Description
তোমার রঙ্গ মেলায় সঙ্গ খোঁজ, সঙ্গও আছে বন্ধু, শত্রু স্বজনে
তোমার সঙ্গ কি নিজ সঙ্গে আছে? ভিতরে খোঁজ নির্জনে।
$ 1.84 $ 3.06
জহিরুল হক বাপি। জন্ম ১৯৭৯ সালে নোয়াখালির এক মফস্বলী ঝড়ো সন্ধ্যায়।
চলচ্চিত্র শিক্ষায় স্নাতক। ব্লগার ও গণজাগরণ কর্মী।
লেখকের প্রকাশিত অন্যান্য বই:
ঈস্রাফীলের শিঙ্গা বাজছে (উপন্যাস)
শোকগাথা’৭১ (উপন্যাস)
আমি আমাকে খেয়ে বেঁচে আছি (কবিতা)
তোমার রঙ্গ মেলায় সঙ্গ খোঁজ, সঙ্গও আছে বন্ধু, শত্রু স্বজনে
তোমার সঙ্গ কি নিজ সঙ্গে আছে? ভিতরে খোঁজ নির্জনে।
Weight | 0.280 kg |
---|---|
Published Year |
আবু তাহের সরফরাজ। সবার মাঝে থেকেও সে আলাদা। দৃশ্যের ভেতরও অদৃশ্য। বেঁচে থাকতে চান লেখালেখির মাঝে।
যখন আঁধার যখন কুয়াশা
শহীদ ইকবাল। প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক। জন্ম ১৩ আগস্ট, ১৯৭০ রংপুর জেলার পীরগঞ্জে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং এখানেই শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রকাশিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছেÑ কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মুখশ্রীর পটে, কবিতা: মনন ও মনীষা প্রভৃতি। লিটলম্যাগ ‘চিহ্ন’ এর সম্পাদক।
হয়নাকো দেখা
ভূমিকা
লেখালেখি আমার কোনো পেশা নয়, এমন কি নেশাও নয়। তাহলে লিখি কেন? আসলে এখনও পর্যন্ত আমি একজন জীবিত মানুষ। এই সমাজ-সংসারের আরও দশ জন মানুষের একজন। তাদের মতো আমারও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে। সুখ-দুঃখ আছে। হাসি-কান্না আছে। তাদের মতো আমারও কিছু বলার আছে। তাই কিছু বলতে চাই আমি। যেহেতু আমার অদৃষ্ট আমাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, আমি একজন গল্প লিখিয়েই হবো, তাই আমার বলতে চাওয়া কথাগুলো হবে কিছুটা গল্পের মতো। কিন্তু এই গল্প কাকে বলবো? নিশ্চয়ই আমার চার পাশের আর দশ জনকেই বলতে হবে কথাগুলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমি কোনো নেতা নই, কোনো বক্তা নই। শব্দ যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে গেলে আমার কথা কেউ শুনবে না। কারণ, আমি নিতান্তই নিরীহদের একজন। তাই কাগজ-কলমই আমার সম্বল। সুতরাং কোনো শব্দযন্ত্র ছাড়াই বলতে হবে নীরবে। কিন্তু তবু আমাকে বলতে হবে, যা আমি বলতে চাই। বলতে না পরলে হয়তো দম বন্ধ হয়ে আমি মারা যাবো। হয়তো কান দিয়ে শুনতে পাবেন না কথাগুলো, তবে চোখের আলোয় পড়তে পারবেন কাগজে মুদ্রিত কালো অক্ষরে।
জিয়াউল হক
গাইবান্ধা।
ধু-ধু বালুচর
রামিশা বিয়ের পরই মাহীকে কেবল ভালোবাসেনি মাহীও রামিশাকে ভালোবেসে ছিলো। ডাক্তার মাহী বছর দুয়েক পর হঠাৎ স্কলারশিপ পেয়ে রাশিয়ায় পি.এইচ.ডি. করার জন্য চলে যায়। তখন রামিশা দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রতিদিনই কথা হতো ইন্টারনেটে, কথা না হলে যেনো দু’জনার কারো ঘুম হতো না। হঠাৎ করেই দু’বছর যেতে না যেতেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। মানুষের জীবনের বিশ্বাসী ভালোবাসার গল্পগুলো কখনো কখনো বড় অদ্ভুত। গতবাঁধা জীবনে কষ্টের ভিন্নতার গল্প কখনো মনে হয় একই রকম। কখন যে হারিয়ে যায় জীবনে সুখের গানগুলো তা কেই-বা বলতে পারে। প্রেম ভালোবাসা যেনো নিত্য নিকানো উঠানে ঘিরে থাকা স্মৃতি। বদলে যায় প্রণয়ের রীতিনীতি। অথচ রামিশার মনজগত ছিলো এতোটাই প্রখর আর স্বচ্ছ সে পারেনি সর্ম্পক ছিন্ন করে সুহাসকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে যেতে। সন্তানের পিতৃ পরিচয় আর এক দিকে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ীকে একা ফেলে স্বার্থপরের মতো চলে যেতে পারেনি। তাছাড়া মাহীতো ডিভোর্স দেইনি। তাই জীবনে নতুন কোনো ভোরের প্রত্যাশা করেনি। এই চিঠি লেখার ভিতর বাস্তবতার ছোঁয়া অজান্তে থেকে গেলেও যেতে পারে। তবুও একতরফা ভালোবাসার ত্যাগ, সন্তানের পরিচয় তাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য, সন্তান যেনো জানে তার বাবা আছেন। তাই সব কিছুই গোপন করে রামিশা। লড়াই ছিলো তার একার তাই সব সময় একতরফা ভালোবাসায় মাহীকে চিঠি লিখে যেতো। এতো ভালোবাসার সম্পর্কের ভিতর একটি নারীর একাকীত্বের সাথী ছিলো এই চিঠি, আর কল্পনায় ঘেরা তার আর্তনাদের ভিতর স্বপ্ন সে বুনে যেতো অবিরাম…
ভালো থেকো ভালোবাসা
শৌখিন ফটোগ্রাফার শুভ্র। তার পৃথিবী মমতাহীন শূন্যতায় ভরা। একে একে কাছের মানুষদের প্রস্থান তার জীবনকে ক্যামেরার ক্লিকের সাথে বন্দি করে ফেলে। এক সময় তার নিঃসঙ্গ জীবনে আসে দুঃখ ভাগ করে নেওয়ায় আগ্রহী মানুষেরা। হয়তো তারা একই মানুষ। ভিন্ন তাদের নাম। তারা সেতু-ঋতু-রূপা অথবা স্বাতী। যারা শুভ্রর মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা-যৌন বিশ্বাস-উড়ন্ত নেশা ও বিপন্ন ক্ষতের সাথে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় জড়িয়ে যায়। অথবা তারা কেউ না। শুধু শুভ্র। শুধু নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। নিজস্বতায় নিমগ্ন। যে ক্রমশ ঢুকে যায় অচেনা এক জগতে! নিষিদ্ধ ভাষা ও চিঠির ভাঁজে…
গুহা
দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী রমণীদের বসবাস এখানে। ওই সুন্দরীদের রূপের সাথে পাল্লা দেয় যৌবন আর যৌবনের সাথে পাল্লা দেয় রূপ কিন্তু সেটা এক রক্ত নহর বহা একনগরী… স্ত্রীর জন্য ৭ পুরের (গ্রামের) জল ও মাটি সংগ্রহ করে পুব্যা এক যুবক। তবে শর্ত ছিল পথিমধ্যে কারো সাথে কথা-টথা বলতে পারবে না সে। যুবকটি কেন বলছে, হায় নারী! হায় স্ত্রী আমার! তুমি আমার অর্ধেক নও, তুমি আমার পুরো পৃথিবী… এরকম অসংখ্য মজাদার কথামালায় রচিত এই দুই প্রহরের প্রেম ও বিপরীত যাত্রা উপন্যাসটি। শরীফ শামিলের লেখনী শক্তি ও কল্পনা শক্তি প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর প্রথম উপন্যাস দীর্ঘ রাত্রির বিরুদ্ধে জেগে থাকা এর ব্যাপারে লিখেছিলাম, ওটি বাংলা উপন্যাসে এক নতুন সংযোজন। আর এ ‘দুই প্রহরের প্রেম ও বিপরীত যাত্রা’ উপন্যাসটি বাংলা উপন্যাসে আরেক (সম্পূর্ণ) নতুন সংযোজন।
আবু এম ইউসুফ
প্রকাশক
দুই প্রহরের প্রেম ও বিপরীত যাত্রা
উপন্যাস ত্রয়ীর চরিত্র, এলাকা, প্রেক্ষাপট, নিসর্গ—সবই কাল্পনিক। লেখকের তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির শস্ত্রে ব্যবচ্ছেদ করা সমাজের নিগূঢ় সত্য বাস্তবতার ক্যানভাসে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তিনটি উপন্যাস দখল করেছে তিন ধরনের উপচার। ফাঁদ উপন্যাসটির ব্যাপক সংস্করণ হয়েছে। পরিবর্তন, পরিমার্জন ছাড়াও কলেবরও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রথম মুদ্রণের পর এই মলাটের উপন্যাসটি একই পাঠক পাঠ করলে হোঁচট খাবেন। ত্রয়ীর মলাটের বাকি দুটি উপন্যাসের সামান্য সংশোধন হয়েছে।
ফাঁদ
পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নারীর শরীরই প্রধান মাধ্যম। যুগ যুগ ধরে পুরুষের মর্ষকামিতা, ভোগ-বিলাস ও নিষ্পেষণের শিকার নারীদেরকে খাঁচায় বন্দি করতে শুধু পুরুষই নয়, বরং স্খলিত ও হীন চরিত্রের নারীরাও সেই ক্ষেত্র তৈরি করায় ভূমিকা রাখে। এমনই এক নারী সাবরিনা তার বাসায় কিশোর বয়সী মেয়েদের ফাঁদে ফেলে পতিতাবৃত্তিতে লাগিয়ে বিত্তবৈভবের মালিক হয় সে। সাবরিনার মতো অনেক মাধুকরীর প্ররোচনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় শহরের অনেক বাসায় পতিতাবৃত্তির বিস্তার লাভ করে। শিকার হয় পুষ্পর মতো নিষ্পাপ কিশোরীরা। সাবরিনার যোগসাজশে আপন ভগ্নিপতি নওয়াব আলী পুষ্পকে দেহ-ব্যবসায় বাধ্য করায়। এক রাতের ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙেপড়া পুষ্প প্রতিশোধ স্পৃহায় নওয়াব আলীর ছোট বোন টুনিকে এই ফাঁদে ফেলে ঢাকায় নিয়ে আসে। টুনিকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে গড়ায়। এই উপন্যাসের মূল কাহিনি থেকে একটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচিত্র (প্রিয়াংকা) নির্মাণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
