Additional information
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.18
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
সম্পাদকীয়
শিল্প-চেতনার ঐক্য
দেশে-বিদেশে সাধারণভাবে এটাই ধরে নেয়া হয় যে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সাধারণ মানুষদের তুলনায় সমাজ সম্পর্কে অধিকতর সচেতন, সক্রিয় এবং অগ্রসর ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এই গোষ্ঠীর সকলেই সমমনা এবং তারা একক কোন সংগঠনে মিলিত অবস্থায় রয়েছেন। এর কারণসমুহ সময়ের সাথে সম্পর্কিত সমাজের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির বাস্তব ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যেতে পারে।
ভাষা, শব্দ, কণ্ঠ, বাদ্যযন্ত্র, রঙ, তুলি অথবা যে কোন উপকরণ ব্যবহার করে সুর ও সুন্দরের চর্চা, অভিব্যক্তি ও নির্মান যা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে, হৃদয়ে আবেগ-অনুভূতি আন্দোলিত করে, মন মুগ্ধ করে অথবা মেধা ও মননে গভীর ছাপ ফেলে যায়- কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সেই কাজেই নিজের প্রতিভা বিকাশের সাধনায় নিয়োজিত থেকে সমাজে সুর ও সুন্দরের সৃষ্টি করে যেতে থাকেন। সুতরাং তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থান কুৎসিত, অন্যায়, অন্যায্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে এবং এটাই একান্তভাবে প্রত্যাশিত। সেখানে বিভেদের কী কোন অবকাশ থাকে? সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করতে চাইলে একজন শিল্পীকে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হবে এবং অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কিন্তু, বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাই? শুদ্ধ শিল্পসিদ্ধি এবং বাস্তবজীবন বীক্ষণ বোধ ব্যক্তি ও ক্ষেত্র বিশেষে যেন সম্পর্কবিহীন দুটো সেতুবিহীন রাজ্যের মতো বিভক্ত রয়ে যায়। কিন্তু, এটা কেন?
আমাদের নন্দনবোধের সাগরে প্রকৃতি যেমন একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে, ঠিক তেমনই জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ চেতনা কী বাস্তব পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? এই দুটি বিষয়কে কল্পনা বা বাস্তবে কী কোন প্রভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায়? অসীমের অন্বেষণ ও স্বপ্নচারিতা একজন শিল্পীর থাকতে পারে। সৌন্দর্যের সন্ধানে অসীম ও অনন্তের দিকে যাত্রা করাও দোষের নয়। পরম সত্যের সৃষ্টির রহস্যকে ঘিরে অনুসন্ধান অনুসন্ধিৎসা আলো-অন্ধকারের উজ্জীবনে না হয় ক্লান্তিতে হয়ত হাবুডুবু খাবে। কখনো কখনো অন্ধকারের স্তব্ধতা নৈঃশব্দের দ্যোতকরূপে চেতনায় সংগুপ্ত থাকবে কিন্তু চিন্তায় সংকীর্ণতা, স্বার্থবাদী ও ক্ষমতাশালী উপনিবাশবাদী শক্তি পরিচালিত ভেদ ভাবনা অথবা মৌলবাদ কখনো মানবমুক্তির স্বপ্নের উজ্জ্বল আলোকে স্পর্শ করতে সাহায্য করতে পারবে না।
কালোত্তীর্ণ শিল্প কী জীবন বিচ্ছিন্ন ছিল? মানুষের দেহ ও তার অবয়বকে, তার যাপিত জীবনের সংগ্রাম অথবা উৎসবের বাইরে মানুষকে ছুঁড়ে দিয়ে মৌলবাদী কোন বিশ্বাসে শৃঙ্খলিত করার কোন অপচেষ্টায় সেসব শিল্প কর্ম কী লিপ্ত ছিল? এমন কোন অভিযোগ অথবা এমন কোন বিশেষণে সেসব শিল্প কর্মকে কী বিশেষায়িত করা সম্ভব? মানবসভ্যতার ইতিহাসে কালোত্তীর্ণ শিল্পের আধারে আত্মার মুক্তি কখনোই অধিক যথার্থ প্রশ্ন ছিল না- যতনা ছিল প্রেম, মানবতা ও মানব মুক্তির বিষয়াবলী। আর এ-কারণেই বুঝে নেয়া দরকার যে ক্ষমতার বর্বরতা ও নৃশংসতার সঙ্গী-সমর্থক হয়ে কখনোই প্রেম, মানবতা ও সুন্দরের পূজা সার্থক সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। কেননা যখন ঘৃণা অথবা প্রেম থেকে শিল্পকে যে কোন একটাকে বেঁছে নেয়ার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় তখন মানবতাই শিল্পের ধর্ম হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কেননা- প্রেমই সুন্দর এবং প্রেমই মানবতার বৈশিষ্ট।
যদিও প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সংবেদনশীলতা বিরাজমান কিন্তু এর মাত্রা ও স্বাতন্ত্র্য সবার অস্তিত্বে সমভাবে লালিত হয় না। যারা একটু অধিক মাত্রায় সংবেদনশীল তাদের ইন্দ্রিয় সদা জাগ্রত থাকে, তাঁরা প্রকৃতি থেকে সৃষ্টির চিরন্তনতার নির্যাস পায়, অসীমের অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্বের মহিমা হৃদয়াঙ্গম করতে পারে। শিল্পী সমাজের সদস্যগণ জীবন প্রবাহের সব উপকরণের মধ্যে সত্য, সুন্দর, সততা ও সরলতাকে অবিচ্ছেদ্যতার সাথে তাঁর অস্তিত্ব দিয়ে আকাঙ্খা করেন। মানুষ ও মানবজাতির কল্যাণ চিন্তায় হন সবচেয়ে অগ্রগামী এবং এ-কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈষয়িক জীবনে বঞ্চিত রয়ে যান। বৈষয়িকভাবে তাঁর বঞ্চিত হওয়া অবাঞ্ছিত নয়, কারণ লেখক ভোগবাদের উপাসক নন, তিনি উপাসক প্রেম ও সত্যের- যে প্রেম, যে সহমর্মিতা, যে ভালোবাসা, মানবজাতির চিন্তা-চেতনা ও জীবন যাপনের সেই সত্য ও সুন্দরতা- যে সত্য থেকে, যে সৌন্দর্য থেকে জীবন সত্য- সদা প্রসারিত ও স্পন্দিত।
জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি যাই থাকুক না কেন, ন্যূনতম ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দাবি মিটিয়ে শিল্পী তাঁর মনে কল্পনার একটি সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করেন, যে জগতে অপ্রাপ্তির ইতিহাসও প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। কল্পনাকে সত্য বলে উপলব্ধি করে লেখক বিশ্বের স্বর্ণযুগ কল্পনা করেন। যদিও স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে অন্তহীন শূন্যতা থাকে তবুও শিল্পী যেমন নিজে স্বপ্ন দেখেন তেমনই অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। এসব সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় অন্যদের মনোজগৎও স্বাপ্নিক ও সুন্দর হয়ে ওঠে। অনেকের ধারণা- শিল্পী শুধু কল্পনারাজ্যে বিরাজ করেন কিন্তু হৃদয়রাজ্যেও যে তাঁর অপ্রতিহত অবস্থান সে বিষয়টি ভেবে দেখেন না। একজন শিল্পী যুক্তিকে স্বীকার করেন, গ্রহণ করেন, ব্যবহার করেন হৃদয় দিয়ে এবং সেভাবেই সৌন্দর্য ও সত্যের অভিন্নতাকে প্রত্যক্ষ করেন। শিল্পী তাঁর চারপাশের সমাজ সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্জাত অন্তরের নির্যাসটুকু শিল্পিতরূপে ছেনী-হাতুরী, রং-তুলি অথবা কলমের ডগা থেকে শূন্যতার সময়পটে চিহ্নিত করেন। নৃশংসতা, বর্বরতা, দমন-নিপীড়নের সাথে যেমন সত্য ও সুন্দরের ঐক্য হতে পারে না তেমনই একজন শিল্পী সমকালীন সমাজের শক্তির বিভাজনে অবশ্যই নির্যাতিতের পক্ষেই তার অবিচ্ছেদ্য অবস্থান নিশ্চিত করেন। এটাই শিল্পী সমাজের ঐক্যের মূল সূত্র। অনুপ্রাণন, শিল্প-চেতনার ঐক্যের এই মূল সূত্রের দিকেই সবাইকে ধাবিত করার প্রচেষ্টা করে যেতে চায়।
সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা- সম্পাদকীয়
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ২০১২। এ-পর্যন্ত ৩২টি সংখ্যা প্রকাশ করে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ টি বছর অতিক্রম করেছে। এ দশটি বছর অনুপ্রাণন’কে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আজ একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করার মুহূর্তে পেছনের দশটি বছরের দিকে ফিরে স্মৃতিতে অনেক কিছুই ভেসে আসে। লেখক, পাঠক এবং সম্পাদনা পরিষদের সাথে ভাগ করে নেয়ার মতো অনেক কথাই হয়তো বলার থাকে, বলার ছিল। কেননা ১০ বছর তো কম সময় নয়। তবে, শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা অথবা লিটল ম্যাগ প্রকাশের ইতিহাসে প্রায় একই ধরনের ঘটনা হয়তো হর-হামেশাই ঘটে থাকে।
টেকসই সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণে পেশাদারিত্বের অভাব আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এখনো সেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অহমবোধ প্রতিটি সংগঠনের ভিত কুরে কুরে খাচ্ছে। বাইরের থেকে যেটা দেখা যায় সেটা ঠিক ভেতরের চিত্র না। আর তাছাড়া অর্থনীতির বিষয়টা তো আছেই। আর সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করার ঘাটতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জগতে সাধারণভাবেই অর্থের সংকট রয়েছে। সাধারণভাবেই বলা যায় যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির গুরুত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো যথার্থভাবে বুঝতে ব্যর্থ। ভাবা হচ্ছে ভৌত কাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নতির চাকা ঘুরলে দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু আমরা জানি উন্নত সভ্যতা মানেই হচ্ছে উন্নত শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
তাই, অনুপ্রাণন যেসব সাংগঠনিক সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে আছে সেসবের সাথে অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য বা ব্যতিক্রম হয়তো নির্মাণ করা যায়নি। কেননা আমরা শেষ পর্যন্ত, এদেশের প্রকৃতি ও মনুষ্যসমাজেরই অঙ্গ। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি- এসবের সংকট ও সম্ভাবনা থেকে অনুপ্রাণন বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ তো নয়।
এটা ঠিক অনুপ্রাণন পত্রিকাটিকে ঘিরে এই দশ বছরে লেখক-পাঠক ও সুভানুধ্যায়ীদের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এই বৃত্ত কোনো বিশেষ সীমানা রেখা দিয়ে ঘেরা কোনো বৃত্ত না। এই বৃত্ত শিল্প-সাহিত্যের মুক্ত চর্চার মতোই উন্মুক্ত। অনুপ্রাণন মুক্ত চিন্তার চর্চাকেই সবসময় সমর্থন করেছে, অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছে। আর অনুপ্রাণন চেষ্টা করেছে এদেশের তরুণরা যেন বেশী বেশী করে বই পড়া আর শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সারাদেশ জুড়ে অনুপ্রাণনকে ঘিরে আছে একদল তরুণ-তরুণী, যারা নিয়মিত শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারাই অনুপ্রাণনের প্রাণশক্তি। যাদের সাথে অনুপ্রাণনের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক সৌহার্দের। একে আরেকের পরিপূরক।
