Additional information
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
$ 1.18
Weight | 0.318 kg |
---|---|
Published Year |
সম্পাদকীয়
অনুপ্রাণন: ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়
গত নভেম্বর ২০১২ থেকে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সাহিত্য ও শিল্প বিভাগের বিবিধ সৃজনশীল ও মননশীল লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে নিয়মিত ভাবেই প্রকাশিত হয়ে আসছিল। কিন্তু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাটি বৃহৎ কলেবরে অর্থাৎ নিয়মিত ১৬ ফর্মার বদলে ১৯ ফর্মা আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পরবর্তী ৫ টি সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্পাদকের অসুস্থতা ছাড়াও অলিখিতভাবে সম্পাদনা পরিষদের যে সদস্যবন্ধুটি পত্রিকার কাজে অফিস সমন্বয়কের গুরুদায়িত্ব পালন করছিলেন নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যেতে তিনি নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকলে পত্রিকার কাজে ছেদ পড়তে থাকে। তাছাড়া সম্পাদনা পরিষদের আর একজন বন্ধু অন্য একটি অনলাইন পত্রিকার কাজে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার ফলে তাঁর পক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকায় প্রয়োজনীয় সময় দেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। সম্পাদনা পরিষদের অন্য আর একজন সংগঠক পর্যায়ের সদস্য পত্রিকার চাইতে গ্রন্থ প্রকাশনায় বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশের কাজে লোকবলের এক বিরাট সংকট দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে- ২০১২’এর নভেম্বরে অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশ করার উদ্যোগ যারা নিয়েছিলেন তারা প্রত্যেকেই শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যার যার নিজ অবদান ও স্বাক্ষর রাখার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম ও ব্যক্তিগত অনুদানের ভিত্তিতে পত্রিকাটির প্রকাশনার কাজের যাবতীয় কাজ ও ব্যয় নির্বাহ করার অভিপ্রায় গ্রহণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ সংস্কৃতিতে এবং বিশেষ করে তরুণদের মনের মাঝে মানবতা, সহমর্মীতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা, শিল্পরুচি, নান্দনিকতা এবং মুক্তচিন্তার চর্চার জানালাটাকে উন্মূক্ততর করার কাজে নিয়োজিত অনুপ্রাণনের এই প্রচেষ্টা যেন বাধাহীন হয় এবং কোনভাবেই যেন প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদীতার কূট সাংস্কৃতিক আবর্তে পড়ে দিক হারিয়ে না যায়।
যশ ও প্রতিষ্ঠার মোহ যখন শিল্পীকে পেয়ে বসে তখন শিল্পচর্চা তপস্যা অথবা সাধনা থাকে না। কিন্তু, এটাই বাস্তব যে তপস্যা ও সাধনা ছাড়া শিল্পের উৎকর্ষতার শীর্ষ স্পর্শ সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বলয়ে যেসব শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও উদ্যোগ ফেনার মত আমাদের চারদিক ভরিয়ে তুলছে সেসবের স্থায়িত্ব সম্পর্কে কী কোন সন্দেহ থাকা উচিত?
বছরখানেক বন্ধ থাকার পরও যখন আমরা অনুপ্রাণনের এই সংখ্যাটি প্রকাশের উদ্যোগ নেই তখন আমরা আমাদের পত্রিকার পাঠক, লেখক ও শুভান্যুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সারা পেয়েছি। এই সারা থেকে এই বিশ্বাস আমাদের জন্মেছে যে, আমরা যে পথ অবলম্বন করে এগিয়ে চলতে চাই সেই পথে বাস্তবেই সঙ্গ-সাথীর আমাদের কোন অভাব নেই। এখনও আমাদের দেশের তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ মিথ্যা যশ, প্রতিষ্ঠা ও কর্পোরেট ভোগবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের মানবিক ও নান্দনিক চর্চা অব্যহত রাখতেই অধিক আগ্রহী। তাই, লেখা আহ্বানে যে সংখ্যক মানসম্পন্ন লেখা আমরা পেয়েছি সেগুলো দিয়ে অনায়াসেই দুটো সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল। চলতি সংখ্যার জন্য লেখা বাছাই করতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় দিতে হয়েছে এবং স্থান সংকুলানের অভাবে প্রায় অর্ধেক লেখাই পরবর্তী সংখ্যার জন্য রেখে দিতে হয়েছে।
লেখা বাছাই করতে গিয়ে আবারো আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সাহিত্য আলোচনা ও সমালোচনা বিভাগে আমরা যথেষ্ট সমৃদ্ধ লেখা পাচ্ছি না যেখানে পেশাদার সমালোচকের কলমের স্পর্শ আরো তীক্ষè অথচ আরো গঠনমূলক হতে পারে। বিশেষ করে কবি ও কবিতা নিয়ে আমাদের আরো তীক্ষè, তীব্র ও গঠনমূলক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কেননা সাহিত্য জগতে কবি ও কবিতার সংখ্যা যতই বাড়ছে কিন্তু আগ্রহী কবিতার পাঠকের সংখ্যা যেন সেই তূলনায় বৃদ্ধি হচ্ছে না। মনে হয়, কবি ও পাঠকের মাঝে বোধ, অনুভব ও ভাষার কোন একটা অন্তর থেকে যাচ্ছে যে অন্তরটি ঘুচে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী কেননা বোধ করি, মূলত কবিতার মধ্যেই রয়েছে তরুণ সমাজের জন্য ভবিষ্যতের বিশেষ বার্ত্তা। অর্থাৎ সাহিত্যের সত্যপাঠ।
দেশে এখন হেমন্ত ঋতু। হাওরের অকাল বন্যা ও দেশব্যাপী অতিবৃষ্টির ফলে ফসলহানী ঘটায় এবছর দেশের সামগ্রিক সমাজ জীবনে খাদ্যের ঊর্ধ্বমূল্য সকল মানুষকেই কষ্ট দিয়েছে। হেমন্তের নতুন ফসল যেমন কৃষকের ঘড়ে ঘড়ে জীবনে ঘুরে দাড়ানোর বার্ত্তা দিয়ে যাচ্ছে- দীর্ঘ বিরতির পর অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকের এই সংখ্যাটি এ-বছর অনুপ্রাণনের ঘুরে দাঁড়ানোরই প্রতীক ও স্বাক্ষর হোক- এটাই আশাবাদ।
ষষ্ঠ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা
সম্পাদকীয়
শিল্প-চেতনার ঐক্য
দেশে-বিদেশে সাধারণভাবে এটাই ধরে নেয়া হয় যে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সাধারণ মানুষদের তুলনায় সমাজ সম্পর্কে অধিকতর সচেতন, সক্রিয় এবং অগ্রসর ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এই গোষ্ঠীর সকলেই সমমনা এবং তারা একক কোন সংগঠনে মিলিত অবস্থায় রয়েছেন। এর কারণসমুহ সময়ের সাথে সম্পর্কিত সমাজের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির বাস্তব ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যেতে পারে।
ভাষা, শব্দ, কণ্ঠ, বাদ্যযন্ত্র, রঙ, তুলি অথবা যে কোন উপকরণ ব্যবহার করে সুর ও সুন্দরের চর্চা, অভিব্যক্তি ও নির্মান যা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে, হৃদয়ে আবেগ-অনুভূতি আন্দোলিত করে, মন মুগ্ধ করে অথবা মেধা ও মননে গভীর ছাপ ফেলে যায়- কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সেই কাজেই নিজের প্রতিভা বিকাশের সাধনায় নিয়োজিত থেকে সমাজে সুর ও সুন্দরের সৃষ্টি করে যেতে থাকেন। সুতরাং তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থান কুৎসিত, অন্যায়, অন্যায্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে এবং এটাই একান্তভাবে প্রত্যাশিত। সেখানে বিভেদের কী কোন অবকাশ থাকে? সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করতে চাইলে একজন শিল্পীকে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হবে এবং অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কিন্তু, বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাই? শুদ্ধ শিল্পসিদ্ধি এবং বাস্তবজীবন বীক্ষণ বোধ ব্যক্তি ও ক্ষেত্র বিশেষে যেন সম্পর্কবিহীন দুটো সেতুবিহীন রাজ্যের মতো বিভক্ত রয়ে যায়। কিন্তু, এটা কেন?