শেষ কথাটি যাও বলে
একটি অভিজাত, নিপাট ও নিষ্কাম প্রেমের আখ্যান। শুরুর দিকে ত্রিভুজ প্রেমের ইঙ্গিত থাকলেও ঘটনাক্রমে প্রথম প্রেমিকার নিরাসক্তির কারণে দুজনের প্রেমই পরিণতির দিকে গড়ায়। বাংলাদেশের ছয়জন পেশাজীবীর কিছুদিনের প্রণোদনা প্রশিক্ষণের সময় দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি নির্মিত হয়। প্রেমের গভীর স্পন্দন অনুভূত হয় বাংলাদেশের নির্ঝর এবং দক্ষিণ ভারতের ট্যুরিস্ট গাইড অধরার বুকের গহিনে।
জলের লিখন
যুদ্ধকন্যা মারিয়াকে ঘিরে নির্মিত হয় জলের লিখন। কোনো এক অশুভ মুহূর্তে কলহপ্রিয় মাকে আতিকের বাবা তালাক দেওয়ার পর যখন হিল্লা বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল তখন, এরূপ হিল্লা বিয়ের মতো ন্যক্কারজনক ও অপমানজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেতে মেধাবী কিশোর গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে সার্টিফিকেটবিহীন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে একটি এনজিওতে চাকরি পায় এবং যুদ্ধকন্যা মারিয়ার দোভাষীর কাজ করার সময় উভয়ের মধ্যে সরল প্রেম-রসায়নের সৃষ্টি হয়। অবৈধ সন্তানের মা পারভিনের সঙ্গে প্রেমের কলি ফুটলেও পাপড়ি মেলেনি। উপন্যাসটির বিস্তর ক্যানভাস জুড়ে খোদিত হয়েছে এনজিওর কুহনিকা।
জনপ্রিয় লেখক না হলে তিনটি উপন্যাসকে একটি মলাটে মুদ্রণ নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যবসায়িক দিক থেকে অসাফল্যের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনেও এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ বোঝার কঠিন দায় নিয়ে অনুপ্রাণন প্রকাশনের পক্ষ থেকে আবু ইউসুফ ভাই বড় ঋণী করলেন। সীমাহীন আন্তরিকতা, অত্যন্ত যত্ন ও দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘উপন্যাস ত্রয়ী’ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রতি রইল অশেষ কৃতজ্ঞতা।
উপন্যাস ত্রয়ী
মফস্বলের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বীথিকা রায় তথা বীথির জন্ম। যে শৈশবেই একাধিক উন্নত রাষ্ট্র ভ্রমণ এবং ধ্র”পদী গ্রন্থাদি পাঠ করে বাঙালি হিসেবে নিজের অবস্থান বুঝতে পারে। একইসঙ্গে স্বনামধন্য বাঙালিদের গৌরবময় কর্মকাণ্ডের ইতিহাসও পাঠ করে—কিন্তু তাঁদের প্রতি বর্তমান বাঙালি জাতির বিস্মরণ আর চারিত্রিক অধঃপতন দেখে বিচলিতবোধ করে। উন্নত বিশ্বে বাঙালির বৈষম্যের শিকার হওয়াও তাকে আঘাত করে। ফলে তার ভেতরে দেশোদ্ধারের জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটতে থাকে।
বীথিকা জাতিগঠনের পেছনে যে সংস্কারমুক্ত আধুনিক শিক্ষাই প্রধান নিয়ামক সেটা ভালো করেই বুঝতে পারে। আরও অনুধাবন করে, বহির্বিশ্বের জ্ঞানে ঋদ্ধ, অভিজ্ঞ, দেশাত্ববোধসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষকরাই কেবল জাতি গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে—রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সেনাপ্রধান নয়।
ভবিষ্যতের সেই রকম একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি ও সম্ভাবনা বীথি দেখতে পেয়েছিল কিশোর শংকরের মধ্যে। কিন্তু সামাজিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে ছেলেটি ছিল খুবই বিভ্রান্ত এবং দুর্বল তথাপি, একরোখা—ঋজু বীথি হাল না ছেড়ে শংকরকে তার স্বপ্নের আরাধ্য আদর্শ শিক্ষকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়। এর জন্য তাকে বিনিয়োগ করতে হয় যৌবনের মূল্যবান দীর্ঘ সতেরটি বসন্ত। কিন্তু হারানোর বেদনায় বীথি ব্যথিত নয়, বরং সে সফল, তৃপ্ত এই কারণে যে, দেশ ও জাতি একজন মহান শিক্ষককে পেয়েছে, যে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও স্বদেশপ্রত্যাগত। তারই ইতিবৃত্ত এই উপন্যাস।
প্রবীর বিকাশ সরকার
অপরাহ্ণে বৃষ্টি
মানুষের জীবন তো গল্পময়। গল্প ছাড়া জীবন হয় না। কেউ সে গল্প অপরকে শুনিয়ে তৃপ্তি পায়। কেউ নিজের মধ্যে গল্প পুষে রেখে জীবনকে ভোগ করে। কোনো একজনকে গল্প শুনাতে ইচ্ছে ছিল। সে গল্পের মধ্যে ডুব দেওয়া আর হয়নি। সে গল্পটা সামনাসামনি শুনাতেও পারিনি ।
তবে শুরুটা করেছিলাম গল্প শোনানোর জন্য, সেই শুরুটা নেশাতে পরিণত হয়ে গেছে। সেই কোনো একজন তো চোখের আড়ালে থাকে, মনের আড়াল হয়নি। তাই গল্প শুনাই আড়ালে-আবডালে- অন্তরালে।
গল্পের কথা বলার কারণ, আমি আসলে গল্পই লিখি। লিখতে লিখতে গল্পটি উপন্যাসে রূপ নেবে কিনা, সেটাও আমার জানা নেই। উপন্যাস তো বৃহৎ পরিসরের বিষয়। তাই এক্ষেত্রে আমি শিশুই। একটি কথা জোর দিয়েই বলতে পারি, অভিজ্ঞতার বাইরে আমি লিখতে পারি না। যেভাবেই হোক অভিজ্ঞতাটা তার জায়গা দখল করে নেয়। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি, বাস্তবতার বাইরে আমার লেখাতে কাল্পনিক বলে কিছু নেই। যদি আগেই বুঝতাম গল্প দিয়ে জীবন চলে তাহলে হয়তো লিখতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আষাঢ়ে বৃষ্টি পড়ার মত।
আমার গল্প প্রকাশ হবে, ছড়িয়ে যাবে, এমন ভাবনা মাথায় ছিল না। শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক ‘অনুপ্রাণন’ গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে আমার চেতনাকে জাগ্রত করে দিয়েছে। গল্প লিখতে লিখতে তিনটি উপন্যাসও লিখে ফেলেছি।
“স্বপ্ন জলে জ্যোৎস্না” তৃতীয় উপন্যাস। পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে বিমুখ হইনি। বরং বুকভরা আনন্দ পেয়েছি। কৃতজ্ঞতা জানাই অনুপ্রাণন প্রকাশকের স্বত্বাধিকারী শ্রদ্ধেয় আবু এম ইউসুফ ভাইকে।
মফস্বলে থেকে লেখক হয়ে, বই প্রকাশ করা বড়ই কঠিন কাজ। অথচ সেই কঠিন কাজটা অনেক অনেক সহজ করে দিয়েছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। আবারও অসংখ্য ধন্যবাদসহ ও কৃতজ্ঞতা জানাই অনুপ্রাণন প্রকাশনের সাথে জড়িতে সকলকে।
স্বপ্ন জলে জ্যোৎস্না
লেখক পরিচিতিঃ
নিজেকে ঘটা করে পরিচয় করিয়ে কি লাভ । আমার এই উপন্যাস পছন্দ হলে এতেই আমার স্বার্থকতা। সবাই ভালবাসুক এই গল্পটা।সবাই ধারণ করুক এই বইটা।
এই পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা ৯টি
১) আমার মা(ভোরের শিশির প্রকাশন
২) বার্লিনে বন্ধুত্ব(ভোরের শিশির প্রকাশন)
৩) ভুতের স্বর্নতাবিজ( বেহুলা বাংলা প্রকাশন)
৪) অল্প কথার গল্প (দ্যুপ্রকাশন)
৫) লাভার্স পয়েন্ট (বেহুলা বাংলা)
৬)তিন প্রজন্মের কাব্য (ছায়ানীড়)
৭) দার্জিলিং কনফেশন (ছোট গল্প) অনুপ্রাণন
৮) উইনিং সেলস এন্ড মার্কেটিং (বেহুলা বাংলা)
৯) পূর্বজদের গুহায় বুদ্ধের দর্শন।(অনুপ্রাণন)
পূর্বজদের গুহায় বুদ্ধের দর্শন
জন্ম বিক্রমপুরের দিঘলী গ্রামে। ছোটবেলা থেকে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত। বর্তমানে বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের কার্যকরী সদস্য। দৈনিক আমাদের সময়ের প্রাক্তন সাব-এডিটর।