দশ বছর নিয়মিত বিভাগ নিয়ে ছাপার সংস্করণ আকারে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশ করার পথে লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে ক্রমেই দুটি দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, অনুপ্রাণনের একটি অন্তর্জাল সংস্করণ প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের মুদ্রিত সংস্করণে সাহিত্য ও শিল্পের বিশেষ ধারা, ধরন অথবা বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা।
ইতোমধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুপ্রাণনের পক্ষ থেকে, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্জালভিত্তিক এই সংখ্যাটিতে থাকছে ২০ টি বিভাগ। যথাক্রমে- শ্রদ্ধাস্মরণ, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রবন্ধ, গুচ্ছ কবিতা, যুগল কবিতা, একক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, বড়ো গল্প, ছোট গল্প, অণুগল্প, অনুবাদ গল্প, মুক্তগদ্য, ভ্রমণকাহিনী, বই আলোচনা, ম্যাগ আলোচনা, পাঠ প্রতিক্রিয়া, চলচ্চিত্রকথা, ধারাবাহিক উপন্যাস, নাট্যকথা এবং শিল্প-সাহিত্য সংবাদ।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ইতিমধ্যে অনিয়মিতভাবে ৬ টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে, (১) তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- প্রিয় উপন্যাস সংখ্যা; (২) অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা- গল্প সংখ্যা; (৩) অষ্টম বর্ষ তৃতীয় সংখা- অণুগল্প সংখ্যা; (৪) অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা; (৫) নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা- কবি ও কবিতা সংখ্যা; এবং (৬) দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- বাংলাদেশের ১৫টি সেরা গল্প- পাঠ ও আলোচনা সংখ্যা।
একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যার মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, সকল মুদ্রিত সংস্করণে নিয়মিতভাবেই শুধুমাত্র দেশের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আরো নিবিড়ভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষ ধরন, বিশেষ বিভাগ, বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশ করার সূচনা করতে চায়।
লেখক, পাঠক এবং অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদের সেই চাওয়া থেকেই ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি নির্বাচিত কবি ও কবিতা সংখ্যা- প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ২৭ জন নির্বাচিত কবির জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং আলোচনা প্রকাশিত হয়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রবীণ ও তরুণ কবিদের নিয়ে এই ধরনের লেখা ও আলোচনা নিয়ে আরো কয়েকটি পর্ব প্রকাশিত হবে বলে আমরা আশা করি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের জীবনী ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিকের কয়েকটি পর্বের এই আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে আশা করি আমাদের দেশের তরুণ সমাজ বাংলাদেশের কবিদের কবিতার সাথে সুপরিচিত হবেন এবং আমাদের দেশের সম্মানিত এই কবিদের কবিতা নিয়ে আলাপ, আলোচনা এবং আড্ডার অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার বৃত্তটিকে প্রসারিত করতে পারবেন।
অনুপ্রাণন ১১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা
অনুপ্রাণনের চড়াই উৎরাই-
তরুণ লেখকদের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার একটি মঞ্চ বা জমিন নির্মাণ করার কাজের অঙ্গীকার নিয়েই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, যাত্রার সূচনা করেছিল। আজ দশ বছর পরে এসে যদি এই প্রশ্ন নিয়ে ফিরে তাকাই যে, এই অঙ্গীকার পূরণে অনুপ্রাণন কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে? অথবা, যদি প্রশ্ন রাখা যায় যে নবীন ও তরুণদের শিল্প-সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণনের মঞ্চ বা জমিনটাই বা কতটুকু প্রসারিত? প্রশ্নের জবাবে অনুপ্রাণনের সফলতা ও ব্যর্থতার একটা প্রতিবেদন হয়তো দেয়া যাবে কিন্তু সে চিত্রটিকে আমাদের সমাজের সামগ্রিক প্রেক্ষিত ও সেটার সাথে সম্পর্কিত মানবিক বোধের ধারায় শিল্প-সাহিত্যের চর্চার বাস্তব পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।
ব্যক্তিক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠে সংগঠন এবং সুগঠিত সাংগঠনিক চেষ্টার মধ্য দিয়ে বস্তুগত শর্ত ও পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। যে শর্ত ও পরিবেশের উপর ভিত্তি করে ভৌত উন্নয়নের পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর সৃজনশীল মন, মনন, উদ্ভাবন-মনস্কতা, নান্দনিক ও মানবিক বোধ জাগ্রত হতে পারে এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যেতে পারে। তাই, এই লক্ষ্য অর্জনের পথে যৎসামান্য অবদান হিসেবে অনুপ্রাণনের উদ্যোগে পরিচালিত সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্য চর্চার কাজে আমাদের ব্যক্তিক ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা কতটুকু কার্যকর ছিল সেই মূল্যায়নের ভার অনুপ্রাণনের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের হাতে। এই বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার দ্বার সবসময় উন্মুক্ত থেকেছে।
বিগত প্রায় দশ বছরের ইতিহাসে অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদ নানা ভাঙ্গা গড়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, যার ফলে প্রচেষ্টার প্রত্যাশিত গমনপথ ও গতিতে পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ অনুপ্রাণনের চলার পথ মসৃণ ছিল না। চড়াই, উৎরাই, অথবা কখনো বন্ধুর পথ অতিক্রম করেই অনুপ্রাণনকে অগ্রসর হতে হয়েছে।
ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এ-৪ সাইজের ১৬০টি পৃষ্ঠা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ছাপার পূর্ববর্তী কাজ, কাগজ ও প্রেসের খরচ প্রতিটির বিনিময় মূল্য ৳ ১৫০/- দিয়ে হিসাব করলে পুরোটা খরচ উঠে আসে না। কর্পোরেট হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকার জন্য অনুপ্রাণন, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও তা প্রকাশ করে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় নি। প্রথম থেকেই অনুপ্রাণনের সম্পাদকেরা কোন সম্মানী ছাড়াই একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। লেখকেরাও কোন সম্মানী ছাড়াই লেখা দিচ্ছেন। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনুপ্রাণনের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি করার প্রস্তাব জোরালো যুক্তি নিয়ে সামনে চলে আসছে। কিন্তু, অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক পত্রিকার বিনিময় মূল্য বাড়ালে পাঠকের উপর যে বাড়তি চাপ পরবে এই বিষয়েও অনুপ্রাণন সম্পাদনা পরিষদ সচেতন রয়েছে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ১০ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন–নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
আমরা এখন একটি বৈশ্বিক মহামারি বা অতিমারি কাল অতিক্রম করছি। নভেল করোনা ভাইরাস ২০১৯ যা সংক্ষেপে ‘এনকোভ-১৯’ নামে পরিচিত যা থেকে সংক্রমিত রোগটির নাম বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে কোভিড-১৯। এনকোভ-১৯ যাকে ব্যাবহারিক সংক্ষেপনে বলা হচ্ছে কেবল করোনা ভাইরাস, অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও প্রাণসংহারী। এই ভাইরাসের সংক্রমণ এর সুত্রপাত হয় এ’বছরে জানুয়ারি’র প্রথমভাগে, চীন এর উহান শহর থেকে। তারপর বিশ্বায়নের অলি-গলি দিয়ে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের প্রায় ২৫০ টি দেশে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় ৮ মার্চ, ২০২০। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার এর অধিক জনের। ২৬ মার্চ, ২০২০ থেকে বাংলাদেশে প্রায় দুই মাস জরুরি বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য, ঔষধ প্রস্তুতকারি ও বিপণন প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালগুলো বাদ দিয়ে সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, দোকান-পাট, শপিং মল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সকল প্রকারের গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। দুই মাস বন্ধের পর স্বাস্থ্যবিধি পালন করা সাপেক্ষে ক্রমে, সরকারি, বেসরকারি অফিস, দোকানপাট, শপিং মল এবং গণপরিবহন খোলা হয়। এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে এবং জুলাই মাস পর্যন্ত আদালতসমুহ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে চালু থেকেছে।
সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আজ পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি এবং মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পৌনে সাত লক্ষ। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ খুবই সীমিত আকারে নানা বাধা নিষেধ নিয়ে চালু আছে। বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারি এবং বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ভাইরাসের সংক্রমণের হাত ত্থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য টিকা বা কোন প্রতিষেধক উদ্ভাবন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বে সংক্রমণ সীমিত করার জন্য সকলকেই প্রায় একই ধরনের এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন কতগুলো জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে।
নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পূর্বে বিশ্বের ইতিহাসে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক মহামারির ঘটনা ঘটেছে। যেসব মহামারিতে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তখনকার সৃষ্ট বিভিন্ন শিল্প, সাহিত্যে ও সঙ্গীতে ঘটে যাওয়া অতীতের অতিমারিসমূহের চিত্র ও বিবরণ পাওয়া যায়। শিল্প, সাহিত্য এবং সঙ্গীতে সর্বদাই সমাজবাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। একই সময়ে সৃজনশীল শিল্প, সাহিত্য এবং সংগীত নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা, দর্শন, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সৃজনশীল ও নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়ে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। শিল্প, সাহিত্য এবং সংগীত ইতিহাসেরই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ঘটনাবলি তাৎক্ষণিকভাবে রচিত শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতে আধৃত হতে দেখা যায়। যার মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্য এবং তৎকালীন সমাজের চিত্র বিম্বিত হতে পারে।
বিগত ১৫০০ বছরে বহুবার ‘বিউবোনিক’ প্লেগের সংক্রমণ ঘটেছে। বিউবোনিক প্লেগ নামের রোগটি ‘ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস’ নামে এক প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়ার কারণে ঘটেছে। ষষ্ঠ, চতুর্দশ, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে বিউবোনিক প্লেগের বৈশ্বিক মহামারি বার বার ফিরে ফিরে আসে এবং বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এই প্লেগের কারণে মারা যায়। প্রতিবারই সংক্রমণ কমে আসে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এসব মহামারির সমাপ্তি ঘটেছিল। একটি অনুমান যে, বিবর্তনের ফলে ‘ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস’ জীবাণুটি দুর্বল হয়ে পড়ে। অথবা সংক্রমিত মানুষদের গ্রামের পর গ্রাম জালিয়ে দেয়ার ফলে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ে নতুন করে আর মহামারি আকার ধারণ করতে পারে নি। ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস নামের ব্যক্টেরিয়াটির অস্তিত্ব প্রাকৃতিকভাবে এখনও রয়েছে প্রেইরি অঞ্চলের এক প্রজাতির কুকুরের লালায়। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম সংক্রমণের সময় এই ব্যক্টেরিয়াটি এক বিশেষ প্রজাতির র্যাট-ফ্লি বা ইঁদুরের মাছিতে জন্ম নিয়েছিল।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পৃথিবীর বিশ্বমহামারিমূহের সমাপ্তি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে হয়েছে। কিন্তু, ইতিহাসে শুধু একটি ব্যতিক্রমই পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে ‘ভ্যারিওলা মেজর’ নামের একটি ভাইরাসের কারণে ছড়িয়ে পড়া গুটি বসন্তের বৈশ্বিক মহামারির ক্ষেত্রে। আর সেটার সমাপ্তি সম্ভব হয়েছে একটি অব্যর্থ টিকা আবিষ্কার এবং সেই টিকা বিশ্বের দেশে দেশে প্রায় সকল মানুষকে প্রয়োগ করার মাধ্যমে। প্রসঙ্গতঃ এই টিকা নিলে একজন মানুষ তার সারাজীবনের জন্য গুটিবসন্তের সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পৃথিবীতে গুটিবসন্ত ভাইরাসটির সংক্রমণের ইতিহাস ছিল প্রায় ৩০০০ বছরের।
১৯১৮ সনের ইনফ্লুয়েঞ্জার বৈশ্বিক মহামারিটিই উদাহরণ হিসেবে আজকের দিনের মহামারির ধ্বংস এবং স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন অথবা সামাজিক দূরত্বের মূল্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে। ১৯১৮ সনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় পৃথিবীতে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এই ইনফ্লুয়েঞ্জাটি সারা পৃথিবীতে ব্যাপক মৃত্যুর স্বাক্ষর রাখার পর ক্রমেই বিলীন হয়ে বিবর্তিত মৌসুমী ফ্লু’র রূপ নেয়, যে ফ্লু দ্বারা বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ প্রতিবছর আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর ঘটনা অনেক কমে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির প্রায় সাথে সাথেই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জার এই বৈশ্বিক মহামারির সমাপ্তি ঘটে। এর পর কতগুলো ফ্লু-এর মহামারি দেখা দিয়েছিল কিন্তু এখনকার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মতো সেগুলোর সংক্রমণ ও মৃত্যুর রূপ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে নি।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং একাবিংশ শতাব্দীতর প্রথম দিকে এবোলা এবং এইচআইভি ভাইরাস এর মহামারি ঘটতে দেখা যায়। যে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি এখনো রয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত এবোলা ভাইরাস এবং এইচআইভি প্রতিরোধের কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র আফ্রিকার কোনো কোনো অঞ্চলে এই ভাইরাস দুইটির সংক্রমণ সীমাবদ্ধ থাকাতে, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা’ এবোলা এবং এইচআইভি মহামারির সমাপ্তি ঘোষণা করে এটাকে জরুরি স্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্বেগের পর্যায়ে নামিয়ে আনে।
যদিও ৩ কোটি বছর পূর্বের কোনো কোনো ফসিল থেকে ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে তবে বিশেষতঃ প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্ব থেকেই বিভিন্ন সময়ে ম্যালেরিয়া মানবসমাজের অস্তিত্বের প্রতি বড় আকারের হুমকি হিসাবে দেখা দেয়। আদি মেসোপটেমিয়া অথবা রোমান সাম্রাজ্যে এবং মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায়। কিন্তু ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটবাহী কিউলেক্স মশার ব্যাপক নিধন এবং ১৮২০ শতাব্দীতে আদি সিনকোনা গাছের ছাল থেকে কুইনাইন আলাদা করা এবং এই ঔষধ অর্থাৎ কুইনাইন এবং পরবর্তীকালে কুইনাইনের উন্নত সংস্করণের ব্যাপক ব্যবহারের পর থেকে ম্যালেরায়ার প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
প্রাচীন ইতিহাসে, হিপক্রিটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭৭) এবং গেলেন (১২৯-২১৬ খ্রিস্টাব্দ) এর বর্ণনায় কলেরা’র মতো একটি রোগ এবং চিকিৎসার বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু, আধুনিক কালের ইতিহাসে কলেরা মহামারি ১৮১৭ সনেই প্রথমে গঙ্গা অববাহিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৮৮৪ সনে কলেরার জীবাণু চিহ্নিত করা হয় এবং কলেরার প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু হয়। ১৮৮৫ সনেই কলেরার টিকার আবিষ্কার হয়, যে টিকা সেবন করলে মানুষ ছয় মাসের জন্য কলেরার অনাক্রমণ্যতা প্রাপ্ত হতে পারে। বিশ্বে কলেরার ৭টি মহামারির ইতিহাস রয়েছে। ৭ম ম্যালেরিয়া মহামারি দেখা যায় ১৯৬১ সনে এবং এই মহামারি ইন্দোনেশিয়ায় থেকে উৎপত্তি হয়ে এশিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯১ সনে এই মহামারি দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছায় এবং সেখানে প্রায় ৪০০০ মানুষ মারা যায়। কলেরার সাতটি পর্বের সংক্রমণে সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটেছিল।
কলেরা মূলত পানিবাহিত রোগ। দূষিত জল পান করার মাধ্যমে এর সংক্রমণ ঘটে তাই শীত প্রধান দেশগুলোর তুলনায় পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলগুলোতেই কলেরার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব অধিক সংখ্যায় ঘটতে দেখা গেছে। ভিবরিও কলেরি নামে একটি জীবানুর কারণে কলেরা হয়। রোগীর মল পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব। যেহেতু কলেরার সংক্রমণ হলে রোগীর প্রচণ্ড উদরাময় হয় তাই দেখা যায় যে প্রথম ধাপে সংক্রমিত হওয়ার সময় খুব দ্রুত শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে পারলেই প্রায় ৯৯% কলেরা রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। সাথে এন্টিবায়োটিক এবং জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে কলেরা রোগ থেকে প্রায় ১০০% রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
বিদেশী চিত্রকর্ম ও সাহিত্যে অতীতের অতিমারিসমূহের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যদিও ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনের শাসক স্বয়ং জাস্টিনিয়ান’এর দুই একটি ফ্রেস্কো দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর প্লেগের ফ্রেস্কো অথবা তৈলচিত্র চতুর্দশ শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগের দ্বিতীয় অতিমারির সময়ে ইউরোপিয়ান কয়েকজন শিল্পী তখনকার সময়ের চিত্র তৈরি’র সময় তাদের কর্মে তুলে আনেন। বোকাচ্চিও এর ডেকামেরন (চতুর্দশ শতাব্দী), ফ্রান্সিস্কো’র ‘মাতৃস্নেহের রূপক কাহিনি’ (১৭৪৩-৪৪) অথবা মানজোনি’র ‘দি বেট্রোথেড (উন-বিংশ শতাব্দীর) তেল চিত্রগুলো এসব শিল্পকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