আমাদের নন্দনবোধের সাগরে প্রকৃতি যেমন একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে, ঠিক তেমনই জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ চেতনা কী বাস্তব পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? এই দুটি বিষয়কে কল্পনা বা বাস্তবে কী কোন প্রভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায়? অসীমের অন্বেষণ ও স্বপ্নচারিতা একজন শিল্পীর থাকতে পারে। সৌন্দর্যের সন্ধানে অসীম ও অনন্তের দিকে যাত্রা করাও দোষের নয়। পরম সত্যের সৃষ্টির রহস্যকে ঘিরে অনুসন্ধান অনুসন্ধিৎসা আলো-অন্ধকারের উজ্জীবনে না হয় ক্লান্তিতে হয়ত হাবুডুবু খাবে। কখনো কখনো অন্ধকারের স্তব্ধতা নৈঃশব্দের দ্যোতকরূপে চেতনায় সংগুপ্ত থাকবে কিন্তু চিন্তায় সংকীর্ণতা, স্বার্থবাদী ও ক্ষমতাশালী উপনিবাশবাদী শক্তি পরিচালিত ভেদ ভাবনা অথবা মৌলবাদ কখনো মানবমুক্তির স্বপ্নের উজ্জ্বল আলোকে স্পর্শ করতে সাহায্য করতে পারবে না।
কালোত্তীর্ণ শিল্প কী জীবন বিচ্ছিন্ন ছিল? মানুষের দেহ ও তার অবয়বকে, তার যাপিত জীবনের সংগ্রাম অথবা উৎসবের বাইরে মানুষকে ছুঁড়ে দিয়ে মৌলবাদী কোন বিশ্বাসে শৃঙ্খলিত করার কোন অপচেষ্টায় সেসব শিল্প কর্ম কী লিপ্ত ছিল? এমন কোন অভিযোগ অথবা এমন কোন বিশেষণে সেসব শিল্প কর্মকে কী বিশেষায়িত করা সম্ভব? মানবসভ্যতার ইতিহাসে কালোত্তীর্ণ শিল্পের আধারে আত্মার মুক্তি কখনোই অধিক যথার্থ প্রশ্ন ছিল না- যতনা ছিল প্রেম, মানবতা ও মানব মুক্তির বিষয়াবলী। আর এ-কারণেই বুঝে নেয়া দরকার যে ক্ষমতার বর্বরতা ও নৃশংসতার সঙ্গী-সমর্থক হয়ে কখনোই প্রেম, মানবতা ও সুন্দরের পূজা সার্থক সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। কেননা যখন ঘৃণা অথবা প্রেম থেকে শিল্পকে যে কোন একটাকে বেঁছে নেয়ার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় তখন মানবতাই শিল্পের ধর্ম হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কেননা- প্রেমই সুন্দর এবং প্রেমই মানবতার বৈশিষ্ট।
যদিও প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সংবেদনশীলতা বিরাজমান কিন্তু এর মাত্রা ও স্বাতন্ত্র্য সবার অস্তিত্বে সমভাবে লালিত হয় না। যারা একটু অধিক মাত্রায় সংবেদনশীল তাদের ইন্দ্রিয় সদা জাগ্রত থাকে, তাঁরা প্রকৃতি থেকে সৃষ্টির চিরন্তনতার নির্যাস পায়, অসীমের অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্বের মহিমা হৃদয়াঙ্গম করতে পারে। শিল্পী সমাজের সদস্যগণ জীবন প্রবাহের সব উপকরণের মধ্যে সত্য, সুন্দর, সততা ও সরলতাকে অবিচ্ছেদ্যতার সাথে তাঁর অস্তিত্ব দিয়ে আকাঙ্খা করেন। মানুষ ও মানবজাতির কল্যাণ চিন্তায় হন সবচেয়ে অগ্রগামী এবং এ-কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈষয়িক জীবনে বঞ্চিত রয়ে যান। বৈষয়িকভাবে তাঁর বঞ্চিত হওয়া অবাঞ্ছিত নয়, কারণ লেখক ভোগবাদের উপাসক নন, তিনি উপাসক প্রেম ও সত্যের- যে প্রেম, যে সহমর্মিতা, যে ভালোবাসা, মানবজাতির চিন্তা-চেতনা ও জীবন যাপনের সেই সত্য ও সুন্দরতা- যে সত্য থেকে, যে সৌন্দর্য থেকে জীবন সত্য- সদা প্রসারিত ও স্পন্দিত।
জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি যাই থাকুক না কেন, ন্যূনতম ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দাবি মিটিয়ে শিল্পী তাঁর মনে কল্পনার একটি সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করেন, যে জগতে অপ্রাপ্তির ইতিহাসও প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। কল্পনাকে সত্য বলে উপলব্ধি করে লেখক বিশ্বের স্বর্ণযুগ কল্পনা করেন। যদিও স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে অন্তহীন শূন্যতা থাকে তবুও শিল্পী যেমন নিজে স্বপ্ন দেখেন তেমনই অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। এসব সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় অন্যদের মনোজগৎও স্বাপ্নিক ও সুন্দর হয়ে ওঠে। অনেকের ধারণা- শিল্পী শুধু কল্পনারাজ্যে বিরাজ করেন কিন্তু হৃদয়রাজ্যেও যে তাঁর অপ্রতিহত অবস্থান সে বিষয়টি ভেবে দেখেন না। একজন শিল্পী যুক্তিকে স্বীকার করেন, গ্রহণ করেন, ব্যবহার করেন হৃদয় দিয়ে এবং সেভাবেই সৌন্দর্য ও সত্যের অভিন্নতাকে প্রত্যক্ষ করেন। শিল্পী তাঁর চারপাশের সমাজ সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্জাত অন্তরের নির্যাসটুকু শিল্পিতরূপে ছেনী-হাতুরী, রং-তুলি অথবা কলমের ডগা থেকে শূন্যতার সময়পটে চিহ্নিত করেন। নৃশংসতা, বর্বরতা, দমন-নিপীড়নের সাথে যেমন সত্য ও সুন্দরের ঐক্য হতে পারে না তেমনই একজন শিল্পী সমকালীন সমাজের শক্তির বিভাজনে অবশ্যই নির্যাতিতের পক্ষেই তার অবিচ্ছেদ্য অবস্থান নিশ্চিত করেন। এটাই শিল্পী সমাজের ঐক্যের মূল সূত্র। অনুপ্রাণন, শিল্প-চেতনার ঐক্যের এই মূল সূত্রের দিকেই সবাইকে ধাবিত করার প্রচেষ্টা করে যেতে চায়।
সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
অনুপ্রাণন ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা- সম্পাদকীয়
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ২০১২। এ-পর্যন্ত ৩২টি সংখ্যা প্রকাশ করে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন ১০ টি বছর অতিক্রম করেছে। এ দশটি বছর অনুপ্রাণন’কে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আজ একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করার মুহূর্তে পেছনের দশটি বছরের দিকে ফিরে স্মৃতিতে অনেক কিছুই ভেসে আসে। লেখক, পাঠক এবং সম্পাদনা পরিষদের সাথে ভাগ করে নেয়ার মতো অনেক কথাই হয়তো বলার থাকে, বলার ছিল। কেননা ১০ বছর তো কম সময় নয়। তবে, শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা অথবা লিটল ম্যাগ প্রকাশের ইতিহাসে প্রায় একই ধরনের ঘটনা হয়তো হর-হামেশাই ঘটে থাকে।
টেকসই সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণে পেশাদারিত্বের অভাব আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এখনো সেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অহমবোধ প্রতিটি সংগঠনের ভিত কুরে কুরে খাচ্ছে। বাইরের থেকে যেটা দেখা যায় সেটা ঠিক ভেতরের চিত্র না। আর তাছাড়া অর্থনীতির বিষয়টা তো আছেই। আর সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করার ঘাটতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জগতে সাধারণভাবেই অর্থের সংকট রয়েছে। সাধারণভাবেই বলা যায় যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির গুরুত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো যথার্থভাবে বুঝতে ব্যর্থ। ভাবা হচ্ছে ভৌত কাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নতির চাকা ঘুরলে দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু আমরা জানি উন্নত সভ্যতা মানেই হচ্ছে উন্নত শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
তাই, অনুপ্রাণন যেসব সাংগঠনিক সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে আছে সেসবের সাথে অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য বা ব্যতিক্রম হয়তো নির্মাণ করা যায়নি। কেননা আমরা শেষ পর্যন্ত, এদেশের প্রকৃতি ও মনুষ্যসমাজেরই অঙ্গ। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি- এসবের সংকট ও সম্ভাবনা থেকে অনুপ্রাণন বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ তো নয়।
এটা ঠিক অনুপ্রাণন পত্রিকাটিকে ঘিরে এই দশ বছরে লেখক-পাঠক ও সুভানুধ্যায়ীদের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এই বৃত্ত কোনো বিশেষ সীমানা রেখা দিয়ে ঘেরা কোনো বৃত্ত না। এই বৃত্ত শিল্প-সাহিত্যের মুক্ত চর্চার মতোই উন্মুক্ত। অনুপ্রাণন মুক্ত চিন্তার চর্চাকেই সবসময় সমর্থন করেছে, অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছে। আর অনুপ্রাণন চেষ্টা করেছে এদেশের তরুণরা যেন বেশী বেশী করে বই পড়া আর শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সারাদেশ জুড়ে অনুপ্রাণনকে ঘিরে আছে একদল তরুণ-তরুণী, যারা নিয়মিত শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারাই অনুপ্রাণনের প্রাণশক্তি। যাদের সাথে অনুপ্রাণনের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক সৌহার্দের। একে আরেকের পরিপূরক।
দশ বছর নিয়মিত বিভাগ নিয়ে ছাপার সংস্করণ আকারে অনুপ্রাণন পত্রিকাটি প্রকাশ করার পথে লেখক ও পাঠকদের কাছ থেকে ক্রমেই দুটি দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রথমটি হচ্ছে, অনুপ্রাণনের একটি অন্তর্জাল সংস্করণ প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের মুদ্রিত সংস্করণে সাহিত্য ও শিল্পের বিশেষ ধারা, ধরন অথবা বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা।
ইতোমধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুপ্রাণনের পক্ষ থেকে, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্জালভিত্তিক এই সংখ্যাটিতে থাকছে ২০ টি বিভাগ। যথাক্রমে- শ্রদ্ধাস্মরণ, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রবন্ধ, গুচ্ছ কবিতা, যুগল কবিতা, একক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, বড়ো গল্প, ছোট গল্প, অণুগল্প, অনুবাদ গল্প, মুক্তগদ্য, ভ্রমণকাহিনী, বই আলোচনা, ম্যাগ আলোচনা, পাঠ প্রতিক্রিয়া, চলচ্চিত্রকথা, ধারাবাহিক উপন্যাস, নাট্যকথা এবং শিল্প-সাহিত্য সংবাদ।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন ইতিমধ্যে অনিয়মিতভাবে ৬ টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে, (১) তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- প্রিয় উপন্যাস সংখ্যা; (২) অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা- গল্প সংখ্যা; (৩) অষ্টম বর্ষ তৃতীয় সংখা- অণুগল্প সংখ্যা; (৪) অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা- কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা; (৫) নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা- কবি ও কবিতা সংখ্যা; এবং (৬) দশম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা- বাংলাদেশের ১৫টি সেরা গল্প- পাঠ ও আলোচনা সংখ্যা।
একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যার মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, সকল মুদ্রিত সংস্করণে নিয়মিতভাবেই শুধুমাত্র দেশের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আরো নিবিড়ভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষ ধরন, বিশেষ বিভাগ, বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশ করার সূচনা করতে চায়।
লেখক, পাঠক এবং অনুপ্রাণনের সম্পাদনা পরিষদের সেই চাওয়া থেকেই ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি নির্বাচিত কবি ও কবিতা সংখ্যা- প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ২৭ জন নির্বাচিত কবির জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং আলোচনা প্রকাশিত হয়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রবীণ ও তরুণ কবিদের নিয়ে এই ধরনের লেখা ও আলোচনা নিয়ে আরো কয়েকটি পর্ব প্রকাশিত হবে বলে আমরা আশা করি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের জীবনী ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিকের কয়েকটি পর্বের এই আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে আশা করি আমাদের দেশের তরুণ সমাজ বাংলাদেশের কবিদের কবিতার সাথে সুপরিচিত হবেন এবং আমাদের দেশের সম্মানিত এই কবিদের কবিতা নিয়ে আলাপ, আলোচনা এবং আড্ডার অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার বৃত্তটিকে প্রসারিত করতে পারবেন।
অনুপ্রাণন ১১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন–১০ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা
শিল্প-সাহিত্যে নারীর ভাষা, ভাষ্য ও দৃষ্টিকোণ নির্মাণে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা
ভাষা সমভাষীদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের সহজ ও বোধগম্য উপায়। কিন্তু যখনই বৈষম্যমূলক সমাজ জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি, অঞ্চল ও লিঙ্গভেদ সৃষ্টি করে, তখন সমভাষীদের মধ্যে নানারকম উপভাষা, আঞ্চলিক ভাষা এবং একইসাথে উপ-সংস্কৃতিতে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভাষা ও ভাষ্যের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে তর্ক ও ক্ষেত্রবিশেষে বিবাদ দেখা দিতে পারে। শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার ভেদের সাথে সাথে উচ্চারণেরও নানা ভেদ ও ব্যতিক্রম সৃষ্টি হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বাক্যগঠন, শব্দ ব্যবহার এবং উচ্চারণে বিভেদ ঘোচালেই মানুষে মানুষে বাস্তব ভেদাভেদসমূহ দূর হয়ে যায়। সমাজে যে সকল বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ ও অন্যান্য প্রকার ভেদাভেদ রয়েছে, সেসব ভেদাভেদের শেকড় সমাজের গভীরে নিহিত। এ সকল ভেদাভেদের পেছনে কলকাঠি নাড়ে ইতিহাস, পরম্পরা, প্রথা, প্রচলন, শাস্ত্র, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-সামাজিক তত্ত্ব ও দর্শন। এসব ইতিহাস, পরম্পরা, প্রথা, প্রচলন, শাস্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-সামাজিক তত্ত্ব ও দর্শন নির্মাণ ও বর্ণনার ভাষা, ভাষ্য, শব্দ, বাক্য ও বাগধারার একটি নির্দিষ্ট ছক থাকে। প্রতিষ্ঠাতার নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করার জন্য সংগঠিত, অন্যদিকে বৈষম্য দূর করার জন্য পরিবর্তন ও মানবিক বিকল্পের প্রয়াসে যারা ভাষা, ভাষ্য, শব্দ, বাক্য, বাগধারা অথবা প্রবাদের আলোচনা-সমালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করায় ব্রত রয়েছেন, তারা যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ অথবা যদি তাদের কোনো সংগঠন থেকে থাকে, তবে সেটাও নিতান্ত দুর্বল।
সরল ও স্বাভাবিকভাবে দেখলে শিল্প-সাহিত্য দেশ, সমাজ, রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং চলমান ঘটনারই প্রতিফলন। তাই সমাজে বিরাজমান ভেদাভেদ ও বৈষম্যের প্রতিফলন শিল্প-সাহিত্যে এসেছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে সেসব প্রতিফলন যে, সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা নয়। ক্ষমতাশালী শ্রেণি-গোষ্ঠী, তাদের মত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার ও প্রসারে যেমন ব্রতী হয়েছে, তেমন একইভাবে নানারকম লিখিত-অলিখিত সেন্সরশিপ আইনের প্রকাশ্য অথবা আড়ালে প্রয়োগ করার মাধ্যমে ক্ষমতার বাইরের শ্রেণি-গোষ্ঠীর প্রতিবাদী মানবিক ও নান্দনিক শিল্প-সাহিত্যকে দমন করেছে, নিশ্চিহ্ন করেছে অথবা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে নিষ্ঠুরভাবে। কোনো ভালো অথবা ন্যায্য কাজেও সমাজের ক্ষমতাধরদের রাগ-বিরাগ দেখা দিলে সেসব কাজ নিরুৎসাহিত করার উপায় নানাভাবেই উদ্ভাবিত হয়েছে, সুকৌশলে এসবের প্রয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছে।
সুতরাং শিল্প-সাহিত্যে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর ভাষা, ভাষ্য ও দৃষ্টিকোণ নির্মাণের পথে এক দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করা; এমনকি আত্মদানের অতীত ইতিহাস রয়েছে, যা কি-না সমকালীন সমাজেও চলমান রয়েছে। শিল্প-সাহিত্য শরীরী কোনো খেলা নয় যে, সেটার জন্য দুটো পৃথক মাঠ থাকবে, যেমন—পুরুষ ফুটবল-নারী ফুটবল বা পুরুষ হকি-নারী হকি। শিল্প-সাহিত্য বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। নারী ও পুরুষের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার বিভেদ রেখা টানার বিধান শাস্ত্রে উল্লেখ করে এই বিভেদ রেখাটাকে স্থায়ী করার চেষ্টা হয়েছে এবং সেই চেষ্টা চলমান রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো বৈষম্য নেই। তাই যত চেষ্টাই করা হয়ে থাকুক না-কেন, শিল্প ও সাহিত্যচর্চার মাঠটাকে নারী-পুরুষে ভাগ করা যায়নি।
একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতার সাথে লড়াই করেই নিজের স্থান করে নিতে হয়। আমরা বিষয়টা বুঝে নিতে পারি যে, কেন ইতিহাসে একজন পুরুষ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি পাওয়া যায়, কিন্তু একজন নারী মাইকেলেঞ্জেলো পাওয়া যায় নাই। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিকের নাম দেখতে পাই না। যদিও এসবকালে মৌখিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, যা কি-না পরবর্তীতে নামহীন সাহিত্য হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এমনকি রেনেসাঁর যুগেও যখন শিল্প ও সাহিত্যের ব্যাপক জাগরণ ঘটেছিল, তখনও আমরা কি সে-রকম উল্লেখযোগ্য নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিকের নাম পাই? বস্তুত আধুনিক যুগে এসেই বহু লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীরা রচিত শিল্প-সাহিত্যে যেমন স্বমহিমা ও মর্যাদার স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে সে-রকম নিজের অসীম মানসিক শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বল্প সংখ্যায় হলেও শিল্প ও সাহিত্যের জগতে শিল্পী অথবা লেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এসব কারণে নারীদের হৃদয়ের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মাত্রাটা অনেক সময়েই সমাজসচেতন ব্যক্তির কাছেও অননুধাবনযোগ্য হয়ে পড়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ভয়ার্ত শৈশব, অব্যক্ত কৈশোর, বৈষম্যের যৌবন, অতৃপ্তির দাম্পত্য, সামাজিক নিষ্পেষণ যে বিষয়বৈচিত্র্য, কোনোরকম রাখঢাক না করেই সেসব কাহিনির কতটা বাস্তবে উন্মোচন ও প্রকাশে সমাজ সাহসী হয়ে উঠবে? কিন্তু ইঞ্চি ইঞ্চি করে হলেও কুসংস্কারগুলো ঝেড়ে ফেলে সমাজ একটু একটু করে এগিয়েছে।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্প-সাহিত্যে নারীর অবয়বকে জন্মদাত্রী মায়ের অথবা যৌন আবেদনময়ী রমণীর বিভিন্ন প্রতীকী উপস্থাপন হয়েছে অনেকটা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো করে। নারীকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যেমন প্রতীক সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি নারীমুক্তির জন্যও প্রতীক রয়েছে। নারী নিজে কখনো প্রতীক হয়েছেন, নারীর পোশাকে প্রতীক ছড়িয়েছে, নারীকে অবমাননার জন্য প্রতীকের ব্যবহার হয়েছে। নারীর প্রতীকী উপস্থাপন শিল্পকলায়, সাহিত্যে, সভ্যতায় যেভাবে এসেছে, বাস্তবের নারী সেখান থেকে বহুদূরেই রয়ে গেছে। অথবা পুরো বিশ্বব্যবস্থা নারীকে প্রতীকী উপস্থাপনের মাধ্যমে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে, নারী কেবলই সেই বাঁধন ছিঁড়ে বেরোবার জন্য নিরন্তর যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র প্রতীকের অচলায়তন ভেঙে এগিয়ে যাওয়াটাই নারী জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম।
শিল্প-সাহিত্যে নারীর প্রবেশ ও অগ্রগতির পথে সমস্যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনুধাবন করার জন্য নারীশিল্পী ও সাহিত্যিকদের শিল্প-সাহিত্য জগতে প্রারম্ভিক প্রবেশ করা, এগিয়ে আসা এবং অগ্রগতির বিষয়গুলো উল্লেখ করে, আমরা কিছুটা আলোচনা করতে পারি। সভ্যতার হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে যখন শিল্প-সাহিত্যচর্চায় একমাত্র পুরুষদেরই পদচারণা ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপ যখন ধীরে ধীরে রেনেসাঁর দিকে গুটি গুটি পা বাড়াচ্ছিল, তখনও মাত্র অল্প কয়েকজন নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিক রেনেসাঁর প্রস্তুতি পর্বে ‘মর্ত্যরে ভগবান’ তথা পুরুষদের বাধা অতিক্রম করে নিজেদের প্রকাশ্যে নিয়ে আসার জন্য কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। এই সারিতে যে আটজন নারীর নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হয়ে থাকে, তারা হচ্ছেনÑ সোফোনিসবা এঙ্গুইসোলা, লেভিনা তিরলিঙ্ক, লাভিনিয়া ফনটানা, ক্যাথারিনা ভন হেমেসিন, এলিজাবেথ সিরানি, ক্লারা পিটার্স, জুডিথ লেইস্টার এবং আর্টমেসিয়া জেনটিলেসিন।