গন্তব্যহীন দুঃখবিলাস
ভূমিকা
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ার হোসেন বাদল চিকিৎসার জন্যে কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের ভেলোর শহরে গিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন তার আজীবন সহযাত্রী, সহযোদ্ধা আমাদের প্রিয় সুলতানা ভাবী। বাদল ভাই ভাবীর সাথে নানান জায়গার ছবি তুলছেন আর তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা লিখে পোস্ট দিচ্ছেন। আমিও মজা করে কমেন্ট করে যাচ্ছি সেইসব পোস্টে। প্রথমদিকে সাদামাটা পোস্ট ভেবেই গভীরে তেমন ঢোকার চেষ্টা করিনি। কিন্তু সময় যতোই যেতে থাকে পোস্টগুলো আমাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে। একসময়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাদল ভাইয়ের ভ্রমণবৃত্তান্তের অপেক্ষায় থাকি, কখন তিনি পোস্ট দিবেন, কখন সেই আখ্যানগুলো পড়বো। অবস্থা যখন এমন পর্যায়ে একদিন বলেই ফেললাম যে লেখাগুলোকে মলাটবদ্ধ করলে একটি ভালো বই হতে পারে। উপযাচক হয়ে এটাও বললাম যে যদি কখনো লেখাগুলো মলাটবদ্ধ হয় আমিই লিখবো এর মুখবন্ধ।
বলেতো দিয়েছি কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে এই গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপবে! সেদিন হঠাৎই বাদল ভাইয়ের ফোন, ‘কমরেড, ভারতে কয়েকদিন নামের বইটি আসছে আগামী বইমেলায়। ভূমিকা কিন্তু আপনাকেই লিখতে হবে।’ আমিতো সপ্তম আসমান থেকে পড়লাম একেবারে জমিতে।
যাইহোক, সচরাচর ভ্রমণকাহিনী বলতে আমরা যা বুঝি আনোয়ার হোসেন বাদল এর ‘ভারতে কয়েকদিন’ সে অর্থে কিন্তু কোনো ভ্রমণকাহিনী নয়। বরং এটি হচ্ছে সাদা চোখে দেখা সাদামাটা অভিজ্ঞতার এক নির্মোহ বিবরণ, কিছু জানা কথা, কিছু অজানা তথ্যের প্রকাশ।
বইটি এমন সহজ-সরল ভাষায় লিখিত যে—পড়ার সময় মনে হতে পারে পাঠক বই পড়ছেন না বরং লেখকের সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভারতের নানান শহর। নিজের চোখেই পাঠক দেখছেন ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থাপনা আর বিচিত্র প্রকৃতি।
আলোচ্য বইটিতে পাঠকের পরিচয় ঘটবে ভারতের ঐতিহাসিক শহর কোলকাতা, তৃতীয় বৃহত্তম শহর দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই আর ভেলোরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্পসংস্কৃতি ও স্থাপত্যকর্মের সাথে।
বইটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমরকীর্তি হিসেবে স্বীকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
কবি হানিফ মোহাম্মদ
তালেপুর, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।
ভারতে কয়েকদিন
ফাঁদ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় দুটি চরিত্র ছিল পুষ্প ও কাদের। ফাঁদ উপন্যাসটি পাঠকের প্রশংসা পাওয়ার পর মনে হলো এই চরিত্র দুটি দিয়ে উপন্যাসটিকে সম্প্রসারণ করা যায় এবং তখন এর দ্বিতীয় খ- লেখার পরিকল্পনা করা হয়। আপন ভগ্নিপতি দ্বারা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী পুষ্প বাধ্য হয়ে আবাসিক পতিতা হয়ে ধন্যঢ্য পুরুষের মনোরঞ্জন করে। একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভগ্নিপতির ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটানোর ফলে ভগ্নিপতি আত্মহত্যা করে এবং পুষ্পর জেল হয়। সেই বাসার দারোয়ান ছিল এমএ পড়–য়া কাদের। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুষ্প ও প্রেমিক কাদের নতুন করে জীবনের স্বপ্ন দেখে, ঘর বাঁধে। অস্থিত্ববাদী কাদের ও পুষ্প যথাসম্ভব লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কঠোর পরিশ্রম করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। কিন্তু সমাজ কি আর তাদের জন্য সেই সুযোগ অবারিত? সামাজিক ও পারিবারিক নানা রকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় তাদেরকে প্রতি নিয়ত। দুটি জমজ সন্তানও হয়। কঠোর পরিশ্রমী কাদের যখন একটি স্বপ্নময় সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখছিল তখনই তার জীবনে নেমে আসে এক কঠিন প্রাণহারী আঘাত।
এই উপন্যাস ধারণ করেছে সময়। চরিত্রগুলোর নির্মাণ ও মনস্তাত্ত্বিক নিবিড় বিশ্লেষণ পাশাপাশি নব্বই দশকের শেষ এবং শূন্য দশকের শুরুর দিককার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ও ঘটনাবলি উপন্যাসটির ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
পুষ্পকথা
Dwitiyo Shrabone Prothom Kadam
সম্পাদকীয়, নবম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা-
কবি ও কবিতার অনুপ্রাণন—
সূচনা লগ্ন থেকেই শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন, সাহিত্যের এই বিশেষ শাখা অর্থাৎ কবিতা বিভাগটির উপর বিশেষ যত্ন দিয়ে এসেছে। কেননা সাহিত্য রচনায় কবিতাই একমাত্র শাখা যেখানে কবির অন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা অনুভূতিটি উপচে বের হয় কবিতায়। যেখানে কোনো প্লট-পরিকল্পনা বা পূর্বপ্রস্তুতির চিহ্ন খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। হতে পারে কবির সেই কথাগুলো নির্গত হয়েছিল কোনো অস্থির অথবা কোনো বেদনার অথবা কোন শান্ত-সমাহিত ধ্যানের মুহূর্তে। হৃদয় মথিত কোনো নান্দনিক অথবা কোনো মানবতবাদী ভাব সৃষ্টি ও রচনার গভীর অনুপ্রেরণায়। কিন্তু স্বতস্ফুর্তভাবে নির্গত শক্তিশালী কোনো অনুভূতি যে কোনো আকারে প্রকাশিত হলেই কী সেটা কবিতা হয়ে উঠতে পারে? কবিতা—সাহিত্য রচনাশৈলীর এমনই একটি বিশেষ ধারা যেখানে শব্দ ও ছন্দ পার¯পরিকভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখা যায়। কবিতায় শব্দগুলো একসাথে জুড়ে থেকে কোনো প্রকার উচ্চারণ, ধ্বনি, চিত্র অথবা চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে থাকে যা কি-না সরাসরি বর্ণনা করতে গেলে হতে পারে অনেক জটিল অথবা বিমূর্ত। কবিতা রচনায় প্রচ্ছন্ন থাকে ছন্দ ও মাত্রা অর্থাৎ অক্ষর অথবা শব্দাংশের সংখ্যার সম্মিলন অথবা বিন্যাস। কিন্তু, কবিতার এসব গঠন প্রক্রিয়া সবসময় সচেতনভাবে কতটুকু কবির মনে ঘটে থাকে, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমান করা কঠিন।
বাংলা ভাষার হাজার বছরের ইতিহাসে সাহিত্যের আরম্ভ অনেকটাই গীতিকবিতা দিয়েই। যেখানে উচ্চারণ ও ছন্দের মিলের সাথে যুক্ত ছিল সুর। বিষয়বস্তুতে গভীর ব্যক্তি অনুভূতির থেকে অগ্রাধিকার পেল সামাজিক-রাজনৈতিক কাহিনী। কেননা, তখন সমাজই ছিল সব, ব্যক্তির অস্তিত্ব একপ্রকার ছিল না বললেই চলে। তাই সেসব কাহিনীতে ছিল সমাজ ও রাজনীতি, ক্ষেত্রবিশেষে শাসকের গুনকীর্তন আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা, রোমান্টিক প্রেমের জনপ্রিয় আখ্যান, যৌনতা, অথবা বীরের শৌর্য-বীর্য, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম অথবা বিবাহ।