বিদেশী সাহিত্যে প্লেগ অথবা মহামারি এসেছে প্রত্যক্ষভাবেই। বাংলা সাহিত্যে কলেরা, ম্যালেরিয়া বা গুটিবসন্ত অর্থাৎ জনমানসে ওলাওঠা বলে পরিচিত রোগের অভিঘাত পড়েছিল ব্যাপক আকারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো বড় উপন্যাস বা মহাকাব্য কখনো লেখা হয়নি। যেমনটি আমরা আমরা পাই আমেরিকায় রেড ডেথ মহামারিতে একটি জনপদ উজাড় হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-আখ্যান নিয়ে ১৯১২ সালে জ্যাক লন্ডন [১৮৭৬-১৯১৬] রচিত ‘দ্য স্কার্লেট প্লেগ’ উপন্যাসে। যেমন করে কালজয়ী হয়েছে ১৯৪৫ সালে আলবেয়ার ক্যাম্যু [১৯১৩-১৯৬০] রচিত ‘দ্য প্লেগ’। মহামারিকালে কোয়ারেন্টিনে অবরুদ্ধ ফরাসি-আলজেরিয় ওরান শহরের চার দেয়ালের ভেতর ঘটা আখ্যানভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। আলজেরিয়ার ওরান শহরে ইঁদুরের উপদ্রব হতে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ মহামারিতে মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে সূচিত ‘দ্য প্লেগ’ আজও বিশ^সাহিত্যে কিংবদন্তি হয়ে আছে। অপরদিকে, ১৯৬৭ সালে নোবেলজয়ী স্পানিশ সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসেও কলেরা মহামারির চিত্র বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে নোবলজয়ী পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগো (১৯২২-২০১০) রচিত ‘ব্লাইন্ডনেস ’ উপন্যাসটিও মহামারী কালের চরিত্র বোঝার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বসাহিত্যে সাড়া জাগানো কল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টেইন’ এর লেখিকা মেমরি শেলি ‘দ্য লাস্টম্যান’ উপন্যাস রচনা করে মহামারি নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছেন।
আমাদের দেশের ইতিহাসেও মহামারি নতুন কিছু নয়। তবে অতীতে তার পরিচয় ছিল ‘মড়ক’ হিসেবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক বাঙালির নিত্য সহচর। আর এগুলোর অনিবার্য সঙ্গী হয়ে এসেছে দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর, মড়ক-মহামারি। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের মানুষ আবহমান কাল ধরে এইসব মড়ক-মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর ইত্যাদির সাথে লড়াই-সংগ্রাম করে টিকে আছে। তাই স্বভাবতই বাংলা সাহিত্যেও এসবের প্রভাব ও প্রতিফলন ঘটেছে সেই আদিকাল থেকে।
প্রচলিত মৌখিক সাহিত্য তথা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পাশাপাশি লিখিত সাহিত্যের সকল শাখায় নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে বর্ণিত হয়েছে মড়ক-মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির কথা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগে এবং আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে অতীতে ম্যালেরি গ্রামকে নিয়ে অনেক অতিলৌকিক বা ভৌতিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে লোক মুখেমুখে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে সরাসরি মড়ক-মহামারির কথা উল্লেখ নেই। তবে বৌদ্ধ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সাধন সঙ্গীত হিসেবে রচিত চর্যাপদে রূপকের আশ্রয়ে সমকালীন দরিদ্র বাঙালির নিত্যদিনের অভাব, ক্ষুধা, দুঃখ-দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি-বেদনা-পীড়িত জীবনের করুণ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারির নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীকে কল্পনা করা হতো এবং এসব থেকে বাঁচার জন্য পূজা-অর্চনাসহ নানাভাবে তাদের পরিতুষ্টি বিধানের চেষ্টা করতো অজ্ঞ-অসহায় সাধারণ মানুষ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের আগে এই সব লৌকিক দেব-দেবীর কাল্টের উদ্ভবের সুবাদে তৈরি হয় দেবদেবী মহিমা-কীর্তনকারী কাহিনিকাব্য, পাঁচালি, ব্রতোপাখ্যান। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের লোকজ বাংলা কাব্যে বিকাশ লাভ করে মঙ্গলকাব্য নামে একটি বিশিষ্ট সাহিত্য ধারা। মঙ্গলকাব্যে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর মাহাত্ম্যকথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, বসন্তের দেবী শীতলাকে নিয়ে শীতলামঙ্গল কাব্য এবং কলেরা বা ওলাউঠার নিয়ন্ত্রণকারী দেবী হিসেবে দেবী ওলাইচণ্ডীকে নিয়ে উলামঙ্গল বা চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। এসব কাব্যে শীতলা দেবী বা দেবী ওলাইচণ্ডীর উপাসনার মধ্যদিয়ে সে সময়ে বসন্ত, কলেরার মড়ক-প্রতিরোধ কামনারই কথা বলা হয়েছে।
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে কাহিনির মূল উপজীব্য হিসেবে না হলেও নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে মড়ক-মহামাররি কথা বর্ণিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অগ্রপথিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সেলিনা হোসেনসহ শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের রচনায় বিশেষ করে কথা সাহিত্যে মড়ক-মহামারির বর্ণনা পাই নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে। বঙ্কিম চন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে ১৭৭৬-এর মন্বন্তর এবং মন্বন্তরের সঙ্গী হিসেবেই মারি বা মড়কের বিবরণ পাওয়া যায়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর কালে সমগ্র বাংলায় কলেরা-বসন্ত মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গোরা ও চতুরঙ্গ উপন্যাসে এবং বিভিন্ন ছোটগল্পে কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও মহামারির উল্লেখ করা হয়েছে। মহামারির ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো। মহামারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায়। রবীন্দ্রনাথ ‘ওলাওঠার বিস্তার’ নামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধও লিখেছিলেন এবং তার ‘স্বদেশী সমাজ’ পর্বের বিভিন্ন প্রবন্ধে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি চেয়ে আলোচনা করেছেন নানা প্রসঙ্গ ক্রমে।
অপরাজেয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসে মড়ক-মহামারির কথা বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই শ্রীকান্ত উপন্যাসের কথা বলা যেতে পারে। পুরো উপন্যাস জুড়েই মহামারি, মারি বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে দুর্বিপাকের কথা ছড়িয়ে আছে। শ্রীকান্ত উপন্যাসে আমরা চার চারটি মারণ-ব্যাধির উল্লেখ পাইÑ কলেরা, প্লেগ, বসন্ত ও ম্যালেরিয়া। তাঁর, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘পল্লীসমাজ’, উপন্যাসেও মহামারির প্রসঙ্গ এসেছে। শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন গল্পেও মড়ক-মহামারি প্রসঙ্গ এসেছে।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে মহামারির বর্ণনা এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ এবং ‘গণদেবতা’ উপন্যসে কলেরা মহামারির প্রসঙ্গ পাই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের গাওদিয়া গ্রামে প্রায়ই মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ত কলেরা, টাইফয়েড, কালাজ্বর ও বসন্তের মতো রোগগুলো। বেগম রোকেয়ার রচনাতেও প্লেগ ও মহামারির কথা পাই। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে বেগম রোকেয়া যে ইউটোপিয়ার দেশ নির্মাণ করেছেন তাতে মহামারির আসল কারণ বর্ণিত হয়েছে।
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে কলেরার মড়ক এবং এ নিয়ে গ্রামবাংলার অজ্ঞ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে আবহমান কাল ধরে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের ইতিকথা বর্ণিত হয়েছে। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে বসন্ত রোগের প্রকোপের সময় মানুষের এ পলাতক মনোভাব ফুটে উঠেছে, ‘কবর আর কবর’ উচ্চারণে। আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে কলেরা থেকে পলায়নপর মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, “কলেরার সময় গাঁ ছেড়ে পালাচ্ছে ডরে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে পাশের বাড়ীর মানুষ উধাও”। হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে মেতর বউ-এর জবানীতে লিখেছেন, ‘এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তারবদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কত! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কত যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই।’ সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে ‘বুধা’ তার পরিবারের চারজনকে হারিয়েছে। বুধার মানসিক বিপর্যস্ততার ইঙ্গিত লেখিকার কলমে ধরা দিয়েছে, ‘চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বোনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকতে পারে?’ হয়তো পারে না। তাই পৃথিবীব্যাপী আজ কান্নার রোল। কলেরা মহামারি কীভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যু উপহার দিয়েছে সেলিনা হোসেন তারও উল্লেখ করেছেন। ‘সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লোক।’
বাংলা ছোটগল্পেও মড়ক-মহামারির প্রসঙ্গ এসছে নানা প্রেক্ষিতে। মুজতবা আলী ‘পাদটীকা’ গল্পের শুরুতেই মড়কের প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে– “গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়।”
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ‘পুষ্করা’-তেও বাংলার মন্বন্তর পরবর্তী মড়ক থেকে উদ্ধার পাবার চিত্র প্রতিফলিত। জগদীশ গুপ্ত’র ‘পয়োমুখম’ গল্পে ভূতনাথ নিজের স্ত্রীদের হত্যার পিছনে তার অর্থলিপ্সু কবিরাজ বাবার দুষ্কর্ম ধরে ফেলে শেষ পর্যন্ত। শেষতম বউ বেঁচে যায়। ভূতনাথ বলে, “এ বৌটার পরমায়ু আছে তাই কলেরায় মরল না, বাবা! পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।” মানুষের এক অন্ধকার অধ্যায় বেরিয়ে পড়ে। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পের কথক যে-পাথরে হোঁচট খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল বসন্ত রোগ থেকে বাঁচতে সেই পাথরেই মাথা নোয়ায়। সুকুমার রায়ও তাঁর ‘নানাগল্পে’-র ‘পেটুক’-এ লিখেছেন, “চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।”