কিন্তু তারও অনেক পূর্বে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীকালে পারস্য ও মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে সহস্রার্ধ মৌখিক গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সম্রাট শাহরিয়ারের স্ত্রী শাহ্রজাদের কথাসাহিত্য হিসেবে। শাহ্রজাদের সৌভাগ্য যে, ইতিহাস তার নামটি মুছে বেনামী নামকরণ করেনি। পৃথিবীর কথাসাহিত্যের জগতে এ-রকম নানা বিষয়ভিত্তিক ১০০১টি গল্পের রচনা বিস্ময়কর, যেখানে প্রতিটি গল্পের শেষে সম্রাটের কাছে তার স্ত্রী শাহ্রজাদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করার প্রার্থনা গৃহীত হওয়ার কথা যুক্ত রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতায় গুহাচিত্র ও পাথরের ভাস্কর্যে নারী জন্মদাত্রী মাতা অথবা যৌন আবেদনময়ী বস্তু হিসেবেই চিত্রিত হয়েছে। বৈদিক পর্বে শাস্ত্রমতে, নারীর অবস্থান জন্মদাত্রী মাতার অবস্থান হিসেবে নারীকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নির্দিষ্ট করে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এই মর্যাদা লাভের কারণে নারী-পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত ছিল। বাস্তবে প্রাক-উপনিবেশবাদ আমল পর্যন্ত সিন্ধু ও ভারতীয় সভ্যতায় নারী, বংশ রক্ষাকারী মাতার বাইরে আর অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠতে পারে নাই। চীন সভ্যতায়ও সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে তাং রাজত্বকালে নারীদের অবস্থানে স্বকীয়তা অর্জনের কিছু সুযোগ গ্রহণ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো নারীশিল্পী অথবা সাহিত্যিকের নাম পাওয়া যায় না। নারীদের নান্দনিক ক্ষুদ্র অঙ্কন ও সুচি শিল্পের নিদর্শন জাদুঘরে দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্বসাহিত্যে প্রথম নারী কবি প্রাচীন গ্রিসের স্যাফো। ষষ্ঠ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে নব কবিদের একজন ছিলেন এই গীতিকবি। চর্যাপদকে বলা হয় বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। চর্যাপদের পদকর্তাদের মধ্যে একজন নারী পদকর্তা ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। এই নারী পদকর্তার নাম কুক্কুরিপা। রজকিনীকে অনেকে চেনেন চণ্ডীদাসের প্রেমিকা হিসেবে। তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে, তিনি একজন কবি। তিনি রামী ও রামমনি—এই দুই নামে কবিতা লিখতেন। তাঁর পদগুলোর নাম ছিল রামীর পদ। ঋগে¦দ-এ কয়েকজন নারী দার্শনিকের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে একজন লোপামুদ্রা। তিনি কৌষীতকি নামেও পরিচিত ছিলেন। ঋগে¦দে ২৭ জন নারী ঋষির রচিত সূক্তের উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাসে এসব উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সংখ্যাবিচারে বলা যেতে পারে যে, বস্তুত আধুনিক যুগে এসেই নারীরা শিল্প-সাহিত্যে ধীর লয়ে প্রবেশ করার সুযোগ গ্রহণ করে, যখন শিল্প-সাহিত্যে নারীর ভাষা, ভাষ্য ও দৃষ্টিকোণ নির্মাণের বিবরণ পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষায় প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। তাঁর রচিত রামায়ণে তিনি রামের পুরুষালি বাহুবলের পরিবর্তে সীতার বঞ্চনা ও পীড়নের বর্ণনাকে মাহাত্ম্য দিয়েছেন। বলা যায়, নারীকবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যে নারীর ভাষা, ভাষ্য এবং দৃষ্টিকোণ নির্মাণের সূচনা করেন। নারী লেখক রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম মনোত্তমা। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৭ সালে নবপ্রবন্ধ পত্রিকায়। তবে এ উপন্যাসের লেখকের কোনো নাম জানা যায়নি। লেখক-নামের স্থলে কেবল লেখা ছিল ‘হিন্দুকুল-কামিনী প্রণীত’। আবার বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের নাম ছিল রূপজালাল। ওই বছরই ঠাকুর পরিবারের মেয়ে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী লেখেন উপন্যাস, ‘দীপ নির্বাণ’। এ ছাড়া পৃথিবীর প্রথম নারী ঔপন্যাসিক বলা হয়, জাপানি লেখিকা মুরাসাকি শিকিবুকে। তাঁর উপন্যাসের নাম গেঞ্জি, যার ইংরেজি অনুবাদ দ্য টেল অব গেঞ্জি। বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম গদ্যরচনার কৃতিত্ব হলো তাহেরুন্নেসার। ১৮৬৫ সালে ‘বামাগণের রচনা’ নামে বামাবোধিনী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর গদ্য। বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম ঔপন্যাসিক হলেন এস এফ খাতুন। ১৯২১ সালে লেখা তাঁর উপন্যাসের নাম জোবেদা।
নারী শিল্পী ও লেখকদের শিল্প ও সাহিত্য রচনার কাজে নিয়োজিত হওয়ার পথ কখনো মসৃণ ছিল না—এখনো নেই। অন্যদিকে নারী অথবা পুরুষ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের দ্বারা নারীর সামাজিক সমস্যাগুলো চিত্রিত করার কাজেও বিস্তর বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এ সকল পরিস্থিতিতে নারীদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যে আধুনিক নারীর সংগ্রামের ভাষ্য ও রূপরেখা নিয়ে নানা মতভেদও দেখা যায়। প্রশ্ন উঠেছে, এসব মতভেদ শিল্প-সাহিত্যে নারীর অবস্থান সৃষ্টিতে নারী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কি-না? তবে আমরা মনে করি, মতভেদ থাকবেই এবং এসব মতভেদ দ্বান্দ্বিক নিয়মেই দূরীভূত হয়ে একটি নতুন স্তরে উন্নীত হতে পারে।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন, শিল্প ও সাহিত্যে নারীর সরব উপস্থিতি কামনা করে। অনুপ্রাণন আশা করে, শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যম দিয়ে নারীর ভাষা, ভাষ্য এবং দৃষ্টিকোণ ক্রমেই সমাজে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার কাজে যেন অগ্রসর হতে পারে।
১০ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন—নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি যখন আসে তখনই আমরা আমাদের ভাষা তথা, বাঙলা ভাষা ব্যবহারের পরিধি, মান, চর্চা এবং গবেষণার ক্ষেত্র ঘিরে অপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি; কিন্তু ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনার পর এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পর আজও আমরা সারা বছর বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য কোনো পদ্ধতিগত ও সদা চলমান কোনো কর্মসূচি প্রণয়ন করতে সক্ষম হইনি। এই অক্ষমতার কারণ আমার জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মাঝেই বিদ্যমান।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি ভাগে বিভক্ত–বাংলা মাধ্যম, আরবি/ফারসি মাধ্যম এবং ইংরেজি মাধ্যম। ইংরেজি অথবা আরবি/ফারসি মাধ্যমে যারা পড়াশোনা করে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে সীমিত কয়েক শ্রেণি পর্যন্ত বাঙলা ভাষা ও বাঙলা ব্যাকরণের সাথে তাদের যৎসামান্য পরিচয় ঘটে। কিন্তু সেটা দৈনন্দিন জীবনে কথ্যভাষা ছাড়া লিখিত কোনো নথি, রচনা, প্রবন্ধ অথবা প্রতিবেদন লেখার জন্য যথেষ্ট হয়ে ওঠে না। যার ফলে, সরকারি কার্যক্রম চালানোর জন্য নথিতে অথবা আইন ও বিচারব্যবস্থার কাজে ব্যবহৃত যাবতীয় আইন, আদেশ ও রায়ের সকল প্রতিবেদনে অথবা চিকিৎসা ও বিজ্ঞানচর্চার উচ্চতর স্তরে বাঙলা ভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হওয়া অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আর সেটাই হতে আমরা দেখে থাকি।
আইন ও বিচারের নথি প্রস্তুতিতে অথবা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শ্রেণি অথবা মেডিকেল শিক্ষা ও চর্চার কাজে সহজে ব্যবহৃত হতে পারে সেজন্য সহজ ও বোধগম্য শব্দ সংবলিত উপযোগী এবং পূর্ণাঙ্গ পরিভাষা কোষ তৈরি করতে আমরা এখনও সফল হইনি। এই কাজটা কঠিন কিন্তু তাই বলে কাজটা শুরুই কি হলো? আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো কাজ যদি হয়ে থাকে, সেটাও অত্যন্ত নগণ্য এবং অস¤পূর্ণ। একটা ক্ষুদ্র এবং অসম্পূর্ণ পরিভাষা কোষ দিয়ে কি কোনো একটি গ্রন্থ সম্পূর্ণ অনুবাদ হতে পারে? তাই আমরা আইন, বিচারব্যবস্থা, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার সকল ক্ষেত্রে এখনো বাঙলা ভাষার প্রচলন করতে পারিনি।
আইন, বিচারব্যবস্থা, চিকিৎসা-বিজ্ঞানসহ সকল বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে শুধু নয়, সাহিত্য ক্ষেত্রেও বিদেশি ভাষা থেকে বাঙলায় অনুবাদ এবং বাঙলা ভাষা থেকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রটিও অবহেলিত রয়ে গেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে যৎসামান্য যেটুকু হচ্ছে সেটা বাঙলা সাহিত্যকে বিদেশে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বিন্দুসম প্রচেষ্টাই বলা যেতে পারে। বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্যই উভয়বিধ অনুবাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অথচ এটা আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা কতটুকু বোঝেন এটা জানা খুব কষ্ট। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তারা আপসহীন সংগ্রামী। কিন্তু জাতিকে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে ভাষার বহুমাত্রিক বিকাশ যে কতটুকু প্রয়োজনীয় সেটা তারা কী আদৌ বোঝেন?
পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ রয়েছে যাদের মাতৃভাষা বাঙলা। শুধু এই সংখ্যাটার জোরেই আমরা জাতিসংঘে অন্যান্য প্রচলিত ভাষাসমূহের পাশাপাশি বাঙলা ভাষাকেও ব্যবহারের জন্য অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করতে চাই। কিন্তু শুধু সংখ্যার জোরেই কি জাতিসংঘের কাছে এই দাবি গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব? বস্তুতপক্ষে আমরা যদি বাঙলা ভাষাকে বিশ্বের একটি অন্যতম ভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে বাঙলা ভাষাকে উচ্চতর জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উপযোগী করে তুলতে হবে। যদি আন্তর্জাতিকভাবে বাঙলা ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো কোনো প্রতিশব্দের অভাবে বিকল্প হিসেবে বিদেশি ভাষাই ব্যবহার করতে হয় তাহলে কি করে আমরা বাঙলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক অথবা বহুদেশীয় কোনো ফোরামে ব্যবহারে জন্য অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হতে পারি? এই বক্তব্যের সাথে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয় মিলিয়ে ফেলা যাবে না। কেননা, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ, বাঙালির ভাষার জন্য সংগ্রাম ও আত্মদানের প্রতি সম্মান দেখানোর কারণেই সম্ভব হয়েছে। এর সাথে বহুজাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য প্রচলিত অন্যান্য ভাষাসমূহের পাশাপাশি বাঙলা ভাষাকে ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করার সম্পর্ক নেই। এটা সফল করে তুলতে চাইলে বাঙলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধি এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিকাশ ও সমৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে।
বক্তব্যটিকে বাঙলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ এবং সমৃদ্ধির প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রেখে বলতে চাই যে, প্রয়োজন ছিল পরিভাষা এবং অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশ এবং সমৃদ্ধির জন্য একটি স্বতন্ত্র এবং দক্ষ ও মেধাবী সাহিত্যিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় পারদর্শী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কিন্তু বেসরকারিভাবে এই কাজটা করা সম্ভব না। এটা করতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং যার জন্য চাই সরকারের সিদ্ধান্ত। কেন যে সরকার আজ অবধি এডহক-ভিত্তিতে দেশ ও জাতির জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাঙলা একাডেমিকেই দিয়ে রাখলো সেটা আমার বোধগম্য না।
এদিকে মাদরাসা ও ইংরেজি শিক্ষা থেকে পাস করে বেরিয়ে আসা ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করার সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। এ-কথা জানা সত্ত্বেও যে উচ্চতর শিক্ষায় অথবা চাকরি-জীবনে আগত এসব ছাত্ররা বাঙলা ভাষা ব্যবহার না করে অন্য বিদেশি ভাষা ব্যবহার করার প্রবণতা নিয়ে উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে ঢোকে। যার ফলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে অথবা সরকারি প্রশাসন এবং আইন ও বিচারব্যবস্থার উচ্চতর মহলে সার্বিকভাবে বাঙলা ভাষা ব্যবহার প্রচেষ্টায় তাদের আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায় না। বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা ব্যবহার পরিহার করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অনীহার ফলে একপ্রকার বাধা সৃষ্টি করতেও তাদের দেখা যায়।
ভাষার বহুমাত্রিক বিকাশ যদি না ঘটে, তাহলে বদ্ধজলের মতোই ভাষা ও একপ্রকার বন্ধ্যা অবস্থায় পতিত হয়। বিকাশ না ঘটলে যে কোনো অস্তিত্ব সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং সঙ্কুচিত হতে হতে একসময় সেই বস্তুর অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে পড়ে। কথ্য অথবা লিখিত ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে অস্তিত্বের এই বিনাশ শুরু হয় নানা বাঙলা শব্দ বা প্রতিশব্দের বদলে বিদেশি শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যেটা এখন হরহামেশা ঘটছে। নাগরিক কথাবার্তায় অথবা লেখালেখিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলার বদলে আরবি অথবা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার এখন আমরা প্রায়শই হতে দেখছি, কিন্তু তবুও আমাদের সাহিত্যিক অথবা বুদ্ধিজীবী মহলে কিংবা নীতিনির্ধারক মহলের টনক নড়তে দেখা যায় না। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে এটা প্রকৃত বাঙলা শব্দের অভাবে হচ্ছে, সেটা যে তা নয়। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এদের মন-মানসিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সচেতনতা ততোটুকু দৃঢ় নয়। এটা কেন হচ্ছে? কেন বহুসংখ্যক নাগরিক বাঙলার বদলে আরবি অথবা ইংরেজি ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন?
জ্ঞান-বিজ্ঞান অথবা প্রযুক্তির উচ্চতর ক্ষেত্রে যখন বাঙলা প্রতিশব্দের অভাব হয়, তখন সম্পূর্ণভাবেই বাঙলা ভাষার বদলে ইংরেজি ব্যবহার যেন অপরিহার্য হয়ে যায়। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই বাঙলায় একসময় আরবি, ফারসি অথবা উর্দু শব্দ সুকৌশলে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে ঘটেছে, কিন্তু সেটা ছিল পাকিস্তান আমল এবং পাকিস্তানি শাসক মহলকে তোষণ করার জন্যই এটা সচেতনভাবেই করা হতো। কিন্তু এখন কেন আরবি, ফারসি, উর্দু অথবা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। বাঙলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে যেহেতু চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে কাজ হচ্ছে না তাই বাঙলা ভাষার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ছে এবং এর জন্য ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা শতভাগ দায়ী। তাহলে আমরা কি করতে পারি? এটা কি বলতে পারি যে, ভাষার জন্য আমাদের সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটেছে?
আমাদের একথা বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙলা ভাষার অস্তিত্ব সুরক্ষা করা, এর বিকাশ ঘটানো এবং চলমান রাখা এবং সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা চলার আন্দোলন ও সংগ্রাম, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চাইতেও জটিল ও কঠিন। যার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চাই নিয়মানুবর্তিতা ও অধ্যবসায়।
খুব নীরবে হলেও বিশ্বজুড়ে ভাষার ব্যবহার এবং প্রসার নিয়ে চলছে এক তীব্র প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতার পেছনে রয়েছে উন্নত রাজনীতি এবং অর্থনীতির অধিকারী দেশ ও জাতিসমূহের উৎপাদিত পণ্যসমূহের বাজার সম্প্রসারণ করার সম্প্রসারণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা। যেসব পরিকল্পনাকে তারা কোনো কোনো সময় তাদের নিজ জাতি ও দেশের সুরক্ষা নীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে প্রচার করে থাকে। এসব পরিকল্পনার বিষয় আমাদের বুঝতে হবে। ভাষা, যা কিনা শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাহক সেগুলো তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী এবং স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের তৈরি সাহিত্য, সংগীত ও চলচ্চিত্রের বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত করে চলেছে। আমাদের দেশেই বিদেশিদের বিদেশি ভাষার বই এবং চলচ্চিত্রের যে বাজার রয়েছে, সে তুলনায় আমাদের বাঙলা সাহিত্য অথবা চলচ্চিত্রের বিদেশি বাজার নিতান্তই ক্ষুদ্র। এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা যদি আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও চলচ্চিত্রের বিদেশি বাজার সৃষ্টি না করতে পারি এবং সেসব বাজার সম্প্রসারিত না করতে পারি, এই প্রতিযোগিতার কোনো ভবিষ্যৎকালে একদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় বাঙলা ভাষাই বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।
সারা বিশ্বে নানা দেশে ছড়িয়ে প্রায় সোয়া কোটি বাঙালি রয়েছে। যাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম ক্রমেই বাঙলা ভাষা ব্যবহারের সীমিত সুযোগ পাওয়াতে বাঙলা ভাষা, সংগীত অথবা চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এইভাবে চলতে থাকলে প্রবাসী বাঙালি সমাজে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে এবং তারা মানসিকভাবে স¤পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। প্রবাসী বাঙালিদের ব্যক্তি উদ্যোগে গুটিকয়েক বাঙলা ভাষা শিক্ষা স্কুল এবং সংগীত বিদ্যালয় আছে, যা কি-না প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আমাদের বিদেশি দূতাবাসগুলো এই ব্যাপারটাই নজর দেয়ার একটা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে এবং বিদেশে বিশেষ করে যে সকল শহরে অধিক সংখ্যায় প্রবাসী পরিবার রয়েছে সেখানে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং পাশাপাশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যেসব লাইব্রেরিতে বাঙলা ভাষায় রচিত অথবা বাঙলা ভাষায় অনূদিত সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও কলাবিভাগের গ্রন্থসমূহ এবং বাঙলা চলচ্চিত্রের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থাকতে পারে। পাশাপাশি বাঙলা ভাষা ও সংগীত শিক্ষার জন্য স্কুল থাকতে পারে।
আমাদের দেশে যদি ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউএস, রুশ অথবা ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টার থাকতে পারে, তবে প্রবাসে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে আমরা কেন ‘বাঙলা শিল্প-সাহিত্য কেন্দ্র’ নাম দিয়ে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে তাদের পরিচিতি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারি না? এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জাতীয় বাজেটে এই কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখার কথা ভাবি না?
নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
লেখক পরিচিতি :
সরদার ফারুক। জন্ম: ৯ই নভেম্বর, ১৯৬২। কপোতাক্ষ নদের তীর খালিশপুরে, পৈত্রিক নিবাস বরিশালের খালিশপুর। পেশায় বিশষজ্ঞ চিকিৎসক। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। বরিশালে ঘাট শ্রমিকদের আন্দোলন, ডেমরায় শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সংগ্রাম ও বাজিতপুরের জেলেদের লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’ সহ মোট ৭টি।
অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি
সোলায়মান সুমন। জন্ম ১মে ১৯৭৯, চাঁপাই নবাবগঞ্জ। তরুণ বয়সে লেখালেখি শুরু। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস। পেশায় শিক্ষক। ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এর সম্পাদনা পরিষদের সদস্য।
ভগ্ন সময়ের কোলাজ
জন্ম ১৯৮৬, মেহেরপুর। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। ‘অরনি ছোটগল্প’ পুরস্কার ২০১২ ও ‘বৈশাখি টেলিভিশন তোমার গল্পে সবার ঈদ’ পুরস্কার ২০১৩ পেয়েছেন। দ্বিধা, আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ সহ আরো প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ
কবি কবির মুকুল প্রদীপ, এক তরুণ কবির নাম
কবির মুকুল প্রদীপে’র প্রথম কাব্য প্রকাশকালে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, তাঁকে পাঠকবৃন্দের কাছে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ্য কতকটা অতিরিক্ত প্রয়াস, কারণ কবি কবির মুকুল প্রদীপ তার নিজগুণে ও ধ্যানে ইতোমধ্যে পাঠক সমাজে নিজেকে গ্রহণীয় করে তুলতে পেরেছেন এবং নতুন এক রুচিধারা প্রবতর্নের চেষ্টায় যুক্ত রয়েছেন। আমি ফ্লাপে যে মন্তব্য লিখছি তা একজন অগ্রজের মুগ্ধতারই অভিব্যক্তি এবং সংশামুখরতা। তার কবিতা সমাজলগ্ন এবং সুস্থ সমাজচেতনা গড়ায় প্রত্যয়ী। আর তাই তিনি অনায়াশে বলেন ‘স্বৈরাচারী চেয়ার নিয়ে আবারও কয়েকযুগ নিশ্চিন্ত হয়।’ এই নিশ্চিন্ত হওয়ার পেছনের কারিগর হচ্ছে অশ্লীল রাজনীতি, যা জনগণকে ক্রমাগত চেতনাহীন নির্জীব প্রাণীকুলে পরিণত করে রেখেছে। আর তারা দেখে সমুদ্রের জলে পা দিয়ে হেঁটে যাওয়া, সমুদ্রে মিলিয়ে যাওয়া, দেখে সামান্য বিষয় নিয়ে মানুষগুলোর ‘অমানুষ’ আচরণে ডুবে যাওয়া এবং এসব ঘটে বাস্তবজীবনের অঙ্কগুলো সঠিক চেতনায় জারিত করে উপলব্ধি হীনতার কারণে।
কবির মুকুল প্রদীপ প্রথাকে ভাঙতে চান নতুন সমৃদ্ধি আনার জন্য, এবং পুরানো প্রথাবদ্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্মাণচেষ্ট কবিতার নতুন শরীর। কিন্তু প্রথাকে তিনি উপলব্ধি না করে ছুঁড়ে দিতে চান না। তার ক্রিয়া নতুন প্রথা নির্মাণের মধ্যদিয়ে কবিতাকে নতুন সময়ের উপযোগী করা। যাতে পরিবর্তিত সময়ের অভ্যেস রুচি ও চেতনা কাঠামোর নবরূপায়ন সম্ভব হয়। কবির মুকুল প্রদীপ বলেন ‘মৃত্যু-মুহূর্ত পর্যন্ত যে ঘুণে খাওয়া চৌকিটিতে বাবা শুয়ে থাকতেন/আজ ভাঙতে গিয়ে—-পায়া-তক্তার মতো দেখি/ আমিও ঝুরঝুর করে খুলেÑ বর্জের স্তুপে পরিণত হয়ে যাচ্ছি’ মুকুল এ ভাবেই পুরানোকে ভাঙতে গিয়ে তার প্রতি যে মোহ তাকে উসকে দিয়ে নিজ কর্তব্যকে নির্ধারণ করেন ভাঙার প্রত্যয়ে। তিনি নানাভাবে কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার একটা মানসিকতা নিজের মধ্যে গড়ে তুলছেন যা আমরা গত কতকটা সময় ধরে দেখছি। তিনি লিখছেন ভাষার নতুন অর্থযোজনার প্রয়াস নিয়ে।
যেমন তিনি বলেন ‘কোথা থেকে এক বিমূর্ত করুণ সুর ভেসে আসেÑ মনে হয়/ইটের নিচে চাপা পড়ে গোঙ্াচ্ছে বাদামি ঘাস/সর্বভূক কংক্রিট-ড্রাগন আর ধর্মের শৃগাল গিলে খাচ্ছে বনবাঁদাড়, খাল-বিল-মেধা’ তখন তো স্পষ্টই হয় কবি তার বিষয়কে কীভাবে নির্বাচিত করেন, কেন নির্বাচন করেন, কেন তিনি তাঁর আঁকুতিকে নিছক কল্পনা বিলাসে ভাসিয়ে না দিয়ে গড়ে নিচ্ছেন চেতনার শব্দবলীর মেলবন্ধন; আর শিল্পীর সামাজিক দায়িত্বকে কীভাবে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে সক্রিয় হয়েছেন বর্তমানের কবিতায়।
মুকুলের এটা প্রস্তুতি পর্ব, তার উত্থান পর্বে আমরা আরো সংহত শক্তপোক্ত কবিতা পাবো, পাবো নতুন ভাষা নির্মাণের পঙক্তিমালা, যা দৃশ্যমান অর্থ থেকে নানা অর্থকে দ্যোতিত করবে, কাব্যসুন্দরকে প্রজ্ঞাপূর্ণ করবে। আমি খুবই আশাবাদী এই তরুণ কবির কাব্যক্ষমতার বর্তমান প্রকাশে। তার জয় হোক।
-মতিন বৈরাগী
অলীক জোছনা
“সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, পিংক ফ্লয়েড, এনাদার ব্রিক ইন দ্যা ওয়াল, এনাদার ফাকিং ব্রিক ইন দ্যা ওয়াল! দরোজা ভাঙো, শেকল ছেঁড়ো, দেয়াল ভাঙো, এই এডুকেশন সিস্টেম তোমাকে বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে। তোমরা এর নেপথ্য কারিগর হে চতুষ্পদ এবং আলখাল্লা। তোমাদের কারণে আজ তাতিন কলা অনুষদে পড়ে শর্টকার্টে রকেট সায়েন্স শেখার মওকা খোঁজে। আজ একটা হেস্তনেস্ত হবে’
চমৎকার শোনা গেলো এখন দেখা যাক প্রতিপক্ষ কী উত্তর দেয়,
“দুধ দিয়ে আনারস খাওয়ার কারণে শত শত শিশু মারা যাচ্ছে।
সাবধান!
ব্রিজে শত শত শিশুর কাটা মাথা আর রক্তপি- পড়ে আছে
সাবধান!
এইখানে পাপ, ঐখানে পাপ, এইটা করলে গুনা, বুঝলা আমার সুনা?
সাবধান!
অবশ্য এর প্রতিবিধান আছে। তাবিজ কবজ এবং দুয়া-দুরূদ। আপনারা আলোর পথে আসুন। আপনাদের চোখে শক্তিশালী টর্চলাইট মারা হবে। এ দে দিনি ঐডে হেনে”।
আমরা দেখতে পাচ্ছি আলখাল্লা পরিহিত প্রাণীটির হাতে একটি শক্তিশালী টর্চলাইট। তিনি আলো ফেলছেন দুই এলিয়েনের চোখে। চমৎকার একটি আক্রমণ। প্রতিপক্ষকে বেশ মুষড়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এদিকে চতুষ্পদ প্রাণীটি সন্তুষ্ট হয়ে ডাকছে তার নিজের মোটা সুরে। খেলার এ পর্যায়ে পানি পানের বিরতি।
ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা
কবিতার মিথকে অগ্রাহ্য না করেও, পরম্পরাকে কবিতায় সন্দেহ না করেও কবি চঞ্চল নাঈম কবিতার অন্তঃস্থলের নিরূপিত একরৈখিক ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছেন। দুর্বোধ্যতার অর্থ ওঁর কবিতায় দূরবোধ্যতা। সুদূরের বোধ ওঁর কবিতায় নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে। আমরা সাধারণভাবে বাংলা কবিতার যে আবহমান ভাষার সঙ্গে অতি পরিচিত, সেই ভাষাকে ছাড়িয়ে যায় কবি চঞ্চল নাঈমের কবিতা। এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় যেন রয়েছে এক ভাষা বিদ্রোহ। ‘চুপ’ থাকার বিষয়টিকে ওই বিদ্রোহের জন্যই হয়তো কবি সম্মান করছেন ক্ষণিক অবসরে। কবির অবসর আর পাঁচটা মানুষের অবসরের সঙ্গে তুলনীয় হয় না কখনোই। কারণ ভাষার ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য ভাষা, বিষয়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য বিষয় সন্ধান করেন কবি। চঞ্চল নাঈমের ‘নুন আর মশলার ঘ্রাণ’ কবিতাগ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশের নাম ‘ধু ধু মুহূর্ত’ আর দ্বিতীয় অংশ ‘উৎস পাঠ’। ’নুন আর মশলার ঘ্রাণ’ নামকরণে কবিতাটি এই গ্রন্থের সামগ্রিক চিহ্নকে ধারণ করে আছে। বাংলা কবিতার আধুনিক প্রবাহ এবং একই সঙ্গে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল টান চঞ্চল নাঈমের এই গ্রন্থের সকল কবিতাকে বিশেষায়িত করছে। দুই তিন চার পাঁচ পংক্তির কবিতায় তীক্ষ্মতা, একেবারে গদ্যের চলনে মনের সংকেতগুলোকে প্রকাশ আর আধুনিক স্মার্টনেস এইসব কবিতাকে স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করে।
অলোক বিশ্বাস
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
নুন ও মশলার ঘ্রাণ - Nun AAR Moshlar Graan
দেবাশীষ ধর। জন্ম: ৫ই জানুয়ারি, ১৯৮৯। চট্টগ্রাম। কবিতার ছোটকাগজ ‘বাঙাল’ এর সম্পাদক। কবির এটি প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
ফসিলের কারুকাজ
সাহিত্যের অন্যতম সংরূপ ছোটগল্প। জীবনের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোকে গল্পকারগণ শিল্পরূপ দিতে ব্যপ্ত হলেও বোদ্ধাদের তীর্যক চোখের তরবারি দীপ্তিতে শিল্পস্বীকৃতি পেতে বাধা পায়। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণদৃষ্টিতে গল্পের ভাব-সুষমা, আঙ্গিক-প্রাঙ্গিক, গঠনশৈলী, পরিবেশনভঙ্গিতে ত্রুটি দৃশ্যত হলেও সৌমেন দেবনাথের গল্পগুলি পাঠান্তে মনে হয়েছে বর্ণনা নান্দনিক, শিল্পশর্তেও উত্তীর্ণ। দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব কাহিনি-কল্পে মাধুর্য ও সৌন্দর্য সুপরিস্ফুট। সমাজ-সমস্যা, আদর্শ-বৈষম্য, অসামঞ্জস্য, বিসংগতির পাশাপাশি সৌন্দর্যতন্ময়তা, ভাবাদর্শ, স্বপ্ন-কল্পনার সংমিশ্রণে যে গল্পসৌষ্ঠব নির্মিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে ব্যক্তিসত্ত্বা হারালেও সৃষ্টিশীল কর্ম মূর্ত-বিমূর্ত পাতায় বেঁচে থাকে। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে জন্ম সৌমেন দেবনাথের গল্পের ভেতরের যে জীবন বীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ, চারিত্রিক লীলার বিকার-বিকাশ, রস-সৌন্দর্য, যুগ-চিত্ত চৈতন্য উন্মোচিত তা বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক যা কালোত্তীর্ণ হতেও পারে। সৃষ্টিশীল কর্ম শিল্পমানে অনুত্তীর্ণ হলেও সমালোচনার পরিবর্তে সাধুবাদ জানানো যুক্তিযুক্ত। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়’ এর মতই তাঁর এই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘এক উপেনের জীবনালেখ্য’ পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা পাক এবং তাঁর মনের মধ্যের গল্পসাহিত্যের সত্ত্বা চারাটি বৃক্ষ রূপ নিয়ে পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ফুলে-ফলে মঞ্জুরিত-বিকশিত হোক এই প্রত্যাশা থাকলো।