চর্যাপদ দিয়েই বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন। চর্যাপদ কতগুলো আশ্চর্য বিপরীতধর্মী কবিতার সমাহার। তাই চর্যাপদের আরেক নাম—চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়। চর্যাপদে বর্ণিত সাধন তত্ত্ব, তৎকালীন বাংলার সমাজ জীবনের চিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশের অপরূপ বর্ণনা, সকলই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে প্রমাণিত ও গৃহীত। কিন্তু, চর্যাপদের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধীতা, অভিজাতদের ধর্মদর্শন ও ধর্মানুষ্ঠানের প্রতি বিদ্রুপ উচ্চারণ ইত্যাদী’তে লোকায়তিক বৌদ্ধ ও জৈনরা যে সেই খ্রিস্টপূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণ্য-বিধানকে অমান্য করে এসেছে, তারই কতক প্রতিচ্ছবি মেলে চর্যাপদের কোনো কোনো পদ্যে। বাঙালি জাতিসত্ত্বার মূলে রয়েছে—হিন্দু লৌকিক, বৌদ্ধ লৌকিক, ইসলাম লৌকিক; এরকম সকল লৌকিকগণ। এই লৌকিক অনভিজাত বা প্রাকৃত বাঙালিই হচ্ছে প্রকৃত বাঙালি। আঠারো শতক পর্যন্ত রচিত সাহিত্য এই প্রাকৃত বাঙালির উপভোগ্য ছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, বাংলায় রূপান্তরিত রামায়ণ-মহাভারত-ভগবত, বৈষ্ণব পদাবলি, চৈতন্যের জীবনী, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, ইত্যাদী সকল সাহিত্যের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। সে সময়ের লোকসাধারণের কবিরা এই ‘লৌকিক করিয়া’ ‘লৌকিকের মতে’, মূলধারায় কবিতা তথা সাহিত্য রচনা করতেন।
কিন্তু তারপর পরে একটি দীর্ঘ ছেদ। বাংলা সাহিত্যে কথিত অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে বড়ু চণ্ডীদাস নিয়ে আসেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলাচ্ছলে জীবাত্মা-পরমাত্মা লীলা লীলায়িত হলেও মধ্যযুগের শুরুতে একাব্য অনবদ্য ভূমিকা রাখে। তবে মধ্যযুগ বিশেষভাবেই বিখ্যাত মঙ্গলকাব্যের জন্য। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শ্রেণির মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। যদিও মঙ্গলকাব্যগুলোর রূপ প্রায় একই রকম। কতিপয় মঙ্গলকাব্যে কবিতার ভারী যাদু থাকলেও সবচেয়ে বেশি ছিল সমকালীন সামাজিক জীবনের বোধ ও পরিচয়। বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাস জানতে হলে মঙ্গলকাব্য অবশ্যপাঠ্য। বৈষ্ণব পদাবলি আমাদের স্বপ্নে বিভোর করে। বৈষ্ণব পদাবলির পাত্র-পাত্রী কৃষ্ণ-রাধাকে কেন্দ্র করে যে কবিতাগুলো রচিত হয়েছিলো সেগুলো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
রাজসভায় রচিত হলেও মধ্যযুগের সাহিত্য কেবল অভিজাতদের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। মধ্যযুগে সামাজিক বৈষম্য প্রকট থাকলেও, পুরোহিত-মোল্লাদের দাপট থাকলেও, অভিজাত কর্তৃক উৎপীড়ন থাকলেও, সে যুগের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাংলার প্রাকৃতজনেরই প্রাধান্য ছিল। যারা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসবিদ, তাদের অনেকের মতে, মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি হলেন ভারতচন্দ্র আর আধুনিক যুগের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন। মাঝখানে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হলো ‘যুগসন্ধির কবি’।
মধ্যযুগের বিদায়ী দামামা বেজে ওঠে, যখন ১৭৫৭-তে আমরা স্বাধীনতা হারাই। বণিক শাসক হয়। অনেক পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের পরিবর্তন বা পতন ঘটে। ভারতচন্দ্রের রচনায় দেখা যায় পতনের ছাপ। বলা হয়ে থাকে ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ এই সত্তর বছর বাংলা সাহিত্যের পতন ঘটেছিল। সে সময় কবিয়াল ও শায়েরদের উদ্ভবে এক নিম্নরুচি সম্পন্ন সাহিত্য রচিত হয়। অর্থাৎ, কবিগান। কবিগানকে গর্ব করার মতো সাহিত্য বলতে অনেকে নারাজ। কবিয়াল ও শায়েররা বিকিয়ে গেলেও কোনো কোনো কবিগান বা শায়েরি আজো বাংলার প্রাকৃতজনের মনে শেকড় গেড়ে আছে সেসবের অনবদ্য ছন্দ ও সুরের নান্দনিকতার কারণে।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা আনেন মাইকেল মধুসূদন। মহাকাব্য রচনা করে বাংলা কবিতার রূপ বদলে দেন। শুধু তাই নয় তিনি বাংলা পয়ারকে এক নতুন রূপে উপস্থাপন করেন। ব্যবহার ক্লান্ত ছন্দরীতিকে মধুসূদন করে তোলেন প্রবাহমান (অমিত্রাক্ষর)। এর আগে অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় আধুনিকতার হাল্কা আলোকচ্ছটা দেখা যায়। তবে মধুসূদন একাই এক ধাক্কায় বাংলা সাহিত্যকে অনেক এগিয়ে দিয়ে গেছেন। মধুসূদনের দেখাদেখি অনেকে (হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, কায়কোবাদ) মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেন। কিন্তু, শেষপর্যন্ত ওগুলো মহাকাব্য না হয়ে আখ্যানকাব্য হয়ে ওঠে।
বাংলা কবিতায় মহাকাব্যের ধুমধাম চলাকালে রোমান্টিকতা নিয়ে উঁকি দেন বিহারীলাল। বাংলা কবিতার তিনি-ই প্রথম রোমান্টিক ও খাঁটি আধুনিক কবি। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘ভোরের পাখি’ বলেছেন। আত্মভাবপ্রধান কবিতার জন্ম বিহারীলালের হাতে হলেও বিকাশ ঘটে রবীন্দ্রনাথের হাতে। অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতনের মত বিহারীলাল চলে গেলেও তার কবিতার পথ ধরে আসে—সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অক্ষয়কুমার বড়াল, ডিএল রায় ও রবীন্দ্রনাথ। প্রথম মহাযুদ্ধের মাধ্যমে বদলে যাওয়া ইউরোপীয় চেতনার প্রভাব পড়ে আমাদের জীবন ও সাহিত্যে। দু’দণ্ড দেরিতে হলেও সেই প্রভাব আমাদের কবিতায় এসে ভালভাবেই পড়ে। আধুনিক কবিতাগুলো বিশশতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে ওঠে।
বিশশতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-যুগ চলাকালে রবীন্দ্রাগুনে পুড়েছেন অনেকেই। তবে রবীন্দ্র-বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি একইসাথে প্রেম ও দ্রোহের কবি। তার কবিতায় যেমন বিদ্রোহ আছে তেমনি আছে কৈশোরিক প্রেমের কাতরতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক কবিতার রমরমা হাট বসে বাংলা সাহিত্যে। বাংলা কবিতায় বাঙালির প্রথাগত বিশ্বাস, সুন্দর, কল্যাণ, আবেগ, স্বপ্ন, সুখ-দুঃখ ও কাতরতা বিসর্জন দিয়ে আধুনিক কবিগণ নগরের কথা ও ক্লান্তি, অবিশ্বাস, নিরাশার কথা ফুটিয়ে তোলেন কবিতায়। কবিতায় পাল্টে যায় বাঙালির চেতনা। বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু ও অমিয়, এই পাঁচজন কবিকে রবীন্দ্রনাথের পর আধুনিক কবিতা সৃষ্টিকারী বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু তারপর অচিরেই এই পঞ্চকবিকে অনুসরণ করে আসলেন সমর ও সুকান্ত।
সাহিত্যে রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতা মুখোমুখী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় প্রায়শই। বিশ শতকের গোড়াতেই আধুনিক সাহিত্যকে অশালীন বলে গালিগালাজ করে প্রবন্ধ ও বই ছাপেন ঊনিশ শতকের বিভিন্ন রক্ষণশীলেরা। আসলে সাহিত্য কখনো অশালীন বা অশ্লীল হয় না। বিশেষ করে কবিতা। কবিতায় সব বলা যায় সব রকম ভাবে। এছাড়া অশ্লীল কথাটি আপেক্ষিক। শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে বাগ-বিতণ্ডা না করে বরং সাহিত্যকে নিরপেক্ষ মন ও মননেই দেখা উচিত। ইতিহাস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যখনই রাষ্ট্রযন্ত্র বা শাসকশ্রেণি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে তখনই যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখচ্ছবি, অর্থাৎ কবি-সাহিত্যিকরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবিতা অথবা নানা ধরনের গদ্য রচনার মাধ্যমে। যে সাহিত্যগুলো নানাভাবে বিভিন্ন আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে। ঊনবিংশ শতককে কখনো বলা যায় বাংলা গণসংগীতের স্ফুরণকাল। সেভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও দেশ ভাগের পর পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনের হাত ধরে রচিত হয়েছে বহু প্রতিবাদী সাহিত্য, কবিতা ও গণসংগীত। পাকিস্তানিরা প্রথম যখন আমাদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানলো, শুরু হলো আন্দোলন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন একুশের প্রথম এবং অমর এক কবিতা—‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’। তবে একুশের প্রথম কবিতাটি ইতিহাস থেকে প্রায় হারিয়েই গেছে। অর্থাৎ, হানাদারদের বহু হয়রানি ও তল্লাশির দাপটে কবিতাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিসহ কবির বাসা কয়েকবার সার্চ করে লুকানো দু’একটি কপি পর্যন্ত নিয়ে যায় পুলিশ। পরবর্তীতে কবিতাটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে লিখলেন শামসুর রাহমান, যা আন্দোলনকে বেগবান ও সফল করে তুললো। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত হয়েছে বহু প্রতিবাদী ও প্রেরণাদীপ্ত কবিতা, সাহিত্য এবং গণসংগীত। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্মলেন্দু গুণ সামরিক শাসনের কড়া পাহারার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে (১৯৭৭) বীরদর্পে পড়ে শোনালেন তার অগ্নিঝরা কবিতা—
“সমবেত সকলের মত আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায়
শেখ মুজিবের কথা বলি।”
নির্মলেন্দু গুণ-ই প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কবিতার বিষয় করে তুললেন। তারপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখলেন জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামালসহ আরো অনেকে। অর্জুনের মত বীর সময় দোষে নপুংসক সাঁজলেও কবি কখনো তেমনটি হয় না বা হওয়া উচিত না। কবি হবে মজলুম, প্রয়োজনে নির্বাসিত। বলবে মানুষের (সংখ্যাগরিষ্ঠ) কথা, মানবতার কথা। রুদ্র পেলেন বাতাসে লাশের গন্ধ আর তসলিমা সব বয়স্কা বালিকাদের গোল্লা হতে ছুটে বেরুনোর আহ্বান জানালেন কবিতায়। তারপর ’৯০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় কিছু প্রতিবাদী কবিতা ও গণসংগীত।
ইতিহাসের একটি বিশ্লেষণে প্রতিভাত হয় যে, ’৯০-এর দশকের পর থেকে কবিতার পাঠক সংখ্যায় যেন ভাটা পড়েছে। ইদানীং কবি দেখলেই বলাবলি শুরু হয়—কবিতার এখন আর দিন নেই, কবিতা এখন পাঠক খায় না, কবিতার বই বাজারে কাটে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এখানেই ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে যে তথাপি কবির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশেষতঃ কবিতা প্রকাশ করতে এখন আর প্রকাশকের পেছনে লাইন দিতে হয় না। চাইলেই ফেসবুক ওয়ালে কবিতা ছুড়ে দেয়া যায়। হাইকোর্টের সামনে থেকে মূর্তি সরানো ও অন্যত্র স্থাপন নিয়ে এখনি সহস্র কবিতা ছুড়ে দেয়া যায়। এখন মিনিটে মিনিটে রচিত হচ্ছে কবিদের ভ্রুণের চেয়েও বেশি সংখ্যক কবিতা। প্রযুক্তির কল্যাণে কবি ও কবিতার পাঠক এখন একবারে মুখোমুখী দণ্ডায়মান। এটা ভাল। কিছুদিন পূর্বেও যেটা সম্ভব ছিল না খুব বেশি। শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন বা আগ্রাসন কি এখন হচ্ছে না? তবে আমরা সে রকম কোনো কবিতা পাচ্ছি না—কিন্তু কেন?
আজকাল কবিতার বিষয় কী কী, সেটা কিন্তু আমরা হাতের মুঠোয়-ই দেখতে পাচ্ছি। আমরা আজ যা হাতের মুঠোয় দেখতে পাচ্ছি তা যদি নজরুল আগেই বলে যেতে পারেন তার কবিতায়, তাহলে কী আমাদের এখনকার কবিগণ আগামী বিশ্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাদের কবিতায়, অথবা এর চেয়েও পরবর্তী কিছু। আজকাল কবিতায় নারীকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, বিদ্যমান প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র কবিতায় কতোটা স্থান পাচ্ছে নিশ্চয়ই চর্যাপদে বর্ণিত বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর এখনকার সৌন্দর্য এক হবে না। মঙ্গলকাব্য পড়ে যদি বাংলাদেশের মধ্যযুগের সামাজিক অবস্থা (ইতিহাস) জানা যায়, তবে আমাদের আজকের কবিদের কবিতা বা সাহিত্যে সমকালীন পঁচনশীল পুঁজিবাদের ভোগসর্বস্ব কায়েমী স্বার্থবাদী ও পাশাপাশি আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানসিকতার যে সমকালীন সমাজ বাস্তবতা, সেই সমাজ বাস্তবতার ঠাঁই পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাঙালির জমিতে কলের লাঙল পড়েছে, ছনের চাল হয়েছে টিনের এবং সেই চালে বসেছে কাক, শাদা কাক। মোড় নিচ্ছে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা। নেওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। সময়কে তো আর অস্বীকার করা যায় না। কালে কালে মহাকাল অবধি কবিগণই মানুষের সমস্ত অনুভূতি কে বাঁচিয়ে রাখে। কবিদের গর্ভেই বাঁচে মানুষ। আমাদের এই কবিসকল কি পারবেন মানুষের মানবিক অনুভূতিগুলোকে কবিতায় বন্দি করে মহাকাল অবধি দীর্ঘজীবন দিতে নাকি ফেসবুক বা প্রযুক্তি নামক কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন কাক ও কাল যত কিছুকেই আমরা আপন করে নিই না কেন? তাতে কোনো দোষ নেই, তবে লৌকিক বাংলার গভীর মানবিক চেতনার স্বকীয়তা কতটুকু বজায় থাকছে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে বাংলা সাহিত্যের দেবী চিরকাল কাব্যজীবি, কবিতার স্বাদ ছাড়া সে বাঁচবে কী করে। আমরা কি কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি?
নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
লেখক পরিচিতি :
সরদার ফারুক। জন্ম: ১৯৬২ সালের ৯ নভেম্বর, কপোতাক্ষ নদের তীরে খালিশপুরে। পৈত্রিক নিবাস বরিশালের কাশীপুর। পেশায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। বরিশালে ঘাটশ্রমিকদের আন্দোলন, ডেমরায় শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সংগ্রাম ও বাজিতপুরের জেলেদের লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৮৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনও করেন। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮০ সালে বরিশালের অধুনালুপ্ত ‘সাপ্তাহিক লোকবাণী’ পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে শামসুর রাহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা, দৈনিক দেশ, সংবাদসহ দেশ-বিদেশের নানা পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকীতে তার লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যান্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থÑ ‘আনন্দ কোথায় তুমি’ ‘পড়ে আছে সমুদ্র গর্জন’ ‘উন্মাদ ভূগোল’ ‘দীপালি অপেরা’ ‘ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ’ ‘দূরের জংশন’ ‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’ ‘খেলছে একা নীল বিভঙ্গ’।
নির্বাচিত কবিতা
বিশ্বাস কথাটা উঠায় সেদিন বন্ধু আমাকে বিশ্বাস নিয়ে মস্ত বড় একটা ক্লাস নিয়ে নিল। আমাকে একজন নিষ্পাপ মানুষের মতো প্রশ্ন করল, বিশ্বাস! বিশ্বাস কী জিনিস তা কি জানো? সে নিজেই তার উত্তর দিল, বিশ্বাস হলো মানুষের মনের রং। আবার এটাকে একটা রংধনু বলতে পারো। দেখ না রংধনুর রং যেমন সাতটা তেমনি বিশ্বাসের রং অনেকটা। কেউ বিশ্বাস করে কেউ অবিশ্বাস করে। আবার কেউ কেউ জীবন মৃত্যুর মাঝখানে বসবাস করার মতো অবস্থায় পড়ে। না পারে বিশ্বাস করতে আবার না পারে অবিশ্বাস করতে। জগতে এই একটা মুহূর্ত খুবই বিভীষিকার। বুঝলে?