বাংলা কবিতাতেও বাদ যায়নি মড়ক-মহামারি প্রসঙ্গ। উনিশ শতকের ঢাকার এক ‘বটতলার কবি’ কুশাই সরকার লোকমুখে প্রচলিত বুলিতে ওলাওঠার মহামারি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তো বহু আগেই তাঁর ‘বোধন’ কবিতায় বলে গেছেনÑ ‘মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার/ আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন/ ভাঙা নৌকার পাল/ এখানে দারুণ দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের কাল’। কবি জীবনান্দ দাশের আট বছর আগে একদিন কবিতায়, “এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!/ রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি” Ñউপমায় প্লেগের জীবাণুবাহী হিসেবে বর্র্ণিত। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসামনী’ কবিতায় পাই- ‘ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে।’
অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর থাবায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে দেশ ও বিশ্ব। এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিণতি ভাবনায় সমাজের আর দশজনের মত আমাদের শিল্পী, কবি-সাহিত্যকরাও উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত। কবি-সাহিত্যিকরা করোনাকে ঘিরে তাদের অনুভব-অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে রচনা করছেন ছড়া, কবিতা, গল্প। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এগুলো প্রকাশিতও হচ্ছে। করোনা কালে রচিত কবিতা নিয়ে ইতোমধ্যে সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। কারও কারও কবিতার আবৃত্তিও স্থান পেয়েছে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এর এই সংখ্যায় অল্পসংখ্যক করোনা কালের কবিতা ও গদ্য ছাপা হয়েছে। মনে হয়, করোনা কাল দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে আর অনুপ্রাণন এর পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে আরো অনেক করোনাকালের কবিতা, ছোট গল্প, অণুগল্প, নাটক, চিত্র-চলচ্চিত্র আলোচনা, প্রবন্ধ ও গদ্য প্রকাশিত হবে, প্রত্যাশা রাখি।
নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
সম্পাদকীয়-
শিল্পী গোষ্ঠীর সমাজ-সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন
শিল্পী ও সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধভাবে একমাত্র নান্দনিক সৃজনের ঘেরাটোপে বন্দী না থেকে সমাজে বসবাসের শর্তাবলী ও পরিবেশ একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক’কে অন্য যে কোন সচেতন নাগরিকের মতোই একান্তভাবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উৎসারিত ও গৃহীত সকল মতামত প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তাঁর কাজে প্রকাশ করতে দেখা যেতে পারে। বিশেষতঃ একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক পরিবেশ ও সমাজের ক্ষেত্রে গভীরভাবে সংবেদনশীল হওয়ার কারনে তাদের সৃজনশীল কাজে ও রচনায় সমাজের রীতি-নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাল-মন্দ এবং দোষ-গুণের প্রতিফলন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না বরঞ্চ এই থাকাটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্র মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকম সীমা বেঁধে দেয়। এসব সীমার মধ্য থেকেই শিল্প চর্চার বিভিন্ন মাধ্যম ও অবলম্বনের সাহায্য নিয়ে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের যেমন প্রচ্ছন্নভাবে নিজের মতটি প্রকাশ করার প্রচেষ্টা থাকে তেমনই আবার শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ দ্রোহী হয়ে মত প্রকাশের ফলে রাষ্ট্রের অথবা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কোপানলে পড়ে নির্যাতিত হওয়া এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে তাদের সহিংস আক্রমণের শিকার হতেও আমরা দেখেছি।
তাই, এখানে প্রশ্ন এটা নয় যে, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সৃজনশীল কাজে ও রচনায় সমাজের রীতি-নীতি, পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভাল-মন্দ এবং দোষ-গুণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে তাদের ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন থাকবে কি-না? বাস্তবে প্রশ্নটা হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে রাষ্ট্র ও জনগণকে সচেতন করা এবং সেসব সমস্যা দূর করার জন্য সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা কীভাবে নির্ধারিত হবে? বরঞ্চ, প্রশ্নটা দুটো হচ্ছে-
ক. শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ নিজেরাই কোন সামাজিক সংগঠন করবে কি-না অথবা পেশাজীবীদের অন্য কোন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হবে কি-না? এবং
খ. স্রেফ শিল্পীদের নিজস্ব অথবা অন্য কোন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে সমাজের কোন ন্যায্য দাবী অথবা সমাজের কোন বাস্তব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত রাজপথের আন্দোলনে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে নিজেরা সম্পৃক্ত হবে কি-না? এবং
গ. যদি শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ নিয়মিতভাবে কোন সামাজিক সংগঠনমূলক কার্যক্রমে সক্রিয় হয়ে যায় এবং সামাজিক ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলনে নেমে পড়ে অথবা সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে যায় তাহলে সময় ও মনোসংযোগ দ্বিধান্বিত হয়ে বাধা পড়ে শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মান ও গুণাগুণের ক্ষেত্রে শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা কোন ক্ষতি বা সমস্যার সম্মুখীন হবে কি-না?
এখানে উল্লেখ্য যে, অন্য সামাজিক সংগঠনের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা অথবা সংহতি প্রকাশ, ঘড়ে বসে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিজস্ব সংগঠন করা অথবা ফেস্টুন ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদী নানা উপায়ে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের পক্ষে সামাজিক আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক সামাজিক আন্দোলনের সাথে কীভাবে যুক্ত হবেন সেটা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এবং এটাও বাস্তব সত্য যে একজন সংবেদনশীল ও সচেতন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক ন্যায্য দাবী ও বক্তব্য নিয়ে পরিচালিত চলমান সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তায় আবদ্ধ হয়ে কোনভাবেই নিষ্ক্রিয় এবং নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না।
১৯৬৯ এর গণভ্যুত্থান অথবা ১৯৭১ এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে শিল্পী সমাজের সদস্যবৃন্দকে সংগঠিতভাবে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে-সংগ্রামে-মিছিলে যুক্ত হতে আমরা দেখেছি। ৭১’এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এমনকি প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মুক্তিযুদ্ধে সংযুক্ত হতে আমরা দেখেছি। এর পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়েছেন। এসব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র।
স্বাধীনতার পর শিল্পী ও সাহিত্যিকদের যেসব সংগঠন গঠিত হয়েছে সংগঠনভেদে সেগুলোর মূল লক্ষ্যই ছিল জোটবদ্ধভাবে শিল্প চর্চা, আলোচনা-সমালোচনা, শিল্পের প্রচার-প্রসার, পরোক্ষভাবে ব্যক্তির প্রচার ও প্রসারলাভের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা থেকে বিপণন কৌশল অবলম্বন করা পর্যন্ত। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয়, সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংবাদ-মাধ্যম, কর্পোরেট অথবা নন-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পদক-পুরস্কার অথবা আনুকূল্য লাভের জন্য এসব কোন কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগঠন ও জোটের তৎপরতার সুযোগ গ্রহণ করতেও আমরা দেখেছি। শিল্প ও সাহিত্যকেন্দ্রিক নানা তৎপরতা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও এসব সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে সৃজনশীল অথবা মননশীল শিল্পগুণের মান ও রুচির উৎকর্ষতা লাভের ক্ষেত্রে এসব সংগঠন বিশেষ কোন অবদান রাখতে বিশেষ কোন সাহায্য করেছে বলে এরকম উদাহরণ পাওয়া যায় না। দলীয় অথবা ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়গুলো সেখানে খুবই নগ্নভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে এবং যার ফলে দেশে মাঝারী মানের শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতাই হয়েছে অত্যন্ত অধিকহারে। অন্যদিকে প্রচার, প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মৌলিক, মননশীল ও উচ্চতর মানসম্পন্ন শিল্প ও সাহিত্যকর্ম পাঠকদের কাছে ব্যপকভাবে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করতে পারেনি। এবং যার ফলে সত্যিকার প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা হতাশা থেকে প্রচারবিমুখতা ও আত্মকন্দ্রিকতার ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা এবং তাঁদের সাহিত্যকর্মকে আধুনিক শিশু-কিশোর ও তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশে কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী সংগঠন কাজ করছেন। কিন্তু, রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্যকর্মের আক্ষরিক পঠন ও মুখস্থ করার উপরই এসব সংগঠনকে বেশী জোর দিতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের মাঝে যে মানবিক চেতনা ও যে দার্শনিক নির্যাস রয়েছে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সাথে অধিকহারে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণদের পরিচয় করিয়ে দেয়া খুব জরুরী। কেননা এতে করে দেশের নতুন প্রজন্মের মনের মাঝে মানবিক চেতনা ও সুন্দর রুচিবোধ স্থান করে নিতে পারে। এসব বিবেচনা করে রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য চর্চা ও গবেষণার জন্য যেসকল সংস্থা ও সংগঠন কাজ করছেন সেসকল সংগঠন দক্ষতার সাথে তাঁদের কাজের পরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে চলুক- এটাই প্রত্যাশা করি।