এক উপেনের জীবনালেখ্য
কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর
সম্পাদকীয়, অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, গল্পকার ও গল্প সংখ্যা (দ্বিতীয় পর্ব)
বালাদেশের ১০০ গল্পকার ও তাদের উল্লেখযোগ্য গল্প নিয়ে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন যাত্রার দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হলো আরও ২৫ জন গল্পকারের জীবনী, প্রকাশনা, পুরস্কার ও সম্মাননা, তাদের রচিত গল্প-সাহিত্য নিয়ে সামষ্টিক আলোচনা এবং একটি করে তাদের উল্লেখযোগ্য গল্পের অনুলিপি। সংখ্যাটিতে গল্পকারদের নিয়ে রচনাগুলোর অনুক্রম লেখা প্রাপ্তির ভিত্তিতে বয়সানুক্রমে প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের চৌহদ্দিতে পৃথকভাবে বাংলাদেশের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনায় বাংলা সাহিত্যে পাকিস্তানি ভাবধারা অর্থাৎ রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব প্রসঙ্গে পূর্বে আলোচনা হয়েছে। দেশভাগের আগের সাহিত্য অখণ্ড বঙ্গসাহিত্যের সাথে পরোপুরি অন্বিত হলেও পূর্ববাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রচিত সাহিত্যপ্রবণতা কতিপয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একটু স্বতন্ত্র ছিল। বিশেষত তার আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এর সাহিত্যকে নতুন কাঠামো দিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বা দেশভাগ পরবর্তী পর্যায়ে আরবি-ফার্সি ও ইসলামিকরণের প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল না হলেও সেই প্রচেষ্টার কারণে মূলধারার সাহিত্য সৃজনপ্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু, সকল প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের একনিষ্ঠ কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমকে মুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক রাখার চেষ্টা কার্যকরীভাবে সক্রিয় ছিল। তাই পাকিস্তানপন্থি সাহিত্যগোষ্ঠী সফলতা পায়নি এবং তাদের রচিত সাহিত্য স্থায়ী কোনো রূপ পায়নি এবং একসময় মানুষের স্মৃতি থেকে তা হারিয়ে যায়।
ইতোপূর্বে অনুপ্রাণন সম্পাদকীয়তে এটাও আলোচনা হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সাহিত্যের ভিত্তি সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার আগের কয়েক দশকে। পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সময় উদ্দীপ্ত মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ সমাজের মানস আবিষ্কার করেছিলেন লেখকেরা। পরবর্তীকালে স্বাধীনতার শক্তি, সংহতি, মর্যাদাবোধ ও গৌরব বাংলাদেশের আপামর জনগণের মনে যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল এর প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। এর সাথে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়েছে এই বাংলার নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরান লীলা, নদীমাতৃক সজল মনন, আঞ্চলিক জীবন ও ভাষার বৈচিত্র্য, ছোট ছোট সম্প্রদায় ও পেশাজীবী মানুষের অন্তর্লীন জীবনধারা ও বোধ।
যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমসাময়িকতা সাহিত্যকে রসদ জোগায় ঠিকই তবে তা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকরও বটে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যদ্ধের কারণে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল তা লেখকদের মনে স্থায়ী এক প্রভাব ফেলে ঠিকই; যুদ্ধের নানা ধরনের তাৎপর্যগত অধীরতা নিয়ে সাহিত্যকর্ম তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু সব লেখক এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন কিনা বা এর গভীর তাৎপর্যকে ধারণ করার মতো শক্তি সবার ছিল কিনা- প্রসঙ্গটির যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
আর একটি বিষয়, সাময়িক ঘটনার তাৎক্ষণিক উত্তেজনা গভীর বা শাশ্বত কোনো জীবনবোধ সৃষ্টি করতে পারে না। ক্লাসিক বা ধ্রুপদি সাহিত্য সমসাময়িকতাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। সেকারণে বড় আকারের কোনো ঘটনা নিয়ে মহাআখ্যান বা ধ্রুপদি রচনা লিখতে লেখককে অপেক্ষা করতে হয় অনেকটা সময়। অপেক্ষা করতে হয় ততদিন, যতদিন না যুদ্ধ বা মারির সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব বা মানবসমাজে তার প্রভাব আবিষ্কার করার পূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলাদেশের মহান মক্তিযুদ্ধ নিয়ে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যান বা অনন্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়ে গেছে এরকমটা ভাবা হয়তো সঠিক নয়। বরং, হয়তো আরও দীর্ঘ সময় আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে এই পঞ্চাশ বছরে যা রচিত হয়েছে তার মান নিয়ে কথার পাশাপাশি তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং এই আলোচনার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যেভাবে মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় তার গভীর ও নির্মোহ বয়ান আমরা পেয়েছি সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের লেখকদের রচনায়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর প্রো-পাকিস্তানি শক্তিবলয় যে রাজনৈতিক অপতৎপরতা শুরু করে তার ভয়াবহ পরিণাম এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যে ঘটেনি। তখন মুক্তবুদ্ধির সত্যিকারের লেখকদের জীবনে অমোঘ অন্ধকার নেমে এলেও, অবাধ সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা বাধাপ্রাপ্ত হলেও, সামরিক সরকার বা ছদ্মবেশী সামরিক সরকার নতুন জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব নিয়ে জোরেশোরে দল বেঁধে মাঠে নামলেও, তাদের বশংবদ লেখকেরা তেমন কোনো মানসম্পন্ন সাহিত্য রচনা করতে পারেননি। যার ফলে ৯০ দশকের পর থেকে মূলধারার সাহিত্য দ্রুতই স্বস্থান ফিরে পেতে শুরু করেছিল।
কিন্তু ইদানীং রাজনীতির আপসকামিতার চোরাগলি দিয়ে রক্ষণশীলতা ও মৌলবাদ উদার ও মুক্ত শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে একপ্রকার বাধা হয়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট রয়েছে। যার ফলে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের ছায়া যেন কবি ও কথাসাহিত্যিকদের শিল্প-সাহিত্য চর্চায় ঈষৎ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে যদিও কোনো গভীর সংকট এখনো সৃষ্টি হয়নি তবুও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সাইবার নিরাপত্তার মতো আইন প্রণয়ন সম্পর্কে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন প্রতিবাদ আরও জোরদার হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শিল্প ও সাহিত্য যে কোনো সেন্সরশিপ বা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা প্রকাশের কার্যকরী ক্ষেত্র প্রস্তুত করার হাতিয়ার। শিল্প-সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে সামাজিক অসঙ্গতি ও সংহতি গড়ার এবং উপায়গুলো আবিষ্কার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ পাঠক শিল্প প্রকরণের মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা সন্ধান করার সুযোগ খোজেন। এই মিথস্ক্রিয়ায় রুচি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চলমান ও প্রগতিশীল একটি প্রভাব আছে। কিন্তু, কেউ কেউ এসব বিষয়ে মত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন বা একাত্মতা প্রকাশ না-ও করতে পারেন।