শেষ রজনীর চাঁদ
ক্ষমা মাহমুদ মানুষের জীবনের কাহিনী শিল্পে বুনন করেন। বুনতে বুনতে সেই কাহিনীর কথা গল্পে বয়ান করেন।এভাবেই তার অন্তর্গতবোধ এবং জীবনাভিজ্ঞতা গোটা এক একটা জীবন হয়ে কাহিনীর শরীরে লেপ্টে গল্প হয়ে ওঠে। শিল্প সৃজনে এখানেই তিনি একান্ত নিজস্ব। নিজের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ব্যক্তি ক্ষমা তখনই শিল্পী হয়ে ওঠেন, যখন তীব্র অনুভূতি, অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খোলা চোখে দেখা পৃথিবীটা শিল্প হয়ে মন ও মননের জগতে ঠাঁই করে নেয়। তার শিল্প ভুবনে ভীড় করা মানুষগুলোর মধ্যে বারবার কথা কয়ে ওঠে প্রধাণত নারী । শিল্পী ক্ষমা নারীর কথাই ভাবেন বেশি; দেখেন-দেখাতে চান নর নারীর পারস্পরিক যোগ-বিয়োগের নির্মাণ-বিনির্মাণের জগত। সবশেষে,ভাবেন, নারী কী তবে জাগতিক, মনোদৈহিক শেকলে সম্মোহিত এক সত্ত্বা-ই শুধু? যে কেবল জীবনের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় জীবনের স্বাদ-সাধ স্পর্শ করার কী এক বাসনায়! সেই আকাঙক্ষার বিচিত্র জীবনকথার সারৎসার নিয়েই তার সৃষ্টিকথা ‘সমুদ্রের কাছে দুঃখ জমা রাখি!’ যে সঞ্চিত বেদনায় শেষপর্যন্ত ব্যক্তির সকল প্রত্যাশা-প্রয়াস ছাপিয়ে সত্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়, হলুদ খামে অন্তরীণ অপার এক জীবনবোধ! সে মৃদু হেসে বলে, হে মহাজীবন, আমিই সত্য!
সমুদ্রের কাছে দুঃখ জমা রাখি - Samudrer Kache Dukkho Joma Rakhi
সাতটি গল্প দিয়ে সাজানো গল্পগ্রন্থ ‘পাপ’। চারপাশের
মানষের মুখ, মুখোশ আর বয়ে চলা জীবনের কথকতা ‘পাপ’।
ভালোবাসা, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা, অপরাধ আর বহমান
জীবনের গল্প।
কখনো নারীর চিরাচরিত বন্দী-জীবন এবং বন্ধনহীনতার গল্প।
কখনো প্রতিবাদী, কখনো নিয়তির কাছে পরাজিত আমাদের
খব চেনা চরিত্রগুলো জীবন ছেনে যত্নে তুলে আনা হয়েছে
‘পাপ’ গল্পগ্রন্থে। পাঠকের ভাবনায় খব ছোট্ট করে হলেও
আলোড়ন তলবে ‘পাপ’।
পাপ
জহিরুল হক বাপি। জন্ম ১৯৭৯ সালে নোয়াখালির এক মফস্বলী ঝড়ো সন্ধ্যায়।
চলচ্চিত্র শিক্ষায় স্নাতক। ব্লগার ও গণজাগরণ কর্মী।
লেখকের প্রকাশিত অন্যান্য বই:
ঈস্রাফীলের শিঙ্গা বাজছে (উপন্যাস)
শোকগাথা’৭১ (উপন্যাস)
আমি আমাকে খেয়ে বেঁচে আছি (কবিতা)
মাটির বাকসো লড়োচড়ো
তোমার নন্দনে ক্রন্দিত আমি একাকিত্বে লুণ্ঠিত দাস
কণ্টকিত গোলাপে পোষণ করিনি আজও লালিত আশ্রয়
এই নিঃসঙ্গতা কেবল আমার এক অগ্নিদগ্ধ অধ্যায়
তবু জানো রক্ষিত অরণ্যে এখনও থমকে আছে সময়
তাকে ছোঁয় অসময়ের পলাতক–বীণায় অচেনা ঢেউ
পেছনে যে ধায় সে অন্য কেউ নয়–আত্মসুখী পথঘোর
বিনিদ্র আমি জখমের কাছে অসম্ভবে খুলি বাহুভাঁজ
তুমিই আগুন বদলে দাও এই ডানা মেলার জন্মান্তর
পুনশ্চ অদম্য অর্জুন
লেখকের কথা
প্রতিটি মানুষের জীবনেই রয়েছে অজস্র গল্প। গল্প ছাড়া মানুষের জীবন হতেই পারে না! আর সেইসব গল্প বাস্তবতার- আদৌ কল্পনার নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। গল্পগুলো সেই সম্পর্কজাত। যা জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। যারা লিখতে পারেন তারা চেষ্টা করেন সেইসব জীবনস্মৃতির গল্পগুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরতে লেখনীর মাধ্যমে। আর যারা লেখায় অভ্যস্ত নন, তারা নিভৃতে মনের ভেতরে সেসব লালন করেন এবং সময়-সুযোগ পেলে অন্যকে বলেন। অনেক লেখক আছেন যারা বিভিন্ন সময় নানা চরিত্রের মানুষের কাছ থেকে তাদের জীবনে অর্জিত অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার গল্প, দুঃখ-বেদনার গল্প, হাসি-খুশির ঘটনা, বিয়োগান্তক কাহিনী ইত্যাদি শুনে উপন্যাস বা গল্পে রূপ দেন।
সাধারণ মানুষ বলি আর বিশিষ্টজন বলি; লেখক বলি আর শিল্পী বলি- তাদের জীবনের গল্পগুলো সাধারণ গল্প নয় বলেই গণমাধ্যমে বা পাঠ্যপুস্তকে সেগুলো প্রকাশিত হয়ে থাকে। শিক্ষামূলক গল্পের যেমন শেষ নেই তেমনি প্রেম-ভালোবাসা, ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, বিচ্ছেদ, লড়াইমুখর গল্পেরও সীমা-পরিসীমা নেই। সেসব জীবনস্মৃতির গল্প পড়ে আমরা বিচিত্র চরিত্র, চিন্তা ও মন মানসিকতার মানুষকে চিনতে, জানতে পারি। এর মধ্যে অনেক গল্পই আছে সাহিত্যরসে টইটুম্বুর- রোমান্টিক, ভাবনার উদ্রেককারী এবং শিক্ষামূলক।
গল্প সাধারণত দুধরনের বলা যায়, এক হচ্ছে, বানানো গল্প বা কল্পলোকের গল্প। দুই হচ্ছে, জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তব গল্প। বানানো গল্পগুলোর চেয়ে জীবনস্মৃতির গল্পগুলো বেশি নাড়া দেয় মানুষ তথা পাঠককে। কারণ সেইসব গল্প অনেক মানুষের জীবনের গল্প। বানানো গল্প যেভাবে সুন্দর ভাষা ও অলঙ্কারে আদর্শ চিত্রকলার মতো করে প্রকাশ করা হয়, জীবনস্মৃতির বাস্তব গল্পগুলো সেই রঙে আঁকা সম্ভব হয় না। এতে করে গল্পের প্রাণ হারিয়ে যায়, সংবেদনশীলতা শীতল হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় আকর্ষণও। বানানো গল্প মনে থাকে না, যদি না তাতে বাস্তবতার নোনাজলের ধারা প্রবাহবান থাকে।
মানুষ হিসেবে আমিও ব্যতিক্রম নই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার এই ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে বহু ঘটনার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, অর্জিত হয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা। কত চরিত্রের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছে তার হিসেব নেই। সেইসব ঘটনা অমূল্য স্মৃতি এবং অকাট্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক এতই অম্ল-মধুর যে, পড়ন্ত বেলায় এসে যতই ভাবি ততই নিজেকে ফিরে ফিরে দেখার সাধ জাগে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিষণ হই। জীবনস্মৃতির সেইসব অজানা গল্পগুলোই পড়ে অনেকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেন। যুগ যুগ ধরে এটাই সাহিত্যে চলে আসছে। এভাবে কালজয়ী, রসোত্তীর্ণ গল্পও আমরা অনেক পেয়েছি। ভবিষ্যতেও পাব।
জীবনস্মৃতির এই গল্পগুলো ‘সম্পর্ক’ শিরোনামে একটি গল্পসংকলনে পত্রস্থ করে স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ‘অনুপ্রাণন প্রকাশন’ ঢাকা প্রকাশ করে আমাকে চিরঋণী করেছেন। আশা করি গল্পগুলো পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেবে।
‘অনুপ্রাণন’কে জানাই অন্তঃস্থল থেকে অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
প্রবীর বিকাশ সরকার, টোকিও.জাপান, ৭, অক্টোবর, ২০১৭
জীবনস্মৃতির গল্প সম্পর্ক
ঘরের খোঁজে নিখোঁজ বাড়ি
বারংবার মিনতি করার পরও
ওখানটাতে কেনো ছুঁও
খুব ব্যথা পাই তোমার ¯পর্শ লাগলে
কলিজা সমেত হৃদয়ের আগাগোড়া
টনটন করে, চিলকে চিলকে ওঠে
নাড়ি নক্ষত্র আকাশ বাতাস
পূর্ব প্রতীচী বসতির দেহাত;
আগলে রাখা আকুতির দ্বীপাঞ্চলে
শিউরে ওঠে সমুদ্রের নোনাজল
লেপটে যায় চোখের কাজল
ভাষার ব্যঞ্জনায় সব অর্থ ফুটিয়ে তোলা যায় না
অকাতর অশ্রুজলে যার মন ভিজে না
তার আবার কিসের নদী কিসের সাগর
বাষ্পাচ্ছাদিত শ্রাবণের ঝোড়ো বাতাসে
স্বর্ণাভ ঠোঁট রেখে উষ্ণতা কমানোর নামই কি শান্তি
হেঁটে যাওয়ায় যে আবেগ অনুভূতি কাজ করে
উড়ে যাওয়াতে কি তা করে?