প্রথম থেকেই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, ব্যক্তি, দলীয়, গোষ্ঠী অথবা কর্পোরেট তৎপরতার বাইরে নিজের স্বাধীন অবস্থান রক্ষা করে দেশের নবীন ও তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী ও সাহিত্যকদের পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন শিল্প-চর্চার জন্য অনুপ্রেরনা যুগিয়ে এসেছে। সপ্তম বর্ষে পদার্পন করে ‘অনুপ্রাণন’ অবিচলভাবেই ঐ ঘোষিত পথেই তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়। অনুপ্রাণন-এর মূল পৃষ্ঠপোষক অনুপ্রাণন-এর পাঠকেরাই। তাই, বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করতে পেরে অনুপ্রাণন-এর লেখক এবং পাঠকেরা অবশ্যই বিশেষ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
রুদ্র সাহাদাৎ কবিতাপাড়ার পরিচিতস্বর, পরিচিত মুখ।নিরলস সাধনায় তার সহজ কবিমন সর্বক্ষণ যেন তাকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রতিটি মুহূর্তের দিকে। বর্ণনা করা যায় না, এমন কিছু অপার্থিব সুন্দর তাকে চঞ্চল করে রাখে জীবনের পথে পথে। বেদনা ও কষ্টের মানবিকতা তাঁর সত্তাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে পরিশুদ্ধির উত্তাপে। প্রেমপূর্ণ ও প্রকৃতিমগ্ন এই কবি অন্ধকার ও অন্ধতার সকল দুয়ার ভেঙে আলোয় ভুবন রাঙাতে বদ্ধপরিকর। তাঁর কবিতার শব্দচয়ন ও চলনের গতি সংবেদী পাঠককে সেই বার্তা দিচ্ছে বারবার। শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজের সীমাবদ্ধতা ও কলুষতা তাকে পীড়িত ও ন্যুব্জ করে। কবিতার ব্রক্ষ্মাস্ত্রে তিনি তাই প্রতিবাদী। হতাশা ও পরিব্যাপ্ত অপাপ্তির ক্ষোভ তাকে প্রকৃত সংবেদনের কাছে নতজানু করেছে,যা কখনো বা নিয়তি বা ললাটলিখনের নামান্তর। পৃথিবীর বহু যুগন্ধর কবি শিল্পীই এই নিয়তির তটে তাদের চেতনার রুধিরাক্ত অর্ঘ্য অর্পন করে গেছেন সজল নয়নে। একালের মানুষও কি তা থেকে মুক্তি পেয়েছে খুব বেশি? কবির একটি উচ্চারণ সেদিক ইঙ্গিত করছে যেন বড় মর্মান্তিকভাবে — বারবার কেন যে জিততে জিততে হেরে যাই প্রভু সব জানে, সব দেখে – চার ছক্কার চক্করে মইহীন পা…… রুদ্র সাহাদাৎ সাচ্চা প্রেমিক ও ভৈরব। কবি ও কবিতা এই কুঞ্জ ও রুদ্রের অভিঘাতেই বেঁচে থাকে নিরন্তর।
হাফিজ রশিদ খান
কবি, প্রাবন্ধিক
চেতনায় একাত্তর হৃদয়ে বাংলাদেশ - Chetonay Ekattor Hridoye Bangladesh
ভূমিকা
‘সীমান্তিনী’ আমার লেখা দীর্ঘ কবিতার মধ্যে অন্যতম। বারোটি কবিতা নিয়ে এই বইটি। কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে প্রেমের পাশাপাশি পাহাড়ি সৌন্দর্য, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারো, হাজং প্রভৃতি আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও তাদের জীবনধারা। পাহাড়ি নারীর সৌন্দর্য, বালুকণা, সমুদ্র, আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পথের দৃশ্যও এই বইতে চিত্রিত হয়েছে। প্রতিটি কবিতার পাতা রাঙানো হয়েছে ভালোবাসার রঙে।
কিসিঞ্জার ভূঁইয়া
০১ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সীমান্তিনী
রোবটদের গল্প
পূর্বপুরুষ কেউ একজন পাগল ছিল। নিলয় সবসময় সেই পাগলামিটা তার নিজের মধ্যে অনুভব করে। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে, অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা মাথায় চেপে বসে; অদ্ভুত কিছু কান্ড করেও বসে। একদিন রাতের বেলা কবরস্থানে গিয়ে একা বসে থাকে! কোরবানির ঈদে চারিদিকে যখন খুশির জোয়ার, তার কাছে সেই ঈদ হয়ে ওঠে বিষাদময়! শতবছর আগে মরে যাওয়া তার বড় দাদার ( দাদার দাদা) সাথে দেখা হয়! স্ত্রী তার সকল পাগলামি মেনে নিলেও সহকর্মীর সাথে সখ্যতা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। অভিমানে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়, সহকর্মীর সাথে প্রেমের ভাঙন ধরে। অফিসের অনিয়ম আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে চাকরিচ্যুত হতে হয়। তার নিজেকে একজন ব্যর্থ মানুষ মনে হয়! এই অবস্থায় তার কাছে এই শহর, শহরের মানুষ, অলি গলি রাজপথ সবকিছু খুব নোংরা মনে হয়। এই নষ্ট নরক ছেড়ে সে চলে যায় তার ছেলেবেলার সেই গ্রামে। কিন্তু ছেলেবেলার সেই গ্রামটি আগের মতো আর খুঁজে পায় না। পরিবর্তিত গ্রামটিকেও একসময় তার কাছে নষ্ট মনে হয়। গ্রাম ছেড়ে সে অজানার পথে বেরিয়ে পড়ে। এক বাউলের সাথে দেখা হলে সে বাউল হতে চায়। কিছুদিন পর বাউল জীবন ছেড়ে সে পথে পথে ঘুরতে থাকে। এক মুক্তিযোদ্ধার বৃদ্ধ বয়সের করুণ অবস্থা দেখে তার কষ্ট হয়। এক বিকেলে নীড়ে ফেরা পাখি দেখে সে তার পৈত্রিক ভিটায় গ্রামে ফিরে আসে। স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করে। এ-সময়ও তার দাদার দাদা তাকে দেখা দেন। বড় দাদার সাথে কথা বলার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে যায়। স্বাভাবিক জীবন যাপন সে কিভাবে করবে? পুর্বপুরুষের সেই পাগলামি যে তার অস্তিত্বে মিশে আছে!
পাগলের জবানবন্দি - Pagoler Jobanbondi
জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৭৮, ভুরুলিয়া, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। একাডেমিক লেখাপড়াÑ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশাÑ শিক্ষকতা। এছাড়াও তার আরো ৭টি গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গ
জন্ম : ০২ জানুয়ারি, ১৯৮৩-তিতাহাজরা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী। বেড়ে ওঠা পাহাড়তলী, চট্টগ্রামে। লেখাজোখার প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই।
প্রথম লেখা ছাপা হয় মাসিক রহস্যপত্রিকায়। ২০০০ সালের মাঝামাঝি লেখালেখিতে সচেতনভাবে মনোযোগী হন। তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিকসহ অজস্র পত্রপত্রিকায়। সমানতালে লিখেছেন লিটল ম্যাগাজিনেও। দীর্ঘদিন যাবত সম্পাদনা করছেন পাঠকপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রকাশ’। গল্প লিখতে এবং গল্পকার পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সিরিয়াস লেখার পাশাপাশি রম্য ধাঁচের রচনায়ও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মাসিক উন্মাদ অতঃপর দৈনিক প্রথম আলোর তুমুল জনপ্রিয় ফান ম্যাগাজিন আলপিন-এর মাধ্যমে রম্যচর্চার হাতেখড়ি। এরপর থেকে লিখেছেন দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র হিসেবে প্রকাশিত বিভিন্ন রম্য-বিদ্রƒপ সাময়িকীতে।
পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন পা-ুলিপি সম্পাদনা, লেখালেখি এবং সাংবাদিকতাকে। বর্তমানে একটি জাতীয় দৈনিকে সাব এডিটর হিসেবে কর্মরত।
প্রকাশ (নির্বাচিত গল্প বিষয়ক প্রবন্ধ)
কোভিড নাইনটিন। সময়ের সাথে জুড়ে দিয়েছে শত্রুর তকমা। এভাবেই একটা ভয়ানক শত্রুসময় পাড়ি দিচ্ছি আমরা। যাপনের ইতিহাসে এ সময় এক দুর্বিষহ শূন্যতা উপহার দিয়েছে আমাদের। শত্রুসময়ের এই শূন্যতায় মুছে গেছে আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ইতিহাস। বিবেক, মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ হারিয়েছে গড়পড়তা সব মানুষ। সেইসাথে মৃত্যুর মিছিলে প্রিয়জন হারানোর শোক মানুষকে করে দিয়েছে আদিম পাথর। সুমন শাম্স’র শত্রুসময় ও শূন্যতা তারই প্রামাণ্যদলিল।
সুমন শামস
‘সব মেঘে বৃষ্টি হয় না’ একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এটি কথাসাহিত্যিক বাসার তাসাউফের একাধারে জীবনচরিত ও নব্বইয়ের দশকের সোনালি সময়ের স্মৃতিচারণ। পরিমার্জিত ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি পুরনো সেই সব দিনের কথা ও সেই সব সময়ের মানুষের জীবন-যাপন এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন।
বাসার তাসাউফের জন্ম ও বেড়ে ওঠা অনন্তপুর নামের সবুজ বৃক্ষের ছায়া ছায়া মায়াময় নিভৃত এক গ্রামে। জন্মস্থান ও শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত সেই গ্রামের মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি, নদ-নদী তাকে লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে তার কিষান পিতা তার জীবনজুড়ে এতটাই মিশে আছেন যে, এই উপন্যাসের সব পাতা ভরেও তিনি উপস্থিত আছেন। পিতা ছিলেন তার বেঁচে থাকার, স্বপ্ন দেখার একমাত্র উপাদান। কিন্তু আকস্মিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় পিতার মৃত্যুতে তিনি ভীষণ মুষড়ে পড়েন। তাই নিজের জবানে বলা নিজের জীবনকাহিনি লেখা শুরু করেছেন পিতার মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে। এরপর মানবজীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের কথা, বিশেষ করেÑ দরিদ্র কিষান পিতার পাতায় ছাওয়া লতায় ঘেরা ছোট কুটিরে জন্ম নিয়ে তিনি যে অপূর্ণতার হাহাকারে জীবন ভর দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন তা এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন মনে হয়, যেন সেই দীর্ঘশ^াসের উষ্ণ আঁচ এসে আমাদের হৃদয়ও উত্তপ্ত করে তোলে। তার মায়ের দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার বর্ণনা হৃদয়ের গহিনে এমনভাবে আঘাত করে যে, রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। বৃষ্টির জল আর পোকামাকড় খসে পড়া ছনের ছাউনির তলে একডজন মানুষের বসবাস আর খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকার কথাগুলো এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা পাঠকের চোখে জল এনে দেয়।