সাহিত্য কেবল অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে জাতিকে উত্তরণের জন্য কাজ করে না, সুন্দরের নানা পথও উন্মোচন করে দেয়। শিল্প-সাহিত্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সন্নিহিত একটি বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠতে আমরা দেখেছি এবং হয়তো চলমান সময়ে ভাঙা-গড়ার প্রক্রিয়ায় কোনো নতুন পথের সন্ধান আমরা পেতে পারি। কিন্তু কোনো কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত ঘটেনি, ঘটবেও না। সেক্ষেত্রে সময়টাকে বদলে দেওয়ার কৌশল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের অনুধাবন করাটা জরুরি।
শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক, অনুপ্রাণন দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা - গল্পকার ও গল্প সংখ্যাঃ দ্বিতীয় পর্ব
পাথুরে মাটির কৃষাণ’ আনোয়ার হোসেন বাদলের সেই উপন্যাস যেখানে আছে টিকে
থাকার লড়াই, দুর্নীতির থাবা, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও প্রত্যাশার ফাটল, আছে কিছু
হৃদয়বান মানুষের আশ্রয় আর নদী ভাঙনের ছোবল। একটি ভালো উপন্যাসে আমরা
অবশ্যই চাইবো সমাজের ভালো-মন্দ আদলের সবটুকু রূপায়ন। ‘পাথুরে মাটির কৃষাণ’
সে ক্ষেত্রে এক অপূর্ব সংযোজন।
দক্ষিণাঞ্চল দ্রোহ আর প্রেমে বরাবরই উর্বর। একদিকে সবুজের সামিয়ানা অন্যদিকে
নদী ভাঙনের হাহাকার। একদিকে প্রতারণা, হয়রানী অন্যদিকে সর্বরিক্ত মানুষের হাত
ধরে বাঁচার সংগ্রামে কতিপয় হৃদয়বান মানুষ। আনোয়ার হোসেন বাদলের চারপাশে
থাকা এইসব মানুষই, ‘পাথুরে মাটির কৃষাণের’ চরিত্র হয়ে উঠেছে। সমাজের কালোসাদা, অন্ধকার-আলো আনোয়ার হোসেন বাদলের উপন্যাসকে এতটাই কাছের করে
তলেছে যে, মনে হচ্ছে একজন প্রক ু ৃত লেখকের কলম থেকে এই ধাক্কাটা দরকার
ছিলো। উপন্যাসের শুরুতে কলকাতা যাবার ভ্রমণযাত্রী হিসেবে যে জমিরুদ্দিনকে দেখা
যায় উপন্যাসের শেষে তাকেই দেখা যায় অনেক উত্তর মিলিয়ে দিচ্ছেন দায়িত্ব নিয়ে।
জমিরুদ্দিনই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যে বিবেকের গান হয়ে পাহারাদার হয়ে
উঠেছেন। আত্মসমালোচনার চাবুক উপন্যাসের গতিকে দুর্বার করেছে। রয়েছে
মনস্তাত্ত্বিক গাঢ়তা।
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বেঁচে থাকার ঐশ্বর্য। এখানেও রয়েছে সত্য, অসত্য কুহক।
কখনো কখনো সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় আড়ালেই থেকে যায়। একজন
শহিদ মুক্তিযোদ্ধার মা বানেছা বুড়ি তাই ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধের
কথা এলেই সেখানে থাকবে রাজাকার অরেছ শিকদারের মতো চরিত্র যাদের দেখলে
আজও ঘৃণার সমুদ্র জেগে ওঠে বানেছা বুড়ির শরীরে। চাঁন গাজী, লালু শরিফ,
প্রতিবাদী যুবক রুস্তম মোল্লা, জেলে জীবন, নদীর তীব্র ভাঙন খেলা, খেটে খাওয়া
মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রাম আনোয়ার হোসেন বাদলের উপন্যাসকে দিয়েছে উত্তাল
উত্তাপ। সেই ধারাবাহিকতায় গভীর অনুরাগ জ্যোৎস্না জামিলা। যা বিরহের জলে ধোয়া
এই কঠিন জীবনের শরীরে দিয়েছে মধুর টান। সমাজের নিয়মে তৈরি দেয়াল বুঝিয়ে
দেয় অসম, অসার প্রতিদিনের ক্ষত। আনোয়ার হোসেন বাদলের উপন্যাস, ‘পাথুরে
মাটির কৃষাণ’ অনেক ছোট ছোট কাহিনি, নানা মানুষ, ভ্রমণপথের বর্ণনায় সমৃদ্ধ।
প্রকৃতি, প্রেম, রাজনীতি, প্রতিবাদ, সরলতায় জীবন্ত এই উপন্যাস হৃদয়বান পাঠকের
কাছে পৌঁছে যাবে আমার বিশ্বাস।
আসমা চৌধুরী
০৮.০৮.২০২২
পাথুরে মাটির কিষাণ - Pathure Matir Kishang
ভূমিকা-
ঘুরে বেড়ানোর স্বভাবটা ছোটবেলা থেকেই ছিলো। এ অভ্যাসটা বাবা‘ই করিয়েছেন। মায়েরও মনে হয় প্রছন্ন প্রশ্রয় ছিলো। যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছি ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি। এরপর পেশাটাও বেছে নিয়েছি ঘুরে বেড়ানোর। এ ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে মানুষকে নানাভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে দুরে বসে মানুষ দেখতে আমার বেশ লাগে। প্রতিদিনের নতুন অভিজ্ঞতা থেকে আজো প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, সংসার থেকে জানার চেষ্টা করছি। মানুষের মনসতত্ত্ব আমাকে বেশ ভাবায়। একজন মানুষের বহুরকম ভাবনা। সে থেকে যদি কিছু অর্জন করে থাকি তা কলমের ভাষায় বলবার এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
অন্যজীবন
গল্পগ্রন্থের নাম-করোনা ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু। এই নামকরণ বলে দেয় আমরা কত রকক জীবাণুর সাথে বসবাস করছি! করোনা-জীবাণুর তান্ডব তো সাম্প্রতিক! জীবন ঘনিষ্ঠ নাকি জীবন-অন্বিষ্ট গল্পকার স্বাতী চৌধুরী! দুটোই সমান প্রাসঙ্গিক; চাইলে তৃতীয় কোনো অভিধা আবিষ্কারও সম্ভব। দৃষ্টি থাকলেই সব দেখা যায় না, যদি না যুক্ত হয় মেধা-প্রজ্ঞার মিশেল। তৃতীয় চোখ তথা অন্তর্দৃষ্টিও জরুরি। স্বাতীর ত্রিনয়ন প্রখর– গেঁথে যেতে পারেন মানুষের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ কাহিনি। মানবিকতার আখ্যান রচনার কুশল ও চাতুর্যে সংবেদী পাঠককে চমকে উঠতে হয় ক্ষণে ক্ষণে। গল্পকার স্বদেশ-সমকাল ও সমাজ-বাস্তবতার অগ্রসর দর্শক। তার ভাষ্যে ঈগলের শ্যেনদৃষ্টি যেমনউচ্চকিত, ডানাভাঙা পাখির উড়ে আসা পালকও আন্দোলিত করে। লেখকের অন্তর্জমিন সততই ক্ষত-বিক্ষত– চৌচির। জাগতিক নানাবিধ রঙ্গ-তামাশায় ধ¦সে পড়ে তাঁর স্বপ্ন-প্রাচীর, উল্টেপাল্টে যায় মানসভূগোল। তাই বলে সেখানে ফুলের সৌরভ, নদীর কলতান, তৃণ কিংবা লতাগুল্মের কোলাহল থাকে না? অচ্যুত জীবনের কথাকার স্বাতী নিস্পৃহভাবে বুনে যান উদ্বাস্তু জীবনের গল্প, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার রকমারি মকশো’র ইতিবৃত্ত
দুর্বলের উপর সবলের আগ্রাসী মনোভাব অন্ধকার-প্রাচীন। দাবিয়ে রাখার অপকৌশলের বিপরীতে সংকট মোকাবেলা করে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। জীবন-শিল্পীর গল্পে খিন্ন জীবনের মুক্তি-প্রচেষ্টা দ্যুতি ছড়ায়। চিনিয়ে দেন সর্বহারার শক্তি-সামর্থ্যরে জায়গা; অস্তিত্বের প্রশ্নে কীভাবে জ্বলে ওঠে দ্রোহের দাবানল! স্বাতী গল্প লেখেন নাকি সমাজতাত্ত্বিকের মতো গ্রাফ আঁকেন! গল্পের শরীরে ক্লেদাক্ত জীবনের নড়াচড়া না থাকলে সাংবাদিকের ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে! প্রচার ও খ্যাতির ডামাডোলের বহু দূরে অবস্থান করেও মূর্ত করে চলেছেন অবাক বাংলার মানুষের মুখ ও মুখশ্রী। কয়েকটি রেখাচিত্রে স্কেচ এঁকে দেওয়া ‘শ্রী’ ও ‘বিশ্রী’র সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক অস্বস্তি বোধ করে, পথ খোঁজে পালানোর! লেখকের ক্ষুরধার বয়ান চাবুক হয়ে তাড়া করে। শেষপর্যন্ত ‘অপরাধী’ পাঠক পথ খুঁজে পায় কি! এখানেই স্বাতী চৌধুরীর সার্থকতা, অনন্যতা।
শফিক হাসান
সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
করোনা ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু
“আমি শুরু থেকেই জানতাম, এরা যেকোন মূল্যে টাইম মেশিনটা তৈরি করেই ছাড়বে!” ক্রিটন তার আর্মচেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, “যেদিন নিকি আমাকে খবর দিলো যে ওরা তথ্যকেন্দ্রে মন্টক প্রজেক্ট সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে, সেদিন থেকেই আমি ওদেরকে আর হালকাভাবে নিই নি। এরপর আমাদের গুপ্তচর রিগা যখন ক্যাপ্টেন নিমোর সাথে ওদের কথোপকথন শুনে আমাকে জানালো যে বিজ্ঞানী ছোকড়াটার মাথায় সময় পরিভ্রমণের চিন্তা খেলেছে পুরনো আমলের একটা চলচ্চিত্রের খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য দেখে, তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে এই ছোকড়ার দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। কেন জানো ক্লড?”
“কেন প্রভু ক্রিটন?”
ক্রিটন ক্লডের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “কারণ আমি এই ছোকড়ার মাঝে আমার স্রষ্টা ডক্টর লির ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। ডক্টর লিও এরকমই ছিলেন, অনেক তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ জিনিসের মাঝেও তিনি অসাধারণ কিছু খুঁজে পেতেন। তিনিও এক অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছিলেন আমাকে তৈরি করে। ডক্টর লির মত মানুষেরা যেমন আমাদের গড়তে পারে, ঠিক তেমনি শত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের গুঁড়িয়ে দেয়ারও ক্ষমতা রাখে, সে আমরা যতই আধুনিক এবং শক্তিশালী হই না কেন। এধরনের মানুষ কোটিতে বড়জোর একজন হয়। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে মানবজাতি টিকে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এধরনের মানুষ জন্মাবার সম্ভাবনা থেকেই যাবে!”
রু
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.