দোহাই তুমি আর ছুঁইয়ো না ঐখানে
আমি এখন ঘরের খুঁজে ঘর বেচে
ঘর খুঁজি তার কাছে, যে দুই কূলেই ঘর রচে।
ঘরের খোঁজে নিখোঁজ বাড়ি
মেঘ অদিতি। কবি ও গল্পকার হিসেবে ‘দু’বাংলাতে পরিচিত। জন্ম: ৪মে, জামালপুর। বর্তমানে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘জলডুমুরের ঘুম (কাব্য)’ ‘অস্পষ্ট আলোর ঘোড়া (গল্প)’ ‘অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি (কাব্য)’ এবং ‘সময় শূন্যতার বায়োস্কোপ (মুক্তগদ্য)।
প্রবেশিধকার সংরক্ষিত
সম্পাদকীয়, কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা। অনুপ্রাণন- অষ্টম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা-
অনুপ্রাণন ও কুহকের কথা
কুহকের কথা বলতে গেলে অনুপ্রাণনের কথা আসবেই। কেননা, কুহক অর্থাৎ কুহক মাহমুদ, শিল্প ও সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন-এর সাথে ২০১২ সালে জন্মলগ্ন থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন ৫টি বছর। কুহকের সাথে আমার পরিচয় সরসিজ আলীমের মাধ্যমে। কবি সরসিজ আলীম তখন ‘ভনে যাহা ভনে’ শিরোনামে একটা ট্যাবলয়েড সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন। ফেসবুকের মাধ্যমেই কবি সরসিজ আলীমের সাথে আমার পরিচয়।
এই পরিচয়ের কিছুদিন পূর্বে হোসনে আরা বেগম নামে একজন মধ্যবয়সী মহিলা ফেসবুকে আমাকে নক করেন। তিনি তখন ফেসবুকে ‘ফেসবুক বইমেলা ২০১২’ নামে একটা গ্রুপের এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে বই প্রকাশ এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। এক বিকেলে আমরা ছবির হাটে মিলিত হই, যেখানে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন তরুণ কবি-সাহিত্যিক। তারা হলেনÑ রেজওয়ান তানিম, স্থপতি রাজীব চৌধুরী, কবি সুমি সিকানদার, ফেসবুকের মানবিক গ্রুপের অঞ্জন, ইহতিশাম আহমাদ টিংকু এবং আরো দুই-একজন হবে যাদের নাম এই মুহূর্তে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। পরে এই বৈঠকগুলো পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনের সামনের বাঁধানো উঠোনে অথবা কখনো কখনো হোসনে আরা বেগমের শ্যামলীর বাসায়ও অনুষ্ঠিত হতো। এই আলোচনা বৈঠকগুলোর মধ্য দিয়েই প্রথমে আমরা পাবলিক লাইব্রেরির সেমিনার-কক্ষে একটি ‘নবীন লেখক সমাবেশ অনুষ্ঠান’ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হই। এই পর্যায়ে কবি সরসিজ আলীমও এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়। সমাবেশ অনুষ্ঠানের পর প্রথম বৈঠকে যখন একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয় এবং যখন পত্রিকার জন্য একটি নাম ও একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়, তখন কবি সুমি সিকানদার পত্রিকাটির নাম ‘অনুপ্রাণন’ করার প্রস্তাব আনেন, যে প্রস্তাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্যোক্তাদের সমর্থন লাভ করায় গৃহীত হয়। ওই বৈঠকগুলোতে পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদ গঠন নিয়ে আলোচনা হলে সর্বসম্মতিতে আমার নাম প্রকাশক, হোসনে আরা বেগম সম্পাদক, কবি সরসিজ আলীম নির্বাহী সম্পাদক এবং সহ-সম্পাদক হিসেবে রেজওয়ান তানিম, রাজীব চৌধুরী, সুমি সিকান্দার, ইহতিশাম আহমাদ টিংকুসহ আরো দুই-একজনের নাম প্রস্তাব হয়। এই প্রস্তাব গৃহীত হলে ঠিক করা হয় যে, সম্পাদক ও সম্পাদনা পরিষদের সদস্যরা পত্রিকার কাজে অভিজ্ঞ আরো দুই-একজন ব্যক্তি যুক্ত করে সম্পাদনা পরিষদ সম্প্রসারিত করতে পারবেন।
এর কিছুদিন পর যখন হোসনে আরা বেগমের বাসায় সম্পাদনা পরিষদের প্রথম সভা হয়, তখন সেই সভায় কবি কুহক মাহমুদ ‘অগ্রদূত’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার মনি মোহাম্মদ এবং তাহমিদের নাম যুক্ত হয়। ওই সভায় কবি কুহক মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। ওই সভাতেই কবি কুহক মাহমুদের সাথে আমার পরিচয়। সেই সভায় লেখা সংগ্রহসহ পত্রিকা বের করার যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই সূচনা সংখ্যার লেখা বাছাই এবং অনুপ্রাণনে অন্যান্য বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের সদস্যদের যুক্ত করা নিয়ে কবি সরসিজ আলীম এবং হোসনে আরা বেগমের মধ্যে তুমুল বিতর্ক হয় এবং সেই বিতর্ক এমন তিক্ততার পর্যায়ে উপনীত হয় যে, সূচনা সংখ্যাটির কাজ যখন প্রেসে চলছিল, ঠিক তখন হোসনে আরা বেগম পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে এবং রাজীব চৌধুরী, সুমি সিকানদারসহ আরো দুই-একজন অনুপ্রাণন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিস্থিতিতে পত্রিকাটিতে আমার নাম প্রকাশক ও সম্পাদক, সরসিজ আলীমের নাম নির্বাহী সম্পাদক এবং সহ-সম্পাদক হিসেবে শুধুমাত্র রেজওয়ান তানিম, কুহক মাহমুদ, মনি মোহাম্মদ ও তামজিদের নাম যুক্ত করে শিল্প ও সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন পত্রিকার সূচনা সংখ্যা নভেম্বর ২০১২-এ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে কুহক মাহমুদ অনুপ্রাণন পত্রিকাটির সাথে পাঁচ বছর যুক্ত ছিলেন। এই পাঁচটি বছরে কুহকের সাথে অনুপ্রাণনের মিথস্ক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ এই সম্পাদকীয়’র পরিসরে দেয়া সম্ভব না।
শিল্প ও সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন একটি অবাণিজ্যিক পত্রিকা। এই অবাণিজ্যিক কথাটির অর্থ বারবার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন দেখা যায়। যেহেতু মনে করা হয়, পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি সচেতন থেকে স্বাধীন ও মুক্ত মতামতের চর্চা ও প্রকাশ করবে, অর্থাৎ পত্রিকাটি আর্থিকভাবে কোনো রাজনৈতিক দল অথবা কোনো সামাজিক সংগঠন অথবা দেশের সরকার অথবা করপোরেট মহলের পৃষ্ঠপোষকতার প্রত্যাশা করবে না। অতএব পত্রিকার পাঠকের কাছে সামান্য যে বিনিময়-মূল্য পত্রিকাটি গ্রহণ করবে, তা দিয়েই পত্রিকাটির যাবতীয় প্রকাশনা খরচ চালানো হবে।
যে কারণে অনুপ্রাণনের সাথে যুক্ত সবাইকে মোটামুটি স্বেচ্ছাশ্রম অথবা সামান্য কিছু সম্মানীর টাকায় চলতে হতো। ২৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে অর্থাৎ ৬ আগট ফেসবুকে তাঁর সর্বশেষ পোস্টে অনুপ্রাণনের প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থসংকটকালে কবি কুহকের সেই কৃচ্ছ্রসাধন ও কষ্টের কথাই বর্ণনা করেছিলেনÑ
“বাজেট ১০০ টাকা। বাসা থেকে বাসে গুলিস্তান ১০ টাকা। সেখান থেকে বাসে কাঁটাবন। শাহবাগ আসলেই জ্যাম। কোনোদিন হেঁটে বা প্রচণ্ড খিদায় নেমে পড়তাম বাস থেকে। হোটেলে প্রবেশ করে করুণ চোখে দু’টি পরোটা আর ডাল দিয়ে নাশতা করে হাঁটতাম। তারপর অফিস। কাজ। দুইটা না বাজতেই খিদা! সস্তাদরের হোটেলে ২৫ টাকার ভাত-ডিম বা মাছ, ডাল নেই। চলে যেত খাবার। কতদিন ১০ টাকা বেশি দিয়ে সবজি বা অন্য তরকারি নিতে পারিনি! আবার অফিস। কাজ। এই করেই সন্ধ্যা।