বাসার তাসাউফ বইয়ের ভূমিকা অংশে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি একজন অসফল মানুষ। আমার আব্বা একজন দরিদ্র কিষান ছিলেন। ফলে অনেক নিগূঢ়তা ও নিষ্ঠুরতা অতিক্রম করে জীবন চলার পথে আমাকে চলতে হয়েছে, পার হতে হয়েছে অসর্পিল ও কণ্টকাকীর্ণ অনেক পথ। কিন্তু গন্তব্য আজো রয়ে গেছে অচিনপুরে। সব পথেরই নির্র্দিষ্ট একটা সীমানা থাকে। কিন্তু আমার জীবন চলার পথের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আমি চলেছি তো চলেছি, না পেরিয়েছি সীমানা, না পেয়েছি গন্তব্য। জীবন চলার পথ অতিক্রম করে গন্তব্য পৌঁছাতে পারলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে। অমরত্বে আমার লোভ ছিল না কোনোদিন। তাই হয়তো জীবনপথের দুর্গম সীমানা আমি আজো পার হতে পারিনি…।’
বলাবাহুল্য, একজন লেখক নিজের জীবনের গল্প নিজের জবানে বলার পর এর যে নিগূঢ় তাৎপর্য পাওয়া যায়, কাল্পনিক গল্পে তা পাওয়া যায় না। বাসার তাসাউফের এই বইয়ের গল্পে রূপকথার বয়ান নেই, আছে দরিদ্র এক কিষান পিতার ঘাম-জল সিঞ্চনের গল্প। নিতান্তই একজন ব্যর্থ মানুষের অপূর্ণতার গল্প। ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হয়েও বাঁক বদল করে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার গল্প।
যে মেঘে বৃষ্টি য় না
লেখকের কথা-
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। এর দ্বারা একটি সময়ে সংঘটিত নানান ঘটনার বিশ্লেষণ করা যায়। তাই, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও বহুমুখী দিকগুলো অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করতে সেই সময়ে প্রকাশিত পত্রিকার রিপোর্টগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
২০১৬’র নভেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক আশফাক ভাই একদিন বললেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষ ১৭ দিনে (ডিসেম্বর ০১ – ডিসেম্বর ১৭) আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রিপোর্টগুলোর অনুবাদ নিয়ে একটি ধারাবাহিক সিরিজ করে দেয়ার জন্য। শুনেই আমি রাজি হয়ে যাই। দৈনিক ইত্তেফাকে ২০১৬’এর ০১ ডিসেম্বর হতে ১৫ ডিসেম্বর (১৪ ডিসেম্বর বাদে) পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ১৪টি রিপোর্টের অনুবাদ প্রকাশ হয়েছিল।
এই বইতে সেই ১৪টি রিপোর্টের অনুবাদ সহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মোট ২০টি রিপোর্টের অনুবাদ রয়েছে। ডিসেম্বর ০১-১৭ এর ১৮টি রিপোর্ট ও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় মার্চের ০২ টি রিপোর্টের অনুবাদ সংযুক্ত হলো।
অনুবাদগুলো ভাবানুবাদ এবং পত্রিকার রিপোর্টগুলো মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের সংগ্রহশালা হতে সংগ্রহীত।
এই অনুবাদ রিপোর্টগুলো বই আকারে প্রকাশের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন সহযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের সভাপতি শান্তা আনোয়ার।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের শেষ ১৬ দিন
চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা সহযোগে রেজা রাজা’র কবিতায় চেতন ও অবচেতনের অদৃশ্য জগত মূর্ত হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা স্বপ্ন, কল্পনা, কামনা, বাসনার চিরন্তন প্রবৃত্তিকে অনন্য কাব্য ভাষায় প্রকাশ করে। অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্যে ঋদ্ধ এসব কবিতা। যেন ঘোরলাগা মধ্যাহ্নের মাতাল মিউজিক বেজে ওঠে তাঁর পংক্তির পর পংক্তিতে। জাগতিক যন্ত্রণা আর অযথা হট্টগোলে অসহায় কবি রচনা করেন অনন্য কবিতা। প্রেম, কামনা, বাসনা, নস্টালজিক আবেগ, অনুভূতি কবিতার পরতে পরতে আলো ছড়ায়। কবিতাগুলি বেশির ভাগই বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
মধ্যাহ্নের মাতাল মিউজিক
একাত্তরের কথকতা
ভূমিকা-
ঘুরে বেড়ানোর স্বভাবটা ছোটবেলা থেকেই ছিলো। এ অভ্যাসটা বাবা‘ই করিয়েছেন। মায়েরও মনে হয় প্রছন্ন প্রশ্রয় ছিলো। যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছি ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি। এরপর পেশাটাও বেছে নিয়েছি ঘুরে বেড়ানোর। এ ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে মানুষকে নানাভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে দুরে বসে মানুষ দেখতে আমার বেশ লাগে। প্রতিদিনের নতুন অভিজ্ঞতা থেকে আজো প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, সংসার থেকে জানার চেষ্টা করছি। মানুষের মনসতত্ত্ব আমাকে বেশ ভাবায়। একজন মানুষের বহুরকম ভাবনা। সে থেকে যদি কিছু অর্জন করে থাকি তা কলমের ভাষায় বলবার এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
অন্যজীবন
এক.
বর্তমান ইরাকের মসুল যে শহর, প্রাচীনকালে তাকে বলা হতো নিনেভেহ। সে সময়ের আসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের লাইব্রেরির ধ্বংসাবশেষ থেকে ১৮৪৩ সালে গবেষকরা প্রাচীন আক্কাডিয়ান ভাষায় লেখা কিছু মাটির ফলক খুঁজে পেয়েছিলেন। আসুরবানিপালের সময়ে লেখার পদ্ধতি ছিল এমন যে, প্রথমে মাটির ফলকে খোদাই করে লেখা হতো। তারপর সেটাকে স্থায়ী রূপ দিতে পোড়ানো হতো। তখনকার দিনে লেখার এই পদ্ধতিকে ‘কিউনিফর্ম’ বলা হতো। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে গবেষকরা মাটির ফলকের সেই লেখার অর্থ উদ্ধার করেছিলেন, যা ছিল আধুনিক সাহিত্যবিশ্বের জন্য চমকস্বরূপ। মোট ১২টি মাটির ফলক থেকে উদ্ধার হয় এমন এক অসাধারণ কল্পকাহিনী, যা পরবর্তীতে ‘উর শহরের রাজা গিলগামেশ ও তার বন্ধু এনকিদুর কাহিনী’ হিসেবে সমাদৃত হয় বিশ্বসাহিত্যের বোদ্ধাদের কাছে! ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর প্রথম লিখিত গল্প এটাকেই ধরা হয়ে থাকে। মাটির ফলকগুলোতে গবেষণা চালিয়ে জানা যায়, সেগুলোর বয়স ছিল প্রায় ৪০০০ থেকে ৪৫০০ বছর, যা শুধু রামায়ণ বা মহাভারতই নয়, গ্রিসের অডিসি আর ইলিয়ডের চেয়েও পুরোনো ছিল।
সাহিত্য জগতে প্রচলিত একটা কথা আছেÑ ‘যারা গল্প বা উপন্যাস লেখেন, তাঁরা স্বভাবজাত নিঃসঙ্গ হন’। এই নিঃসঙ্গতাই লেখককে বিভিন্ন গল্পের ভিতরে একাকার করে দেয়, উদ্বুদ্ধ করে গল্প রচনায়। কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললে এভাবেও বলা যায়, ‘গল্পের ভিতরে যা কিছু থাকে, তা লেখকের মনোজগতে বিচরণ করা পুঞ্জিভূত বিভিন্ন ঘটনা, চরিত্র আর দিনরাত্রির গুচ্ছভাবনা’। লেখকের মনোজগতের যে বিশাল সময়ভা-ার, তা টইটম্বুর থাকে এসব ঘটনা, চরিত্র আর দিনকাল দিয়ে। ঘটনা, চরিত্র, দিনকাল বলতে গল্পের ভিতর যা কিছু থাকে, তা তো লেখকের ভাবনারই ‘কার্বনকপি’। সুতরাং ভাবনার জগতে লেখক কোনো অর্থেই নিঃসঙ্গ নন! বরং পার্থিব জগতের যে কোনো মানব-মানবীর অভ্যস্ত সমাজ-জীবনের চেয়ে লেখক অনেক বেশি সামাজিক এবং ব্যস্ত! লেখকের পার্থিব জীবন বিবিধ ‘অনুষঙ্গে’ পূর্ণ থাকলে গল্পের যে ঘটনা, চরিত্র বা আবহাওয়াগুলো থাকে, তা সৃষ্টিতে হয়তো লেখক সেভাবে সফল হতে পারতেন না। তাহলে কি লেখক সামাজিক জীব নন? লেখক কি তাহলে সংসারত্যাগী এমন কেউ যাকে সন্ন্যাসী, বাউল বা ব্রহ্মচারী বলে? এর জবাব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৪ সালের ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে ইন্দিরা দেবীকে এভাবেই দিয়েছিলেন- ‘আজকাল মনে হচ্ছে যদি আমি আর কিছু না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি, তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লেখার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তাঁরা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় বদ্ধঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেরিয়ে বেড়াবে’! রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনার প্রাথমিক প্রেরণা বা উদ্দেশ্যের যে রূপকল্প, তার কিছুটা আভাস এই কথাগুলোর ভিতরেই পাওয়া যায়।
রেহানা বীথি এমনই একজন গল্প-লেখক। বীথির পৈতৃক নিবাস চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহাডাঙা গ্রামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম পাস করার পর ২০০১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় একজন আইনজীবী হিসেবে বীথির কর্মজীবন শুরু হয় এবং বর্তমানে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শনিবারের আসর’ নামে একটি সংকলনে তাঁর প্রথম গল্পটি প্রকাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে রেহানা বীথির গল্প-লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
রেহানা বীথি মোট চৌদ্দটি বাছাইকৃত ছোটগল্প দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর ‘আলো আসে ওখানেও’ বইটি। এটাই বীথির প্রথম বই। প্রথম বই প্রকাশের সময় সব লেখকই প্রচ- স্নায়ুচাপে থাকেন। এটা অবশ্য নিয়ম নয়; তবে অবধারিত! বই প্রকাশের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজটি হচ্ছে বইয়ের একটা যুৎসই নাম দেয়া। শুধুমাত্র নাম খুঁজতে গিয়ে লেখককে অনেক রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়, সলাপরামর্শ করতে হয় সজ্জনদের সাথে। তারপরেও কি লেখক সন্তুষ্ট হতে পারেন! ‘বইয়ের শ্রেষ্ঠ নাম পৃথিবীর কোনো লেখকই কোনোদিন খুঁজে পেয়েছেন বলে শুনিনি’। রেহানা বীথির ক্ষেত্রেও হয়তো এর ব্যত্যয় হয়নি! একটা বইয়ে অনেকগুলো গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ থাকতে পারে এবং সেখান থেকে কোনো একটা লেখার ‘শিরোনাম বা নাম’ ব্যবহার করে বইয়ের নামকরণ করাটা বেশ পুরোনো প্রথা, যা বীথির বইয়ের ক্ষেত্রেও হয়েছে। বইয়ে ব্যবহৃত নামটি যে লেখার শিরোনাম বা নাম থেকে নেয়া হয়, সেই লেখাটি তখন একই সাথে অন্যান্য লেখাগুলো থেকে কিছুটা আলাদা গুরুত্ব বা মর্যাদা পায় এবং বইয়ের অন্যান্য লেখাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বইয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে লেখককে যথেষ্ট সচেতন এবং মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হয়, যাতে ‘বইয়ের নাম’ পড়ে পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা না হয় বাকি লেখাগুলোর আদি-অন্তের খবর এবং সেই সাথে বইয়ের পরিশোধিত আগাম কিছুটা স্বাদ!
