয়েছে। কাহিনি বর্ণনায় হালকা রসের আশ্রয় নেয়া হয়েছে Ñ যা শিশুমনে অফুরান আনন্দ জোগাবে।
এ গ্রন্থে লেখকের শৈশব কৈশোরের দুরন্ত ও ঘটনাবহুল দিনগুলোর ছবি জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
চেরাগ আলীর ফুটবল কাল
রাজীব নূর খান। জন্ম ১৯৮৫ সালে ঢাকায়। বর্তমানে ফটোসাংবাদিক। আড্ডা দেয়া ভীষণ পছন্দ। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে লেখার চেষ্ঠা করেন। মানুষের গভীর গোপন অনুভূতিগুলো ছবি ও লেখালেখির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলোর চেষ্টা করেন। এলামেলো জীবনে অভ্যস্ত হলেও আগোছালো কাজ সহ্য করতে পারেনা একেবারেই।ওর ভীতর রয়েছে আশ্চর্য এক সুন্দর শৈল্পিক সত্ত্বা; যাপিত জীবনের খুব তুচ্ছ বিষয়কেও নিজের রুচিবোধ আর সৃজণী ক্ষমতা দিয়ে পরম উপভোগ্য আর সুখপাঠ্য করে তোলেন।
টুকরো টুকরো সাদা মিথ্যা
মায়ের জঠরে রক্তের নদীতে
সাঁতরে সাঁতরে
জন্মাতে চাইনি রক্তপাতে
অস্থির এই পৃথিবীতে
জন্মাতে চাইনি বলে
মা’র সাথে তর্কবিতর্কে-
অপেক্ষা করেছি নয় মাস
মা একদিন পৃথিবীর সব ব্যাথা
গোপনে শুষে বললো
বাছা, ন’মাস তো শেষ,
এবার জন্ম হও
আজ ১৬ ডিসেম্বর
একা এক দারুগাছ
লেখক পরিচিতি :
মনির ইউসুফ। জন্ম: অসম্ভ্রান্ত কৃষি ও জেলে পরিবারে। ঈদগাহ, ইসলামাবাদ, কক্সবাজার। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি তীব্র আকর্ষণ। সময় যাপন কবিতার ঘোরে।
প্রতিকবিতা ও অবাধ্য গোলাপ
লেখকের কথা
প্রতিটি মানুষের জীবনেই রয়েছে অজস্র গল্প। গল্প ছাড়া মানুষের জীবন হতেই পারে না! আর সেইসব গল্প বাস্তবতার- আদৌ কল্পনার নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। গল্পগুলো সেই সম্পর্কজাত। যা জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। যারা লিখতে পারেন তারা চেষ্টা করেন সেইসব জীবনস্মৃতির গল্পগুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরতে লেখনীর মাধ্যমে। আর যারা লেখায় অভ্যস্ত নন, তারা নিভৃতে মনের ভেতরে সেসব লালন করেন এবং সময়-সুযোগ পেলে অন্যকে বলেন। অনেক লেখক আছেন যারা বিভিন্ন সময় নানা চরিত্রের মানুষের কাছ থেকে তাদের জীবনে অর্জিত অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার গল্প, দুঃখ-বেদনার গল্প, হাসি-খুশির ঘটনা, বিয়োগান্তক কাহিনী ইত্যাদি শুনে উপন্যাস বা গল্পে রূপ দেন।
সাধারণ মানুষ বলি আর বিশিষ্টজন বলি; লেখক বলি আর শিল্পী বলি- তাদের জীবনের গল্পগুলো সাধারণ গল্প নয় বলেই গণমাধ্যমে বা পাঠ্যপুস্তকে সেগুলো প্রকাশিত হয়ে থাকে। শিক্ষামূলক গল্পের যেমন শেষ নেই তেমনি প্রেম-ভালোবাসা, ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, বিচ্ছেদ, লড়াইমুখর গল্পেরও সীমা-পরিসীমা নেই। সেসব জীবনস্মৃতির গল্প পড়ে আমরা বিচিত্র চরিত্র, চিন্তা ও মন মানসিকতার মানুষকে চিনতে, জানতে পারি। এর মধ্যে অনেক গল্পই আছে সাহিত্যরসে টইটুম্বুর- রোমান্টিক, ভাবনার উদ্রেককারী এবং শিক্ষামূলক।
গল্প সাধারণত দুধরনের বলা যায়, এক হচ্ছে, বানানো গল্প বা কল্পলোকের গল্প। দুই হচ্ছে, জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তব গল্প। বানানো গল্পগুলোর চেয়ে জীবনস্মৃতির গল্পগুলো বেশি নাড়া দেয় মানুষ তথা পাঠককে। কারণ সেইসব গল্প অনেক মানুষের জীবনের গল্প। বানানো গল্প যেভাবে সুন্দর ভাষা ও অলঙ্কারে আদর্শ চিত্রকলার মতো করে প্রকাশ করা হয়, জীবনস্মৃতির বাস্তব গল্পগুলো সেই রঙে আঁকা সম্ভব হয় না। এতে করে গল্পের প্রাণ হারিয়ে যায়, সংবেদনশীলতা শীতল হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় আকর্ষণও। বানানো গল্প মনে থাকে না, যদি না তাতে বাস্তবতার নোনাজলের ধারা প্রবাহবান থাকে।
মানুষ হিসেবে আমিও ব্যতিক্রম নই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার এই ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে বহু ঘটনার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, অর্জিত হয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা। কত চরিত্রের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছে তার হিসেব নেই। সেইসব ঘটনা অমূল্য স্মৃতি এবং অকাট্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক এতই অম্ল-মধুর যে, পড়ন্ত বেলায় এসে যতই ভাবি ততই নিজেকে ফিরে ফিরে দেখার সাধ জাগে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিষণ হই। জীবনস্মৃতির সেইসব অজানা গল্পগুলোই পড়ে অনেকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেন। যুগ যুগ ধরে এটাই সাহিত্যে চলে আসছে। এভাবে কালজয়ী, রসোত্তীর্ণ গল্পও আমরা অনেক পেয়েছি। ভবিষ্যতেও পাব।
জীবনস্মৃতির এই গল্পগুলো ‘সম্পর্ক’ শিরোনামে একটি গল্পসংকলনে পত্রস্থ করে স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ‘অনুপ্রাণন প্রকাশন’ ঢাকা প্রকাশ করে আমাকে চিরঋণী করেছেন। আশা করি গল্পগুলো পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেবে।
‘অনুপ্রাণন’কে জানাই অন্তঃস্থল থেকে অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
প্রবীর বিকাশ সরকার, টোকিও.জাপান, ৭, অক্টোবর, ২০১৭
জীবনস্মৃতির গল্প সম্পর্ক
জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৭৮, ভুরুলিয়া, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। একাডেমিক লেখাপড়াÑ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশাÑ শিক্ষকতা। এছাড়াও তার আরো ৭টি গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গ
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.