পুরি-চা ১০ টাকা। আবার কাজ। ৬০ টাকা শেষ। অফিস শেষ করে হাঁটতাম। ভার্সিটির মাঝ দিয়ে গুলিস্তান। বাসের লাইনের অপেক্ষা। কোনোদিন ৫ টাকার বাদাম। তারপর বাসা। ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা। মেয়ে অপেক্ষা করত খাবার নিয়ে। ছেলে-মা অন্য বাড়ি থাকত। মেন্যু বেশিরভাগ ডিম ভাজা, ডাল। পেট পুরে খেতাম। আহ! কি সব দিন গিয়েছে। আনন্দ বেদনার। স্মৃতি কাঁদায়। (৬ আগস্ট, ২০১৯)”
সে সময়ে পত্রিকার কাজ করার পাশাপাশি কবি কুহক মাহমুদ অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে “গোধূলির প্রস্থানে জ্বালাও পূর্ণিমা (ফেব্রুয়ারি ২০১৪)” এবং “না-মানুষ (নভেম্বর ২০১৪)” শিরোনামে দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই বই দুইটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই সংখ্যার স্মৃতিচারণ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। বলতে গেলে কবি কুহক মাহমুদ অনুপ্রাণনের সাথে যুক্ত হওয়ার পূর্ব থেকেই যকৃতের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রোগের চিকিৎসা করা দূরে থাক, শরীরের প্রতি যতœ নেয়া দূরে থাক, তাঁর চলমান জীবন যাপন পদ্ধতি তাঁর শরীরের ক্ষতিই বৃদ্ধি করেছে। এসব ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্য বারবার বলা সত্ত্বেও কবি কুহক মাহমুদ কারো কথারই কর্ণপাত করেনি। যার ফলে যথাযথ চিকিৎসা ও সেবার অভাবে তাঁর শরীরের অবস্থা দিনে দিনে অবনতি হতে থাকে। অসুস্থতার জন্য গত প্রায় দু’বছর কুহক আর সময় দিতে পারেনি অনুপ্রাণনকে। বলেছিলাম, না-মানুষের ২য় খ- লিখে দেন প্রকাশ করি। বলল, পারবো না। এই শরীরে কুলায় না।
কুহক মাহমুদের অকাল মৃত্যুতে আমরা শোকগ্রস্ত। অনুপ্রাণন-এর সাথে যুক্ত সকলের পক্ষ থেকে কুহকের বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করি। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে “কুহক মাহমুদ স্মৃতি সংখ্যা” হিসেবে নিবেদন করি শিল্প ও সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনের ৮ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যাটি।
অষ্টম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা
প্রায় তিন দশক ধরে কাব্যচর্চায় আত্মনিবেদিত কবি হানিফ মোহাম্মদ এই প্রথম তাঁর কাব্য “পদাশ্রিত পাঞ্চজন্য” নিয়ে গ্রন্থ-প্রকাশনার জগতে পা রাখলেন। এ কাব্যটি দীর্ঘ সাধনায় অর্জিত তাঁর সাহিত্যিক ও কাব্যাদর্শিক চেতনার ফসল। জীবন ও সমাজের নানা ক্ষেত্রের ক্লেদ, দুর্গতি ও বঞ্চনা নিয়ে দুর্বিষহ সময় কবির দৃষ্টিতে যেভাবে ধরা পড়েছে, তার-ই কিছু ছবি ফুটে উঠেছে এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায়। কবি শুধু বৌদ্ধিক ও অন্তরঙ্গ ভাষিক-রেখায় সমাজের নানা স্কেচ এঁকেই ক্ষান্ত হননি, পরোক্ষ উচ্চারণে নিজের আদর্শভিত্তিক একটি আগামির স্বপ্ন ছড়িয়েছেন কবিতার পর কবিতায়। সর্বদাই তাঁর আবেগ থেকেছে নান্দনিক রসধারায় সিঞ্চিত এবং কাব্যবোধ প্রগতিশীল চেতনায় ঋদ্ধ। তিনিও, প্রত্যেক পূর্ণতাপ্রাপ্ত কবি যেমন, স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে একটি আলাদা কাব্যভুবনের নির্মাতা। তাঁর মাঝে কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই; সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায় অনেকটা প্রত্যক্ষ শৈল্পিক উপস্থাপন তাঁর। বঞ্চনা-পীড়িত জীবন ও সমাজের নানা চালচিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর কাব্যবোধ ও শৈলী তিলমাত্র অপচিত হয়নি।
তাঁর কবিতার দৃশ্যমান, পরাবাস্তব ও বিমূর্ত চিত্রকল্পগুলো একাধারে পেলব, দৃষ্টিনন্দন, বোধ-উদ্দীপক ও হৃদয়স্পর্শী। তাঁর পংক্তিগুলো গণমানুষের চেতনার সাথে সমানুভূতিতে, প্রেমের পরাকাষ্ঠায় এবং নিসর্গ-সুষমার প্রদীপ্তছটায় অনাস্বাদিতপূর্ব প্রতিমাপুঞ্জ। শব্দচয়ন ও বাণীবন্ধ গঠনে তিনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। পুরো কাব্যটিতেই তাঁর পরিমিত বাকভঙ্গি ও পরিশীলিত মননের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সেইসাথে শব্দাবলীর যথাযথ বিন্যাস ও ছন্দময় প্রবহমানতা তাঁর কবিতার বাণীবন্ধকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
পরিশেষে, কবি হানিফ মোহাম্মদের বিশ্বাস এবং ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনার সাথে ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও আমি নির্দ্বিধায় বলবো যে, কাব্যটি শৈল্পিক মানদ-ে উন্নত এবং যথেষ্ট রস সমৃদ্ধ।
আবুল কাইয়ুম
প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক
পদাশ্রিত পাঞ্চজন্য
বাংলা সাহিত্যে অনেক কবিতা আছে যার ভেতরে গল্প আছে, কাহিনি আছে। আবার অনেক কবিতা এমন কিছু অনুভূতি বা ভাবে ডুবিয়ে দেয় যা থেকে গল্প বা কথাসাহিত্য নির্মাণ করা যেতে পারে। এমনকি কিছু কবিতা আছে যার ভেতরে এমন কিছু চরিত্র আছে, যে চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে গল্প দাঁড় করানো যায়। যেমন, এক বনলতা সেনকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। কবিতাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা বেশ কিছু গল্প এক মলাটে আনার প্রয়াসেই এ সংকলনের পরিকল্পনা।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে—কেন এমন সংকলন? কেন কবিতাকে গল্পে রূপান্তরের প্রয়াস? গল্প লেখার বিষয় বা প্লট কি এতই অপ্রতুল হয়ে পড়ল যে কবিতার আশ্রয় নিতে হবে, কবিতাকে অবলম্বন করতে হবে? কবিতা কবিতার মতো থাক কবিতার জগতে, গল্প গড়ে তুলুক গল্পের জগৎ। দুটো জগতকে এক জগতে একাকার করার যৌক্তিকতা কী? প্রশ্নগুলো আকাশ-বাতাস থেকে আসে নি, আমাদের ভেতর থেকেই এসেছে। আসলে আমার কাছে যে উত্তর আছে তাকে শক্ত কোনো যৌক্তিক উত্তর দাবি করছি না। আর প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গে যাবই না। এতটুকু বলতে পারি—ভাবনাটা যখন মাথায় এসেছিল তখন একটা বিষয় আমাকে প্রভাবিত করেছিল, তা হলো ‘বন্ধন’। কবিতাকে গল্পে রূপান্তর—কবিতা আর গল্পের মাঝে কি একটা বন্ধন তৈরি করছে না? সাহিত্যের অন্যতম দুটি শাখা হিসেবে কবিতা এবং গল্পের মাঝে গড়ে ওঠা এমন বন্ধন সাহিত্যের কোনো ক্ষতি অন্তত করবে না—এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। জোর দিয়ে এ-ও বলা যায়, কবিতার বীজে গড়ে ওঠা গল্প বরং কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করবে কথাসাহিত্যকে—এ সংকলনে লিপিবদ্ধ গল্পগুলো সে স্বাক্ষরই বহন করছে।
এ সংকলনের পাঠকদের জন্য আগাম শুভকামনা।
গল্পরূপে প্রিয় কবিতা
Get access to your Orders, Wishlist and Recommendations.
There are no reviews yet.