দুই.
রেহানা বীথির চৌদ্দটি গল্পের একটি ‘আলো আসে ওখানেও’ এবং এই গল্পের নামেই লেখক মূল বইয়ের নামকরণ করেছেন। স্বভাবত কারণেই গল্পটির গুরুত্ব বা মর্যাদা বইয়ের অন্যান্য গল্পের চেয়ে কিছুটা আলাদা হয়েছে! ‘আলো আসে ওখানেও’ গল্পটি সমাজ-জীবনের হাজারো অনুচ্চারিত যে অধ্যায়গুলো রয়েছে তাঁদেরই একটি, যেখানে অন্ধগলির এক ববিতার কথা লিখেছেন বীথি। তাঁর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে অন্ধকার গলির বাসিন্দাদের কথা। ‘দিনের আলোয় ঘুমিয়ে থাকে তাঁরা। দিন শেষে যখন রাত নামে, জেগে ওঠে ওরা। সাজানো পসারের মতো নিজেদের সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকে দোকানের মতো ঘরগুলোর সামনে; খদ্দেরের আশায়! উৎকট সাজ আর শরীরের মোহময় বিভঙ্গে খদ্দেরকে আকৃষ্ট করার প্রয়াসে ঢাকা পড়ে যায় পাহাড়সম বুকের মাঝে জমে থাকা কষ্টগুলো। কোনো অবসরে কষ্টগুলো কখনো-সখনো জেগে ওঠে, মনে করিয়ে দেয় অতীতের ভাসা ভাসা কিছু সুখস্মৃতি! ‘ফুলি’ নাম থেকে ববিতা হয়ে ওঠা নারীর মৃত বৃদ্ধ স্বামীর গায়ের আতরের কড়া গন্ধ আর হামানদিস্তায় পান ছেঁচার মতো কদর্য হাসি গায়ে জ্বালা ধরায়। মনে পড়ে যায় সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া ফুলির কথা, দুখিনী মা, সবুজ গ্রাম…’। গল্পের মূল নায়িকার ফুলি থেকে ববিতা হয়ে ওঠার অবিচারে ভরা অসম যে পথ, রেহানা বীথি চমৎকার শব্দশৈলীতে তা ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন এই গল্পে। আদিকাল থেকে বাংলাসাহিত্যে এ-ধরনের গল্পের পটভূমি পাঠকদের কাছে নতুন নয়। তবুও রেহানা বীথির ‘আলো আসে ওখানেও, পাঠকদের কাছে এক ‘ভিন্নতার’ স্বাদ এনে দেবে!
ধবধবে জ্যোৎস্নায় সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে গিয়ে দেখা যায় ডাকঘর, যেখানে গচ্ছিত রয়েছে প্রিয়জনদের অসংখ্য চিঠি। অথচ কেউ সেখানে নেই! সিঁড়ির সবক’টা ধাপ পেরিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে স্বপ্নভঙ্গের এক অনবদ্য গল্প ‘সামনে সিঁড়িপথ’। ‘স্বপ্নচাষী’ গল্পে একজন টিউশন মাস্টারের স্বপ্নহীন জীবন কীভাবে একটু একটু করে রঙিন স্বপ্নের বুননে বদলে দেয়া যায়, তারই গল্প! বাস্তবতার পরাশৃঙ্খলতাকে অস্বীকার করে অলীক স্বপ্নের জালে বোনা অবাস্তব জীবনের যে উপাখ্যান, লেখক শব্দের নিপুণ কারুকার্যতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘স্বপ্নচাষী’ গল্পে। গ্রামের সহজ-সরল ভ্যানচালকের গল্প ‘আলাদিনের চেরাগ এবং…’। আধুনিক গল্পের সাথে রূপকথার অনবদ্য সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গল্পকারের ভূমিকায় লেখক রেহানা বীথি এক অনবদ্যতার ছাপ রেখেছেন এই গল্পে, যেখানে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে তিনি দারিদ্র্যের কষাঘাতে পতিত নিম্ন-মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক ঘোর-প্যাঁচগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। বেদে বহরের মেয়ে ললিতার ডাঙার প্রতি আকর্ষণ, ডাঙার ছেলে গণেশের সাথে তার প্রেম এবং সংসার বাঁধার স্বপ্ন, ‘এই তিনকে’ বেঁধেছেন লেখক তাঁর ‘মধুমতির বেদেনী’ গল্পটিতে। এছাড়াও বইটিতে রয়েছে নগরে দেবদূত, অতিক্রম, দলছুট প্রজাপতি, সুখকেদারা এবং অতসীপ্রেম, বিষধর, ফেরা, কাঁসার বাটি, শোরগোল অতঃপর…ইত্যাদি শিরোনামের অত্যন্ত সুপাঠ্য গল্পগুলো।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ শহর উরের রাজা ছিলেন গিলগামেশ। একাধারে তিনি ছিলেন অত্যাচারী এবং খামখেয়ালী। তিনি শারীরিকভাবে তিনভাগের দুই ভাগ ছিলেন দেবতা। ভাবতেন, দেবতাদের মতো তিনিও ছিলেন অসীম ক্ষমতাশালী এবং অসাধ্য বলে তাঁর ভাবনায় কিছু ছিল না। গিলগামেশের গল্পটি ছিল মূলত ‘অহংবোধ ভেঙ্গে একজন সাধারণ মাটির মানুষে রূপান্তর হওয়ার’ গল্প। ‘রাজা গিলগামেশ’ গল্পে রূপকের ব্যবহার অত্যন্ত প্রাঞ্জল। কয়েক হাজার বছরের পুরোনো গল্পে রূপকের ব্যবহারে এবং তার মাত্রায় যে পা-িত্যের বহর দেখা যায়, তা গল্পটিকে করেছে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য। রেহানা বীথির গল্পগুলোতেও রয়েছে রূপকের অকৃপণ ব্যবহার। তাঁর প্রতিটা গল্পে একই সাথে রয়েছে জীবনের বিবিধ বৈচিত্র্য এবং অবিচারে পতিত জীবন, যা খোলা চোখে দেখা গেলেও লেখকের বর্ণনাশৈলীতে হয়েছে আরো বেশি প্রাঞ্জল।
‘রাজা গিলগামেশ’ যদি পৃথিবীর প্রথম স্বীকৃত গল্প হয়, তাহলে তারই ধারাবাহিকতায় আজ-অবধি যত গল্প লেখা হয়েছে এবং রেহানা বীথির গল্পগুলোও একই ধারাবাহিকতায় এবং ফ্রেমে বাঁধা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। বইয়ের প্রতিটা গল্পে রূপক ব্যবহারের আধিক্য, সূক্ষ্ম বিবেচনায় সমাজ-সংসারের চুলচেরা বিশ্লেষণ, জীবনের বিস্তৃত স্বপ্ন, গল্পের ছলে বিবিধ সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বিষয়াদিগুলো গল্পকে শুধু গল্পের সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, আগবাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষে তার সমাধানও দিয়েছেন লেখক। বীথির প্রতিটি গল্পে যে মিলের জায়গাটি রয়েছে, তা হলো ’স্বপ্ন’। গল্পের উপাদান হিসেবে স্বপ্নের ব্যবহার একটি স্বভাব বা অভ্যাস। সে কারণে গল্প-লেখক হিসেবে রেহানা বীথির ‘লেখক-চিহ্ন’ হতে পারে ‘স্বপ্ন’, যা তাঁকে পাঠকসমাজে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন এবং স্বপ্রতিভূ করবে!
গল্প লেখার মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই; তবে গল্প বলতে পারে প্রায় সবাই। গল্প লেখা আর গল্প বলা এক জিনিস নয়। গল্প লেখা এক ধরনের কাজ, যা তৈরি করতে হয়। ‘ঘরে তো মানুষই থাকে। কিন্তু ঘর বানাতে পারে কয়জন’! গল্প লেখারও কিছু শৈলী এবং কলাকৌশল আছে, যা সবাই রপ্ত করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কয়েকজন লেখকের সাথে একাধিকবার আলাপও হয়েছে আমার। সবাই একমত হয়েছেন যে, গল্প লেখা গল্পবাজদের কাজ নয়। গল্প লেখার সুনির্দিষ্ট কলাকৌশল বা ব্যাকরণ হয়তো নেই। তবে যা কিছু আছে, তা নিজ থেকেই আয়ত্ত করতে হয়। লেখকের সিদ্ধতা লাভ হয় নিজ তাগিদেই। গল্প লেখা ‘গুরুমুখী বিদ্যা নয়’! পৃথিবীর সবকিছুই সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলে। গল্প লেখারও কিছু নিয়ম আছে, যার অনুসরণে লেখকের সিদ্ধতার পরিমাপ হয়। ভিন্ন কথায়, একজন লেখকের সাথে অন্য লেখকের পার্থক্যের জায়গাটা মূলত তাঁদের সিদ্ধতা পরিমাপের মধ্য দিয়েই হয়। আর এই পরিমাপের গুরুদায়িত্বটি পালন করেন পাঠক! ২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় রেহানা বীথির প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘আলো আসে ওখানেও’ নিঃসন্দেহে পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে।
সাব্বির খান, লেখক ও সাংবাদিক
আলো আসে ওখানেও
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.